রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ৭

রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ৭
ফারজানা মুমু

অক্ষর বুঝল সে ভুল করেছে। ঘুমন্ত চৈতির অগোচরে প্রমিজ ভঙ্গ করেছে। অপরাধবোধ মুখশ্রী এলোমেলো হয়েছে মন। চৈতি যদি বুঝতে পারে তাহলে নিশ্চয় অ’সভ্য লোক ভাববে? ভালোবাসার বিনিময়ে তখন তিক্ততা সৃষ্টি হবে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় বলল, আমায় ক্ষমা করবেন চৈতি। আমি নিজের অজান্তেই আপনার সাথে ঘ’নিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম।

জলপট্টির কাপড় ভিজাবে এমন সময় চৈতি বিড়বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে কথা বলল যা অক্ষর বুঝল না।
ভোরের আলো ফুটেছে। রোদের তেজ কম। আকাশটা আজও মেঘলা। বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। আম গাছে মুকুল ধরেছে। এখনকার বৃষ্টি মুকুলের জন্য শুভময় নয়। নষ্ট হবার আশঙ্খা। অক্ষর নিশব্দে রুম থেকে বের হলো। চৈতি তখনও ঘুমে বিভোর। নিজ রুমে এসেই হাতমুখ ধুয়ে চলল কিচেন রুমে। ঝাল-ঝাল কিছু বানাবে। বেশিরভাগ একা থাকার কারণে টুকটাক রান্নাবান্না জানে অক্ষর। তাইতো সহজেই চৈতির জন্য ভেজিটেবল স্যুপ এবং নিজের জন্য স্যান্ডউইচ বানিয়ে ফেলল। চৈতি ঘুম থেকে উঠার অপেক্ষা শুধু।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঘুম ভাঙলো চৈতির। জ্বরে ভোগার ফলে শরীর বেশ ক্লান্ত। ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে দেখল সাইড টেবিলে বাটিতে পানি তারই সাথে রয়েছে রুমাল। মুহূর্তেই বুঝে গেল কাজটা অক্ষর করেছে। মনেমনে লজ্জারা বাসা বাঁধলো। লোকটা সারারাত এখানে ছিল? তাঁর সেবা করেছিল?
ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসল। অক্ষর তখন ল্যাপটপ নিয়ে বিজি। চৈতিকে দেখা মাত্রই চোখজোড়া ল্যাপটপের দিকে নিক্ষেপ করে জিজ্ঞাসা করল, শরীর কেমন এখন?

-” জি ভালো!
এতটুকু বলে আবার প্রশ্ন করল চৈতি, আপনি গতরাত আমার রুমে ছিলেন?
অক্ষর নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকাল। দম নিয়ে বলল, ভয় পাচ্ছিলেন সেজন্য থাকতে হয়েছে।
-” আপনি জানতেন আমি বজ্রপাতের শব্দে ভয় পাই?
-” হুম। আপনার মা বলেছে।
-” মায়ের সাথে যোগাযোগ কীভাবে হলো আপনার?

চোখ তুলে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল, এখন আপাতত জানার দরকার নেই। জানতে পারলে কষ্ট আপনারই হবে। লাভ কী বলুন অযথা কষ্ট পাওয়ার তার-থেকে ভালো আপনার জন্য ভেজিটেবল স্যুপ বানিয়েছি খেয়ে নিন। রিভিউ দিবেন আমার রান্নার হাত কেমন!

চৈতি কথা বাড়ালো না। খাবার টেবিলে বসে বাটিতে থাকা স্যুপ খেতে লাগল। আড়চোখে দেখল অক্ষরকে। এখনও নির্বিকার ভাবে ল্যাপটপে কাজ করছে। লোকটার ল্যাপটপে এত কিসের কাজ সে জানে না তবে মাঝে-মাঝে মনে হয় জীবনের সবটুকু সময় শুধু ল্যাপটপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ল্যাপটপ তাঁর প্রথম বউ। এখন ল্যাপটপের সতীন বানানোর তাঁর পিছনে উঠেপড়ে লেগেছে।

