রঙিন রোদ পর্ব ৬

রঙিন রোদ পর্ব ৬
নাজমুন বৃষ্টি

মৃত্তিকা জানে না, এখানে কতদিন তাকে এভাবে আটকে রাখবে! আস্তে আস্তে তার দেহ’র ভার ছেড়ে দিচ্ছে, দুর্বলতা গ্রাস করছে। আজ কয়েকদিন ধরে সে এভাবেই বদ্ধ রুমে কাটাচ্ছে। কোনো আলোর হদিস পাচ্ছে না এখানে। শুধু খাওয়ার সময়ে একজন এসে খাবার দিয়ে যায়, তখন দরজা দিয়ে একটু আলো ঢুকে। সেই আলোতেই মৃত্তিকার খাবার শেষ করতে হয়। প্রথম কয়েকদিন পালানোর চেষ্টা করেও পালাতে পারেনি। হাত-পা সবসময় বেঁধে রাখে। এখন আর পালানোর মতো ক্ষমতা তার নেই।

সে এই কয়েকদিনে বুঝতে পেরেছে, এখান থেকে পালানো অনেক কঠিন। সে জানে না, এভাবে তাকে এখানে আটকে রেখে তাদের কী এমন কার্যসাধন হবে! এই কয়েকদিনে এখানকার কোনো মানুষকেই সে দেখেনি। শুধু খাবারের সময় একজনই আসতো, সেও মাস্ক পরিহিত। মৃত্তিকা এখন বুঝতে পারছে, ঢাকার বাইরে এই অচেনা জায়গায় কাউকে না বলে আসাটা তার সবচেয়ে বোকামি। এখন আর কিছুই তার হাতে নেই। মৃত্তিকা আস্তে আস্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সে এখন তার জীবনের আশা ছেড়ে দিছে।আদিবের কাছ থেকে হয়ত আর ক্ষমা চাওয়া হবে না। তার একমাত্র মা হয়ত মৃত্তিকাকে না পেয়ে পাগলপ্রায়। তিনি তো এমনিই নরম মনের, এর উপর তার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ শুনলে কী করে থাকবে! তা ভাবতেই মৃত্তিকার খারাপ লাগছে। অন্তত মা’কে বলে আসা উচিত ছিল। রিনিকে শুধু বলছিল, মৃত্তিকা একটি কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছে -পরে এসে সব বলবে। মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করতেই ঈশানের চেহারাটা তার চোখের উপর ভাসতে লাগলো। মৃত্তিকা বিড়বিড় করে উঠল,’ঈশান ভাই।’ ঈশান ভাইয়ের কথা ভাবতে গিয়েই তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে তার ঈশান ভাইয়ের কথা অমান্য করেছে। তিনি মৃত্তিকাকে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কাজে হোস্টেল থেকে বের হতে বারণ করেছিল। ঈশান ভাই কী জানে! মৃত্তিকার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে! তিনি কী মৃত্তিকাকে খোঁজতে আসবে!

হঠাৎ বাইরে থেকে কয়েকজনের আওয়াজ আসতেই মৃত্তিকা বুঝতে পারলো তাকে আটকে রাখা এই রুমটিতেই বোধহয় আসছে। তাহলে এতদিনে মৃত্তিকা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে হয়ত জানতে পারবে। মানুষগুলো রুমে ঢোকার আগেই দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন আগে আগে ঢুকে মৃত্তিকার চোখ বেঁধে দিল। এরপর পর বাকি মানুষগুলো ঢুকলো। মৃত্তিকা পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলো এখানে অনেকজন। ভয়ে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এই লোকগুলো এখন মৃত্তিকার সাথে কিছু করতে আসলেও মৃত্তিকা পেরে উঠবে না। মৃত্তিকা দুর্বলভাবে তাদের কথোপকথন শুনতে লাগল।

