ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১০

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১০
মেহা মেহনাজ

মোরশেদ দুপুর বেলায় খেতে এসে দেখেন, তাঁর মা ও স্ত্রীর ভেতরে তুমুল কথা কাটাকাটি চলছে। মোরশেদ বাজখাই গলায় জিজ্ঞেস করেন,
“কি হইছে? দুইডা ম*রনের লিগা চেতছো নাকি? কেডায় ম*রবো?”
রুনু বেগম ছেলের এহেন কথা শুনে তাজ্জব বনে যান। কথা থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেই সময়টায় শাহজাদি দৌড়ে এসে স্বামীর পাশে দাঁড়াল। চোখের কান্না, নাকের কান্না একত্র করে বলে,

“আপনের মায়ে খালি আমার লগা তাউরাশ করে। আমারে হেয় এহনো মন থেইকা মাইনা নেয় নাই। আমি যা করি, যা কই- সবতে ভুল ধরে আর চিল্লায়। কতক্ষণ মুখ বুইজা থাকন যায় কন দেহি। আমিও তো একখান মানুষ। শ্বশুর বাড়ি থাকি দেইহা সব কতা সহ্য করন লাগব? এমুন কুন হাদিসে লেহা আছে?”
মোরশেদ রুনু বেগমের দিকে র*ক্তচক্ষু করে তাকাল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কি মা? কি সমিস্যা? নতুন বউয়ের লগে এমুন লাগাইছো ক্যান? শাহজাদিরে মাইনা নিতে সমিস্যা কুন জায়গায় তুমার?”
“বাপ, তর বউ একটা কামও হাত দিয়া ধরতে চায় না। খালি গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুরে। আমি কি সব এললা এললা পারি? শরীলডাও তো ভালা না। দুপুর কতখানি হইছে। এহনো রান্ধা শেষ হইয় নাই। তুই আইয়া কয়ডা ভাত যদি মুখে না দিতে পারোস! আমি হেইগুলা ওরে বুজায়ে কইতেছিলাম। কিন্তু ওয় আমারে কেমুন কইরা কইলো, বেশি জ্ঞান দিতে আইবেন না! আমি তো ওর শ্বাশুড়ি। শ্বাশুড়ির লগে এমনে কতা কয়?”

মোরশেদ শাহজাদির দিকে তাকাতেই শাহজাদি নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করে,
“আমার শইলডা ভালা ঠেহে না। কুনু কাম ধরবার মন চায় না। সবেতে গন্ধ পাই। খাইবার কথা ভাবলেই পেডটা পাঁক দিয়া উঠে। এই অবস্থায় এরম হইবেই। এইডা হেয় বুজে না? হেয়ও তো মাইয়া পিলা জন্ম দিছে। এইগুলা কইছি দেইখা আমি বেদ্দপ হইয়া গেছি হের কাছে। আপনেই বলেন, আমি কি ভুল কতা কইছি? নিজেরে কষ্ট দিয়া পেডের ছাওডার ক্ষতি করলে আমারেই তো ধইরা মা*রবেন আপনে।”

মোরশেদ রুনু বেগমের দিকে ফিরলেন। কণ্ঠে কাঠিন্য যোগ করে বললেন,
“শাহজাদি না থাকলে কেমনে সংসার গুছাইতা তোমার? সেমনে এহন হইতে করবা। ভাইবা লও শাহজাদি নাই। বাপের বাড়ি গেছে গা। তোমার সংসার তোমারই গুছাইয়া লইতে হবে আম্মা। আমি যেন এডি নিয়া আর কুনু কতা না হুনি। হুনলে তোমগো দুইজনারই খবর আছে। আর শাহজাদি, তুই যদ্দুর পারবি, আম্মার লগে করবি। যেডা করতে কষ্ট হইবো, মন টানবো না, হেইডা মায়রে কবি। মায় কইরা দিবো। কি কইছি, দুইজনে হুনছো?”

