রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৬

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৬
লেখনীতে: সালসাবিল সারা

–“তাহুরা তোর বোনের সম্পর্কের কথা তুই জানতি?তারা অনেক ধনী।আমাদের ধারার বাহিরে।”
কেমন আফসোসের সুর মুন্সী মিয়ার।সুনেরার পছন্দের ছেলেটা ভালো চরিত্রের,তার কলেজ- ভার্সিটিতে গিয়েও খোঁজ নেয় বাবা।সবদিকে ছেলেটা যথেষ্ট উত্তম।তবে,পারিবারিক দিক দিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নেই মুন্সী।ছেলের পরিবার উচ্চবিত্ত।

নিজেরা ঠিক কতোটা দিয়ে খুশি করতে পারবেন ছেলের পরিবারকে এই নিয়ে যতো দ্বিধা তার।মেয়ের বিয়েতে নিজের সাধ্যমতো খরচ করবে সে,এক টাকাও ধার নেওয়ার নিয়ত নেই।
তাহুরা বাবার প্রশ্নে তাজ্জব বনে। মিথ্যে সে বলতে পারে না।শুরু থেকে না জানলেও বোনের গোপন প্রেমের সম্পর্কে সবটা জানে। তবে,পারিবারিক কোনো সূত্র জানেনি তাহুরা কখনো।আলগোছে সে বাবাকে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–“জানতাম বাবা।”
–“ছেলেটা অনেক বড় ঘরের।তোর মনে হয় না আমাদের সাথে ওরা যায় না!”
মুন্সীর দীর্ঘশ্বাস।
–“এটা জানতাম না বাবা।যেখানে ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে,সেখানে পারিবারিক দূরত্ব দিয়ে কি হবে বাবা?ধরো আমাদের পরিবারের সাথে মিল রেখে তুমি জোর করে আপুকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়েছো,
সেখানে আপুই অসুখী হবে। কাল উনারা আসুক,দেখবে সব ঠিক।”
তাহুরা হাসার চেষ্টায়।

বাবাকে কোনোভাবে রাজি করাটা যেনো বড় কাজ এখন।বাবা মেয়ে দুজনে পুকুরঘাটে বসে।মুন্সী মিয়া মেয়ের কথা মনোযোগ সহকারে শুনে।কথাগুলো আমলে নেওয়ার মতো।ঠিকই,মেয়ের অমতে বিয়ে দিলে সারাজীবন কষ্ট তার মেয়ে পাবে।বাবাকে শত্রু ভাববে।
আকাশের পানে দৃষ্টি দেয় মুন্সী।খুব করে দোয়া করে আল্লাহ্ এর নিকট,কাল সবটা যেনো ঠিক হয়।দুই পরিবারের মাঝে একটা মিল বন্ধন হোক।

–“দেখা যাক, মা।সুনেরা খুশি থাকলে আমি খুশি।”
–“ভেতরে চলো বাবা।রান্নার আয়োজনে কম রাখা যাবে না।মা আর আমি লিস্ট বানাবো।চলো।”
বাবার হাত ধরে উঠে পড়ে তাহুরা।মুন্সীর আঁখিতে জল আসলেও চেপে যায় সে।মেয়ের হাত আকড়ে হাঁটতে শুরু করে।তাহুরাদের সেমি পাকা ঘরটা ব্যাপক পরিপাটি।সেই পরিপাটির উপর আরো কিছু নতুন ফুলদানি, নতুন সোফা কভার,নতুন টেবিল শিট দিয়ে সাজায় শিউলি।

কাল এতসব কাজের মাঝে এই কাজগুলো আগে সামলানো দরকার।
মুন্সী মিয়া খানিক ইতস্তত।এই প্রস্তাবে মত না দিলেও এখন নিজের সবটা উজাড় করতে চায় বড় মেয়ের খুশির জন্যে। বাজারের লিস্টের কথা বলতে গেলেও জড়তায় তার গলা জড়িয়ে আসে। তাহুরা বাবার অবস্থা বুঝে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সে মুখ খুলে। অযথা সোফা কভার ঠিক করার বাহানায় মাকে বলে,

