যদি তুমি বলো পর্ব ২

যদি তুমি বলো পর্ব ২
আফনান লারা

লোকটার ওরকমভাবে নিজেকে লুকানোটাকে ভালভাবে দেখলোনা তিথি। সে এ পাশের মেয়েটার কোনো কথার জবাব না দিয়েই লোকটাকে দেখার চেষ্টায় মত্ত।
কিন্তু মেয়েটা বোধহয় চাইছেনা সে এরকমটা করুক।তাই সে তিথির হাতটা ধরে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করলো আর বললো সে যেন তাড়াতাড়ি ঠিকানা বলে।

তিথির হাত ধরেছে তাও সে কিছু না বলেই ঐ ছেলেটার লুকোচুরি দেখে চলেছে।
মেয়েটার টানাটানিতে এক সময় বিরক্ত হয়ে তিথি বললো,’রাখেন তো আপু!লিফট দিছেন বলে কি মাথা কিনে নিছেন আমার?দেখছেন না আমি ড্রাইভারকে দেখতেছি।আপনি নিজেও দেখেন।কেমন চোরের মতন বারবার চোখ লুকাচ্ছে।’
ওমনি গাড়ী থেমে গেলো।শোনা গেলো এক লাইন
‘গেট আউট’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এটা শুনে তিথির বকবকানি বন্ধ,সাথে ঐ মেয়েটার টানাটানিও বন্ধ।
তিথি গাল ফুলিয়ে বললো,’গেট আউট তো অবশ্যই হবো কিন্তু তার আগে আপনার মুখ দেখে তারপর আউট হবো।দেখি?’
এটা বলেই তিথি এগিয়ে ছেলেটার মাস্কে হাত দিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয় এবার।
বাধ্য হয়ে পাশের মেয়েটা তিথিকে আটকায় আর বলে,’শোনো ও আমার ভাই হয়।সে এরকম থাকতে পছন্দ করে।ফাজলামি করিওনা’

এটা শুনে তিথি থামে এরপর বলে কথাটা আগে বললেই হতো।সে চুপচাপ ব্যাগপত্র গুছিয়ে নামা ধরতেই ছেলেটা বললো,’এড্রেস দাও’
এটা শুনে তিথি এমন ভাবে তাকালো যেন ছেলেটা শুদ্ধু পুরো গাড়ীটাকে সে চিবিয়ে খেয়ে নেবে।এক লাথি দিয়ে গাড়ীর দরজা খুলে সে বের হয়ে বলে,’আমাকে একবার গেট আউট বললে ঐ জায়গায় আমি জীবনে গেট ইন হইনা।জাহান্নামে যাও ভাই বোন দুইজনে!’

এটা বলে তিথি দরজাটা বন্ধ করে পেছনে চেয়ে দেখে মরুভূমির মতন একটা জায়গায় সে নেমেছে।দূর দূরান্তে কোথাও কোনো গাড়ী নেই।এদিকে তার সামনের গাড়ীটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে।ভেতরে বসা সে মেয়েটি টু শব্দ ও করছেনা।যেন তার ভাই যেটা বলবে সেটাই হবে।
আর ঐ ছেলেটি এমন ভাবে বসা যেন সে চাইছে তিথি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুবা নত হয়ে গাড়ীতে ঢুকতে পারে।
তিথি ও কম না,সে তার ব্যাগ উঠিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।পায়ের ব্যাথাকে তোয়াক্কা না করেই সে তার বান্ধুবীর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে হেঁটে হেঁটেই।

পাত্রপক্ষকে আরও কিছু সময় ধরে রাখার জন্য তিথির বাবা,মা খালা,ফুফু সবাই সব করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারাও জেনে গেছেন তিথি পালিয়েছে।কি করে ওকে খুঁজে বের করবে সেটা চিন্তা না করে তারা ভাবছেন কি করে এই পরিবারকে আটকানো যায়।এত বড় বংশ হাতছাড়া করা যাবেনা।
তিথিকে কেউই খোঁজার চিন্তা করেনা,সকলে নানা পদ্ধতিতে পাত্রপক্ষর সেবা করে চলেছে।
তিথির ছোট বোন তানিয়া তখন টিউশন থেকে ফিরেছে।সে তিথির দু বছরের ছোট।গায়ের রঙ তিথির থেকেও চাপা হলেও তার চেহারায় একেবারে মায়ায় ভর্তি।দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটা তিথি।কারণ উচ্চতায় আর গড়নে দুজনেই প্রায় একই রকম।