রুনু বেগম কোনো জবাব প্রদান করলেন না। তিনি শুধু হা হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই ছেলে, কোনোদিন মায়ের অবাধ্যতা করেনি। আর না কোনোদিন গলা উঁচু করে কথা বলেছে। সেই ছেলে আজ! অস্বীকার করার উপায় নেই, রুনু বেগম মনে গভীর চোট পেলেন। মেনে নিতে পারলেন না দুই দিন আসা একটা মেয়ের জন্য তার ছেলে এরকম আচরণ। কেমন চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মুখখানা হলো তাঁর। সেই সাথে তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারলেন, তিনি মৃত্যুর মুখে পতিত হওয়া মাত্রই এই সংসারের বালির মতো ঝরে পড়ে যাবে। তিনি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

ওরা বাড়ি ফিরলো আসরের পর পর। অনেকক্ষণ গল্প হলো দু’জনার মাঝে। অনেক কথার ছড়াছড়ি, অনেক জ্ঞান বিনিময়, একে অপরকে আরেকটু গভীর ভাবে চেনা, একজন আরেকজনের সংস্পর্শে আসা। তুষারের ভালোই লাগল। মেয়েটা অশান্ত, চঞ্চল, কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় না আর। তুষার মনে মনে প্রার্থনাও করল একবার, রব ওকে ভালো রাখুক!
কিন্তু নিমিষেই রাজ্যের মেঘ এসে পুনরায় জড়ো হলো বকুলের আকাশে। মেঘদল টেনে নিয়ে এলো কালো বৈশাখীর ঝড়। গ্রামের অনেকেই নাকি বকুল আর তুষারকে একে অপরের কাছাকাছি আসতে দেখেছে। দেখেছে একজোড়া কপোত-কপোতী বনের ভেতর একে অন্যের সাথে…ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ওসব কথা মুখেও আনা যায় না।

ওরা যখন বকুলদের উঠোনে পা রাখে তখন জনা বিশেক মানুষের উপস্থিতি টের পায়। দু’জনেই আকাশ সমান চমকায়। এত মানুষ কেন? বাড়িতে কারো কিছু হয়েছে? বকুল দৌড়ে ভেতরে ঢুকে। তুষার যেতে নিলে ওকে আঁটকে ফেলে দুই-তিন জোড়া কালো হাত। গম্ভীর কণ্ঠে কেউ যেন আদেশ করল,
“পোলাডারে গাছের লগে বান্ধো। আমগো মাইয়ার সর্বনাশ করতে আইছে।”

তুষার বুঝে উঠতে পারে না কিচ্ছুটি। সবকিছু মুহূর্তের ব্যবধানে ঘটে গেল। তুষারকে টেনেহিঁচড়ে একটা গাছের সঙ্গে মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। যখন বাঁধা শেষ, তুষার বুঝতে পারল, ভীষণ খারাপ কিছু হতে চলেছে। সে হৈহৈ করে উঠল।
“আরে, কি করছেন আপনারা! আমাকে এভাবে বাঁধছেন কেন! কি করেছি আমি! অদ্ভুত তো..”
ভীড়ের ভেতর থেকে কেউ ধমক লাগায়,
“এ ছেড়া, চুপ থাক। আকাম কইরা গলা চড়াস!”

“কীসের আকাম? কি করেছি আমি! আমাকে এই মুহূর্তে ছাড়ুন। আমার বাবার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আপনাদের।”
“গরম দেহাস গরম? ওইসব গরম তোগো শহরে চলে। আমাগো গেরামে না। এইনে আইছোস মাইয়া মাইনষের সর্বনাশ করার লিগা। কি মনে করোস, আমরা বুজি না? আর ছেড়িডারেও কই, তালাক খাইয়া আইছে আষ্টদিন হইতে পারে না, এর মধ্যে আরেক ছেড়ার লগে বিষ মজাইবার গেছে! কই? নটি মা** কই? ওর বাপেরে খবর দাও। মাইয়ার চুলকানি কমাক..”

