রঙিন রোদ পর্ব ৮

রঙিন রোদ পর্ব ৮
নাজমুন বৃষ্টি

এখন মৃত্তিকা পুরোপুরি সুস্থ তবে ওই ঘটনাটা এখনো তাকে খুরে খুরে খায়। তবুও সেটা সে মাথা থেকে ঝেড়ে পড়াশোনায় মন দিতে চায়। এতদিন সে মা-রিনিদের জোরাজুরিতে বাসায় ছিল। প্রতিদিন সিয়া এসে বা মোবাইলের মাধ্যমে নোট পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু মৃত্তিকা আজ আর মানবে না। তার হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে। অনেক পড়া এখনো বাকি। এমনিও ঈশান ভাইয়ের কথার অনেক অমান্য করে ফেলেছে, এখন থেকে আর করবে না। যথারীতি ব্যাগ গুছিয়ে বের হওয়ার আগে রিনির সাথে ড্রয়ইং-রুমে খেতে বসতেই দেখলো আরশি রুম থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনেকদিনের জন্য কোথাও যাচ্ছে। আরশির পেছন পেছন তার মা-বাবা বের হচ্ছে। তার মা আঁচলে মুখ ঢেকে চোখের পানি নিয়ে মেয়েকে বিদায় দিচ্ছে।

মৃত্তিকা আর রিনি কিছুই বুঝলো না। হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে আরশি! আরশির পরিবার ঈশান ভাইয়ের বিয়ে ভাঙার পর থেকে বাসার কারো সাথে তেমন কথা বলে না যার ফলে আজ সে কোথায় যাচ্ছে সেটা মৃত্তিকা-রিনি ধরতে পারছে না।
আরশি দেশের বাইরে পড়াশোনা করে। তার বিয়ে উপলক্ষে খুশিতে দেশে এসেছিল। সে আগে থেকেই ঈশানকে পছন্দ করতো। ভেবেছিল, বিয়ের পর আর দেশের বাইরে যাবে না। এখানেই বাকি পড়াশোনাগুলো শেষ করে ফেলবে কিন্তু তা তো হলো না।
আরশি দরজার সামনে গিয়ে রিনির দিকে এগিয়ে এলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-‘আমি যায় রিনি। ভালো থাকিস।’
-‘কই যাচ্ছ আরশি আপু?’ রিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশি ছলছল চোখে মলিন হাসলো। আরশির এই মলিন হাসি দেখে মৃত্তিকার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে জানে, এই হাসির পেছনে কতটা বেদনা লুকিয়ে আছে। মৃত্তিকার আরশির জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু মৃত্তিকার কিছুই যে করার ছিল না তখন। ছোটকাল থেকেই আরশি রিনি-মৃত্তিকাকে বড়ো বোনের মতো আগলে রাখতো। ভিনদেশে যাওয়ার পরেও রিনি-মৃত্তিকার প্রতি আরশির ভালোবাসা একটুও কমেনি। আরশি অনেক আগে থেকেই ঈশানকে পছন্দ করতো কিন্তু কোনোদিন মুখ ফুটে লজ্জায় বলতে পারেনি।

-‘আগে যেখানে ছিলাম এখন আবার সেখানেই পাড়ি জমাচ্ছি।’ আরশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।
-‘ইংল্যান্ড?’ রিনির চেহারায় বিস্ময় সাথে মৃত্তিকাও অবাক দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকিয়ে রইল।
-‘হ্যাঁ, রে।’
-‘তুমি তো আর যাবে না বলছিলে ওখানে!’