–“মা,বাজারের লিস্ট করবো। কাল রান্না বান্না অনেক।আজ থেকে কিছুটা কাজ এগিয়ে নেওয়া যাক।”
মুন্সী মিয়া মেয়ের পানে চায়।তার সহজ সরল মেয়েটা বড্ড আবেগী।বাবার দ্বিধা বুঝে নিলো কতো সহজে!
শিউলি ঘর মুছতে ব্যস্ত।মেয়ের কথা তার ঠিক মনে হয়।দ্রুত উঠে সে।ডাইনিং রুমের চেয়ারে বসে,
–“খাতা,কলম নিয়ে আয় জলদি।”
–“আনছি।মা তুমি বাবাকে বলো কি কি রান্না করতে চাও কালকের জন্যে।”

তাহুরা হেসে নিজ কামরায় ফিরে। খাতা-কলম খুঁজে নেয়। সুনেরা জুবায়েরের সাথে ফোনে কথা বলছিলো।তাহুরাকে দেখে ফোন কাটে।তাহুরার হাসিখুশি মুখশ্রী সুনেরার আতঙ্ক কাটতে সাহায্য করে।সে সহসা বোনকে প্রশ্ন করে,
–“বাবা মত দিচ্ছে?”
–“না দিয়ে যাবে কই?”

অধর প্রসারিত হয় তাহুরার।টেবিলে পরিপাটি খাতার ভাঁজ হতে খাতা নেয় সে।হাত উঁচিয়ে বোনকে দেখায়,
–“বাজারের লিস্ট করছি।ভাইয়ার পছন্দের খাবার কি?”
–“গরুর কালাভুনা।বেশি পছন্দ ওর।তুই করিস এটা রান্না।তোর হাতেরটা ভালো হয়।”
নিসংকোচ আবেদন বোনের।তাহুরার অন্তরে আনন্দের জোয়ার।যাক অবশেষে পরিবারের সবাই নিজেদের মতামত প্রকাশ করছে।কালকের দিনটা খুব ভালো কাটুক,তাহুরার অন্তঃস্থলের দোয়া।
–“আমি ছাড়া আর কে করবে?করবো আপু।চিন্তা করো না।”

খাতা,কলম বুকে জড়িয়ে তাহুরা আনন্দের সহিত বাবা মায়ের নিকট যায়।তার বাবা-মা বাজার নিয়ে আলোচনা করছে।বাবাও জড়তা ছেড়ে মায়ের সাথে আলাপে মগ্ন।তাহুরা ধীরে এগিয়ে যায় সেইদিকে।খাতা রাখে টেবিলে,
–“আলোচনা শেষ?লিস্ট বলো।লেখি।”
–“আমি লেখছি।তুই গিয়ে গরুর মাংস বের কর ফ্রিজ থেকে।মাংস আছে পর্যাপ্ত।”
শিউলি বলে।
–“যাই তবে।”
হাস্যোজ্বল তাহুরা গলা হতে ওড়না সরায়। বুক,কোমরে ওড়না বাঁধে।ঝুঁকে ফ্রিজ খুলে।মাংসের পোটলায় বরফ জমে।শক্ত পোটলা টেনে হিঁচড়ে বের করে পানিতে ভেজায়। দুচোখে তার স্বপ্ন।বোনকে সুখের রাজ্যের রাণী হতে দেখার স্বপ্ন।

সকালে বেরিয়ে যায় উমাইর।একেবারে পরিপাটি সে।কালো ডোরাকাটা দাগের শুভ্র রঙের শার্টে আবৃত তার সুঠাম তনু। দুপুর দুইটায় তার কলেজের কাজ শেষ হবে।অন্যরা সবাই একটার দিকে তাহুরাদের বাড়িতে পৌঁছাবে জানালে,উমাইর জানায় তার পৌঁছাতে তিনটা কি চারটা বাজবে।রাস্তাঘাটে জ্যামের বিশ্বাস নেই।

