কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ২

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ২
সাবিকুন নাহার নিপা

শাওনের সঙ্গে রিশাবের কথাবার্তা হয়ে গেল। শুক্র, শনি বাদ দিয়ে যেকোনো দিনে শাওন দের বাড়ি রিশাব মা’কে নিয়ে আসবে। কথাবার্তা শেষ করে দুজন যার যার মতো চলেও গেল। বাড়িতে গিয়ে রিশাব ঘরের কাউকে কিছু বলল না। মা, বাবা, বোন কেউ অবশ্য বাড়িতেও ছিলো না। রেনু খালা নামে ওদের একজন দু:সম্পর্কের আত্মীয় আছে। সবাই মিলে নাকি সেখানে গেছে।

রিশাব বাড়ি ফিরে খানিকক্ষণ টিভি দেখলো। ওদের বাসায় পার্মানেন্ট একজন হেল্পিং হ্যান্ড আছেন নাজমা খালা নামে। সে বাসায় থেকে গেছে রিশাবের জন্য।
রাতের খাবার টা রিশাব একটু তাড়াতাড়িই খায়। আজকে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে ও শাওনকে স্টক করলো। মেয়েটার পোস্ট আর ছবির ক্যাপশন দেখে মনে হলো খানিকটা রুক্ষ স্বভাবের। অথচ সামনাসামনি সেটা একবারও মনে হয় নি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রতিটি কথাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলেছে। এমনকি রিশাব যখন জিজ্ঞেস করেছে শুক্র, শনি বাদ দিয়ে কেন ওদের বাসায় যাবে তখনও উইদাউট এনি হেজিটেশনে বলেছে যে বাবা ওই দুই দিন থাকেন। ওনার সামনে ওরা অতোটা স্বতঃস্ফূর্ত না।
রিশাবের একটু বেশি আনন্দ হচ্ছে। মা কতো খুশি হবে তার পুরোনো বান্ধবী কে খুঁজে পেয়ে। পরিবারের মানুষজন কে খুশি দেখতেও ভালো লাগে।

দীপার ঘুম ভাঙলো মাঝরাতে। মাথার কাছে শাওন বসে আছে। শাওনের হাতে একটা বই। দীপাকে উঠতে দেখে বলল,
“এখন কেমন লাগছে?”
“ভালো। ”
“মাথায় অনেকক্ষন পানি ঢালা হয়েছে। ভালো লাগার কথা। জ্বরটাও একটু কম আছে। কী খাবে?”
“কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না আপু। ”
“না ইচ্ছে করলেও খেতে হবে। ডাক্তার অনেকগুলো ওষুধ দিয়েছে।”
দীপা একটু ভেবে বলল,

“তোমার যা ইচ্ছে হয় আনো। আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
শাওন চলে গেল। ওর পরনে সাদা ছাপার টপ আর ট্রাউজার। চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো। বাসায় দীপার বেশভূষা এমনই থাকে। তবুও দেখতে কী সুন্দর লাগে!
শাওন প্লেটে করে ভাত নিয়ে এলো। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, শুকনো মরিচ ভাজা, ডিম ভাজা। ভাতের উপর একটু ঘি ছড়িয়ে দিয়েছে। সারাদিন রাত অভুক্ত থাকার কারণে হোক, আর ভাতের গন্ধে হোক দীপার খিদে পেয়ে গেল। শাওন জিজ্ঞেস করলো,

“আমি খাইয়ে দেব নাকি নিজে খেতে পারবে?”
দীপা মৃদু হেসে বলল,
“চেষ্টা করলে পারব।”
“থাক চেষ্টা করতে হবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ”
দীপা হাসলো। এই বাড়িতে এই একটা মানুষ কেই ওর আপন মনে হয়। শাওনের সঙ্গে ওর সম্পর্ক আন্তরিকতার হলেও অতো বেশি ঘনিষ্ঠ না। বয়সে দুজন প্রায় সমান ই। তবুও দীপা শাওন কে আপু বলে ডাকে। শাওন অবশ্য ও’কে কখনো ভাবী বলে ডাকে না।
গরম ভাত ডিম ভাজা দিয়ে খেতে খুব একটা খারাপ লাগছে না। জ্বরের কারনে তেতো লাগছে ঠিক ই তবুও মন্দ না। দীপাকে খাইয়ে দেয়ার সময়টাতে সুহাস ঘরে এলো। ঘুম থেকে উঠে এসেছে, মাথার চুল খানিকটা এলোমেলো। শাওন কে বলল,

“ওষুধ গুলো ঠিকঠাক খাওয়াস। ”
“আচ্ছা।”
“রোজ রোজ ডাক্তারের কাছে যেতে পারব না কিন্তু। ফোন অফ করে ওষুধ না খেয়ে ঘরে পড়ে থাকা ব্যাপার গুলো কী আমি বুঝিনা। সব সিমপ্যাথি পাবার জন্য করে।”
দীপা নত মস্তকে কথাগুলো হজম করে নিলো।
দীপা জবাব না দিলেও শাওন বলল,
“তুমি কী এতো রাতে এই কথাগুলো বলার জন্যই উঠে এসেছো?”
সুহাস রুক্ষ গলায় ই বলল,

