রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১৩

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১৩
লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)

বিকাল হয়ত বাজে ৩:৪০।আজকে মেডিকেলে যাননি সাদি।বাহিরে ঝড়-বৃষ্টির প্রকোপ। আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে গঙীর ঘুমে নিমজ্জিত তিনি। আর আমি? একহাতে আমার পেটের উপর থাকা ওনার হাতটার উপর হাত রেখে ফন্দি আঁটছি কি করে পিকনিকের জন্য ওনাকে রাজি করানো যায়। ওনার জন্যে নাকি এটা সময় নষ্ট। এরচেয়ে বাসায় বসে পড়শোনা করাই শ্রেয়।ঠোঁট উল্টে কথাগুলো চিন্তা করে ওনাকে আস্তে করে ডাকতে লাগলাম আমি। ক্ষানিক পরেই উনি নড়েচড়ে জড়িয়ে ধরে বললেন,

___” এই ডাকিস না তো।”(ঘুম ঘুম গলায়)
___” উঠুন না।”
___” চুপ করে ঘুমা।”
আমি ঘাড়টা ঘুরিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। উনি চোখ বন্ধ করে আছেন। ওনার গরম নিশ্বাস আমার ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে। আমি গোমড়া মুখে বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

___” আপনি কি আমার একটা আবদার পূরণ করবেন না?”
___” ঘুমাতে দে।পরে শুনবো।”
___” না এক্ষুণি।”
উনি এবার বিরক্ত হয়ে আমার দিকে চোখ খুলে তাকালেন। ভ্রু জোড়া কুঁচকে আছে। আমি মন খারাপ করে বললাম,
___” চলুন না যাই আমরাও পিকনিকে।”
___” আমি তখন না করলাম না?”
___” প্লিজ..”
উনি চোখ বড়বড় করে ধমকের সুরে বললেন,
___” আবার!!”

আমি ওনার দিকে ঘুরে বুকে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে লাগলাম৷ এইটার জন্য আমাকে এভাবে বকলেন উনি? সবসময় আমার সাথে কেন এমন করবেন। উনি আমার চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,
___” আমি তো তোর ভালোর জন্যই না করি। অন্য কোনোদিন আমিই ঘুরতে নিয়ে যাবো। ”
আমি তাও ফোঁপাতে লাগলাম। তুমি একাই পারো চান্দু? আমি পারি না? আমি জানি না আমার কান্না মানেই তোমার দূর্বলতা? উনি এবার নরম হলেন। মাথায় চুমু দিয়ে বললেন,

___” আচ্ছা যাস তুই। তিনদিন তো? আচ্ছা আই উইল মেনেজ।”
এবার আর আমার খুশি দেখে কে! ওনার বুক থেকে মাথা তুলে চোখ মুছে ঝাঁপিয়ে পড়ে গালে চুমু খেয়ে বললাম,
___” থ্যাংক ইউ।”
___” কান্না ভ্যানিশ?”(হেসে)
আমি কিছু না বলে দাঁত কেলাতে লাগলাম।
___” হি হি।”
উনি আচমকা আমাকে বিছনায় শুইয়ে দিয়ে ঘোরলাগা কন্ঠে বললেন,

___” এভাবে হাসিস না! বুকে লাগে।”
আমি ওনাকে সরানোর বৃথা চেষ্টা করে বললাম,
___” সরুন সরুন।”
___” জানিস পারবি না তাও কেন যে বৃথা চেষ্টা করিস।”
আমি কিছু না বলে চুপ করে আছি। বাহিরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা হাওয়ায় জানালার পর্দাগুলো উড়ছে। ওনার গরম নিঃশ্বাস আমার গলায় পড়ছে। আর প্রতিটা স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছি। অনুভব করছি,ওনাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আমি।ওনাকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারছি না। আচমকা কানের কাছে একটা ঘোরলাগা কন্ঠ ভেসে এলো। উনি আস্তে করে বললেন,

___” ভালোবাসি ধানিলংকা।”
কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নিলাম আমি।মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। এমন অনুভূতি আমি কখনো পায়নি। এভাবে কেউ কখনো বলেনি যে ‘ভালোবাসি’।অয়নও না। ওর বলায় তো এত তৃপ্তি পায়নি। এই লোকটায় এত মায়া কেন?পরক্ষনেই থুতনির নিচে উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম আমি,সাথে পেটে ওনার হাতের স্পর্শ। বুঝলাম!আস্তে আস্তে ওনার মাঝে ডুবে যাচ্ছি আমি। আর বাঁধা দেয়ার ইচ্ছে নেই।

