কি করিলে বলো পাইব তোমারে গল্পের লিংক || সাবিকুন নাহার নিপা

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১
সাবিকুন নাহার নিপা

ফাইল চেক করার সময় ডেট টা চোখে পড়লো সুহাসের। গতবছর এমন দিনে ওর আর দীপার বিয়ে হয়েছিল। দীপার আসল নাম মনিদীপা। বিয়ের পর সুহাসের পদবী টা ব্যবহার করে মনিদীপা মল্লিক হয়েছে অবশ্য। সুহাস খানিকটা অবাক হলো। ওদের বিবাহিত জীবন টা আর দশ টা স্বাভাবিক দম্পতির মতো নয়। বিয়ে নিয়ে তেমন মিষ্টি, মধুর স্মৃতিও নেই। অথচ বিয়ের ডেট টা মনে আছে! আশ্চর্য তো!

দুপুর অবধি বিষয় টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলো না। ভীষণ রকম রাগ হলো দীপার উপর। দীপা অবশ্য এখন হোস্টেলে থাকে। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ততায় দিন কাটাচ্ছে। পর পর দুটো শুক্রবার বাসায়ও আসে নি। প্রথম শুক্রবার সুহাস কিছু জিজ্ঞেস না করলেও দ্বিতীয় শুক্রবার মা’কে আকারে ইঙ্গিতে দীপার না আসার কথা জিজ্ঞেস করলো। মায়ের থেকেই জানতে পারলো যে পরীক্ষা নিয়ে ব্যপক ব্যস্ততায় সময় কাটাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সুহাস অবশ্য দীপার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। শুধু দীপা না, সংসারের কোনো ব্যাপারেই ওর তেমন আগ্রহ নেই। মাসের চার তারিখে খাম ভর্তি টাকাটা মায়ের হাতে দেয়া আর রাতে খাবার টেবিলে টুকটাক দুই একটা কথা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
দুপুরের দিকে সুহাসের নাম্বারে মায়ের ফোন এলো। মা জানালেন যে দীপা কে ফোনে পাচ্ছেন না। কাল দুপুরে বলেছিল জ্বর জ্বর ভাব। তারপর আর কথা হয় নি। আজ সকাল থেকে ফোন করেও কোনো রেসপন্স পাচ্ছে না। সুহাসের খুব রাগ হলো। না চাইতেও দীপার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হলো।

জানালার ফাঁক গলে চনমনে রোদ টা ঘরে ঢুকেছে। দীপার বিছানা টা ঠিক জানালার পাশে। অন্যান্য সময় হলে এই রোদটুকু সানন্দেই মেনে নিতো। কিন্তু আজ বড্ড বিরক্তি ধরিয়ে দিচ্ছে। বিকেলের এই সময় টাতে কর্কশ গলায় কাকগুলোও ডেকে যাচ্ছে। দীপা হাত দিয়ে চোখ আড়াল করার চেষ্টা করলো। কাল রাত থেকে জ্বর। সকাল থেকে না খাওয়া। দুপুরে একটু চিড়া ভিজিয়ে রেখেছিল। কিন্তু খাওয়ার রুচি হয় নি।
চার সিটের এই রুমে দীপার মতো আরও দুজন থাকে। আর একটা সিট ফাঁকা। সেই সিট টা সকলের হাড়ি, পাতিল, প্লেট রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে বেশীদিন সম্ভব হবে না। এসব জায়গায় খুব বেশী সিট ফাঁকা থাকে না। কেউ না কেউ এসেই যায়।

দীপা ঘড়ি দেখলো। পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। এখন বৈশাখ মাস। দীপার রুমমেট রা এখন কেউ নেই। দুজনই টিউশনিতে গেছে। দীপার অবশ্য সেসবের ঝামেলা নেই। ক্লাস, ক্যাম্পাস আর রুমে আসা এর বাইরে আর কোনো কাজ নেই।
দীপার ঘরের সামনে এসে রিসিপশনের মেয়েটা ডাকলো।
“মনিদীপা রুমে আছ?”
“হ্যাঁ আছি।”