“এই কথাগুলো তো বলা দরকার তাই না?”
“যদি মনে হয় দরকার, তাহলে মা’কে ঘুম থেকে উঠিয়ে তারপর বলো। কারণ সে তোমাকে পাঠিয়েছে দীপার খোঁজ নিতে। ও তো তোমাকে বলে নি যেতে। ”
সুহাস চুপ থাকলেও রাগে ফুসছে। রাগ টা ঠিকঠাক মতো দেখাতে পারলো না।
যাবার সময় বলে গেল,
“ওষুধ গুলো তুই নিজের হাতে খাইয়ে দিস।”
“আচ্ছা। তুমি যাও। ”

সুহাস চলে গেল। ঘরে গিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লেও ঘুমালো না। দীপাকে নিয়ে আজ সারাদিন ওরও কম ধকল যায় নি। এমন উথাল-পাথাল জ্বর নিয়ে কেউ অমন ঘরে ফোন বন্ধ করে শুয়ে থাকে! ও না গেলে কী হতো! সুহাসের আজ সারাদিন দীপার উপর মেজাজ খারাপ হয়েছে। এতোটা কেয়ারলেস কী করে একটা মানুষ হয়! নিজের যত্নটুকু অন্তত নিবে।
সুহাস আবারও বিছানা ছেড়ে উঠলো। জ্বর টা এখন কত আছে সেটা শাওন কে জিজ্ঞেস করা হয় নি।
সুহাসের গিয়েও লাভ হলো না। শাওন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দরজায় নক করতে সুহাসের বড্ড সংকোচ হচ্ছে। তাই ফিরেই এলো।

দীপা চোখ বন্ধ করে আছে। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা। আজকের দিনের অনেক কিছুই ওর মনে নেই। সুহাস ও’কে হোস্টেল থেকে এনে গাড়িতে বসিয়েছিল। তারপর ও বেশ কয়েকবার বমি করেছে। এরপরের স্মৃতি ভাসা ভাসা। মায়ের উদ্বিগ্ন গলা, শাওনের মাথায় পানি ঢালা সবকিছুই ভাসা ভাসা শুনেছে।
“আজকের ঝাড়ি টা কিন্তু ঠিক ছিলো। ”
শাওনের কথায় দীপা চোখ খুলে তাকালো। শাওন মৃদু হেসে বলল,
“ভাইয়ার গায়ে নাকি বমি করে দিয়েছ!”
দীপা লজ্জা পেল। শাওন আবার বলল,

“তবে আজ একটা দারুন ব্যাপার ঘটেছে। ভাইয়া তোমাকে কোলে করে নিয়ে এসেছে।”
দীপা আবারও লজ্জায় পড়ে গেল। ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসিটুকুও চেপে রাখার চেষ্টা করলো। মৃদুস্বরে বলল,
“লাইট টা খুব চোখে লাগছে আপু। ”
শাওন বাতি বন্ধ করে এলো। মাঝখানে জায়গা রেখে দীপার পাশেই শুয়ে পড়লো। তারপর বলল,
“তুমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলে তাই না? এজন্য বাতি নেভাতে বলেছিলে?”
“আপু ঘুমাও তুমি।”
“আমার ধারণা ভাইয়া আরও দু’বার দরজার সামনে এসেছিল। তোমার খোঁজ নিতে। ”
দীপা পাশ ফিরলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতো সুখ ওর কপালে আছে নাকি! শাওন আপু কী যে বলে!

রিতি রিশাবের একমাত্র বোন। এই বছর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলো। ক্যামেস্ট্রির মতো শক্ত সাবজেক্টে পড়ছে। পড়াশোনায় ভীষণ ভালো। এমনিতে গোছানো স্বভাবের। রিশাব রিতিকে ভীষণ পছন্দ করে। শুধু যে রিশাব পছন্দ করে এমন না, বাবা, মা, ভাইয়া কাজিন গ্রুপ রিতিকে ভীষণ পছন্দ করে। মায়েরা সচরাচর ছেলেমেয়েদের ফুল মার্কস দিতে চান না, কিন্তু রিতির বেলায় মায়ের নিয়ম ভিন্ন।
আজ অফিস থেকে ফেরার পর রিতির কাছে শাওনের সঙ্গে মিটিং এর কথা বলল রিশাব। রিতি রিশাবের মোবাইলে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলল,
“অল্প বয়সে মা’কে দেখতে একটু বোকা বোকা লাগছে তাই না?”