চয়ন রা চলে এসেছে। সারারাত ঘুম হয়নি চয়নের। বোনের চিন্তায় পাগল হবার উপক্রম। এক প্রকার বাধ্য হয়েই ফোন দিয়েছে অক্ষরকে। অক্ষর জানালো রাতে চৈতির জ্বর এসেছে। তাইতো সকাল হতে না হতেই বউ বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভাই ভাবিকে দেখে অবাক হওয়া গলায় চৈতি বলে, তোমাদের তো কিছুদিন থাকার কথা ছিল। গতকাল গেলে আবার আজকেই চলে আসলে?
বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল চয়ন,অনেক চিন্তা হয়েছিল আমার। ম’রে যাচ্ছিলাম প্রায়। তুই কিনা বলছিস আরো থাকতে?

ঝুমুর তখন কপট রাগ দেখিয়ে বলল, চৈতি তুমি ভাবলে কী করে তোমার অসুস্থ্যতার কথা শুনে আমরা আসবো না? আমরা বুঝি তোমার কেউ নই?
হেসে উঠল চৈতি। হঠাৎ মনে পড়ল অতীতের গোপন কথা। প্রশ্ন করল, ভাইয়া, মা যখন বেঁচে ছিল তখন তুমি কেন আমার খোঁজ নেওনি। ফোন দেওয়ার পরেও রিসিভ করনি। তখন বুঝি আমরা তোমার কেউ ছিলাম না?
কষ্টে পাথর জমলো চয়নের। আড়চোখে দেখল অক্ষরকে। ঈর্ষা জন্মালো মনে বলল, কিছু মানুষ আছে যারা দেখতে ভদ্র, কিন্তু মনের ভিতরে রয়েছে শয়তানের কারখানা। সেজন্যই আমি তোদের সাথে যোগাযোগ রাখিনি।
অক্ষর কানে কথাটা বাজতেই হেসে উঠল। চয়ন মুখ বুজে সহ্য করে নিল সেই হাসি। নিরবেই ঘটল দুজনার যু’দ্ধ। কিন্তু ঝুমুর কিংবা চৈতি ঘুণাক্ষরেও টের পেল নিরব যু’দ্ধের পরিণীতি।

পরপর দুদিন সময় অতিবাহিত হলো। চৈতি এখন সুস্থ। আজ থেকে তাঁর ইনকোর্স পরীক্ষা। সকল প্রস্তুতি নেওয়া শেষ। অনেকে বলে ইনকোর্স পরীক্ষা নাকি কিছু না কিন্তু চৈতির মনে হয় জীবনে আসা যত পরীক্ষা সবগুলোই গুরুত্বসহকারে সাধরে গ্রহণ করা উচিৎ। পড়তে যেহেতু হবে তাহলে হ্যালাফ্যালা কীসের?
রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। চয়নের আজকাল কাজের চাপ খুব বেশি। সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয় ফিরে অনেক রাতে। ভাইবোনদের মাঝে দুদিন ধরে দেখা সাক্ষাৎ প্রায় বন্ধ।

-” ম্যাম চাইলে আমার বাইকে উঠতে পারেন।
চৈতি ভেবে বলল, পটানোর চেষ্টা করছেন আবার?
-” যে পটার সে এমনিই পটবে। চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই।
-” একরোখা মানুষের ত্যারা জবাব। আপনি আরেকটু সামনে বসুন আর হ্যাঁ বাইক ধীরে-ধীরে চালাবেন। আমি ভয় পাই।
ভ্রু কুঁচকে অক্ষর প্রশ্ন ছুড়লো, আজ সূর্য মামা কোনদিক হতে ওঠেছে?

-” ইয়ার্কি করছেন? থাক উঠব না।
-” আপনার সাথে আমার ইয়ার্কির সম্পর্ক। ইয়ার্কি না হলে চলে?
-” আমার পরীক্ষার দেরি হয়ে যাবে।
অক্ষরের বাইকে বসল চৈতি। ঠোঁটে লাজুক হাসি, চোখে মুখে উৎফুল্লতা, বাহুডোরে স্পর্শ করা, পাগল করে দিচ্ছে অক্ষরকে। চৈতির লাজুক হাসি আরেকটু বাড়ানোর জন্য বলে উঠল, মনে হচ্ছে বউ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আপনার কী মনে হচ্ছে বরের সাথে ঘুরাঘুরি করছেন?

