লীলাবালি গল্পের লিংক || আফনান লারা

লীলাবালি পর্ব ১
আফনান লারা

বাংলা বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল ঠিক নয়টা থেকে।অথচ স্যাররা এখনও আসেননি।ছাত্রছাত্রীরাও ধীরে সুস্থে এক একজন করে আসছে।একজন আরেকজনকে দেখে আনন্দে হট্টগোল লাগিয়ে দিচ্ছে।আগে থেকেই একে অপরকে চেনা তাদের।কারণটা হলো অনলাইনে তারা সবাই একই গ্রুপের সদস্য ছিল।তাই এখন শুধু হাসি মুখে কেমন আছিস বলা বাকি।তোমার নাম কি,বাসা কই এসব আর জিজ্ঞেস করার প্রসঙ্গ এখন আসেনা।সময় করে সকলে তাদের আসন গ্রহণ করলো।ছেলে পঞ্চাশ আর মেয়ে পঞ্চাশজন।অবশ্য আরও আছে।রিলিজ স্লিপের কাজ শেষ হলেই মোট সংখ্যার চার্ট হাতে আসবে।

এতদিন পর ক্লাসটা যেন হইহুল্লড়ে বিধে গেছে।ঠিক দশটার সময়ে তিনজন স্যার আর দুজন ম্যাম আসলেন ক্লাসে।হাসিমুখে এক এক করে তাদের পরিচয় বলে দিলেন।একজন স্যার জানালেন তিনি ট্রেনিং এ যাবেন।তার বদলে গেস্ট স্যার ক্লাস করাবেন আজ থেকে।সেসময়ে তার ফোনে একটা কল আসায় তাকে রুম ছেড়ে চলে যেতে হলো।তার পরপরই সানগ্লাস পরে স্টুডেন্টের মাঝ থেকে এক তরুণী স্যারের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,’শোনো সকলে!!আমি হলাম তোমাদের গেস্ট টিচার।আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনবে।আচ্ছা ওসব পরে বলছি..
আগে শোনো আমার বাসার মরিচের গুড়া শেষ,হলুদ ও শেষ।ওগুলো কিনতে হবে বুঝলে??বাজারের যে অবস্থা।নতুন বাজেট করলো কিনা!!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সবাই হাসতে হাসতে শেষ।যে স্যার মাত্র চলে গেলেন উনি এমন করে কথা বলেন সবসময়।তাকেই কপি করছে মেয়েটা।অফলাইনে ক্লাস হবার আগে তাদের কিছুদিন অনলাইনে ক্লাস হয়েছিল।তাই স্যার ম্যামদের সাথে আগের থেকেই সবার পরিচয় আছে।
মেয়েটা কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আবার শোনো!!আচ্ছা ওসব পরে হবে।আগে শোনো আমার সংসার আর বাচ্চাকাচ্চার কথা’

এবার কেউ হাসলো না।সবার চোখ দরজার দিকে।হাসির কথা তাও কেউ হাসলো না বলে আশ্চর্য হয়ে মেয়েটা কোমড়ে হাত রাখা অবস্থায় সেদিকে তাকালো।একটা ছেলেকে দেখে কোমড় থেকে হাত নিচে ঝুলে গেছে মেয়েটার।ঢোক গিলে এক দৌড়ে সে তার আগের জায়গায় ফিরে গেছে।
ছাই রঙের পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা এগিয়ে এসে স্যার যেখানে দাঁড়ায় সেখানে দাঁড়ালো।সবাইকে সালাম দিয়ে ইশারা করলো বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো তরুণকে।তারা ধরাধরি করে এক বালতি গোলাপ নিয়ে হাজির হয়েছে।আরেকবার বেরিয়ে আরেক বালতি গোলাপ নিয়ে আসলো।