রিশাব হেসে ফেলল। বলল,
“আমার কাছে তো আন্টি মানে মায়ের বান্ধবীকে বেশী ইন্টেরেস্টিং লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে ক্যামেরাম্যান তার ক্রাশ টাইপের কিছু একটা। ”
রিতি হেসে ফেলল। বলল,
“এখন মা’কে কিভাবে ম্যানেজ করতে চাও?”
“এই দায়িত্ব টা তোকে দিলাম। তুই প্লিজ ম্যানেজ করে নিস। আমি ভালো করে গুছিয়ে ব্যাপার টা ম্যানেজ করতে পারব না। ”
“আচ্ছা দেখি।”
ভাই বোনের সিক্রেট মিটিং আর সিক্রেট থাকলো না । দিলশাদ চৌধুরী জেনে গেলেন যে তার ছেলে মেয়েরা তাকে বিশাল এক সারপ্রাইজ দিচ্ছেন।

আজ মঙ্গলবার। বিশেষ কোনো দিবস না। সুহাসের অফিস ছুটি। সকালে ঘুম থেকে উঠলো দশটার খানিক পরে। ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরে এলো পত্রিকার খোঁজে। শাওন বাড়িতে থাকতে শুরু করার পর এই বাড়ি পত্রিকা আসে।
পত্রিকা নিতে এসে দেখলো ডাইনিং টেবিলে দীপা কাজ করছে। কপাল কুঁচকে খানিক্ষন সেদিকে তাকিয়ে রইলো। দুই তিন দিন আগেও এই মেয়ে জ্বরে বেহুশ ছিলো। অথচ এখন এমন ভাবে কাজ করছে যেন কিছুই হয় নি। জ্বর কমলেও দূর্বলতা নিশ্চয়ই যায় নি, তাও কাজ করছে।

সুহাস পত্রিকা হাতেই এগিয়ে গেল ডাইনিং টেবিলের দিকে। দীপা নিবিষ্ট মনে কাজ করছিল। সুহাস বলল,
“তোমার শরীর এখন ঠিক আছে?”
হঠাৎ সুহাসের গলা শুনে দীপা চমকে উঠলো। দীপাকে অমন ভাবে চমকে উঠতে দেখে সুহাসও থতমত খেল। দীপা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
সুহাস গম্ভীর গলায় বলল,

“এরমধ্যে শরীর ঠিক হয়ে গেছে? কাজেও নেমে পড়েছ?”
দীপার মুখ টা ছোট হয়ে গেল। নিশ্চয়ই এখন শুরু হয়ে যাবে কঠিন কথাগুলো।
কিন্তু দীপাকে অবাক করে দিয়ে সুহাস বলল,
“এসব কাজ বাদ দাও। তোমার এখন রেস্ট দরকার। ”

সুহাসের এমন গলা শুনে দীপা আজ খুব অবাক হলো। এতো নরম গলায় কথা বলছে! তাও ওর সঙ্গে!
দুজনের কথোপকথনে ব্যাঘাত ঘটালো শাওন। গরমে ঘেমে নেয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাজির হলো। সকালে উঠে কাওরান বাজার গিয়েছিল বাজার করতে। রুই, চিংড়ি, কাতলা সব ই কিনে এনেছে। কিন্তু ডিমওয়ালা ইলিশ পায় নি বলে মন টা একটু খারাপ।
বাজারের ব্যাগ দেখে সুহাস জিজ্ঞেস করলো,
“বাসায় কেউ আসছে নাকি? এতো এলাহি আয়োজন যে?”
শাওন ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“বিশেষ কেউ আসছে ভাইয়া। তুমি ধারণাও করতে পারবে না।”

সুরমা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাজারের ব্যাগগুলো দেখে তার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। অল্প সময়ের মধ্যে ভালোই বাজার করেছে শাওন। মাঝেমধ্যে নিজের মেয়েকে দেখে সুরমা বেগম ভারী অবাক হন। সব কাজ ই হাসিমুখে করার চেষ্টা করে। পারেনা এমন কাজও আগ বাড়িয়ে করতে যায়। সুহাস টা আবার এমন হয় নি। শেষ পর্যন্ত স্বভাব গিয়ে বাপ, চাচাদের মতোই পেল। বাপ, চাচারা যেমন বউয়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে শিখে নি, সুহাসও তেমন হয়েছে।

“তোমার কেমন বন্ধু উনি মা?”
সুরমা বেগম হেসে বললেন,
“প্রানের বন্ধু।”
সুহাস তীর্যক হেসে বলল,
“সেটা আবার কেমন হয়?”
সুরমা বেগম ছেলের হাসি দেখলেন। তারপর নরম গলায় বললেন,
“যার কাছে প্রানের কথা বলা যায়। সংকোচ, দ্বিধা কিছু থাকে না। যাকগে, তোদের সেই কথা বলে লাভ নেই। এমন কপাল তোদের নেই।”

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ১

সুহাস নিভে গেল। সত্যিই কী তেমন কেউ নেই! নাহ! ছিলো তো একজন! কিন্তু…..
সুহাস অতি সন্ত:র্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শাওনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দীপার জন্য একটা শাড়ি কিনেছে অনলাইন থেকে। সেটা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ি লোক কিভাবে দিন টা ভুলে গেল কে জানে! দিন টা মনে রেখে অল্প করেও দীপার জন্য আয়োজন করতে পারতো।

কি করিলে বলো পাইব তোমারে পর্ব ৩