ঝরঝরে মেজাজে পুরোটা সময় পার করলেও তার মেজাজ বিগড়ে যায় শেষ ক্লাসে। অযথা কথা বলায় এক ছেলেকে শাসন করে উমাইর।সে ছেলে নিজ পরিবারের দাপট দেখিয়ে বুক ফুলিয়ে তর্ক করে তার সাথে।এটাই ছিলো ছেলেটার ভুল। উমাইর গর্জে উঠে। একদফা চিৎকারে তার সকল রাগের সমাপ্তি হয়নি।ছেলেটার অভিভাবককে আসতে বাধ্য করলো।সেই ছেলের অভিভাবকের সাথে কথা বলে এবং ছেলেটির উচিত বিচার করে শান্ত হয় উমাইর।তারপরও মেজাজের খুঁতখুঁত ভাব কমেনি।

ইন করা অবস্থা হতে শার্টকে সাধারণ অবস্থায় ফেরায়।মোবাইল ফোন অনবরত বাজলে,তখন ধরেনি।
এইবার মোবাইল বেজে উঠলে উমাইর ফোন তুলে।ঝাঁঝালো কণ্ঠে নিবরাসকে বলে উঠে,
–“এতো ফোন দিচ্ছো কেনো?কলেজে আছি জানো না?”
–“তোমার কাজ শেষ হয়নি এখনো?”
নিবরাস প্রশ্ন করে।
–“শেষ।কি হয়েছে?”
উল্টো প্রশ্ন করে উমাইর।

–“আমরা সবাই বাসায়।তোমার অপেক্ষায়।জুবায়ের ভাইয়া তোমাকে ছাড়া যাচ্ছে না।”
নিবরাস ভনিতা ছাড়া উত্তর দেয়।
–“কেনো?ভাইয়া কি ছোট?দুপুরের কথা বলে এখনো যায়নি কেনো?ওরা আমাদের অপেক্ষা করছে না?ভাইয়ের এতো নাটক করতে হয় কেনো?”
উমাইর ব্যাগ হাতে অফিস হতে বেরোয়।
–“এমন চিল্লাচ্ছিস কেনো উমাইর?বাসায় আয় জলদি।”

জুবায়ের বলে।
–“স্পিকারে রেখে তামাশা করছো সবাই?”
রাগান্বিত স্বর উমাইরের।
–“তামাশার কি?এমন করছিস কেনো?”
জুবায়ের বিরক্ত।
–“রাখো ফোন।আসছি।কথা দিয়ে ভনিতা করো।আজব।”
উমাইর ফোন কাটে।গাড়িতে উঠে ঘড়ি দেখে চারটা বাজতে আঠারো মিনিট বাকি।বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আসে।গাড়ি স্টার্ট দেয়।গন্তব্য তার বাড়ি।

মিনিট পনেরো বাদে বাড়ি ফিরলে উমাইর অবাক হয়।সকলের তৈরি কিন্তু যায়নি কেনো? উমাইরের গাড়ি দেখলে সকলে নিজেদের গাড়িতে উঠে যায় দ্রুত।উমাইরের গাড়িতে বসে জুবায়ের,নিবরাস এবং আফিয়া।
আফিয়ার কান্ডে দাঁতে দাঁত চাপে উমাইর।চোখ বুঁজে লম্বা শ্বাস নেয়।সব বিরক্ত আজ একসাথে প্রকাশিত হচ্ছে যেনো।অথচ উমাইর কতোটা উত্তেজিত ছিল আজকের দিনের জন্যে ব্যাপারটা কেবল তার জানা।

চলন্ত গাড়িতে উমাইর মস্তিষ্ক সচল রাখার চেষ্টায়।তার বোকাকে বিরাট সারপ্রাইজ দেওয়ার প্রত্যাশায় মনটা শীতল হয়।আচমকা খেয়াল করে তার ডানদিকে না চাওয়া স্পর্শ।তার পিছের সিটে আফিয়া বসে। উমাইরের বুঝতে দেরি হয়নি।মুহূর্তেই সে চিল্লিয়ে উঠে,
–“আফিয়া,ধাক্কা দিয়ে বের করবো গাড়ি থেকে?বেয়াদব।”
আফিয়া কেঁপে উঠে হুংকারে।তার বুকের উপর বিশাল পাথর চাপা দিয়েছে যেনো।জুবায়ের, নিবরাস অবাক হয়ে চেয়ে।নিবরাস ভ্রু নাচিয়ে বোনকে জিজ্ঞেস করে,