-‘যার জন্য আসলাম তাকেই পেলাম না। এখানে থেকে আর লাভ কী বল! চেষ্টা করবো আর না আসার এখানে। আমি যে এতো তাড়াতাড়ি অনুভূতিটা ভুলতে পারবো না। চোখের সামনে এগুলো সহ্য করতে পারবো না। অনেক আগে থেকে সেখানে একেবারের জন্য থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ভেবেছিলাম এই বিয়ের পর এখানেই থেকে যাব। পাপা, মাম্মাও কয়েকমাসের মধ্যে আমার এখানে চলে আসবে একেবারের জন্য। আশা করি, সমস্যা হবে না। দোয়া করিস আমার জন্য।’ আরশি মৃত্তিকার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রিনির উদ্দেশ্যে জবাব দিল।

এরপর চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা কী বুঝে আরশিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
-‘আরশি আপু। তুমি আমাকে বড়ো বোনের মতো সবসময় আগলে রেখেছিলে। তুমি আমার সাথে কথা না বললে আমি থাকতে পারবো না। তোমার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারছি না। বিশ্বাস করো, তোমার চোখের পানি দেখে আমার বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সেদিন আমার কোনো দোষ ছিল না আপু। আমাকে দরকার হলে ছোটবেলার মতো মেরে-কেটে শাসন করো তবুও আমার সাথে কথা না বলে থেকো না আপু প্লিজ।’

আরশি মৃত্তিকার দিকে ফিরে মাথায় হাত বুলিয়ে মলিন হাসলো।
-‘এই পাগলী! বড়ো বোনে কোনোদিন ছোট বোনের কথায় রাগ করে থাকতে পারে! এখানে তো তোর দোষ নেই। সেদিন আমি রাগের মাথায় সবার সাথে সাথে তোকে দোষারোপ করেছি কিন্তু কয়েকদিন যেতেই বুঝেছি সেখানে তোর কোনো দোষ ছিল না। সব আমার নিয়তি। ঈশান হয়ত আমার কপালে ছিল না ;তাই তো এতো আয়োজনের পরেও তাকে আমি পেলাম না।’
-‘আপু, আমাদের ছেড়ে আবার চলে যাচ্ছ যে!’

-‘আমার যে যেতেই হবে। তোরা নিজেদের খেয়াল রাখিস, ভালো থাকিস বোন। তোদের উপর আমার কোনো রাগ নেই। আমি যায় রে।’ বলেই আরশি রিনি-মৃত্তিকাকে দুই’হাতে জড়িয়ে ধরে এরপর একে একে সবার সাথে আলাপ শেষ করে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে।
মৃত্তিকা আরশির যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন বোন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মৃত্তিকা না চাইতেও অনেক বড়ো কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বোধহয় আরশিকে।

আরশি যেতেই রিনি মৃত্তিকার কাঁধে হাত রেখে খাবারের দিকে ইশারা করলো। মৃত্তিকা চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো।
এরপর রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো হোস্টেলে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ব্যাগ নিয়ে মা’কে আর বাসার বাকি সবাইকে বলে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। রিনি সাথে আসতে চেয়েছিল কিন্তু মৃত্তিকা যেতে পারবে বলে চলে এসেছিল। রিনি আবার এতো পথ কষ্ট করে আসবে- যাবে ;সেটা মৃত্তিকা চায়নি।

কেটে গেল আরো কয়েকটা দিন। সময় চলে যাচ্ছে আপন-গতিতে। মৃত্তিকা নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত এখন। আদিবের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে পড়াশোনায় মন দিয়েছে। আর কোনো অঘটন সে চায় না। ঈশানের আদেশ মেনে চলার চেষ্টা করছে। এখন সে ঈশানের অর্ধাঙ্গিনী। না চাইলেও ঈশান তার স্বামী। স্বামীর কথা মেনে চলা উচিত।

আজ ক্লাস আছে। তাই মৃত্তিকা সকাল সকাল উঠে কিছু বানিয়ে খেয়ে নিল। আর বাকি কিছু সিয়ার জন্য রেখে দিল। সিয়া তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছে কিছুদিনের জন্য। গ্রামে তার চাচাতো বোনের বিয়ে। মৃত্তিকাকে কাল রাতের দিকে বলেছিল, সে হোস্টেলে ফিরে আসার উদ্দেশ্যে রাত দশটার বাসে উঠেছে। মৃত্তিকা তৈরী হয়ে ক্লাসে যাওয়ার আগে সিয়া’কে কল করার উদ্দেশ্যে মোবাইল হাতে নিতেই স্ক্রিনে সিয়ার নাম ভেসে উঠলো। তা দেখে মৃত্তিকা মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে মাত্রই কল করতে মোবাইল নিয়েছিল। মৃত্তিকা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে রুমের দরজা আটকাতে আটকাতে সিয়ার কল রিসিভ করল।