তুষার সমস্ত শরীর ঘেন্নায় রি রি করে উঠে। মানুষের চিন্তাভাবনা কতটা নিচুতে আজ তা সরাসরি দেখার ভাগ্য হলো। এটা সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য- তুষার জানে না। শুধু জানে, বকুলকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে। তার জন্য মেয়েটা মারাত্মক বিপদের মুখে পড়ল। ও এখান থেকে চলে গেলেও বকুলকে আজীবন এই নোংরা পরিবেশেই থাকতে হবে। এমনিতেই গায়ে কালো কালির ছাপ লেগে গেছে আর এখন লাগল কলঙ্ক! তুষার এদিক ওদিক তাকায়। বকুল কই?

বকুল তখন সৎ মায়ের চড়ের আঘাতে পিষ্ট হচ্ছে পেছনের ঘরে। বেশ কয়েকজন মহিলা ওদের ঘিরে রেখেছে। আরজু সমানে থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছেন। বেশ কয়েকবার চুলের মুঠিও খপ করে চেপে ধরলেন। বকুল ব্যথায় গুঙিয়ে উঠে।
“আম্মা ছাইড়া দেন আমারে। ছাইড়া দেন। আপনের পায়ে পড়ি। আমি কিচ্ছু করি নাই।”
“মাইনষে না দেখলে মিছা কতা কইবো হ? কিছু করোস নাই তুই? ওই ছেড়ার লগে কিয়ের সম্পর্ক জুড়ছোস এই দুই দিনে?”

“হের লগে আমার কোনো সম্পর্ক নাই আম্মা। আপনে বিশ্বাস করেন। কেউ মিছা কতা কইছে। আমরা ওই জঙ্গলের মধ্যে ওই আম গাছের তলায় দাঁড়াইয়া গল্প করছি। আর কিচ্ছু না আম্মা।”
“ওই ছেড়া তোর গায়ে হাত দেয় নাই? তোর মাথায় হাত দেয় নাই? আর কই কই হাত দিছে হেডি কমু আমি মুখ পুরি… দুনিয়ায় এত মানুষ ম*রে, তুই মরোস না কেন? খালি আমারে আর তোর বাপেরে ঝামেলায় ফালানোর লিগা বাঁইচা আছোস হ?”

বকুল স্তব্ধ হয়ে যায়। সত্যিই তো তুষার ওর মাথায় হাত রেখেছিল। একটু কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সেই ছোঁয়ায় ও অন্য কিছু পায়নি। যা ছিল, সবটুকু মমতার, স্নেহের, ভরসার! এখন এই কথা কীভাবে বোঝাবে ও বাকি সবাইকে!
এতগুলো মানুষ ঘরে দাঁড়িয়ে তবুও কেউ এসে বকুলকে ধরল না। আরজু সুযোগ পেয়ে ইচ্ছেমতো মেয়েটাকে মা*রলেন। যখন চেহারা ফুলে গেল, ঠোঁটের এক পাশ গেল ছড়ে, মুঠো মুঠো ছেঁড়া চুলে মাটির ঘর ভরে গেল, তখন যেন সকলের হুশ ফিরে আসে। দুই তিনজন ‘আরে করো কি, করো কি’ করে এগিয়ে যায়। বকুলকে ধরে একজন নিজের বুকের মধ্যে আগলে নিলো। ঘর ভরে উঠল কথার কলকাকলিতে।

কেউ বলল, ‘ছেড়িডা কি ম*রছে?’
কেউ বলল, ‘ও আরজু, কেমন পাত্থর দিল গো তোমার। সৎ দেইখা এমনে মা*রবা?’
কেউ আবার বকুলকেই দোষারোপ করল সবকিছুর জন্যে।

বকুলের কানে সব কথা ভেসে আসে তবে অস্পষ্ট, ছাড়া ছাড়া। সে চোখ মেলে রাখতে পারে না। কেমন ভারী হয়ে উঠলো শরীর। কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট হয়। শরীরের চেয়েও মনের কষ্ট টা বড়। অস্ফুটস্বরে বার দুয়েক মায়ের নামটি ধরে ডাকলো ও। তারপর জোর ছেড়ে দিলো। লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর। নাক মুখ দিয়ে র*ক্তের বন্যা বইছে। এহেন অবস্থায় ঘরের মধ্যে থাকা সকলের মুখ চিঁড়ে বেরিয়ে আসে চিৎকার। আরজু সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেলেন। বেহুশের মতো মে*রেছে ও। আগের যত ক্ষোভ ছিল সব ঝেড়ে দিয়েছে এই সুযোগে। এখন যদি মেয়েটা ম*রে যায়, কি হবে!