–“কিরে কি হলো?”
–“বেয়াদব হয়েছে ও।আমাদের ভাইবোনের মতো না মেয়েটা। অদ্ভুত বিরক্তিকর।”
উমাইর নাক সিটকে বলে।
অপমানে আফিয়ার আঁখি ভিজে।উমাইর কেনো বুঝে না আফিয়া তাকে ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখতে পারবে না কোনোদিন!কেনো এতো ধমকায় সে?বুকে টেনে নিতে পারে না?
উমাইরের দৃষ্টি জোড়া কঠোর।স্টিয়ারিং শক্ত হাতে ধরা।আফিয়াকে গাড়িতে একদন্ড সহ্য হচ্ছে না তার।মেয়েটাকে গাড়ি হতে ছুঁড়ে ফেলাটা এখন যেনো তার একমাত্র লক্ষ্য! ক্রোধে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে উমাইর।

সকাল হতে নানান কাজে মুখরিত ছিলো তাহুরা।অস্থিরতায় সুনেরা বারবার তাহুরাকে ডেকে হয়রান।তবে স্বস্থি মিলে যখন শুনে জুবায়েরদের আসতে দেরী হবে।সুনেরাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে শুনে তাদের কিছু সংখ্যক আত্মীয় আসে।ইমনদের পরিবারের সবাই এলেও মুন্সী এখনো জানায়নি কাউকে সুনেরাকে দেখতে আসা পরিবার কে বা কারা।মুন্সী নিজের পারিবারিক অবস্থা নিয়ে ছোট হতে চায় না পূর্বেই। বাড়ির সকলে নিশ্চয় এই প্রস্তাব মুন্সীর জন্যে চ্যালেঞ্জ ভাববে।আপাতত তাই চুপ করে রয় সে।

তাহুরা বোনকে তৈরি করে।গোলাপী শাড়িতে সুনেরার উজ্জ্বল ফর্সা ত্বক শোভিত। হালকা প্রসাধনীতে খুব লাগছে মনোরম মেয়েটাকে।
সুনেরা জুবায়ের হতে জানে তাদের আসতে আর মিনিট পাঁচেক বাকি।তাহুরা সেই সুযোগে বাথরুমে ঢুকে।সকালে একবার গোসল সারলেও,ঘরের আত্মীয় সামলিয়ে আবারও ঘামে চুপচুপ সে।তাই ফের গোসলের সিদ্ধান্ত নেয়।
কলাপাতা রঙের সুতির থ্রিপিস নিয়ে গোসলে যায় মেয়েটা।

তাহুরা গোসল শেষে বেরুলে দেখে কক্ষে কেউ নেই।রুমের অবস্থা পরিষ্কার।বাহির হতে শব্দ আসছে প্রচুর।জানালা দিয়ে উঁকি দেয় তাহুরা।উঠান জুড়ে দুইটা গাড়ি দাঁড়িয়ে।একটা গাড়িতে তাহুরার দৃষ্টি আটকে।পরিচিত এই গাড়িটা।কোথায় দেখেছে ঠিক মনে আসছে না।ভাবুক হয় সে। উমাইরের গাড়ি হুবহু দেখতে এমন।মনের উপর জোর দেওয়ার পূর্বে তার মা ঢুকে রুমে হুড়মুড়িয়ে।তাহুরার মাথা হতে ভেজা তাওয়াল খুলে।তাহুরার চুল মুছার ভঙ্গিতে বলে,
–“তোকে ডাকতে আসতে পারিনি।সুনেরাকে দেখতে এসেছে।তোর নানু বললো আগে সুনেরাকে নিয়ে যেতে।এরপর তোকে ডাকতে।”

–“উনারা এসেছেন?এসে আপুকে দেখতে চেয়েছে নাকি!”
–“হ্যাঁ।কথাবার্তা হচ্ছে।নাস্তা পানির আগে তাদের মেয়ে দেখা চায়।বিশেষ করে ছেলের মা।সুনেরাকে নিজের পাশে বসিয়ে আদর যত্ন করছে।আন্তরিক বেশ।”
চুল মোছা শেষ হয় শিউলির।
–“ভালো তো।বাবা কই?খুশি?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।