তানিয়াকে দেখে পাত্রপক্ষ শুরুতে খুশি হয়ে গেলো।তারা ভাবলেন এটাই তিথি।ছেলেটি কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে।তানিয়া বেশ বুঝতে পেরেছে এরাও ওকে দেখে গুলিয়ে ফেলেছে।সে কিছুক্ষণ পাত্রর পেটের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’আসসালামু আলাইকুম দুলাভাইয়া’
এটা শুনে সকলে অবাক।পাত্রকে দুলাভাই কেন ডাকছে?তারা তখনও জানতোনা তিথির ছোট বোন আছে।
পাত্র হকচকিয়ে গেলো।তানিয়া পাত্রকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার ভূড়ির দিকে তাকাচ্ছিল বারবার।
পাত্র শেষে লজ্জা পেয়ে পেটে হাত দিয়ে ফেলে।

পাত্রর খালা তানিয়াকে প্রশ্ন করে সে কি তিথি নয়?
তানিয়া রিদমের মতনই অনেক বেশি দুষ্টু স্বভাবের।তার বিয়ে করার অনেক শখ থাকলেও তিথি অবিবাহিত বলে কেউ তাকে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছিল না।এখন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবে বলে সে ঠিক করে এদের সাথে কিছু সময় মজা করবে।বিয়ে বিয়ে খেলবে।
সে গলায় ঝুলানো ওড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে ঐ খালার সামনে বসে বলে,’একটু মজা করলাম।কিছু মনে করবেন না।আমি খুব মজার মানুষ’

খালামণি হাসি দিয়ে বললেন,’ছবিতে ধবধবে সাদা মনে হলেও বাস্তবে দেখি চাপা।ফিল্টার মোরে ছবি দিয়েছিলে বুঝি?’
‘নাহ তো!ফিল্টার আমি কখনওই দিই নাই।মনে হয় ফোনের দোষ।আপনাদের ফোনের দোষ। কেউ ছবি পাঠালে ফোনের ব্রাইটনেস বাড়িয়ে দেখবেন।
কাউয়ারেও ধলা মনে হবে তখন।তাছাড়া আমি রোদে পুড়ে টিউশন থেকে আসলাম তো!এই সময়ে এমনিতেও আমাকে কাজের বেডির মতন লাগে।আপনারা বসুন আমি ফেইস ওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে আসি।আমার রুপের আগুনে তারপর সবাইকে ঝলসায় দেবো”

এটা বলে তানিয়া উঠে বলে,’আবারও মজা করলাম।ঝলসাবোনা।আদর দিবো উম্মাহ খালামণি’
এটা বলে তানিয়া চলে গেলো।পাত্রর খালা পাত্রর মায়ের কানে ফিসফিস করে বললেন,’মাইয়া বেশি কথা বলে।আমাদের রকিবকে কি মানাবে?রকিব তো একদম কম কথা বলে।এই মাইয়া তো সবার মাথা খাবে’
‘আপা দেখেন না কি হয়।একটা দোষ দিয়ে তো বিয়েসাদি বাদ দেয়া যায়না।তাছাড়া আমাদের রকিবের ও তো দোষগুণ আছে’

‘হ্যালো মহেন্দ্র সিং ধনী স্পিকিং!হু আর ইউ?’
‘আমি’
‘টুকু! জানো এখানে কি হচ্ছে?’
‘জানতে হবেনা,শোন আমি কি বলি।বাবাকে বলবি আমি এই ছেলেকে বিয়ে করবোনা।যদি মানে তবেই আমি ফেরত আসবো।আর বলবি আমি কোনো ছেলের সাথে পালাই নাই, একা একা পালাইছি’
‘আরে শোনো,তোমার জায়গায় তানিয়া টুকু বিয়ে করে নিচ্ছে তো!’
‘তানিয়া?ওহ হ্যাঁ আমি তো ভুলেই গেছি তানিয়ার স্বভাবের কথা।ওকে চালিয়ে যেতে বল।আমি রাখছি।পাত্রপক্ষ গেলে আমায় একটা মিসড কল দিবি’