“তোমার ফোন টা অফ কেন? একজন এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।”
দীপা একটু অবাক হলো। কে এসেছে এই অসময়ে! মা কিংবা শাওন আপু হলে তো সোজা রুমেই চলে আসতো। উঠে বসে হাত বাড়িয়ে ওড়না টা নিলো। শুকনো ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো,
“কে এসেছে আমার খোঁজে? ”
“তোমার হাজবেন্ড।”

দীপা এবার আরও অবাক হলো। সুহাস এসেছে এখানে! বাড়ি আবার কোনো অঘটন ঘটলো না তো! দীপা উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়ানোর শক্তি নেই, তবুও চেয়ার ধরে দাঁড়ালো। রিসিপশনের মেয়েটা এগিয়ে এসে দীপাকে ধরে বলল,
“চলো আমি নিয়ে যাই। সিড়ি ভেঙে একা যেতে পারবে না।”
দীপা বাঁধা দিলো না। কিন্তু দু’পা হেটেই বুঝলো যে শরীর টা একদম ই চলছে না। চারদিক ঘুরছে। দীপা চোখ বন্ধ করে ফেলল। আর কিছু মনে নেই।

সিদ্ধেশ্বরী তে শাওনের একটা টিউশনি আছে। মেয়েটা নিউ টেনে পড়ছে। সপ্তাহে চারদিন ও’কে একাউন্টিং পড়াতে হয়। এই একটা টিউশনিই করায় এখন। টাকাটাও অবশ্য ভালোই পায়। বাকী সময় টা নিজের পড়াশোনায় কাজে লাগায়। একটা ভালো চাকরি শুধু ওর দরকার ই না, ভীষণ প্রয়োজন।

শাওন আজ শাড়ি পরে এসেছে। লাল পাড়ের সাদা শাড়িটা ও’কে দীপা দিয়েছিল। শাড়িটায় ও’কে বেশ মানায়ও। আজ সিদ্ধেশ্বরী তে যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে। আজিমপুরে পলাশ ভাইয়ের ওখানে একবার যাবে।
রাস্তায় বেরিয়ে শাওনের মনে হলো মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। ইলিশ মাছ দিয়ে কচুর লতির তরকারি টা বক্স ভরে ঘরেই ফেলে রেখে এসেছে। বাড়িতে ফিরে যাবার উপায় নেই।

মা অসংখ্য প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলবে। যদি জানতে পারে শাওন পলাশের ওখানে যাচ্ছে তাহলে তো আরও খারাপ অবস্থা হবে। শাওন বক্স নেবার চিন্তা বাদ দিলা। মালিবাগ মোড়ে এসে রিকশা খুঁজতে লাগলো। ঠিক এই সময় একটা বড়সড় অঘটন ঘটলো। রাস্তার পাশের পানির উপর দিয়ে একটা প্রাইভেট গাড়ি যাওয়ায় ওর শাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল। ময়লা পানিতে মাখামাখি হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। আজকের দিন টাই আসলে খারাপ। পলাশ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া ওর কপালে নেই।

রিকশা নিয়ে নাখালপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ভীষণ মন খারাপ লাগছে। এই বছর বৈশাখে খুব গরমও পড়েছে। একটু পর পর ই মুখ, কপাল ঘেমে যাচ্ছে। শাওনের ভীষণ মন খারাপ লাগলো। আজ ও কাজল পরেছিল। অন্যান্য সময় সাজলেও কাজল পরে না। আজ পলাশের ওখানে যাবে বলেই কাজল পরেছিল। ইশ! এভাবে একটা দিন খারাপ হবারও কোনো মানে হয়!
বাড়ির গেটে নামতেই মায়ের সঙ্গে দেখা। মা বললেন,

“এই শাওন, দীপার নাকি খুব জ্বর। ”
শাওন কথা বলল না। ঘরে ঢুকে সোজা ওয়াশরুমের দিকে গেল। শাওয়ারে ভিজতে লাগলো চোখ বন্ধ করে। অতি যত্নে পরা কাজলের প্রলেপ টা ধুয়ে যাচ্ছে শাওয়ারের পানিতে। সঙ্গে কয়েক ফোঁটা নোনা জলও আছে। শাওন মনে মনে বলল,
“কেন এরকম হয় পলাশ ভাই। কেন সবসময় তোমার, আমার মাঝে অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয়!”

