রংধনুতে প্রেমের বাড়ি সারপ্রাইজ পর্ব

রংধনুতে প্রেমের বাড়ি সারপ্রাইজ পর্ব
ফারজানা মুমু

চৈতিকে আলগোছে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ গুঁজে নেষাময় কণ্ঠে শুধাল, কী শ্যাম্পু ইউজ কর চৈতি? বুড়ো বয়সেও বারংবার তোমার প্রেমে পড়তে বাধ্য হই।
অক্ষরকে দুহাতে সরিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো চৈতি। বিরক্তি হয়ে বলল, বয়স বাড়ছে না কমছে তোমার? তিন বাচ্চার বাপ হয়েও এখনও অ’সভ্যতা কমলো না।

হেঁচকা টান দিয়ে চৈতিকে বুকের সাথে মিশিয়ে চোখের সামনে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে কপালে চুমু দিয়ে বলল, বয়স পেরিয়ে যায়, কৃষ্ণ কালো চুল সাদা হয়, তা বলে ভালোবাসার লাল রঙ পাল্টে যায়? যায় না।
চৈতি অক্ষরের বুকে মাথা রেখে মিটিমিটি হাসলো। মাথা উচুঁ করে চোখের দৃষ্টিতে চোখ ডুবলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” ওরা চলে আসবে, প্রচুর কাজ আমার।
বাচ্চাদের মত মুখ ফুলিয়ে অক্ষর বলল, সবার জন্য সময় আছে শুধু আমি বেচারার জন্য তোমার সময় নেই।
-” তুমি বেচারা? আচ্ছা বাদ দেও সেসব কথা তোমার ছানাপোনারা কোথায়?
-” কোথায় হবে আর নিশ্চয় স্বাক্ষর কে জ্বা’লা’চ্ছে। বেচারা আমার ভাইটা।

চৈতি হেসে দিল। ছেলে দুটো শান্ত থাকলেও মেয়েটা ওর একেবারে দস্যিপনায় উস্তাদ। শাড়ি সুন্দর করে গায়ে জড়িয়ে অক্ষরকে সাথে নিয়ে ড্রইং রুমে চলল। একটু পর জয়রা আসবে। স্বাক্ষরের বিয়ে ঠিক হয়েছে শান্তার ছোট ফুপির ননদের মেয়ের সাথে। এনিয়ে কথাবার্তা হবে আজ। শান্তার মেয়ের নাম অরিত্রা ও কান্তার ছেলের নাম উৎস। ওরা সকলে আজ আসবে।

ড্রইং রুমে পা ফেলতেই দেখল চেরিকে খাবার খাওয়াচ্ছে ঝুমুর। ছোট্ট মেয়েটা ভীষন দুষ্টু, খেতে চায় না। চেরিকে খাবার খাওয়াতে হয় এক প্রকার যুদ্ধ করে। চৈতিকে দেখা মাত্রই চেরি দৌড়ে গিয়ে পিছনে লুকিয়ে ঝুমুরের উদ্দেশ্য ভেংচি কেটে বলে, এবাল খাওয়াও দেখি তুপ্পি তলে এতেতে।
ঝুমুর জোর করে আনতে যাবে অক্ষর বাঁধা দিয়ে বলল, এখন ও’কে খাওয়াতে হবে না আর যা ফ্রেশ হয়ে আয়। একটু পর যখন বাচ্চারা সবাই খেতে বসবে তখন আপনাআপনি খাবে।

বাধ্য মেয়ের মত ঝুমুর চলে গেল। অক্ষর গিয়ে বসলো সোফায়। চৈতি কিচেন রুমে চলে গেছে। চয়ন খবরের কাগজে মুখ লুকিয়েছে। অক্ষর অনেকক্ষণ ধরে চয়নকে দেখে যাচ্ছে। কিন্তু চয়ন সে তো অক্ষরের কথা থেকে বাঁচার জন্য মিছে অভিনয় করে চলেছে। গলা ঝেড়ে কেশে উঠল অক্ষর, আজকাল পত্রিকা উল্টো ধরেও পড়া যায় জানতাম না।
আচমকা অক্ষরের ঠেস মা’রা কথা শুনে পত্রিকার দিকে ভালো করে দৃষ্টিপাত করল চয়ন। সত্যিই তো উল্টো ধরে আছে পত্রিকা। মুখটা কাচুমাচু করে হেসে বলল, বুঝিনি।

অক্ষর আরেকটু এগিয়ে চয়নের সামনাসামনি বসলো। মুখ থেকে পত্রিকা সরিয়ে দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল, আমি তোমার প্রেমিক হই? লজ্জা পাচ্ছ কেন? মনে হচ্ছে বাসর ঘরে নতুন বউ, স্বামীকে দেখে লজ্জায় ম’রে যাচ্ছে। ভাইবোন একই ধাতুর তৈরি।
চয়ন ঘাবড়ে গেল। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমা হলো। ছোট্ট করে দম নিয়ে বলল, যেমন আপনি এবং আপনার বোন। দুজনের মেজাজ বেশ গরম।

-” বাদ দেও সেসব কথা এখন বলো সারাদিন রুমে বসে থাকলে চলবে? ডিউটি আছে না। চাকরি চলে যাবে।
মন ভরে নিঃশ্বাস ছাড়ল চয়ন। এক হাত অক্ষরের কাঁধে রেখে বলল, ছোট বোনের স্বামী থাকতে আমার সমস্যা নেই। আমার বোন জামাইয়ের মাথায় বদবুদ্ধি খুব। সমস্যা হলে সমাধান করতে দুমিনিট লাগবে না।

-” কাম চোর।
-” আপনি আমার বোন চোর।
-” তুমিও আমার বোন চোর।
ওদের কথার মাঝে রাগান্বিত হয়ে দাঁড়ালো চৈতি। এরা দুজন শুধরবে না। সুযোগ পেলেই এক আরেকজনের পিছনে লাগবেই লাগবে। দুজনের সম্পর্ক যেন সতীন-সতীনের মত।

চৈতিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে দুজনেই বোকা হাসলো। একত্রে বলল, মশকারি করছি।
বেলা এগারোটা, জয়রা চলে এসেছে। ড্রইং রুমে চলছে আড্ডা আসর। কান্তা আগের মতোই শান্ত কিন্তু শান্তা ঠিক উল্টো। এই যেমন ভরা আসরে অক্ষরের উদ্দেশ্য বলেছে, অক্ষর ভাইয়ের পাওয়ার কিন্তু চমৎকার। প্রথমে যমজ দুই ছেলে তারপর দুই বছর হতে না হতেই এক মেয়ে। এদিকে আমাদের জামাইরা একেকটা অকর্মা।
শান্তার কথায় জয়ের মাথায় হাত। একটা মেয়েই হয়েছে কত সাধনার পর। অন্যরা তো হেসে গড়াগড়ি।

উৎস কান্তার একমাত্র ছেলে। রাদ ও সাদের সমবয়সী। রাদ ও সাদ যমজ হওয়া সত্বেও ওদের চেহারায় কোনরকম মিল নেই। সাদের চেহারা লম্বাটে দেখতে পুরো অক্ষরের আদল পেয়েছে সে, অন্যদিকে রাদ পেয়েছে মায়ের আদল। তবে দু’ভাইয়ের মধ্য একটাই মিল তা হলো দুজনের কোঁকড়ানো চুল। সারা হলো চৈতি-অক্ষরের একমাত্র মেয়ে। মা-বাবার দুজনের মতোই হয়েছে সে। মায়ের চোখ,ঠোঁট, বাবার নাক। শান্তার মেয়ে অরিত্রা। অনেক সাধনার পর জন্ম নিয়েছে। ডক্টর তো বলেই দিয়েছিল সম্ভবনা নেই কিন্তু আল্লাহর রহমতে শান্তা কনসিভ করে। ঝুমুরের দুই মেয়ে চাঁদ ও চেরি। চাঁদ মাশাআল্লাহ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে কিন্তু চেরি সবে চার বছরে পা দিয়েছে।

শক্ত মোটা কার্ড দিয়ে টাওয়ার বানাতে ব্যাস্ত উৎস। সমস্ত মনোযোগ সেখানে। গুটিগুটি পা বাড়িয়ে উৎসের পিছনে এসে দাঁড়ালো সারা। পিটপিট করে তাকিয়ে টাওয়ার বানানো দেখল। উৎসের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, আমায় একটা ছবি এঁকে দিবে উৎস ভাইয়া?