-” বাজে বকলে বাইক থেকে নেমে যাব।
-” তাই বুঝি? হৃদয়ে রঙধনুর সাত রঙা ছবি এঁকেছে। এখন শুধু আমার বাড়িতে পা রাখার অপেক্ষা।
চৈতি চুপ করে রইলো। অক্ষরের কথাগুলো আজ ভীষন রকমের ভালো লাগছে। দিনকে দিন লোকটার ব্যাবহারে অবাক হয় সে। কখনো রহস্যময় পুরুষ, কোনো বা ঠোঁটকাটা,গম্ভীর, জেদী রাগী। তবে আরেকটি রূপে সে বিমোহিত হয়েছে। লোকটি ভালোবাসতে পারে। ভীষণভাবে ভালোবাসতে পারে। সেদিনের রাতের পর থেকেই চৈতির মন মজেছে একজনের ভালোবাসায়। সেই একজন অক্ষর।

বাইক এসে থামলো ভার্সিটির সামনে। চৈতি বাইক থেকে নেমে হাঁটা দিল। পিছন থেকে অক্ষর বলে উঠল, ভালোবাসি বললেন না তো ম্যাম।
মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিল চৈতি, ভালোবাসাবাসি এত সহজ নয় সাহেব। ধৈর্য ধরতে হয়। তাছাড়া আপনার মাঝে প্রেম ভাব খুব কম। প্রথমে প্রেমিক হবার চেষ্টা করুন তারপর নাহয় খাঁটি প্রেমিক আমি বানাবো।
-” একবার ভালোবাসি বলেই দেখুন না। আমার মত খাঁটি প্রেমিক আপনি খোঁজে ও পাবেন না। মনের গভীরতা দিয়ে দেখলে আমার মত প্রেমিক আপনি দুটো খোঁজে পাবেন না।

-” উহু। প্রথমে চোখের খোঁজে প্রেমিক খুঁজব তারপর মনের চোখ দিয়ে। আমাকে পেতে হলে ধৈর্য ধরতে হবে যে, সহজে চৈতিকে পাওয়া দুষ্কর। চৈতিকে পেতে হলে যু’দ্ধের সংগ্রাম করতে হবে।
-” ওকে তাহলে আজ থেকে আমি যোদ্ধা হলাম। আপনাকে পাওয়ার জন্য যুদ্ধে প্রা’ণ ত্যাগ হলেও আমার জীবন স্বার্থ।
কপট রাগ দেখিয়ে চৈতি বলল, যুদ্ধের শুরুতে অশুভ কথা বলতে হয় না সাহেব। শুরুটা রাখতে হবে যুদ্ধ জয়ী হওয়ার লক্ষ্য।
চৈতি চলে গেল। অক্ষর তখন বুকে হাত রেখে বলল, আপনি ভীষন ভাগ্যবতী চৈতি কেননা আমার মত একজন পুরুষ আপনার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করছে।

বিশ নাম্বারের পরীক্ষা। পঁয়তাল্লিশ মিনিটে শেষ। সবকিছুই কমন। ত্রিশ মিনিট পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে হল থেকে। অপেক্ষা করে শান্তা-কান্তার জন্য। পরীক্ষা শেষ করে শান্তা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চৈতিকে। চিল্লিয়ে বলে, দোস্ত আজকের খাতায় কী লিখছি জানিস?
কান্তা ও চৈতি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে, কী?