বন্ধুরা সবাই মিলে প্ল্যান করেছিলো সমুদ্রের আশেপাশের জায়গাগুলোর একটিতে যাবো।পিকনিক তো নাম মাত্র। আপাতত সবাই একটু রিলাক্সে ঘুরতে চাইছি। কিন্তু সাদির নির্দেশে এই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে রাঙামাটি যাওয়ার পরিকল্পনা চলছে।তবে আমি না করেছি। আমার সমুদ্র পছন্দ মানে সমুদ্রেই যাবো।আমার বন্ধুমহল আবার সাদি বলতে অজ্ঞান। সে যা বলবে সব সঠিক। আর আমি যা বলব সব ভুল।

কিন্তু এবার তো তাদের সাদিও আমার কথায় সায় দিলো।তাই সবশেষে আমরা সমুদ্র দেখতেই যাচ্ছি।কিন্তু সাদির প্রতি এদের এত প্রেম!এগুলা ভাবতেই কপাল চাপড়ে বলতে ইচ্ছে করে,কেমন আহাম্মকের দলগুলা কপালে জুটছিলো।মেরি বিল্লি,মুজিসে মেউ।দেখতে দেখতে আমাদের যাওয়ার দিন চলে এলো। আপাতত বাসের জন্য সবাই মিলে দাড়িয়ে আছি। এখনো সানি আর শুভর আসা বাকি।গাড়ির লেট দেখে সাদি বিরক্ত হয়েই বললেন,

___” এজন্য বলেছিলাম আমাদের গাড়িতে যাই।কিন্তু আপনি তো আমার কথা শুনবেন না তাই না!”
আমি হাতে হাত ভাজ করে বললাম,
___” উফফো। বাসে যাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে।তাও সবাই মিলে।”
উনি চোখ-মুখ অন্ধকার করে বলে উঠলেন,
___” হ্যা যাও। আমি কি না করেছি। দাঁড়ায় থাকো।সময় নষ্ট।”
আমি মুচকি হেসে আস্তে করে বললাম,

___” প্রিয় মানুষটার সাথে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সময় নষ্টেরও একটা মজা আছে ডক্টর। ”
উনি হাসলেন।কিছু বলতে যাবেন তার আগেই দেখলাম সানি এসে সামনে দাঁড়ালো। শয়তানি হেসে বললো,
___” কিরে, এত ফিসফিস না করে আমাদেরও একটু শোনার সুযোগ দে।”
সাদি হেসে সানিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

___” শালীসাহেবা,বিয়ে শাদী করে নাও। এমনিই মা মা শুনতে পাবা।আমাদের কথা আর শোনা লাগবে না।”
আহা!সানিয়ার চেহারাটা দেখার মত ছিল। আমরা সবাই মিলে হাসতে লাগলাম। হঠাৎ পরিচিত একটা কন্ঠ শুনে মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো আমার। সানিয়া সামনে থেকে সরতেই মানুষটাকে দেখতে পেলাম আমি। এতদিন পর নিজের পুরনো একটা অতীতকে সামনে দেখে আমার আঁখি জোড়া জলে টইটম্বুর হতে লাগলো। অয়নের সেই হাসোজ্জল চেহারাটা কেন যেন নেই। কেমন ভেঙে গেছে।

পাশেই মিশমি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। বুকটায় কেমন চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে।ঠিক তখনই সাদি সকলের অগোচরে আমার কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।আমি ওনার দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই উনি মুচকি হেসে ভরসা দিলেন। আমি অয়নের থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। অতীত ঘেটে লাভ নেই। আমার বর্তমানে শুধুই আমার সাদির বিচরণ। অয়ন হালকা হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

___” কেমন আছিস তোরা সবাই?”
রুশ অয়নের কাঁধে চাপড় দিয়ে বললো,
___” নিজে তো বিয়ে করে বউ নিয়া সোজা শহরের বাহিরে চলে গেলা। আবার আমাদের কথাও মনে পড়ে?”
অয়ন আমার দিকে কেমন করে তাকালো। আমি ভড়কালাম।কিন্তু কিছু বললাম না। অয়ন ঠান্ডা গলায় বললো,
___” মনে তো পড়েই।না পড়লে কি তোদের কথায় ঘুরতে যেতাম। ”
প্রান্তি হাসলো। অয়নের পিঠে মিছে চড় দিয়ে বললো,