-‘এইটাকে কী করা যায়।’
-‘ঈশানের বউ নাহ? এটাকেই তো খুজছিলাম। সে ধোঁকা দিছিলো আমাদের।’
-‘কী করা যায়!’
-‘অন্য মেয়েগুলোকে যেমন করা হয় , এটার সাথেও সেটাই হবে। এটাকে একটু স্পেশালভাবে পাঠানো হবে।’
এরপর পরই সবাই হেসে উঠল। মৃত্তিকা কিছুই করতে পারলো না, চুপচাপ শোনা ছাড়া। সেখান থেকে সেদিনের বাসে মৃত্তিকার পাশে বসা ছেলেটারও আওয়াজ শুনতেই মৃত্তিকা যা বুঝার বুঝে ফেলল।

-‘তবে তাই হোক।’
-‘এইটাকে শেষবারের মতো এখানে ভালোমতো খাইয়ে দেয়। এরপর এতো ভালো খাবার নাও পেতে পারে।’
-‘বস, মেয়েটা কয়দিন ধরে তেমন কিছু খাচ্ছে না। শুধু পানি ছাড়া।’
-‘আজকের রাতে ওর ফ্লাইট। না খেলেও জোর করে খাইয়ে দিবি। বসের টার্গেট বলে কথা। এইটা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান সম্পদ। এটার যেন কোনো ক্ষয়-ক্ষতি না হয়। এরপর ৩২নাম্বার রুমের মেয়েগুলোকে খাইয়ে দিবি। খাওয়ার পর স্পেশাল পানীয় খাইয়ে দিবি।’
-‘আচ্ছা ভাই।’

এরপর পর রুমটা আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হয়ত লোকগুলো চলে গিয়েছে। এই লোকগুলোর কথোপকথন শুনে মৃত্তিকা বুঝতে পারলো – সে খুব বিশ্রী ভাবে ফেঁসে গিয়েছে। হয়ত এই ফাঁদ থেকে আর বেরও হতে পারবে না। ৩২নাম্বার রুমে আরো মেয়ে আছে তার মানে নারী পাচার! মৃত্তিকার গা রাগে রিরি করে উঠল।

আরো অনেক অসহায় মেয়ে এখানে আটকে আছে। ওদের মনের অবস্থা হয়ত আরো করুণ। মৃত্তিকার নিজের চিন্তা হচ্ছে না কিন্তু মেয়েগুলোর জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা,ওরা ঈশান ভাইয়ের কথা কেন বললো! ঈশান ভাই কী ওদের চেনা-পরিচিত! তাহলে ঈশান ভাই কী জানতে পারবে মৃত্তিকা এখানে আটকে পড়েছে! ঈশান ভাই কী মৃত্তিকাকে বাঁচাতে আসবে! না, উনি কীভাবে আসবে! উনি তো এই দেশে নেই! তাহলে কী মৃত্তিকা শেষবারের মতো আর কাওকেই দেখতে পারবে না! মৃত্তিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। তার মা, বড়ো মামা, ঈশান ভাই, রিনি-আদিব সবার কথা ভীষণ করে মনে পড়ছে।

দরজা খোলার আওয়াজে মৃত্তিকার কান খাড়া হয়ে গেল। বুঝতে পারলো কেউ একজন তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। মৃত্তিকা ভেবেছিলো খাবার নিয়ে আসা লোকটাকে সুযোগ বুঝে মেরে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করবে, বাকিটা কপালে যা লেখা থাকে তাই হবে। লোকটা এসে মৃত্তিকার চোখ খুলে দিতেই মৃত্তিকা নিরাশ হলো। আজ লোক একসাথে দুইটা আসছে। হয়ত আজকে শেষদিন বিধায় একটু বেশিই সিকিউরিটি রাখছে। মৃত্তিকা খেতে না চাইলে একটা লোক এসে তার গাল টিপে ধরলো। বাইরের পরপুরুষ মৃত্তিকার গায়ে হাত দেওয়ায় মৃত্তিকা আটকা অবস্থায় গা দিয়ে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে লোকটার মুখের উপর থুথু দিল। এতে লোকটা রেগে গর্জন করে মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে আসতেই অন্যজন লোকটাকে আটকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতেই লোকটা শান্ত হয়ে গেল কিন্তু মৃত্তিকা লোকটার চোখ দেখে বুঝলো ওর চাপা রাগ তবুও কমেনি।

