ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১১

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১১
মেহা মেহনাজ

চাঁদ রাণী,
ঘুম আসছে না! রাত কত হলো কে জানে। তোমায় খুব মনে পড়ছে। আমার চেয়ে অল্প খানিক দূরত্বে তুমি ঘুমিয়ে আছো। ইচ্ছে করছে আর একবার গিয়ে ওই শুভ্র মুখখানি দেখি! কিন্তু না, পায়ে যে শেকল বাঁধা। ভোর হতে কত দেড়ি বলো তো! আগামীকাল কি হবে কি না হবে, আমি জানি না। শুধু জানি, যাই হয়ে যাক, আমি তোমার পাশে থাকবো। তোমার শরীরে আদ একটা আঁচড়ের আঘাত আমি পড়তে দিবো না। এটা নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা চাঁদ রাণী। তুমি চাঁদ হয়ে আকাশে ভাসো, আমি মেঘ হয়ে তোমায় ছুঁয়ে দেওয়ার প্রতিক্ষা করি!

ইতি,
তোমার মেঘবালক!
তুষার ডায়েরিটা বন্ধ করে বুকে চেপে ধরে। কেমন অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। মেয়েটা কেমন করে তার বুকের ভেতর জায়গা করে নিলো! প্রেম বুঝি এমনই। হুট করে হয়ে যায়। তুষার মুচকি হাসে। যেদিন বকুল প্রথম জানতে পারবে, তার ভাষ্যমতে এই দামড়া পাঠা-ই তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, কেমন চাহনি হবে ওর? অবাক হবে নিশ্চিত। আর কি কি থাকবে ওই চাহনিতে? তুষার দেখার জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। ওর হৃদয় কেমন ছটফট করে ওঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বকুলের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। আজ যেন শরীর কোনো কথাই মানছে না। সকাল থেকে বারবার নিজেকে তোলার চেষ্টা করলেও শরীরের ব্যথার কাছে হার মেনে অবশেষে গুটিশুটি মে*রে পুনরায় ঘুমিয়ে গেছে। তুষারের সেরকম ঘুম হয়নি। ছাড়া ছাড়া এবং অস্বস্তি মিশে ছিল পুরো রাত জুড়ে। ভোরের আলো ফুঁটতেই সে উঠোনে চলে এসেছে। এদিক ওদিক পায়চারি করেছে। খোপ থেকে মোরগ-মুরগি ছেড়েছে। এত ঠান্ডার মধ্যেও কেমন ঘেমে অস্থির হয়ে ওঠায় পুকুরে নেমে গোসল ও করে নিয়েছে। তবুও বকুলের দেখা নেই। তুষারের অস্থিরতা এবার যন্ত্রণায় পরিণত হয়। মেয়েটা আজ উঠছে না কেন ঘুম থেকে? নাকি উঠেছে, চুপ করে শুয়ে আছে? একবার কি গিয়ে দেখে আসবে ও?

আরজু রান্না চাপিয়েছেন। আজ সকাল থেকেই উনি চুপচাপ। গতকাল রাতেই মকবুল অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছেন। নেহাৎ মেহমান আছে বিধায় গায়ে হাত তোলেননি। নাহলে বোধকরি সেটুকু করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। আরজু এর পর থেকেই ফাটা বেলুনের মতো চুপসে রয়েছেন। তুষারের সাথে সকাল থেকে অনেকবার চোখাচোখি হলেও নিজ থেকে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তুষার বোঝে, উনি রাগ করে আছেন। থাকুক! তাতে তুষারের কিচ্ছু যায় আসে না। আপাতত ওর কারো সাথেই কোনো লেনাদেনা নেই। শুধুমাত্র ওই মেয়েটি ব্যতীত…

তুষার গম্ভীর মুখে ডাকল,
“কাকী।”
আরজু জবাব না দিয়ে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
“কাকা কোথায়?”
“জানি না।”
প্রায় ঝামটা মে*রে উত্তরটা প্রদান করেই ফের কাজে হাত লাগালেন। তুষার তাঁর এই অগ্রাহ্যটুকু গায়ে মাখলো না। পুনরায় প্রশ্ন করল,