চুল মুছতে মুছতে বসার ঘরে এলো। মা’কে বলল,
“এক কাপ আগুন গরম চা খাওয়াতে পারবে মা?”
মায়ের কঠিন মুখ। তাকিয়ে আছে শাওনের দিকে। রুক্ষ গলায় বলল,
“পলাশের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলি?”
শাওন হাসলো। মোবাইল দেখতে দেখতে বলল,
“যাই নি মা। দীপার কথা কী যেন বলছিলে?”

“কথা ঘুরাবি না শাওন। তুই আবারও কোন আক্কেলে পলাশের সঙ্গে দেখা করতে যাস? তোর সত্যিই লজ্জা নাই?”
শাওন জবাব দিলো না। ওর মনোযোগ এখন মেসেঞ্জারের মেসেজ বক্সে। একটা মন ভালো করা মেসেজ এসেছে আজ। শাওন উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
“মা আমি যদি তোমাকে একটা সারপ্রাইজ গিফট দেই তাহলে কী তুমি আরেকদিন কচুর লতির আইটেম টা করে দেবে?”
মা তাকিয়ে আছেন রাগী চোখে। শাওন হেসে বলল,

“ধরো, তোমার সেই বান্ধবীকে খুঁজে এনে দিলাম।”
সুরমা বেগমের চোখ চকচক করে উঠলো। উত্তেজিত গলায় বললেন,
“দিলুর খোঁজ পেয়েছিস!”
শাওন কথা বলছে না। ওর চোখ দুটো হাসছে। আনন্দে ঝলমল করা চোখ দুটো দেখে সুরমা বেগম বুঝলেন। বললেন,
“কী করে পেলি? তোর ওই ফেসবুক থেকে? ”

“এটাকে এখন তুমি জাদুর বাক্স বলতে পারো। তোমার সেই দিলশাত চৌধুরী কে সত্যিই আমি খুঁজে পেয়েছি।”
সুরমা বেগমের চোখে আনন্দ ঝলমল করছে। দিলু তার প্রানের বন্ধু ছিলো একসময়। তারপর মাঝখানে কেটে গেল কতগুলো বছর। দুজনের দেখা নেই, খোঁজ নেই। শেষবার যখন চিঠি আদান, প্রদান হয়েছিল তখন শাওনের বয়স পাঁচ বছর।

“মা চা খাওয়াও। চা খেয়েই বেরিয়ে যাব। ”
সুরমা বেগম চা বানাতে গেলেন। শাওন, সুহাস সুরমা বেগমের ছেলেমেয়ে। স্বামী সোবাহান মল্লিক সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন একসময়। এখন টুকটাক ব্যবসা করেন। নাখালপাড়ার এই বাড়িটা বছর দশেক আগে বানিয়েছিলেন। সুরমা বেগমের বাপের বাড়ির সম্পত্তির অংশ টা ভালোই ছিলো। ভাইয়েরা বোনের ভাগ দিতে কার্পণ্য করেন নি। খুশি হোক, বেজার হোক বোনের অংশ টুকু যথাসময়ে বুঝিয়ে দেয়া ছাড়াও নানান দায়িত্ব পালন করেছেন।
শাওন এবার গ্রাজুয়েশন শেষ করলো জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে। মাথায় চাকরির ভুত ঢুকেছে তাই চাকরির জন্য পড়াশোনা করছে।

সুহাস একটা বহুজাতিক সংস্থায় ভালো পোস্টে কর্মরত আছে। দীপার সঙ্গে বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হলেও খানিকটা ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। যে কারনে সম্পর্কটা এখনো বেশ জটিল।