ছেলেটি হেসে দিয়ে বললো,’এই ফুলগুলো আপনাদের জন্য।
আজকে প্রথম ক্লাস তো তাই’
একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের কানে ফিসফিস করে বললো,’ দেখলি!কি হ্যান্ডসাম ছেলেটা তাই না রে?’
-“এটা স্যার?হতেই পারেনা।আমি বিশ্বাস করিনা’
-‘তোকে বিশ্বাস করতে কে বলেছে?এটা আমি মানি নিশ্চয় আমাদের গেস্ট স্যার হবেন।স্টুডেন্টের মতন তো লাগেনা।

আহা আমি তো এখনই ফিদা।দাঁড়া কয়েকটা ছবি তুলি’
করচ করচ করে দু চারকানা ছবি তুলে নিলো মেয়েটা।আর যে তরুণী এতক্ষণ মজা করছিল সে মুখের মাস্ক টেনে চোরের মতন বসে রইলো।মনে মনে দোয়া করছিল যেন এটা স্যার না হয়।স্যার হলে কাঁচা চিবিয়ে খাবে তাকে।আরেক স্যারকে নিয়ে বেয়াদবি করা অন্য স্যার তো ভালো চোখে দেখবেননা নিশ্চয়।
ছেলেটা ঐ ছেলেগুলোকে বলছে সবার হাতে হাতে গোলাপ দিয়ে আসতে।

একটা মেয়ে দুষ্টুমি করে বললো,’স্যার আপনি নিজের হাতে ফুল দিয়ে দিন না আমাদের’
মেয়েটির কথা শুনে ছেলেটি হাসলো।তার সাথের দুজনও হেসে ফেললো।হাসি থামিয়ে ছেলেটি এবার টেবিলে হাত রেখে বললো,’আমি স্যার নই।আপনাদের মতনই স্টুডেন্ট। তবে আমি ফাইনাল ইয়ারের।তার মানে আপনাদের সিনিয়র ভাইয়া।আমার এখানে আসার অন্য কারণ হলো আমি আপনাদের একটা সাবজেক্ট পরাবো আজ থেকে।যতদিন না এনামুল স্যার তার ট্রেনিং শেষ করে ফিরে আসেন।
আমাকে ভাইয়া বলতে পারেন অথবা স্যার।যেটা খুশি।’

সেই দুষ্টু মেয়েটা বললো,’ভাইয়া বলার চেয়ে স্যার বলা হাজারগুণ ভালো।অন্তত কলিজায় লাগবেনা’
ছেলেটা ঠোঁট গুটিয়ে হাসি আটকালো কোনো রকমে।তার সাথের গুলো হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
হালকা করে কাশি দিয়ে ছেলেটা একটা গোলাপ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে টেবিলে রেখে বললো,’তো আমার পরিচয়টা দিয়ে দিই।তারপর আপনাদের সবার পরিচয়টা নিয়ে নেবো।প্রথম দিন আবার কিসের পড়া!!
আমি হলাম অর্ণব হাসান।বাংলা বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।আমাদের পরীক্ষা তো আর এক মাস পরেই।শুধু এই মাসটা আমি আপনাদের পড়াতে পারবো।আমার বাসা আই মিন গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা।আমি এখানে মেসে থাকি।পড়াশুনা ইন্টার থেকে ঢাকাতেই।এবার আপনারা একটা করে গোলাপ নিন আর পরিচয়টা দিয়ে দিন।আমাকে আমার নিজের ক্লাসেও যেতে হবে আজ।

তার আগে এই দুই ভাইয়ার সাথেও পরিচয় হয়ে নিবেন।তারা অবশ্য আমার ক্লাসমেট না।একজন সেকেন্ড ইয়ার,আরেকজন থার্ড ইয়ার।সম্পর্কে বড় ভাইয়া আমরা তিনজন।’
বাকি দুজন দাঁত কেলিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।
অর্ণব যে ফুলটা টেবিলে রেখেছিল সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো সেই দুষ্টু মেয়েটা।
-‘আমি হলাম তপন কুমার।সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি।’
-‘আর আমি হলাম মৃদুল রহিম।আমি আর অর্ণব সেম ইয়ার।সে সবসময় আমাকে জুনিয়র প্রমাণ করতে চায়।তাকে ক্লাস শেষে ধরা দিবো।এখন আপনারা পরিচয় পর্ব শুরু করুন’