“বাড়ি নাই?”
“কইলাম না, কইতে পারি না। বাড়ি খুঁইজা দেহো, আছে কি নাই।”
“দেখলাম তো। কোথাও পেলাম না।”
“তাইলে কই গেছে আমি জানি না। আমারে কইয়া যায় নাই।”
“ঠিক আছে।”
তুষার ঠোঁট টিপে সরে এলো। আরজুর গরম মেজাজ তাকে রাগ নয় বরং প্রশান্তি দিচ্ছে। যে জ্বালা সে বকুলের হৃদয়ে ধরিয়েছে তার কিছুটা হলেও এর মাধ্যমে ফেরত দিতে সক্ষম হয়েছে তুষার। আপাতত ভালোবাসার মানুষের জন্য এতটুকু করতে পেরেই তুষারের মনটা ভালোলাগায় ভরে ওঠে।

অতি সন্তর্পণে ও এগিয়ে গিয়ে বকুলের রুমের সামনে দাঁড়াল। এ রুমে কোনো দরজা নেই। উঁকি দেবে কি দেবে না তাই নিয়ে ক্ষণকাল দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলো ও। হাতে সময় বেশি নেই। আরজু অথবা অন্য কেউ দেখে ফেলার আগেই এখান থেকে সরে যেতে হবে। তুষার উদ্বেগ নিয়েই ভেতরে পা বাড়ালো।

বকুল এলোমেলো শুয়ে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। বেহুশ ও। গায়ের কাপড় ঠিক নেই। এই প্রথম এত খোলামেলা দেখছে তুষার। গতকাল রাতেও শরীরে কাঁথা পেঁচানো ছিল। এখন সেটিও নেই। পায়ের উপর জড়িয়ে আছে। বুকের ওড়না মাটিতে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। একটা হাত বিছানা থেকে নিচের দিকে ঝুলছে। চুলগুলো খোলা। আলুথালু হয়ে পড়ে রয়েছে। তুষার অবাক হলো। সবসময় খোঁপা করে মাথায় ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখার ফলে ওর চুল সেভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়নি এর আগে। আজ হলো। কোমর ছাড়ানো দীঘল কালো চুল। তুষার মুগ্ধ চোখে ওদিকেই চেয়ে রইলো।

এমন কেশ দেখেই বোধহয় কবিদের হৃদয়ে কাব্য রচনার সৃষ্টি হয়। এমন কেশেই বোধহয় মানুষ ডুবে যায়, হারিয়ে যায় আর একবার হারিয়ে ফিরে আসার পথ খুঁজে না পায়! তুষার বিড়বিড়িয়ে স্বগতোক্তি করল,
“আমার গল্পের রাণী, তোমার চাঁদ বরণ অঙ্গে তবে এই কৃষ্ণ থাকুক। বিশ্বাস করো, তুমি এত সুন্দর, আমি আগে বুঝিনি!”
তারপর চুপচাপ বেরিয়ে এলো ও। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। প্রাণের প্রিয়তমার আগুন ঝলসানো রূপ তুষারকে উন্মাদ করে তুলেছে। ও চায় না, ভুল হোক! বরং সব ভুল চাঁদ রাণীর সংস্পর্শে এসে ফুল হয়ে ফুটে উঠুক।

মকবুল সকাল বেলায় মাছ আনতে বেরিয়েছিলেন। আজ শিং মাছের পাতলা ঝোল, সাথে থাকবে নতুন আলু এবং টমেটো দিয়ে ধোঁয়া উঠা গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। সাথে থাকবে পুই শাঁক আলু দিয়ে ভাজি আর লেবু। জলপাই দিয়ে টক টক করে একটা ডাল রান্না করার ও আদেশ দিয়ে গেছেন উনি আরজুকে। ফিরে দেখলেন আরজু সব পদ রেঁধে বসে আছেন। মাছ আসার অপেক্ষা করছিলেন। মকবুল ব্যাগ খুলে কুলার উপর মাছ গুলো বের করেন। হাসিমুখে বললেন,

“মাছ গুলান একদম মন মতো পাইছি দ্যাখ।”
আরজু আগ্রহ করে মুখ বাড়ালেন,
“হ আকাশের বাপ। এক্কেবারে ছোডোও না, আবার বড়োও না। খাইতে ভাল লাগবো।”
“কিনছিও মেলা কমে। এক কাম কর, মাছ গুলান আস্তা আস্তা রান্ধিস। বেশি টমেটো দিবি না। ভালা মতো রান্ধিস। বাবাজি খাইয়া যাতে সাধ কয়।”

আরজুর হুট করে একটা কথা মনে পড়ে গেল। এই সুযোগ, মকবুলের মন মেজাজ ভালো আছে। যেদিন বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না হয়, সেদিন তাঁর মন খুব ফুরফুরে থাকে। যা বলা হয়, বিনা বাক্যে মেনে নেয়। এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর আসবে না কথাটি তোলার জন্য। তাই আরজু কণ্ঠ নিচু করে বলতে লাগলেন,
“আপনে ইট্টু বহেন। আমার একখান কতার কাম আছে।”
মকবুল পিড়ি টেনে বউয়ের পাশে বসেন।
“কি কতা?”

