ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১২

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১২
মেহা মেহনাজ

“কি কইলেন?”
ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল ওর। তুষার হেসে বলল,
“কিছু না। আমি চললাম।”
“শোনেন।”
“হ্যাঁ?”
বকুল কণ্ঠ নিচে নামালো,

“হাঁটতে যাইবেন?”
তুষার গোল চোখ মেলে,
“তোমার সাথে?”
বকুল একটু সময় নিয়ে ঘুরিয়ে উত্তরটা করল,
“আমি কাউরে ডরাই না।”
তুষারের ঠোঁট চিঁড়ে এই এতক্ষণে একটা প্রাপ্তির হাসি ফুঁটে ওঠে। সে খুশিমনেই সম্মতি দিলো।
“ঠিক আছে। সামনের উঠোনে আছি।”
“আইচ্ছা।”
তুষার চলে গেল। ওর গমন পথের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো মেয়েটা। ওর কেমন যেন লাগল। লোকটা আসলেই ভদ্রলোক!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আহ্লাদী হারেসের একমাত্র কন্যা সন্তান। ওর আগে ছয়জন বড় ভাই রয়েছে। শেষ বয়সের বড় শখের মেয়ে ও। তাই হারেস খুশিতে নাম রেখেছেন আহ্লাদী। হারেস আরজুর একমাত্র ভাই। সেই হিসেবে বকুলের মামা এবং আহ্লাদী বকুলের মামাতো বোন। ওর চেয়ে বছর দুয়েক ছোট হবে বয়সে। কিন্তু দুর্দান্ত মাত্রায় চালাক এবং স্বার্থান্বেষী। নিজের স্বার্থ ছাড়া একটি সুতোও এদিক থেকে ওদিক করে না। স্বার্থ থাকলে পুরো পৃথিবী পাল্টে দিতে দুইবার ও ভাববে না।

সেই আহ্লাদিকে এক প্রকার জোর করেই এই বাড়ি পাঠানো হলো। শ্বশুর বাড়ি, বিয়ে, স্বামী, নাম গুলো শুনলেই কেমন জ্বর চলে আসে ওর গায়ে। কত ভালো ভালো পাত্র এলো, বড় বড় ঘর, আহ্লাদির কাউকে মনে ধরেনি। এই সমাজে ছেলেরা মেয়েদের পছন্দ করতে আসে। অথচ আহ্লাদির পছন্দ না হলে সেই ছেলে বাদ! এমনকি সেই ছেলে পক্ষের জন্য আপ্যায়ন ও হবে কম। এটাই ওর নিয়ম। নইলে বাড়ি মাথায় তোলে। কাউকে পরোয়া করে না।

ইচ্ছে হলে কারো কথা শোনে, ইচ্ছে না হলে শোনে না। হারেস মিয়া অনেক বুঝানোর পরও যখন আহ্লাদি মানছিল না, তখন এক শর্তে ওকে এখানে পাঠালেন। আহ্লাদি গিয়ে নিজে দেখুক। যদি ওর পছন্দ হয়, তবেই ছেলের বাড়িতে তারা খোঁজখবর দেবে। নইলে দেখাতেই বাদ। আহ্লাদি নিমরাজি হলো। এক প্রকার নেতিবাচক মনোভাব নিয়েই খালার বাড়ি এলো।

ও এলো পেছন দিক দিয়ে। ওদিকের রাস্তাটা ছোট, যদিও জঙ্গল পড়ে। কলা পাতা দিয়ে ঘেরাও করা বেড়ার কাছে খুচখুচ শব্দ হলো। বকুল সবেমাত্র শরীর মুছে কাপড় পাল্টেছে। সে সচেতন গলায় ডেকে উঠল,
“কে?”
শুকনো কলা পাতার ভেতর দিয়ে একখানি চতুর মুখ উঁকি দিলো,

“আমি।”
বকুল অবাক হলো,
“আহ্লাদি, তুই?”
আহ্লাদি এগিয়ে আসে,
“হ বাবা আমি! এই অসময়ে গোসল দিতাছো?”
বকুল নিচু হয়ে পুকুরের পানিতে কাপড় ধুঁতে শুরু করল।
“শরীলডা ভালা আছিল না। গা মুছলাম।”
“খালা কই?”
“ভিত্রে।”
“হুনলাম একজন মেহমান আইছে।”

বকুল সরু চোখে তাকাল,
“হ।”
“দেখবার আইলাম তোমাগো মেহমানরে।”
“দেখবার আইলি মানে?”
“মানে..”
কি ভেবে যেন আসল কথাটা লুকিয়ে ফেলল ও,
“এমনিই মাইনষেরে দেখবার আহে না?”
“ওহ!”
বকুল আপন মনে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ভিত্রে যা। সামনের উডানে আছে।”