–“দেখে খুশি মনে হচ্ছে।দেখা যাক কি হয়।চল নাস্তা ঠিক করবি।এরপর ওদের গিয়ে একটা সালাম দিস।”
–“দিবো মা।”
মায়ের কথায় সায় দেয় তাহুরা।
ভেজা চুল আঁচড়িয়ে মাথায় কাপড় টানে তাহুরা।বসার ঘর হতে তাদের কক্ষ স্পষ্ট।তাই দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের পানে ছুটে সে।
দ্রুত ছুটেও লাভ হয়নি।উমাইরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবদ্ধ হয় মেয়েটার সত্তা।কলাপাতা রঙের ওড়নায় আবৃত মেয়েটাতে ঘোর লেগে যায় উমাইরের।লম্বা চুলগুলো ভেজা ছিলো তখনো।উমাইর খেয়াল করে বেশ।দৃষ্টি জোড়া যেনো সারাদিনের তিক্ততায় ফিরে পায় একফালি তৃপ্তি।

টেবিলে নাস্তা সাজায় তাহুরা।তার মামী সাহায্য করে তাকে।এরমাঝে ডাক পড়ে বাড়ির ছোট মেয়ের।তাহুরা লজ্জায় আড়ষ্ট।এইভাবে সে নতুন মানুষদের সামনে যেতে নারাজ।তবে এই পরিবারের সামনে না গেলে আপু কষ্ট পাবে।মনঃক্ষুন্ন হবে বোনের।মাথার কাপড় ঠিক করে তাহুরা ধীরে আসে বসার ঘরে নতজানু হয়ে।দৃষ্টি তার মেঝেতে।ছোট করে সালাম দেয়,

–“আসসালামুয়ালাইকুম।”
–“ওয়ালাইকুম আসসালাম, তাহু।”
নিবরাস হাসিমুখে বলে।মুহূর্তে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ে।
নিবরাসের কণ্ঠে তাহুরা অবাক হয়।দৃষ্টি তুলে তাকায়।নিবরাস,তার পাশে উমাইর বসে।উমাইরের খেয়াল আছে কি নেই বুঝেনি তাহুরা।উমাইর নিজের মোবাইলে মগ্ন। দৃষ্টি ডানে বামে ঘোরালে তার বোন,বাবা,বোনের পাশে বসা ছেলেটা সম্ভবত জুবায়ের।অনেকটা তাদের উমাইর স্যারের মতো চেহারা।কাহিনী কি আয়ত্বে আসছে না তাহুরার।এরা দুইজন ভাই?তার আপু কখনো জুবায়েরের ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু বলেনি।তাহুরা কখনো জানতে চায়নি।আচ্ছা উমাইর কি জানতো সুনেরার কথা বা এতসব কাহিনীর কথা?প্রশ্নে প্রশ্নে ছেয়ে যায় তাহুরার ছোট্ট হৃদয়।
তার ভাবনার মাঝে উমাইরের চেহারার সাথে মিল রাখা এক মহিলা কাছে ডাকে তাহুরাকে,

–“এইদিকে আসো তাহুরা।ভাই সাহেব আপনার দুই মেয়ে কিন্তু একদম ফুলের মতো।আমি কথা ফাইনাল হওয়ার পরে কিন্তু চা পানি খাবো।এর আগে না।বিয়ের তারিখ আমরা অন্যদিন এসে দিবো।”
মুন্সী মিয়া নিঃশব্দে হাসে।অত্র বাড়ির সকলে অমায়িক।আসছে পর্যন্ত সুনেরাকে “মা” ব্যতীত কথা বলছে না।
–“জ্বী মুন্সী সাহেব,আপনাদের উত্তর হ্যাঁ চাই।”