-” অক্ষর ভাইয়ার সাথে তোর প্রেমকাহিনী। আজ তো দেখলাম গেইটের বাহিরে দারুণ প্রেম চলছে। তাহলে ওইদিন কেন আমাদের বাঁশ দিলি? যেভাবে ফোনে বলেছিলি লোকটা বয়স্ক আমি ভেবেছি হয়তো দাদা-নানা টাইপের হবে। কিন্তু কে জানত পুরো হট, চকলেট, আইটেম বোমের কথা বলছিস। জয় না থাকলে এটাকেই পটিয়ে ফেলতাম।
চৈতি রাগী গলায় বলল, নির্লজ্জ মেয়ে। খবরদার ওনার দিকে নজর দিবি না।

-” তাহলে কাল থেকে অক্ষর ভাইয়াকে কালো টিপ পড়িয়ে আনিস নজর দিবো না।
দুজনের কথার মাঝে কান্তা নিজের চশমাটা ঠিক করে শান্তাকে প্রশ্ন ছুড়লো, সত্যিই কী খাতায় তুই রাম-লীলা লিখেছিস?
শান্তা ভাব নিয়ে বলল, কিছু পারি না তাই ভাবলাম সাদা খাতা কেন জমা দিবো। তাই ওদের প্রেমকাহিনী লিখে আসছি। এজন্য অবশ্য আমাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিৎ কিন্তু আমাদের ভার্সিটিতে জ্ঞানি মানুষদের কদর নাই। তাই আমিও পাব না নোবেল।

কান্তা তখন শান্ত হেসে বলল, এবারের খাতা ইকবাল স্যার দেখবেন। ওনি মুখে যেহেতু বলেছেন খাতা দেখবেন তাহলে দেখবেন। তোকে নোবেল প্রাইজ নয় সোজা বান্দরবনের সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিবেন। চৈতির শাস্তি অবশ্য ভিন্ন। চয়ন ভাইয়াকে ডেকে খাতা দেখিয়ে ওর শাস্তি দেওয়া হবে।
কান্তার কথায় হকচকিয়ে উঠল বাকি দুজন। মাথায় হাত দিয়ে শান্তা বলল, আমিই কেন সব জায়গায় বাঁশ খাই। বয়ফ্রেন্ড সবসময় বাঁশের উপরে রাখে। কদিন আগে অক্ষর ভাই। বাসায় তুই। এখন আবার পরীক্ষার খাতা। দুনিয়াতে আমি একাই বুঝি বাঁশ খাওয়ার জন্য জন্ম নিয়েছি।

চৈতি তখন হা হুতাশ নিয়ে বলল, শুধু বাঁশ খাওয়ার জন্য না রে অন্যদের সেই বাঁশ খায়ানোর জন্যও তোর জন্ম। ভাইয়া যদি জানতে পারে অক্ষর ভাইয়ার কথা তাহলে আমি শেষ। প্রেম সূচনা হবার আগেই ইতি টানবে। ভাইয়া জীবনেও মানবে এই সম্পর্ক।

-” তাহলে এখন কী করা উচিৎ?
কান্তার কথায় দুজনে ভয়ার্ত কন্ঠ কিন্তু চোখে-মুখে দুঃসাহসের ছায়া নিয়ে বলল, খাতাটা সরাতে হবে। যেকোনো মূল্যই হোক।
-” কিন্তু কীভাবে?

বিকাল শুরু হতেই আবারও আজ বৃষ্টি শুরু। চালভাজা মাখিয়ে টিভির সামনে বসল ঝুমুর। বৃষ্টির দিনে ভাজাপোড়া খাবার খেতে ভীষন ভালো লাগে। চাঁদ ও চৈতি ছবি আঁকছে। চাঁদের ড্রইং এ বেশ ঝোঁক। চৈতি টুকটাক আঁকিবুকি করতে পারে। চাঁদ বিকাল হলেই ফুপির কাছে রঙ পেন্সিল নিয়ে বসে।

রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ৬

অক্ষর ও চয়ন অফিসের কাজ করছে। ঝুমুরের একা থাকতে ভালো লাগছে না। ভাজাপোড়া খাবার একা খাওয়া যায়? তাইতো বাটিতে নিয়ে অক্ষরের রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়াল শুনতে পেল অক্ষর চয়নকে বলছে, ঝুমুরকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য আমি জানি না ভাবছো?

রংধনুতে প্রেমের বাড়ি পর্ব ৮