“আপনে রাগ না হইলে বলতে পারি।”
“রাগনের কতা হইলে রাগ করমু, এইডাই স্বাভাবিক। আইচ্ছা ক কি কতা। ঘুরাইস না বেশি। ঘুরানো পছন্দ করি না।”
আরজু আমতা আমতা করে বললেন,
“আকাশের বাপ, হারেস আইছিল।”
মকবুল ভ্রু কুঁচকালেন,

“কহন?”
“বিয়ান কালে। আইসে মেহমানরে দেখনের পর একটা ইচ্ছার কতা জানাইয়া গ্যাছে।”
“কি ইচ্ছা?”
“আপনে রাগ হইয়েন না। আমি আপনেরে জানাইতেছি। আপনে যেডা কইবেন ওইডাই মাইনা নিমু। ইচ্ছাডা হইলো, আমগো আহ্লাদীর লগে মেহমানের যদি..”

বাকি কথা বলার আগেই মকবুল বুঝে নিলেন। তাঁর চোখ বড়বড় হয়ে ওঠে।
“এডা তুমি কেমন তর কতা কইলা? না, না, এইডা হয় না।”
“ক্যান হয় না? আহ্লাদী গা দিয়া কাঁচা দুধ বাইর হয়। কি সোন্দর মাইয়া আমগো। একবার মেহমানরে দেহান। পছন্দ না হইলে চাপাইয়া তো দিমু না। কথাবার্তা কইতে সমিস্যা কোতায়?”
মকবুল জিভে কামড় দেন,

“এহহ বোজে না কিছু! আমি কেমন কইরা বাবাজিরে এগলা কই? হের বাপ-মায়ে থাকলে ভিন্ন কতা আছিল।”
“তাইলে আমি কমু?”
“যা মনে লয় করো। তয় আমি কইয়া রাখি, এইডা কহনোই সম্ভব না। হেরা কই আর আমরা কই। মাইয়া যতই সোন্দর হোক, তুষার বাবাজি চায় শিকখিত মাইয়া। হের লগে এই গেরামের কারো বনে না।”
আরজু নিরবে মাথা ঝাঁকালেন। তিনি যা করার বুঝে গিয়েছেন। মকবুল আর কথা এগোলেন না। পুনরায় মাছের দিকে প্রসঙ্গ চলে গেল।

রুনু বেগম ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। আজকে একটা অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন তিনি। ঘটনাটা শাহজাদিকে নিয়ে। উনি সকাল বেলায় নামাজ পড়ার জন্য উঠেছিলেন। ওযু করে নিজের রুমে আসবার পথে উনি টের পান পেছনে কেউ আছে। উনি ঘুরে তাকাতেই শাহজাদিকে আবিষ্কার করেন। শাহজাদি যেদিক থেকে আসছিল, সেদিকটায় বড় খাল আর জঙ্গল। ওদিকে ভোরবেলা এই মেয়ের কি কাজ থাকতে পারে, রুনু বেগম যুতসই উত্তর খুঁজে পান না। শাহজাদি কে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলে সে দায়সারাভাবে জবাবে বলেছে,

“ওযু কইরে ইট্টু হাঁটতে গেছিলাম। সক্কালের বাতাসডা গায়ে লাগলে শরীর ভালা ঠেহে।”
তারপর হেলেদুলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গিয়েছে। নামাজ নিয়ে এই মেয়ের মাথাব্যথা নেই। আসার পর এক ওয়াক্ত নামাজও তাকে পড়তে দেখা যায়নি। সেই মেয়ে আজ সাত সকালে একা একা ওযু করে ওদিকে হাঁটতে গিয়েছে! বিষয়টা হাস্যকর শোনালো। সেই সাথে অবিশ্বাস্যও!