উৎস চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। বিরক্তি নিয়ে বলে, সারা, বিরক্ত করবে না। তুমি পঁচা মেয়ে।
“পঁচা মেয়ে” শব্দটি শুনে হাত পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে সারা। এক পা সামনে বাড়িয়ে উৎসের বানানোর টাওয়ার ভেঙে ফেলে। উৎস রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, এ কী করলে তুমি? এইজন্যই তোমাদের বাড়িতে আসতে চাই না। স্টুপিড মেয়ে।
সারা আবারও কান্নাকাটি শুরু করে। ধম মে’রে উঠে গিয়ে উৎসের হাতে কা’মড় বসিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। উৎস কিছুক্ষণ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠে।

সাদের কোলে উঠার জন্য বায়না ধরেছে চেরি। চেরির জন্মের পর থেকেই সাদ ওকে সহ্য করতে পারে না। কারণ ছোট থেকেই সাদের সাথে চেরির নানান অঘটন ঘটেছে। যেমন, সাদ যখন ছোট্ট চেরিকে কোলে নিত তখনই পটি কিংবা হিসু করে দিত চেরি। মাথার চুলগুলো টে’নে ধরত, নাক কা’মছে ধরত। যখন চেরির প্রথম দাঁত উঠে সেই ধা’রালো দাঁতের স্পর্শ প্রথম সাদের গা’লে দাগ বসিয়ে ফেলেছিল। এজন্যই চেরিকে দেখলেই রাগ উঠে সাদের।

-” তোকে কোলে নিতে পারব না যা এখান থেকে।
-” আমি তোমাল তোলে উঠব।
-” মাইর খাবি, যা ভাগ।
ছোট্ট চেরি কথা শুনে না। দৌড়ে গিয়ে সাদের বুকের উপর বসে পরে। তারপর দুহাত কা’মছে সাদের বু’কে দা’গ বসিয়ে দেয়। ব্যা’থা’য় সাদ কঁ’কিয়ে উঠে। চেরিকে ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে পরে।

অরিত্রা ও রাদ পুতুল খেলছে। রাদ পুতুল খেলতে একটুও পছন্দ করে না কিন্তু অরিত্রা জোর করে ও’কে দিয়ে খেলাচ্ছে। খেলার মাঝে রাদ খেলনা গাড়ি দিয়ে বউ পুতুলের উপরে চা’পিয়ে দিয়ে হাততালি দিতে থাকে।
-” তোর পুতুল ম’রে গেছে। যা এখন আর খেলতে হবে না।
মুখ ফুলিয়ে কান্না করে অরিত্রা। রাদ উপায় না পেয়ে ডাক্তারের খেলনা জিনিস দিয়ে পুতুলকে ভালো করার অভিনয় করে বলে, এই নে তোর পুতুল সুস্থ্য হয়ে গেছে। কাঁদিস না।

হেসে উঠে অরিত্রা। বর পুতুলের সাথে মিলমিশ করে বিয়ের আয়োজন করে। রাদ ধৈর্য্য ধরে বসে থাকে অরিত্রার পাশে। ওর এখন পুতুল খেলতে একটুও ভালো লাগছে না।
চাঁদের রুমে সবগুলো বসে আড্ডা দিচ্ছে। যেহেতু চাঁদ সকলের বড় সেজন্য সে বসে-বসে রূপকথার গল্প শুনাচ্ছে সবাইকে। ছয়জন উৎসুখ হয়ে শুনছে সে গল্প। ড্রইং রুমে চলছে বড়দের আসর, চাঁদের রুমে চলছে ছোটদের আসর। প্রেমময় আসরে আজ সকলের আড্ডা আলাদা হলেও শান্তিময়।

রংধনুতে প্রেমের বাড়ি শেষ পর্ব 

[বিঃদ্রঃ ১ আমি অন্তিম পর্বে লিখেছিলাম বিয়ের ছয় বছর পরের কাহিনী। এখানে আরও চার বছর অতিক্রম করেছে অর্থাৎ ওদের বিয়ের দশ বছর পরের কাহিনী ছোট্ট করে লিখলাম। ]

সমাপ্ত