___” যাক!ভালোবাসিস আমাদের। ”
অয়ন আমার দিকে এগিয়ে এলো। আজ ওর চোখটা পড়তে পারছি না আমি। কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হালকা হেসে বললো,
___” কেমন আছিস?”
আমিও মুচকি হেসে জবাব দিলাম,
___” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”

ও কিছু না বলে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আমি সাদির দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
মিশমি নিজের ফোনটা বের করে ক্যামেরায় চেহারা দেখতে দেখতে কিছুটা ভাব নিয়েই বললো,
___” ভেবেছিলাম একটু দেশের বাহিরে ঘুরবো।কিন্তু তোমাদের তো যতসব ক্ষেত জায়গা পছন্দ। ”
সবার মধ্যে কেমন একটা ফিসফিস আওয়াজ হওয়া শুরু হলো।কিন্তু কেউ কিছু বলছে না সামনাসামনি।অয়ন ফিসফিস করে বললো,

___” এখানে অন্তত সিনক্রিয়েট করো না।”
সাদি হঠাৎ হেসে উঠলেন।সবাই বেশ অবাকই হলো।মিশমিও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। ততক্ষণে বাসও এসে গেছে। সাদি একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
___” মেডাম,কিছু কিছু মানুষ দেখবেন যেখানে যায় সেখানের সব জিনিস গ্রাস করতে চায়। কেড়ে নিতে চায়। নিজের ক্ষমতায় সেটা হাসিল করতে চায়। সেসব মানুষদের আবার ভিনদেশে গেলেও বিপদ। দেখা যাবে কি না কি আবার কার থেকে কেড়ে নিয়ে চলে আসবে।বলা তো যায় না। সেক্ষেত্রে একটু সাবধান।”

বলেই উনি মুচকি হেসে আমার হাত ধরে বাসে উঠলেন। ওনার জবাবে যে সবাই বেশ খুশি এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমিও যে খুশি নই তেমন না। আসলে এতদিন পর নিজের কাছের জনকে দেখলে সবারই এক প্রকার কষ্ট হয়।কিন্তু ওর ব্যবহারে ওকে আমি ঘৃণা করতাম। আর করিও। সাদি আমার পাশে বসে পড়লো। আমি ওনার বাহুর মধ্যে নিজের বাহু ঢুকিয়ে কাঁধে মাথা রাখলাম। গাড়ি চলছে। শুভ গান গাইছে..

ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
গানের লাইনগুলো অনুভব করছি নিজের প্রিয় মানুষটার সাথে।এদিকে একজনের রক্তাক্ত চোখজোড়া সেদিকে দৃষ্টি রেখে তার আফসোসের সুরে বললো,

___” হারিয়ে ফেললাম!”
সাদি আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছেন,
___” অনু শোন।”
___” হুম।”
___” আমি তোর পাশে আছি। সব পরিস্থিতিতে। শুধু আমার হাতটা ধরিস। কখনো ছাড়িস না। দেখবি আমাকে পাশে পাবি।”
আমি মুচকি হেসে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

___” জানি আমি। আপনি কখনো ঠকাবেন না আমায়।”
বলে কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। তারপর বাসের জানালায় চোখ রেখে আস্তে করে বললাম,
___” জীবন এত সুন্দর কেন?”
পাশ থেকে সাদির কন্ঠ ভেসে এলো,

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১২

___” ভালোবাসা থাকলেই জীবন সুন্দর। সুন্দর একটা অতীত থাকতে হয় না,সুন্দর একটা বর্তমান থাকলেই জীবন সুন্দর।অতীত যতই খারাপ হোক,তোর বর্তমান তোর সুখ। জীবনকে উপভোগ করতে শিখ। সবসময় আমাকে পাশে পাবি।”
আমি কিছু বললাম না। প্রিয় মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে জানালার বাইরে তাকিয়ে মুহূর্তটাকে অনুভব করতে লাগলাম। এত সুন্দর অনুভূতি!এত সুখ!যা শেষ হবার নয়।আর আমি শেষ হতে দিবোও না।

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ১৪