মকবুল গিয়েছিলেন স্টেশনে, একজনের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে। বাড়ি ফিরলো যখন তখন সূর্য ডুবে আকাশে এক ফালি চাঁদের আগমন ঘটেছে। তিনি আসলেন হেলতে দুলতে, অনেক ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে। বাম হাতের টর্চ লাইটটা বাড়ির ধারে এসে নিভিয়ে দিলেন। এদিক দিয়ে পুরো রাস্তাটাই মুখস্ত। শুধু শুধু টর্চ চালিয়ে ব্যাটারি অপচয় করার কোনো মানে হয় না। গত দুই শুক্রবার আগে একটা সিনেমা দেখেছিলেন মন্টু মিয়াদের বাড়ি। সেই সিনেমার একটা গান তার খুবই মনে ধরেছে। সেই গানের কিছু লাইন মাথায় এসে বাজছে। মকবুল আপন মনেই গান ধরলেন। চুপেচাপে, ফিসফিস করে, পাছে কেউ শুনে না মজা নেয় আবার! তার বয়সে এসে এসব পাগলামো সাজে না।

আজ উঠোন নয়, একটু ঘুরে জঙ্গল দিয়ে বাড়ির পেছন দিকে এলো। এসে দেখল দরজা বন্ধ। ভেতরে মানুষের সাড়াশব্দ নেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে? মকবুল মনে মনে উত্তর দলো, ঘুমিয়েই পড়েছে। রাত তো কম হয়নি। সে আবার হেঁটে সামনের দরজার দিকে এলো। এই ঘরে সে ঘুমায়। টোকা দিলেই আরজু শুনতে পেয়ে খুলে দেবে। দ্রুত দ্রুত পা চালালো এবার ওঁ। শীতটা বেশ জেঁকে বসেছে। ঠান্ডায় শরীরের হাড্ডিসহ কাঁপছে যেন। এমনই সময়ে একটা কণ্ঠস্বরের ডাক ভেসে এলো পেছন থেকে,

“কাকা…”
মকবুল থমকে তড়িৎ পেছন ঘুরে তাকাল।
“কেডা? কেডা ওইনে?”
বলতে বলতে টর্চের আলো জ্বেলে সামনে তাক করতেই হাত দিয়ে নিজের দু-চোখ চেপে ধরে একটুখানি পিছিয়ে যায় তুষার।
“ও তুমি!”

তুষারকে চিনতে পেরে দ্রুত টর্চ সরিয়ে নেয় তবে বন্ধ করে না। এত রাতে এই ছেলে বাড়ির বাইরে কেন?
“তুমি এইনে কি করো? ঘুমাও নাই?”
“আমার আপনার সাথে একটু কথা ছিল কাকা।”
মকবুল এগিয়ে এলেন।
“কি কতা যা কওয়ার লিগা তুমি এত রাইতে এইনে খাড়াইয়া রইছো? কি হইছে?”
তুষারও এগিয়ে এলো।
“কাকা আমি চলে যাবো আগামীকাল।”

“ওমা! এ কি কতা! হঠাৎ কেন বাবাজি? তুমি তো কইলা মাসখানেক কাটাইবা। অগ্রিম টেহাও দিলা।”
“জি আমার ইচ্ছে ছিল থাকার কিন্তু এমনটা হবে বুঝলে কখনোই থাকতে আসতাম না।”
“কি হইছে বাবাজি?কেউ তোমারে কিছু কইছে? তোমার কাকী কিছু কইছে?”
তুষার মিথ্যে করে একটু বানিয়ে বলল,
“আপনি জানেন না এদিকে কতকিছু হয়ে গেছে আমি আর বকুল বিকেলে বাইরে বেরিয়ে ছিলাম তাই। দেখুন কাকা, এই গ্রাম আমার অচেনা। আমি এখানে এসেছিই প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার জন্য। সেটাই যদি না হয় তাহলে আমার এখানে আসার স্বার্থকতা কি রইলো, বলুন।”