দীপা চোখ খুলে দেখলো ওর পাশে চেয়ারে সুহাস বসে আছে। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়৷ সুহাস নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“জ্বরের ওষুধ নাও নি?”
দীপা অস্ফুটস্বরে বলল,
“হু।”
“কখন নিয়েছিলে?”
দীপা চুপ করে রইলো। প্যারাসিটামল নিয়েছিল কাল রাতে। সকালে বমি হওয়ায় আর ওষুধ খায় নি।
সুহাস গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার ফোন টা অফ কেন? অসুখ বিসুখ বাঁধিয়ে ফোন অফ করে রেখেছ বাড়ির লোকেদের টেনশনে রাখার জন্য?”
দীপা জবাব দিলো না। মুখের ভেতর তেতোভাব লাগছে। গলাটাও শুকনো লাগছে। সুহাস একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। তোমার রুমমেট রা কোথায়? এখন যাবে কিভাবে? ইত্যাদি.. ইত্যাদি..
দীপা জবাব দিচ্ছে হু হা তে। সুহাসের সঙ্গে এমনিতেও ও বাড়তি কথা বলে না। কারণ সুহাসের কথাবার্তার ধরন খুবই কঠিন। এরকম কঠিন গলায় কথা বলতো ওদের স্কুলের ইংরেজি স্যার। সেই স্যার কে দীপার ভীষণ অপছন্দ ছিলো।
দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুহাস বলল,

“পারলে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি গাড়ি ডাকছি। ”
“গাড়িতে যেতে পারব না।”
দীপা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল।
“তাহলে কিভাবে যাবে?”
“গাড়িতে গেলে বমি হতে পারে।”
“এতোটা পথ রিকশায় ই বা যাবে কী করে….
দীপা কিছু বলল না। একবার বলতে চেয়েছিল যে আমি যাব না। কিন্তু সেটা বললেই সুহাসের কঠিন এক ধমক সহ্য করতে হবে। তাই থেমে গেল।

সিড়ি দিয়ে নামার সময় সুহাস দীপার হাত ধরলো। আর ঠিক তখনই দীপার অসহ্য রকম কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। মাঘ মাসের শীতে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় যেমন কাঁপুনি হয় তেমন কাঁপুনি। সুহাস ভালো করে ধরলো। গাড়িতে বসিয়ে বলল,
“আগে হসপিটালে যাব। তোমার ভীষণ জ্বর। এই জ্বর প্যারাসিটামলে কমার মতো জ্বর না।”
দীপা চোখ বন্ধ করে শুনলো। তখনও ও ঠকঠক করে কাঁপছে।

“আমি রিশাব চৌধুরী। দিলশাদ চৌধুরী আমার মা। নাটোরের গ্রুপে আপনিই ফটোটা আপলোড করেছিলেন তাই না?”
“জি। আমি নিহারিকা শাওন। দিলশাদ চৌধুরী সত্যিই আপনার মা?”
“জি।”
“উনি কী আপনাকে রিশু বলে ডাকে?”

রিশাব হেসে ফেলল। ফেসবুকের প্রফাইল ছবিটাতে মেয়েটাকে একটু ভারিক্কি লাগলেও এখন বেশ ছোটই লাগছে। চোখে হালকা কাজলের প্রলেপ। দুই চোখের একটাতে আছে, অন্যটাতে নেই। ঠোঁটের লিপস্টিক টা অবশ্য সতেজ। বেরিয়ে আসার সময় লিপস্টিক টা ঠোঁটে লাগালেও আয়না দেখার সময় পায় নি।
শাওন হাসলো। হাসিটা সুন্দর। সম্ভবত মেয়েটা শব্দ করে হাসে না। শাওন বলল,
“আমার মা আপনাদের নিয়ে অসংখ্য গল্প বলেছেন। ”

“উনি কেমন আছেন?”
“ভালো। আপনি কী আন্টিকে জানিয়েছেন?”
“না। আমি ভেবেছিলাম আপনার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে সোজা বাসায় চলে যাব কিন্তু….
“সরি.. আমি আসলে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।”
রিশাব হেসে বলল,
“ইটস ওকে।”

টুকটাক কথাবার্তার পর ওরা চা খেতে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে রিশাব শাওন কে যে জায়গায় চা খাওয়াতে নিয়ে গেছে সেই জায়গাটা শাওনের ভীষণ পছন্দের। আজ সকালে শাওন ভেবেছিল পলাশ ভাইয়ের সঙ্গে এখানে চা খেতে আসবে।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ২