রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ৩

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ৩
লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)

মার্চ মাসের পাঁচ তারিখ।সূর্যের তীব্র তাপদাহে মানুষ যখন অতিষ্ট, ঠিক তখনই ঝর ঝর করে বৃষ্টির ফোঁটা উপহার সরূপ গ্রহণ করছে প্রকৃতি। দুদিন আগেও যা ছিল মরুভূমি, আজ তা সবুজে ভরে উঠছে। সবকিছু কেমন যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে এই সুন্দর বৃষ্টির শান্ত স্নানে।আজ সকাল থেকেই তেমন থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে।

এতদিনের গরমের পর এই বৃষ্টি হওয়ায় বেশ আনন্দই হচ্ছে আমার। ফুপির বাসায় এসেছি আজ দুদিন। আগামীকাল থেকে কলেজ যাবো বলে ডিশিসন নিয়েছি। আজ বৃষ্টি হওয়ায় তিনদিন পর মুখে হাসি ফুটলো আমার।কেমন যেন এনার্জি পাচ্ছি কাজ করার।আলাদা একটা আনন্দ আর সতেজতা পাচ্ছি। আহ!দিনটা কি সুন্দর! এই দিনে সারাদিন কাজে বসে থাকলেও আমার মন খারাপ হবে না।তাইতো ফুপিকে হেল্প করতে চলে এলাম রান্নাঘরে। আমাকে দেখেই মিষ্টি হেসে ফুপি বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

___” কিরে? তুই এখানে?”
আমি ফুপির হাত থেকে ছুড়ি নিয়ে সিদ্ধ আলু কাটতে কাটতে বললাম,
___” এইতো কাজ করতে এলাম।”
ফুপি হাসলো। গ্যাস অন করতে করতে বললো,
___” ওরে পাকনীবুড়ি রে। তুই আবার কবে থেকে রান্নাঘরে কাজ করতে আসিস শুনি তো।”
আমি গুণগুণ করতে করতে বললাম,

___” ওই করি আরকি অল্প অল্প। এমন ভান করছো যেন কখনোই তোমাকে হেল্প করি না আমি ফুপি।”
___” ধূর। একথা কখন বললাম? তুই তো সবসময়ই আমাকে হেল্প করিস,সব কাজে। সাদি চলে যাওয়ার পর একা ছিলাম। তোর ফুপাও অফিসে থাকতো।মাঝে মাঝে তোকে আমার কাছে নিয়ে আসতাম। যেন দু দন্ড বসে কথা বলতে পারি। কথা বলার মানুষ ছিল না।”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফুপি। আমি হেসে বললাম,

___” এখন তো তোমার ছেলে চলে এসেছে। এখন কি আর আমাকে মনে থাকবে তোমার?”
ফুপি মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
___” মনে না থাকলে কি সাথে করে আনতাম?”
আমি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে হাসলাম। আর বললাম,
___” সেই যে মেডিকেলে এক্সাম দেয়ার ২ মাস আগে এসে তিনদিন থেকেছিলাম।এরপর তুমি দুবার আমাদের বাসায় গিয়েছো ঠিক!কিন্তু আমার আর আসা হয়নি।”

___” হ্যা রে।বেশ একা একা লাগত। ”
___” বাদ দাও তো সেসব কথা।এখন সময়টা আনন্দের।”
ফুপি হেসে বললো,
___” একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো অনু?”
___” হুম..”(আপন মনে)
___” তোর কি মন খারাপ?”
হাতটা থেমে গেলো আমার।ফুপি কি সন্দেহ করলো? আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম,

___” আরে নাহ। ঠিক আছি একদম। ফিট পুরো।”
___” কেন যেন মনে হলো তোর মনটা খারাপ। কেউ কিছু বলেছে? গতকাল থেকে দেখছি।”
___”না না ফুপি। সব ঠিকঠাক।কে কি বলবে?”
___” না মানে, আমার ছেলেটার তো বিশ্বাস নেই।কেন যে তোর পিছনে লাগে শুধু। বুঝতে পারি না।”
আমি ফুপির হাতের উপর হাত রাখলাম। হেসে বললাম,
___” বাদ দাও তো ফুপি। উনি আমাকে কিছু বলেননি। তুমি মন খারাপ করো না।”
ফুপি আমার গালে হাত রেখে বললো,

___” লক্ষ্মী মেয়ে। আচরণ চল ফুপি-ভাতিজিতে মিলে হাতে হাতে -হাতে সিঙারাগুলো বানিয়ে ফেলি।”
আমি মাথা নাড়ালাম। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে পেঁয়াজ কাটতে লাগলাম। অনুভব করলাম, চোখ পানিতে ভরে আসছে। ফুপি গরম তেলে খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললো,
___” অনু, তুই গিয়ে তোর বাবার সাথে টিভি দেখ। বাকিটা আমি করে নিবো।”
আমি নাক টেনে বললাম,
___” আরে তুমি একা পারবা না। আমি সাহায্য করলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।”
ফুপি আর কিছু বলতে যাবে তখনই সাদি ভাই রান্নাঘরে ঢুকে বললেন,
___” কি করা হচ্ছে এখানে?”
আমি চুপচাপ কাজ করছি।ফুপি হেসে বললো,

___” গল্প করা হচ্ছে আব্বু। তুমি যাও। আমরা সিঙারা বানিয়ে আনছি।”
সাদি ভাই শান্ত গলায় বললেন,
___” পানি খেতে এসেছি।”
বলেই আমার পাশে দাড়িয়ে গেলেন। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,
___” মা! ঘরে কি কাজের লোকের অভাব? থাকলে বলো,আরেকটা এনে দি।”
আমি পেয়াজগুলো ফুপির দিকে এগিয়ে দিয়ে প্লেট মুছে চলেছি তখন।ফুপি হালকা হেসে বললো,

___” নাহ। লাগবে না। তোর মা কি বুড়ি হয়ে গেছে নাকি।”
___” ধূর। আমার মা তো ওয়ার্ল্ডের বেস্ট সুন্দরী।”
ফুপি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।আমিও সায় দিলাম।তারপর বললো,
___” হয়েছে যাও। বাবার সাথে বসে কথা বলো।”
___” না মানে মা! বলছিলাম কি, তোমার এমনিতেও কিন্তু কাজের লোকের অভাব নেই। তাহলে আর লাগবে না। যাক!টেনশন মুক্ত।”
ফুপি সিঙারাগুলো তুলতে তুলতে বললো,

___” মানে?”
___” মানে হলো রান্নাঘরে তুমি ছাড়া তো ভালো কাজের লোক আছে দেখছি।”
আমি চোখ বড়বড় করে ফুপির দিকে তাকালাম। ফুপিও মুখ টিপে হাসছে।সাদি ভাই আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবার বললেন,
___” তো পারলে সারাজীবনই রেখে দাও। আর গল্প করার লোকের অভাব হবে না।কাজও হবে ঝটপট। ”
ফুপি হালকা রাগ দেখিয়ে বললো,
___” তবে রে!”
ততক্ষণে সাদি ভাই পগারপার। আমি কাঁদো কাঁদো অবস্থায় ফুপির দিকে চেয়ে বললাম,
___” দেখলে ফুপি!!”

রাত ঠিক ১১ টা। কফি মগ হাতে নিয়ে ছাদে দাড়িয়ে আছি আমি।বাসায় সবাই ঘুম। শুধু ছাদে উঠার সময় দেখেছিলাম সাদি ভাইয়ের রুমের লাইট জ্বলছে।মানে রাক্ষসটা জেগে।সে যাই হোক।উনি ওনার জায়গায়। আমার ভাবনাটা হলো অন্য জায়গায়। অয়ন এখনো অবধি আমাকে একটা কল করলো না। সেই যে কথা হয়েছিল। বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে আমায়।
কেন করছে? ওর আর আমার দিনগুলো তো বেশ ভালোই কাটছিল। কি হয়ে গেলো এরমধ্যে যে ওকে অন্য একজনকে বেছে নিতে হলো? ও তো আমাকে ভালোবাসে।

কথাগুলো ভেবেই চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।ঠিক তখনই থুতনিতে কারোর হাতের স্পর্শ পেলাম। অবাক হয়ে পাে তাকালাম। আমার চোখের এক ফোটা পানি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদি ভাই। মুখে মুচকি হাসি।উনি এক হাতে আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে বললেন,

___” চোখের পানি নষ্ট করিস না ধানিলংকা।”
আমার চোখজোড়া তখনো ছলছল। উনি হেসে বললেন,
___” তোর মনে আমাকে নিয়ে ধারণাটা একটু হাস্যকর। অবশ্য হওয়াটাও স্বাভাবিক। ”
___” আপনার এখানে কি চাই?ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছি তাও সহ্য হচ্ছে না?”
মুহুর্তেই ওনার মুখের রং বদলে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

___” তোর এই বিহেভিয়ারের জন্যই তোর সাথে ভালো ব্যবহার করতে মন চায় না। বেয়াদব।”
___” তো কে করতে বলেছে ভালো ব্যবহার?”
উনি আচমকা আমার থুতনি চেপে ধরে বললেন,
___” কারোর কথায় বলতে আসি না। নিজের মনের কথা শুনেই তোর কাছে আসি।”
আমি চোখমুখ খিঁচে আছি।বেশ ব্যথা লাগছে গালে। কিছু বলতেও পারছি না।শুধু উম উম করছি। উনি চোখমুখ লাল করে বললেন,

___” এত রাতে ছাদে কি?”
আমি কিছু বলতেই পারছি না। নয়তো উত্তরটা দিতাম। উনি আবারো ধমকালেন,
___” বল এতরাতে ছাদে কি তোর! বেশি বার বেড়েছে তাই না মেয়ে?”
আমি ওনার পায়ে পাড়া দিতেই উনি ছিটকে সরে গেলেন। আমি চেঁচিয়ে বললাম,
___” বেশ করেছি এসেছি ্একশবার আসব। কি মনে করেন আপনি নিজেকে?আমার নিজস্ব কোনো ইচ্ছে নেই? কোনো মন নেই আমার? সব শুধু পুরুষজাতিরই রয়েছে? ওহ পুরুষজাতিকে বলে কি লাভ! সবাই তো আর এক নয়। তবুও কিছু কিছু মানুষের নিষ্ঠুরভাবে একজনের মন ভাঙার জন্য কেউ এখন আপনাদের বিশ্বাস করতে পারে না। ”
সাদি ভাই অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার কাঁধে হাত রাখতে চেয়ে বললেন,

___” অনু..”
আমি ওনাকে ছুঁতে দিলাম না। দূরে সরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
___” আমারো একটা মন রয়েছে। কেন খেলা করা হচ্ছে আমার মনটাকে নিয়ে? কোথায় আছি আমি!কি হচ্ছে আমার সাথে কিছু বুঝতে পারছি না আমি। কেন কেন কেন!দুদিন আগেও যে আমার সব ছিল আজ আমি তার কিছুই না নাকি তার আমাকে মনেই নেই? আমি কিছু বুঝতেই পারছি না।সবটা কেমন যেন আবছা। এখানে কে ঠকছে! কে ঠকাচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না আমি। তারমধ্যে আপনি আমার উপর এমন অত্যাচার কেন করছেন? কেন?

___” চেঁচাস না অনু। সবাই জেগে যাবে। আস্তে বল!আমি সব শুনবো।”
বলে সাদি ভাই আবারো আমাকে ধরতে নিলে আমি আরো দূরে সরে এলাম।তারপর চেঁচিয়ে বললাম,
___” ডোন্ট টাচ মি। কিছু শোনার নাই আপনার। নাথিং। জাস্ট লিভ মি এলোন। আই জাস্ট হেইট ইউ।জাস্ট হেইট ইউ।”

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ২

বলেই দৌড়ে রুমে চলে এলাম আমি। দরজাটা লাগিয়ে অজোরে কাঁদতে লাগলাম। সাদি ভাইয়ের আজ উচিত শিক্ষা হয়েছে।এই কাজটা আরো আগে করার দরকার ছিল।কিন্তু ওনার উপর কি শুধু শুধু চেচালাম?আসল রাগটা আমার কার উপর?ভেবেই ফোঁপাতে লাগলাম আমি।নিজেকে অসহায় লাগছে ভীষণ।

রাঙিয়ে দিয়ে যাও পর্ব ৪