“তা তো অবশ্যই। কিন্তু হইছেডা কি বাবাজি? আমারে একটু খুইলা কও!”
“আজকে আমি আর বকুল বাইরে গেছিলাম। পূবে একটা খালপাড় আছে না? ওইখানে। আমি কাকীর থেকে অনুমতি নিয়েই গিয়েছি। সেখানে আমাকে আর বকুলকে একসাথে কথা বলতে অনেকেই দেখেছে। হাঁটতে দেখেছে। আমরা দুইজন একটু হাসাহাসি করে কথা বলেছি তাই সেসব নিয়ে কাকীকে এসে কারা উলটাপালটা কিসব বলেছে, আমি জানি না। বকুল আর আমি বাড়ি ফেরা মাত্রই আমাকে ধরে গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছে।

বকুলকে ঘরে নিয়ে মে*রে অজ্ঞান করে ফেলেছে। পরে ওর ভয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে সব পালিয়েছে। এসব কি কাকা আপনিই বলুন। অন্যায় হয়ে থাকলে ন্যায়ের বিচার হবে। আমাকে ডাকতেন, আমার থেকে সব শুনতেন, বকুলের থেকে শুনতেন, তারপর যা শাস্তি দিতেন, আমি মাথা পেতে নিতাম। কিন্তু কারো থেকে কিছু না জেনে না শুনে সবাই মিলে যা করল, এমনকি কাকীও যা করলেন, আমি এসব আশা করিনি! মেয়েটা আমার জন্য…আমি এখন ওর সামনেই বা মুখ দেখাবো কেমন করে কাকা? তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আগামীকালকেই চলে যাবো।”

মকবুল তাজ্জব বনে গেলেন। ক্ষণকাল চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
“তুমি একটু শান্ত হও বাবাজি। আমি দেখতাছি। বকুল কই?”
“বলতে পারি না। শেষ যখন দেখেছিলাম, তখন ও অজ্ঞান ছিল।”
“সকালডা হইতে দাও। দেহো আমি কি করি… আসো, ভিত্রে আসো। বাইরে মেলা ঠান্ডা। আহো বাবাজি…”

তুষার কে নিয়েই মকবুল ঘরে ঢুকলেন। তারপর দুজন মিলে এগিয়ে চললেন বকুল যে ঘরে ঘুমায়, সেই ঘরের দিকে। একটুখানি ছোট্ট ঝুপরির মতো ঘরটায় বকুল থাকে। মকবুল আগে ঢুকলেন। মোটা কাঁথার তলায় বিড়ালের বাচ্চার ন্যায় গুটিশুটি বকুল ঘুমে বিভোর। মুখখানা বড় শুষ্ক, রুক্ষ। ঠোঁটের পাশে কালশিটে পড়ে গেছে। কপালে গালে চড়ের দাগ। মুখমন্ডল ফোলা।

মকবুলের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। যতই বকা দিক, নিজের সন্তান তো! তাও আবার মা হারা বেঁচে থাকা সন্তান! বকুলের নিস্তব্ধ মুখটার দিকে চেয়ে থাকে আরও একজোড়া চোখ। তুষারের হৃদয়ে র*ক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। ইচ্ছে করে মেয়েটাকে তুলে নিজের বুকের ভেতর চেপে ধরে ওর সব দুঃখ নিজের করে নিতে। কিন্তু এটা কি আদৌও কোনোদিন সম্ভব?

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ৯

তুষার নিজ মনে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল,
“আমার চাঁদের গায়ে এত কলঙ্ক মানাচ্ছে না। জলদি সুস্থ হয়ে উঠো চাঁদ রাণী।”

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১১