হো হো করে হাসে জয়।মুন্সীদের ব্যবহারে লোকটা তার সকল ব্যবধান ভুলেছে।এমন একটা শান্তির নীড় হতে মেয়ে নিতে পারলে তাদের পরিবারে প্রশান্তি ছড়িয়ে যাবে বিনা স্বার্থে।
তাহুরা মেঘলা বেগমের সম্মুখে গেলে মহিলা হাত টেনে তার পাশে বসায় তাহুরাকে। আড় চোখ জোড়া কেবল উমাইরের পানে যাচ্ছে।লোকটা ভাবলেশহীন।নিজের কাজে ব্যস্ত।
মেঘলা বেগম তাহুরার হাতে হাত রাখলে তাহুরা মিষ্টি হাসে,

–“ভালো আছেন আন্টি?”
–“আলহামদুলিল্লাহ্ মা।তুমি নাকি আমাদের উমাইরের স্টুডেন্ট।কি অপরূপ তুমি,মা শাহ্ আল্লাহ্।আমি চেয়েছিলাম আমার শেষ সন্তান মেয়ে হোক,কিন্তু হলো কি?এইযে আমার আদরের জিদওয়ালা উমাইর।”
বসার ঘরে এক পরশ অট্টহাসির বিচরণ হয়।তাহুরা নিজেও হেসে কুটিকুটি।তার উমাইর স্যারের বড্ড জিদ,এটা পুরো কলেজ জানে।এরই মাঝে ভেসে এলো উমাইরের গম্ভীর কণ্ঠ,

–“মা,ভাইয়ের জন্যে মেয়ে দেখতে এসেছি।আমার জিদের বিবরণ দিচ্ছো কেনো?”
–“সরি সরি বাবা।তো ভাই সাহেব আমরা কথা পাকা করছি তবে।”
মেঘলা বেগম বলে।
–“সুনেরা তুই রাজি?”
মুন্সী উত্তর জানা সত্ত্বেও প্রশ্ন করে মেয়েকে।
সুনেরা উপর নিচ মাথা দোলায়।মেঘলা বেগম সহ সকলে বেজায় খুশি হয়। বাক্স হতে আংটি পড়ায়,চেইন দেয় সুনেরাকে। উমাইরের চাচা কিছু নগদ টাকা দেয় তাদের হবু বউকে।হাসি ঠাট্টা পর্যায় শেষে শিউলি অনুরোধ করে সকলকে,

–“চলুন চলুন,নাস্তা করবেন।আজ কিন্তু ভাত না খাইয়ে ছাড়বো না।”
কি আন্তরিক,কি অমায়িক আহ্বান! জয় বেজায় খুশি।নিজ বোন না থাকায় কখনো এমন আবদারের সম্মুখীন হয়নি।এই যেনো বোনের আবদার।
খুশিতে আত্মহারা জয় জবাব দেয়,
–“খেয়ে যাবো আপা।অবশ্যই খেয়ে যাবো।”
সকলে উঠে ডাইনিংয়ে যায়।মেহমানরা অনায়াসে বসতে পারে।সুনেরাও বসে জুবায়েরের পাশে। জয় মুন্সী মিয়া,ইমনের বাবা এবং তাহুরার নানুকে বসতে জোর করে।
মুন্সী তাহুরাকে নির্দেশ দেয়,

–“মা,ভেতরের রুম থেকে কয়েকটা এক্সট্রা চেয়ার নিয়ে আয়।ইমন সাথে যা তো বাবা।”
ইমন,তাহুরা যেতে নিলে সেদিকে দৃষ্টি মেলে উমাইর।আচানক তার মাঝে পাহাড়সম তিক্ততা জমে।বেহুদা সে নিচু স্বরে নিবরাসকে বলে,
–“তোমার ফ্রেন্ডকে গিয়ে হেল্প করো।বা আমাকে বলো হেল্প করতে যেতে।”
নিবরাস এমন খাবার দাবার সেরে উঠতে নারাজ।তাই সে সহসাই জোরে বলে,
–“উমাইর ভাই,তুমি গিয়ে সাহায্য করো তাহুরাকে।”
সচরাচর উমাইরকে কেউ নির্দেশনা দেয় না।নিবরাসের এমন উক্তিতে ভয়ানক নজরে তাকে ঝলসে ফেলছে তার মা বাবা।