-‘হ্যাঁ রে, সিয়া! কই তুই? ঢাকা এসে গে…’
-‘মৃত্তি…তো…তো…কে…’
সিয়া মৃত্তিকাকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই হাপাতে হাপাতে উত্তেজিত কণ্ঠে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বেশি উত্তেজনার কারণে কথা সম্পূর্ণ করতে পারছে না।
মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে সিয়ার কথা বোঝার চেষ্টা করছে কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। মেয়েটার আজ কী হয়েছে।
-‘সিয়া। কী হয়েছে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তোর কথা। কী বলতে চাচ্ছিস?’

-‘ আ… আমার… তো… তোকে গুরুত্বপূর্ণ ক…’ সিয়া হাপাতে লাগলো।
-‘আচ্ছা, তুই এসে রিলেক্স হয়ে বলিস। এতো কষ্ট করে বলতে হবে না। আমি ক্লাসে যাচ্ছি, তোর মুখ থেকে এসে সব শুনবো। সাবধানে আ…’ মৃত্তিকার কথার মাঝখানে’ই অপরপাশ থেকে কল কেটে গেল। দ্বিতীয়বার কল লাগাতেই মোবাইল বন্ধ শুনালো। মৃত্তিকা তা দেখে মাথা নেড়ে আপনমনেই ‘পাগলী’ বলে বিড়বিড় করে উঠলো। মেয়েটাও বাসা থেকে এতো দূরে আসতেছে অথচ মোবাইলটা ঠিকমত চার্জ দিয়ে আনতে পারল না। কথার মাঝখানে সিয়া’র মোবাইল বন্ধ হয়ে যাওয়া-আজকের নতুন ব্যাপার নয়। যখন থেকেই সিয়ার সাথে পরিচয় মৃত্তিকার তখন থেকেই এমন। মেয়েটা কোনসময় মোবাইলে পুরোপুরি চার্জ দিয়ে রাখতো না। প্রথম প্রথম মৃত্তিকার বিরক্ত লাগলেও সময়ের সাথে সাথে সয়ে গেছে। সে আর কিছু না ভেবে মোবাইলটা ব্যাগে রেখে রুম লক করে ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

ক্লাস শেষ করে মৃত্তিকা রুমে এসে ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরে কিছু খাওয়ার উদ্দেশ্যে গেল। সকালে সিয়ার জন্য যা খাবার বানিয়ে রেখে গিয়েছিল সেসব আগের মতো আছে দেখতেই মৃত্তিকার টনক নড়লো। সিয়া কী এখনো আসেনি! সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়ালো কিন্তু মেয়েটার আসার নাম-গন্ধ নেই। এতক্ষন তো লাগার কথা নয়! সিয়ার গ্রামের বাড়ি ঢাকার বাইরে অন্য জেলাতে হওয়াতে বাসে করে যেতে হয়।

রঙিন রোদ পর্ব ৭

সর্বোচ্চ ৭ ঘন্টা লাগে স্টেশনে পৌঁছাতে। এরপর স্টেশন থেকে হোস্টেলে ফিরতে আধ-ঘন্টা মতো লাগে। আজ এখনো এলো না কেন ভাবতে পারছে না মৃত্তিকা! সে তাড়াতাড়ি সিয়াকে কল করার উদ্দেশ্যে মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো ঠিক সেসময়ে সিয়ার নাম ভেসে উঠেছে। মৃত্তিকা মোবাইল রিসিভ করে কড়া ভাষায় কিছু বলতে নিতেই অচেনা কারো কণ্ঠস্বর শুনে থমকে গেল। মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে কান থেকে মোবাইল নামিয়ে দেখলো। না, এটা সিয়ারই নাম্বার। কিন্তু অচেনা মানুষের কণ্ঠ কেন! মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে মোবাইল কানে ধরতেই ওইপাশ থেকে কিছু একটা বলতেই মৃত্তিকা স্তব্ধ হয়ে গেল।

রঙিন রোদ পর্ব ৯