মৃত্তিকা নিজেই খাবারের প্লেট এগিয়ে নিয়ে খেতে লাগলো। সে বুঝতে পারলো, এখন খেতে না চাইলে লোকগুলো তার গায়ে হাত দিতে চাইবে কিন্তু মৃত্তিকার জীবন থাকতে এমন কিছু সে মোটেও হতে দিবে না। সে ঈশানের অর্ধাঙ্গিনী। একমাত্র ঈশানই ছুঁতে পারবে মৃত্তিকাকে।

মৃত্তিকা খাওয়া শেষ করতেই অন্য একটা লোক তাকে একটি গ্লাস এগিয়ে দিল। মৃত্তিকা বুঝতে পারলো, এই পানীয় জাতীয় এটাতেই সব ভেজাল। কিছুক্ষন আগে ওই লোকগুলোর মুখ থেকে শুনেছিল, খাওয়ার পর স্পেশাল পানীয় খাওয়াতে। হয়ত এই পানি খেয়েই সবাই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। যাতে রাতে তাদের মেয়েগুলোকে পাচার করতে কোনো অসুবিধা না হয়। মৃত্তিকা কোনোমতেই খাবে না এই পানি।

কিন্তু লোকগুলো বারেবারে তার দিকে এগিয়ে আসছে। যেন সুযোগ পেলেই মৃত্তিকার শরীরে হাত দিতে চাচ্ছে। মৃত্তিকা তার আটকানো চেয়ার দিয়ে একজনকে ধাক্কা দিতেই অন্যজন এসে তার মুখ আটকে ধরতেই আরেকজন পানিগুলো তার মুখে ঢেলে দিল এতে মৃত্তিকা না চাইতেও খেতে হলো। লোকগুলো মৃত্তিকাকে আগের মতো আটকে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মৃত্তিকা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে। চোখগুলো বারেবারে খুলে রাখতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছে। তার চোখ গড়িয়ে অঝোরে ধারায় পানি পড়ছে। তার বুঝি শেষবারের মতো পরিবারকে আর দেখা হলো না! সে বুঝি হেরে যাচ্ছে! মৃত্তিকাকে বাঁচাতে ঈশান ভাই কী আসবে না!

চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে মৃত্তিকার নাকে একটি সুগন্ধ আসতেই সে তাড়াতাড়ি চোখ খুলে উত্তেজিত হয়ে উঠল। মৃত্তিকা আপনমনেই বিড়বিড় করে অস্থির দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো।

-‘ঈশান ভাই।’ বলে বিড়বিড় করে আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগলো। চারদিকে তাকিয়ে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তার আশা এখানে ঈশান ভাই আছে। এই পারফিউমের সুগন্ধটা একমাত্র ঈশান ভাইয়ের কাছ থেকেই আসে। মৃত্তিকা যেন আশার আলো খুঁজে পেলো। তার ঠোঁটে আপনা-আপনি হাসি ফুটে উঠলো।

তার মন বলছে, এখানে আশেপাশে কোথাও ঈশান ভাই আছে। কিন্তু অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মৃত্তিকাকে কেউ নিতে আসলো না তখন সে হতাশ হয়ে পড়লো। হয়ত একই পারফিউম এখানের মধ্যে কেউ একজন ব্যবহার করে। আর তার চেয়ে বড়ো কথা, ঈশান ভাই এদেশেই নেই। এসব ভাবতেই মৃত্তিকার আশার আলো নিভে গেল। দুর্বলতা তাকে আরো বেশি গ্রাসঃ করে নিলো। পানীয় জাতীয় ওষুধটার হয়ত কাজ হয়ে যাচ্ছে।

রঙিন রোদ পর্ব ৫

মৃত্তিকার চোখ বন্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার সময় ঝাঁপসা চোখে দেখল তার রুমটার দরজা দিয়ে আলো ঢুকছে। হয়ত কেউ একজন এসেছে। আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে গেল ওর। তাহলে কী হার মেনে নিলো সে!

রঙিন রোদ পর্ব ৭