ও কি লুকোচ্ছে? কি করছে আড়ালে? রুনু বেগমের বুকটা কেমন ভার হয়ে আসে। এরপর যখন নামাজ শেষ করে রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়েছেন উনি, তখন জানালায় দেখেছেন, ঘুমন্ত মোরশেদের মাথায় কেমন করে ফুঁ দিচ্ছিলো শাহজাদি। সেই থেকে বুকের ভেতরটা একটু পর পর কামড় দিচ্ছে। মন বলছে, কিছু একটা হতে চলেছে। কিছু একটা অবশ্যই হতে চলেছে। কিন্তু কি?
রুনু বেগম উঠোনের এক পাশে বসে দুপুরের রান্নার জোগাড় করছেন। এমন সময়ে তমার খালা এলো হাঁক পাড়তে পাড়তে,

“ও চাচী! চাচী গো… বাড়ি আছোনি?”
রুনু বেগম হাত ধুয়ে উঠে পড়লেন।
“কেডায়? শারমিনে না? ওরে বাবা, কত্তদিন পর আইলা এদিকে। স্বামীর বাড়ির থেইকা লড়তে মন চায় না বুজি।”
“জামাই যদি মাথায় তুইলা রাহে, কারই বা নড়বার মন চাইবো কও! তুমি ভালা আছোনি?”
“আছি। বও বও, এই পিড়িডার উপরে বও।”
রুনু বেগম পিড়ি এগিয়ে দিলে শারমিন বসল।

“সব খবরই হুনলাম। তোমার নতুন বউ কই? তুমি এইনে কে? নতুন বউ ঘরের দুয়ার দিয়া ঘুমায়নি?”
রুনু বেগম লজ্জিত গলায় বললেন,
“পোয়াতি তো। শরীরডা ভালা না।”
“ওমা! আইতে না আইতে পোয়াতি হইয়া গেল? নাকি বিয়ার আগেই পোয়াতি হইছিল চাচী?”
রুনু বেগম গম্ভীর গলায় বললেন,

“অন্য প্যাঁচাল থাকলে ক। নাইলে বাড়িত যা। আমার দুইন্নার কাম আছে।”
শারমিন কটাক্ষ করে হাসল,
“চেইতো না চাচী। আইচ্ছা বাদ দাও। তোমারে একখান খবর দিতে আইলাম।”
রুনু বেগম আগ্রহী চোখে তাকালেন,
“কি খবর?”

শারমিন আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে রুনু বেগমের দিকে আরেকটু ঝুঁকে প্রায় ফিসফিস করে গোপন সংবাদটি দিলো।
“তোমার আগের বউ, বকুল…আকাম ঘটাইছে যে, জানো কিছু?”
রুনু বেগম অবাক চোখ মেললেন,
“কি কও? আমি কিছুই কইবার পারি না। ইট্টু খুইলা কও।”

“বকুল গো বাড়ি এক ছেঁড়া আইছে। নাম তুষার না কি যেন। সেই রহমের সুন্দর। বয়স খানও কম। জোয়ান পোলা আর কি। হেইডার লগে এইনে সেইনে ঘোরবার যায়। কেউ জিগাইলে কয়, ছেঁড়া বলে ওগো বাড়িত মেহমান হইয়া আইছে। কি লেহালেহি করতে। কয়দিন থাকব। ওত কিছু বুজি আমি? আমি কই, এডি সব মিছা কতা। ওই ছেঁড়ার লগে বকুলের কিছু একটা তো আছেই। হেইডা গোপন কইরা রাখছে। তয় বেশিদিন গোপন থাকবো না। একবার আম বাগে গেছিল। হেইনে বলে ডলাডলি করছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! হেইয়া নিয়া কত ঝগড়া কাইল। আমি দেইক্ষা আইলাম তবে। নাহ, বকুলরে যতডা সিধাসাধা ভাবছিলাম, অর চরিত্র খারাপ। মোরশেদ ভাই ওরে তালাক দিয়া এক্কেবারে ঠিক কাম করছে। তোমগো পরিবারে কলঙ্কের কালি লাগনের আগেই বাইচা গেছো চাচী।”

রুনু বেগমের মাথা ঘুরে উঠল। এসব তিনি কি শুনলেন! বকুল এরকম হতে পারে বা করতে পারে সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি কোনোদিন। বকুল চঞ্চল, উড়া ওর স্বভাব, এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। বাচ্চা স্বভাব বিদ্যমান। তাই বলে চরিত্রহীন? কিন্তু শারমিনের কথা অবিশ্বাস করারও প্রশ্ন নেই। কিছু যদি নাই ঘটে তাহলে এসব কথা হাওয়ায় উড়ে আসেনি নিশ্চয়ই! রুনু বেগম মোরশেদদের ঘরের পানে তাকালেন। ভেতরে শাহজাদি ঘুমিয়ে আছে। এতক্ষণ যে ক্ষোভ আর রাগটুকু ওর উপর কাজ করছিল রুনু বেগমের, সেটুকু মিটে গেছে। শাহজাদি আর যাইহোক, চরিত্রহীন মোটেও নয়!