আহ্লাদি জবাব প্রদান করল না। হেলেদুলে চলল ওদিকে।
সূর্যের আলো পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। তুষার দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব দিকে মুখ করে। পেছন থেকে একটা ছায়া তুষারের সম্মুখে পড়ল। তুষার তড়িৎ পেছন ঘুরে তাকাল। চোখের সামনে নতুন মুখ দেখে অবাক হওয়ার বদলে বিরক্তই হলো খানিক। অথচ সে মানুষ হিসেবে অমায়িক। পরিচিত, অপরিচিত যার সঙ্গেই দেখা হোক না কেন, সবসময় ঠোঁটে হাসি লেগেই থাকে ওর। এই প্রথম মনে হয় কাউকে দেখে হাসি ফুঁটলো না।
তুষারের কপাল কুঞ্চিত। আহ্লাদির দৃষ্টি এড়ালো না। সে মিষ্টি করে হেসে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

“আপনেই মেহমান?”
তুষারের কণ্ঠ হঠাৎ ভারিক্কি হয়ে ওঠে।
“জি।”
তারপর আহ্লাদির উলটো দিকে ঘুরে পুনরায় দাঁড়িয়ে রইলো আগের মতো করে। বকুলের অপেক্ষায়। আহ্লাদি হেঁটে হেঁটে তার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। তুষারের বিরক্তি এবার আকাশ ছোঁয়।

“আমি আহ্লাদি, বকুলের মামাতো বইন।”
“আচ্ছা।”
ছোট্ট করে জবাব দিলো ও।
আহ্লাদি বলল,
“আপনে নাকি লিহালিহি করেন।”
‘লিখালিখি’ শব্দটি ‘লিহালিহি’ হিসেবে শুনে একটা চিড়বিড়ানি রাগ ওর মাথায় গিয়ে চাপে। তুষারের কণ্ঠস্বর আরও ভারী হলো।

‘জি।”
“কি লেহেন?”
“অনেক কিছু।”
“আমারে পড়তে দিবেন? আমি পড়তে জানি।”
তুষার কঠিন করে বলল,
“ওগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। কাউকে দেই না।”
“আমারে দিলে কি এমুন হইবো? আমি তো জনে জনে যাইয়া শুনামু না।”
“আপনি তো আমার পরিচিত কেউ নন! আমি আপনাকে কেন দিতে যাবো?”
“ওমা! মাত্রই তো কইলাম। আমি বকুলের মামাতো বইন।”
“এইটুকুই কি আপনার আমার পরিচয় হওয়ার জন্য যথেষ্ট?”

“মানে?”
তুষার ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে।
“মানে বোঝার মতো বয়স তোমার হয়নি। তুমি বোধহয় বকুলের চেয়েও ছোট, তাই না?”
“হুম।”
“এই জন্যেই…”
তুষার বাকি কথা বলার আগে থেমে গেল। আহ্লাদি চোখ মুখ কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কি?”
তুষার মাথা নাড়ে। অযথা কথা বলা ভালো লাগছে না। একটু এগিয়ে যেতেই আহ্লাদি বলে উঠল,
“আপনে ভাব দেহাইতেছেন!”

তুষার পেছন ফিরে তাকিয়ে উত্তরটা দিতে যাবে ওমনি ওর ঠোঁট চিঁড়ে হাসি বেরোলো। হাসিটা যে আহ্লাদির জন্য নয় তা বুঝতে পেরে আহ্লাদিও পেছনে তাকাল। বকুল তরতর করে এগিয়ে আসছে।
হাতের নাগালে এসে অপরাধী স্বরে বলল,
“দেড়ি কইরা ফালাইলাম বেশি।”
তুষার মাথা নাড়ে,

“কোনো ব্যাপার না। খুব একটা অপেক্ষা করতে হয়নি।”
“আইচ্ছা। চলেন তাইলে।”
আহ্লাদি মাঝখান দিয়ে বলে উঠল,
“কোথায় যাইতাছো তোমরা?”
উত্তরটা দিলো বকুল,
“সামনেই।”
“আমিও যামু।”

“ইয়া খোদা, এই বিচ্ছুটা কোথা থেকে এসে হাজির হলো! মুডের বারোটা বাজিয়ে দিলো। কোথায় ভাবলাম আমি আর বকুল কিছুক্ষণ আলাদা ভাবে সময় কাটাতে পারব কিন্তু হচ্ছে টা কি! এই মেয়েকে আর পাঁচ মিনিটও সহ্য করা অসম্ভব।”
মনে মনে রাগে গজগজ করতে থাকে ও। তুষারের ইচ্ছে করে, একটা বড় পাথর দিয়ে আহ্লাদি নামক প্রাণীটার মাথা থেতলে দিতে। এই প্রথম কাউকে মা*রার জন্য হাতটা নিশপিশ করে ওঠে ওর।
বকুল সরল মনে বলল,