অর্ণব হাসতে হাসতে গোলাপের বালতিটা তুলে ধরলো
প্রথম বেঞ্চ শেষ করে দ্বিতীয় বেঞ্চে এসে কিছুক্ষন আগে স্যারকে কপি করা মেয়েটাকে দেখে হাতের বালতিটা নিচে রেখে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।মেয়েটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাস্ক টেনে মুখটা আরও ঢাকার চেষ্টা করছে।
-‘মাস্ক খুলে বলুন।কানে কম শুনি তো।কিছু বুঝিনা’

মেয়েটা বিড়বিড় করে কিসব বলে মাস্ক সরালো।চুলগুলোকে কানের কাছে গুজে দিয়ে আস্তে করে বললো,’আমার নাম জুথিকা মৃন্ময়ী।আদর করে সবাই জুথী ডাকে।ইন্টারে পড়েছি চট্টগ্রামে’
-‘আমরা আদর করে জুথি ডাকবোনা।মৃন্ময়ী ডাকবো আপনাকে।স্যারকে নকল করা বেয়াদবি ছাড়া আর কিছুইনা। এনামুল স্যার যদি দেখতেন মনে কষ্ট পেতেন।জানেন আপনি?স্যারকে সম্মান দেয়না আমাদের আর কতটুকু দেবে হায়রে!!!’

জুথী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।অর্ণব ওর পাশের মেয়েটার সামনে গোলাপ রেখে বললো,’আপনাকে গোলাপ দিচ্ছিনা।এটা আপনার শাস্তি।
-‘(আমি মনে হয় কাঁদি)
অর্ণব অন্য বেঞ্চে যেতে যেতে বললো,’হ্যাঁ আপনি কাঁদেন না।আমিও আপনার কান্না দেখতে যাচ্ছিনা।আপনার গোলাপ আমি একজন পথশিশুকে দিব’
জুথী রাগে আর বসলোইনা। তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে।অর্ণবও আর তাকায়নি।
জুথী বসে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’যেন আমি তার বাপরে নিয়ে এক্টিং করছিলাম।’

-‘তো আপনারা এবার রুটিনটা লিখে নিন।সবাই খাতা কলম বের করুন।
প্রথম ক্লাস এনামুল স্যারের বদলে আমি নেবো,এরপরের ক্লাস রোজিনা ম্যাম আর নেক্সট ক্লাস সজীব স্যারের।
এমন করে বাকি দিনগুলো হবে।’
জুথী খাতায় লিখে রাখলো প্রথম ক্লাস কোনোদিন হবেনা।

-‘আজ ৩টা বছর হয়ে গেছে তোমার ছেলে বাড়ি ফেরেনা।এরকম রাগ করে থাকলে চলে?একবার বলোনা আসতে।তুমি বললে ঠিক আসবে’
-‘বাপ কেন ছেলের কাছে নিচু হবে??তোমার ছেলে পারেনা নিজ থেকে আসতে??বাড়ি সে নিজের ইচ্ছায় ছেড়েছে।আমি তাকে ছাড়তে বলিনি’

-‘ছাড়তে বাধ্য করেছিলে।আমি কিছু জানিনা।এবার ঈদে তুমি ওকে আসতে বলবে’
-‘সাবিনা তুমি ভেবে বলছো তো??আমি কিন্তু তোমার ছেলেকে আসতে বললে সে যদি আসে তবে সেই কথা আবারও উঠাবো যেটার কারণে সে তিনটা বছর আগে বাড়ি ছেড়েছিল’

লীলাবালি পর্ব ২