–“উমাইর যা বাবা।”
মেঘলা বেগম বলে।
–“নাহ নাহ,ওরা নিয়ে আসবে।”
শিউলি বললেও উমাইর ততক্ষণে উঠে পড়ে।নিবরাসের মা ভয় পায় অন্তরে।তার ছেলেকে উমাইর খারাপ কিছু না বলে বাড়ি ফিরলে!
ইমন সাহসা দুইটা কাঠের চেয়ার দুই হাতে তুলে বেরোয় রুম হতে। উমাইরকে দেখে থামে ইমন,
–“ভাই,কই যাচ্ছো?”
–“কোথাও না।চেয়ার নিয়ে যাও।”

ইমন সম্মুখে এগোয়। উমাইর দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ালে তাহুরা খুব কষ্টে দুই চেয়ার মেঝেতে ঘষে আনছে।মাথার কাপড়টা কাঁধে।উমাইর লম্বা কদমে তাহুরার দুহাতে বিদ্যমান চেয়ার আলগোছে নেয়।বিড়বিড় করে বলে,
–“ইমন বেয়াক্কেল।”
–“আপনি..আমি নিচ্ছি।”
তাহুরা যেনো হাঁপিয়ে।
তার বাক্য উহ্য করে উমাইর। কাঠকাঠ শব্দে ঝাঁঝিয়ে উঠে,
–“মাথায় কাপড় দিয়ে সামনে আসবে সবার।”
–“জ্বী?”
তাহুরার প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে আসে উমাইরের,
–“মাথামোটা।”
গটগট পায়ে চেয়ার নিয়ে যাচ্ছে উমাইর।ইমন এলেও থামেনি।তবে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে অবলোকন করে দৃশ্য।তাহুরা মাথায় কাপড় জড়িয়ে ইমনকে উপেক্ষা করে তার পিছুপিছু আসছে।মন শান্ত হয় উমাইরের।বরফের ন্যায় শীতলতা অনুভব করছে সে।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হয়। সন্ধ্যার পূর্বে সুনেরা, জুবায়েরকে বাহিরে কথা বলতে পাঠানো হয়।সূর্যের তেজ এখনো বিদ্যমান।সাথে বেরোয় উমাইর,তাহুরা,আফিয়া,ইমন এবং তার ছোট ভাইবোন।
পুকুর পাড়ে ভিড় করে সকলে।সুনেরার হাসিতে মুক্ত ঝরে।সে জানতো না ভালোবাসার পূর্ণতা খুব সহজে পাবে।আল্লাহ্ এর নিকট মেয়েটা বারংবার শুকরিয়া আদায় করছে।তাদেরকে ঘিরে ইমন এবং বাকিরা আড্ডা দিলে তাহুরা ব্যস্ত তার ফুলের গাছে পানি দেওয়ায়,উমাইর আপাতত চারিদিকে দেখছে।তাহুরাদের একা বাড়ি, গাছাছালিতে ভরপুর।বেশ পরিচ্ছন্ন।

পুকুর পাড়ের ঠিক বিপরীতে অনেক ফুলের সমাহার।সবটা তাহুরার প্রিয়।উমাইর গাড়িতে হেলান দেওয়া হলেও দৃষ্টি তার সরলতার প্রেয়সীতে আবদ্ধ।
তাহুরা তার ফুল গাছের পরিচর্যাকালে তার নিকট আসে শায়ন,আয়মা। আয়মা তাকে জিজ্ঞেস করে,
–“আপু,একটা গোলাপ নিবো আমি?”
–“ছোট এখনো। বড় হলে অবশ্যই দিবো।খুব সুন্দর রং হয়।একদম লাল।”
তাহুরার হাসিতে উমাইরের দুনিয়ায় জেগে উঠে সহস্র আলোর মিছিল।
শায়ন হাত দুদিকে নাড়িয়ে জবাব দেয়,
–“ওয়াও।”