বিকেলের দিকে শরীরটা ভালো লাগল বকুলের। জ্বর কমে এসেছে। ব্যথায় টান পড়েছে। গতকাল রাত থেকে এক নাগাড়ে ঘুমানোর জন্য শরীরটা হালকা লাগছে। এই মুহূর্তে বিছানায় একেবারেই মন টেকে না ওর। গোসলও করা হয়নি। দুপুরে একবার জেগেছিল। মকবুল বলে কয়ে কয়েক লোকমা ভাত খাইয়ে দিয়েছেন। এরপর আবার ও ঘুমিয়ে পড়েছে। বকুল ভাবল, এখনো সন্ধ্যা হতে অনেক বাকি।

পুকুরের পানি খুব একটা ঠান্ডা হয়নি। গোসল করলে আরও ভালো লাগবে। ঘামে চিটচিটে শরীরে প্রশান্তি আসবে। বকুল কাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল হালকা পায়ে। ওর ঠোঁটজোড়া অজান্তেই গুনগুনিয়ে উঠে গিটারের টুংটাং শব্দের ন্যায়। পুকুর পাড়ে এই মুহুর্তে কেউ থাকার কথা না। কিন্তু দড়ির উপর দু’হাত মেলে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকা তুষারকে দেখে ও একটু চমকালো।

“আপনে এইনে?”
তুষার চমকালো না। যেন ও জানত বকুল আসবে। পেছন ঘুরে একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর টা দিলো তাই,
“ভালো লাগছিল না ঘরে।”
বকুল দড়ির উপরে নিজের কাপড় গুলো রাখতে রাখতে বলল,
“ঘুমাইতে পারেন না? আপনে রাইতেও ঠিক মতো ঘুমান না। দিনেও ঘুমান না। শরীলডা চলে কেমনে?”
তুষার মুচকি হেসে প্রত্যুত্তরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

“কে বলছে আমি ঘুমাই না?”
“আপনের চোখ দেখলে বুজি।”
তুষার উৎসুক হলো,
“তুমি আমার চোখের দিকে তাকাও?”
বকুল ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মাইনষের লগে কতা কইলে হের চোক্ষের দিকে তাকায় না?”
“ওহ! বুঝেছি।”

সমস্ত আগ্রহে যেন এক গাদা জল পড়ে। তুষার ভেবেছিল, হয়তো বকুলও তাকে পছন্দ করে। অন্য ভাবে তাকে দেখে। কিন্তু…বকুলের কাছে সবটা স্বাভাবিক।
“আপনের প্যাঁচাল হইলে এহন যান। আমি গোসল করমু।”
“এখন?”
“হ।”
“মোটেও না! তোমার গায়ে জ্বর।”
“কইমা গেছে।”
“আবার উঠবে!”

“উঠলে উঠুক। শরীল ঘামছে। কেমুন জানি লাগতাছে। গোসল না করলে শান্তি পামু না।”
“শরীর মুছে ফেলো। কিন্তু গোসল না। তাও এই বেলায় এই ঠান্ডা পুকুরের পানি দিয়ে!”
বকুল বিরক্ত হয়।
“আপনের কি তাতে? আপনে সরেন।”
“বকুল!”
“কি?”

তুষার জমাট বাঁধা ঠান্ডা গলায় আদেশের স্বরে বলল,
“আমি মানা করেছি না?”
বকুল সরু চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“মাইনা নিলাম। আপনে যান। আমি গা টা মুইছা নেই।”
তুষারের ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠল।
“ঠিক আছে চাঁদ রাণী।”

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১০

[গল্প একদিন না দিলে আপনারা অনেকে অনেক কথা বলেন। আমি চুপচাপ দেখি শুধু। আপনারা ৩-৪ মিনিটে একটা পর্ব পড়ে চলে যান। আর এই পর্বটা লিখতে আমার ৩-৪ ঘন্টা সময় লাগে! অনেক ভাবতে হয়। কা*টতে হয়। তারপর গিয়ে লিখি। সেই সাথে গল্প লেখাটা সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। মন ভালো থাকলে গড়গড় করে লিখতে পারি। মন ভালো না থাকলে একটা লাইনও লিখতে পারি না। আজ কয়েকদিন যাবত আমার মন একদমই ভালো নেই। হয়তো বলেছিলাম, আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি এক্সিডেন্ট করে অসুস্থ হয়ে রয়েছে।]

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১২