“চলো, সমিস্যা নাই।”
দ্রুততার সঙ্গে তুষারের বাক্যবাণ,
“আমার সমস্যা আছে। তোমরা বরং যাও। আমি যাবো না।”
আহ্লাদি বকুলের দিকে তাকাল। বকুল বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“ক্যান? কি অইলো আবার?”
“কিছু হয়নি। আমার হঠাৎ করে একটা কাজের কথা মনে পড়ে গেছে। সেটা করতে হবে।”
“কি কাম?”
“অত কিছু তোমাকে জানতে হবে না বকুল। তুমি যাও, উনাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো।”
আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না ও। গটগট পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে এলো। ওদিকে বকুল অবাক হয়ে চেয়ে রইলেও আহ্লাদি কেমন থমথমে রূপ ধারণ করে।

শারমিন অনেকক্ষণ বসল। বসে রইলো কাঙ্ক্ষিত একজন কে দেখার জন্য। সে বাড়ি আছে নাকি নেই, সেই খবর বারবার রুনু বেগমের থেকে নিতে চেয়েও নিতে পারে না। মনের ভেতর জড়তা কাজ করে। ভয় হয়। পাছে কেউ কিছু টের পায় যদি!

অনেকক্ষণ পরেও যখন ব্যক্তিটির দেখা মেলে না, শারমিন উঠে দাঁড়ায়। এবার তার বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। এ বাড়ি এসেছে তাও ঘন্টাখানেক সময় হয়ে গেছে। সে রুনু বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে উঠোন পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতেই উনি এগিয়ে আসেন বাজারের পথ দিয়ে। বাজারে গিয়েছিলেন বুঝি? শারমিন নিজেকে থমকে দাঁড়াল। মোরশেদ হঠাৎ সম্মুখে শারমিন কে দেখে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। দাঁড়াতে চাইলেন না। শারমিন কে পাশ কাটিয়ে তরতর করে এগোতে নিলেই শারমিন ডেকে উঠল।

“খাড়ান ইট্টু।”
মোরশেদ যেন মাত্রই শারমিন কে খেয়াল করেছে, এমন ভঙ্গিমায় বললেন,
“আরে শারমিন তুই! আইলি কবে? বাড়িত সব ভালো?”
শারমিন নিচু কণ্ঠে বলল,
“সব ভালো। আমি বাদে।”
“ক্যান, তোর আবার কি অইলো?”
“আপনে জানেন না?”
মোরশেদ গম্ভীর স্বরে বললেন,
“ওইসব এহনো ভুলতে পারোস নাই?”
শারমিন জোর গলায় জবাব প্রদান করে,

“না পারি নাই। কেমনে পারমু? আপনে তো খালি খাওনের লোভে এই শরীলডা হাতাইছেন। কিন্তু আমি তো আপনেরে মন থেইকা…”
“চুপ কর ছেড়ি…”
মোরশেদ চেঁচিয়ে উঠেন।
“কেউ হুনলে তোরেই পিছা দিয়া দিবো। ব্যাডাগো এরম ছুকছুকানি স্বভাব থাকেই। তুই বিয়াত্তা হইয়াও ক্যান আমারে বিলাইছোস হ? এহন যা হবার হইয়া গেছে। তুই তোর সংসারে মন দে। আমি আমার সংসার নিয়ে ভালা আছি।”

“আমার মনে ব্যথা দিয়া কতদিন ভালা থাকবেন আপনে?”
শারমিনের চোখজোড়া ছলছল করে।
“আপনেরে মন থেইকা চাইছি। আপনের লিগা সব ছাড়তে রাজি। ওই মাইয়া যদি সংসার করনের সুযোগ পায়, তাইলে আমি কি দুষ করছিলাম? ওর মধ্যে এমন কি আছে যা আমার নাই? আমার শরীল ও সুন্দর। আপনে নিজে কইছেন। তাইলে আমি ক্যান আপনেরে পাইলাম না?”

মোরশেদের রাগ ধরে। মাঝ রাস্তায় তাঁর পথ আঁটকে কেউ কৈফিয়ত চাইছে! তাও ছুঁচোর মতো একজন মেয়ে মানুষ! নিজের রাগটা খুব কষ্টে অপ্রকাশিত রেখে বেশ ঠান্ডা স্বরে মোরশেদ বলেন,
“এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে নাই। সামনে থেইকা সর। আমারে চেতাইস না শারমিন। তুই ভালা কইরা জানোস, আমি চেতলে কি করতে পারি।”

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১১

মোরশেদ গটগট হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়। শারমিনের দুই চোখে বন্যার পানি। সে এবার বাড়িতে এসেছে একটা বিশেষ খবর নিয়ে। সেই বিশেষ খবরটা মোরশেদকে সবার আগে জানানো প্রয়োজন। যদিও শারমিন জানে, মোরশেদ জানার পর এর ফল কি হবে! শারমিন দ্রুত চোখের পানি মুছে মোরশেদের পেছন এগিয়ে চললো। এই সুযোগ, যা থাকে কপালে, সে মোরশেদকে সত্য কথাটা বলবেই…

ঝরা বকুলের গল্প পর্ব ১৩