উমাইরকে এগোতে দেখে তাহুরা অনেকটা বিচলিত হয়।স্যার এখন তার অন্য আত্মীয় হতে যাচ্ছে।কিভাবে সম্মুখীন হবে সে এই মানুষটার! আড়ষ্ট হচ্ছে তাহুরা।হাত হতে পানির মগ পড়ে যায়।আফিয়া ভাবে উমাইর তাদের নিকট আসছে।উৎসুক ভঙ্গিতে নিজেকে পরিপাটি করলে,মনে আধাঁর নামে তার।উমাইর তাহুরার নিকট স্থির হয়।আফিয়া প্রথমে বিস্ময়মুখে তাকালেও পরে তাদের কথোপকথন শুনে শান্ত হয়।
–“একটা গোলাপের চারা লাগবে।আমারটা শেষ।বাতাসে ভেঙেছে।”
উমাইর সহজে বলে।
উমাইর প্রকৃতি প্রেমী,সাথে তার প্রিয় গাছ এবং ফুল।সেই ভেবে বাকিরা নিজেদের কাজে মন দেয়।উমাইর,তাহুরার কথায় আর ঘাটেনি।
তাহুরা উঠে দাঁড়ায়।দৃষ্টি তার উমাইরের বুকে স্থগিত।উপরে উঠানোর সাহস নেই।কিছুক্ষণ থেমে তাহুরা জবাব দেয়,

–“সেই গাছে ফুল হতো?”
–“হতো।”
ছোট উত্তর উমাইরের।
–“আচ্ছা কিনে দিবো,স্যার।”
কি সাবলীল ভাব তাহুরার।উমাইর হেসে উঠে।দুলে তার সর্বাঙ্গ।তাহুরার উৎসুক মন,উৎসুক নজর,ঘাড় উচুঁ হয় অনেকটা।উমাইরকে দেখে।এই যেনো অন্য উমাইর।অন্য মানুষ।বুকে ধাক্কা লাগে তাহুরার।শীতলতা হানা দেয় অন্তরে।শুভ্র শার্টে আবৃত মানবটা অদ্ভুত সুদর্শন ঠেকলো তাহুরার নিকট। একপল দুইপল কতো পল চেয়ে রইলো তাহুরা,জানে না।
হঠাৎই গম্ভীর হয়ে উমাইরের মুখশ্রী।খুব গম্ভীর গলায় বলে,

–“এটা কলেজ?স্যার কে?”
–“তাহলে..কি বলবো?”
তাহুরা প্রশ্ন করে।
–“তুমি জানো।”
উমাইর দু পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।আয়মা যেনো তাদের সব কথা শুনেছে।সে অকপটে তাহুরাকে বলে,
–“ভাইয়া বলবে।”
–“ভা..ভাই..”
পূর্ণ হয় না তাহুরার বাক্য।এরপূর্বে উমাইর জবাব দেয়,
–“তুমি বোন না আমার।মোটেও না।”
–“তাহলে?”
–“তুমি জানো।”
উমাইর ঘাড় ফিরায়।

তাহুরা অনেকক্ষণ ভাবে।তার ভাবান্তর মুখশ্রী ঠিকই উমাইরের দেওয়া “স্টুপিড রূপসীর” সাথে মিলে যাচ্ছে।দুজনের দৃষ্টি মিললে ভাবুক তাহুরা জবাব দেয়,
–“বুঝছি না তো।”
–“বুঝতে পারলে একটা মেসেজ দিও।যতদিন উত্তর দিবে না,ততদিন চারা নিবো না।যতদিন চারা নিবো না,ততদিন তোমার আপুদের বিয়ে পিছনে যাবে।”
–“আপু চায় বিয়েটা জলদি হোক।”
–“উত্তরটাও জলদি দিও।”
–“আমি তেমন একটা মোবাইল চালায় না।”

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৫

–“ভেরি গুড।কিন্তু,শুধু আমাকে মেসেজ দেয়ার জন্যে চালাবে।নাহলে,ফলাফল ভুগবে।আজ রাতের ভেতর উত্তর দিলে ভালো হয়।”
উমাইর বাড়ির ভেতরে ঢুকে।তাহুরা সেদিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় কেবল।মনে বিশাল ভাবনা।যতটুক আয়ত্বে এসেছে,আপুর দ্রুত বিয়ের জন্যে এই ধূর্ত মানবকে আজ রাতে উত্তর পাঠাতে হবে।

রেখেছি তারে মন পিঞ্জিরায় পর্ব ৭