এই বলে তিথি ফোন রাখে।সে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তার বান্ধবীর বাসায় এসে পৌঁছেছে।পাত্রপক্ষ চলে গেলেই সে বাড়ি ফিরবে।ফেসবুকে ঢুকে তিথি দেখে আদিল তাকে ব্লক দিয়ে দিয়েছে।
আদিল তিথির জীবনে হুট করেই এসেছিল,তার চলে যাওয়াটাও হুট করেই ঘটে গেলো।
দেড় বছর আগে ভার্সিটিতে তাদের প্রথম বার দেখা হয়।তিথি যখন ফার্স্ট ইয়ারে,আদিল ছিল ফাইনাল ইয়ারে।একটা কলেজ অনুষ্ঠানে তাদের দেখা হয়,এরপর আলাপআলোচনা। তারপর থেকে তিথি খেয়াল করে আদিল নিজ থেকে ইন্টারেস্টেড অনেক বেশি।তিথিও বাধা দেয়নি।সেও জড়িয়ে যায় সম্পর্কে।

তবে তাদের সম্পর্কটা ছিল আর ১০টা সম্পর্ক থেকে ভীষণ আলাদা।আদিল কখনও তিথিকে স্পর্শ করেনি,কখনও কোথাও ঘুরতে গেলে মাঝে এক হাত দুরত্ব রেখে হাঁটতো।হাত ধরতোনা কোনোদিন।তার কথাবার্তায়,চালচলনে সর্বদা মনে হতো সে নাটক করছে।
কিন্তু তিথি প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি,সে ভাবতো আদিল হয়ত বেশ ভাল একটা ছেলে।যা করবে বিয়ের পরে করবে।এই নিয়ে আদিলের প্রতি সফট কর্ণার তৈরি হয়েছিল তিথির মনে। তার থেকেই ভালবাসার সৃষ্টি।কিন্তু আদিল যে নিমিষেই সব শেষ করে দিয়ে চলে যাবে তা তিথি মানতে পারছেনা।অবশ্য তার প্রতিদিনই মনে হতে আদিল হয়ত তাকে বিয়ে করা নিয়ে সিরিয়াস না।

এই মনে হওয়াটা যে সত্যি হয়ে যাবে তা কে জানতো!
তিথি গালে হাত দিয়ে তার বান্ধবী সুরাইয়ার বারান্দার দোলনায় দোল খাচ্ছিল।সেইসময় সুরাইয়া তার জন্য কফি বানিয়ে এনে তার দিকে ধরে বলে,’আমার আব্বু আম্মু বিয়ের দাওয়াতে বরিশাল গেছে ভোরে।আমি এখন তোর ভাইয়ার সাথে লেট নাইট ড্রাইভে যাবো।ফিরতে রাত তিনটাও বাজতে পারে আর আমার বড় বোন তো বাসায় নেই।কালই শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে।একা বাড়িতে থাকতে পারবি?’

‘কেন পারবোনা?আমি অনেক সাহসী!’
‘তাহলে ভাল।তারপরেও এত বড় ফ্ল্যাট।সাবধানে থাকবি।ভয় পেলে আমায় কল দিয়ে লাভ নাই।আমি ফোন অফ করে বিন্দাস ইঞ্জয় করবো’

‘ওতো ভাবতে হবেনা,আমি যে টেনসনে আছি,তাতে ভূত সামনে এসে হ্যালো বললেও আমার কিছু যায় আসবেনা’
সুরাইয়া মুচকি হাসি দিয়ে রেডি হতে চলে যায়।তিথি কফিতে চুমুক দিয়ে দোলনা থেকে উঠে বারান্দার রেলিংয়ের উপর মগটা রেখে চোখ বন্ধ করে বাতাস নেয় গায়ে।তারপর চোখ খুলতেই সে দেখে সুরাইয়াদের বিল্ডিংয়ের সামনে সেই সাদা গাড়ীটা এসে দাঁড়িয়ে আছে।তিথি আশ্চর্য হয়ে যায় এক মূহুর্তে।
অনেকক্ষণ দেখে সে ভাবে এটা হয়ত অন্য গাড়ী।তাও তার কিছুটা সন্দেহ হচ্ছিল বলে সে সুরাইয়াকে ডাক দেয়।সুরাইয়া আসার পর সে গাড়ীটা ওকে দেখায়।তখন সুরাইয়া ওকে জানায় এই বিল্ডিংয়ের প্রায় সবারই গাড়ী আছে,তাদের কারোর হতে পারে।

যদি তুমি বলো পর্ব ১

তিথির মন তাও কেমন কেমন করছিল।সে বারান্দায় আর থাকলোনা।ভেতরে এসে গ্লাস টান দিয়ে বারান্দা লক করে বিছানায় এসে বসে কফিটা শেষ করে।

যদি তুমি বলো পর্ব ৩