লীলাবালি পর্ব ৮৭

লীলাবালি পর্ব ৮৭
আফনান লারা

‘আপনি না বলেছিলেন বৃষ্টিতে ভিজবেন।তবে এখানে কেন আবার?’
‘কেউ দেখলে লজ্জায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে থাকতে হবে,বুঝলে।তোমার তো এখনও সেই জ্ঞান হয় নাই’
‘বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা দারুণ ব্যাপার।আমাদের সেই দারুণ ব্যাপার অন্য কেউ দেখলে তাতে ক্ষতি কোথায়?’
‘ঐ যে বললাম সে জ্ঞান তোমার এখনও হয়নি,আমার পরিবার যে নিরামিষ টাইপের,আমার মনে হয়না বারান্দায় এসে দাঁড়াবে বৃষ্টি দেখবে বলে।চলো তবে বৃষ্টিতে ভেজা যাক’

কথাটা বলে সে কুসুমকে টান দিয়ে বাগানের মাঝে নিয়ে আসলো।ওর হাত ছেড়ে আকাশের দিকে চেয়ে বললো,’জীবন তো একটাই,কোনো কিছু বাদ রাখা যাবেনা।সবকিছু করে দেখে নিতে হবে’
বৃষ্টি পড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে অনেক।কুসুম মাথায় হাত দিয়ে হাসতে হাসতে সবুজ ঘাসের উপর বসে পড়ে।অর্ণব ওর দেখাদেখি নিজেও বসলো।আসলেই খুব মনকাড়া একটা মূহুর্ত।কখনও বৃষ্টির সময় ঘাসে বসে দেখা হয়নি।এখন মনে হয় এর চেয়ে সুখকর আর কি হতে পারে।এত ভাল কেন লাগে??

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কুসুম হাসি আটকাতে পারছেনা।শুধু হেসেই চলেছে।অর্ণব ওর হাসি দেখে নিজের হাসিটাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি,সেও খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো আনন্দে।
কুসুম কাদা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে অর্ণবের সারামুখে ডলে দিয়ে এক ছুট লাগিয়েছে।কিন্তু আফসোস! পিছলে কাদা মাটিতে নিজেই ধপাস করে পড়ে গেছে কিছুদূর যেতেই।এদিকে অর্ণব কাদা মাটি এক মুঠোর মতন নিয়ে এগিয়ে এসে ওকে ঝাপটে ধরে লাগিয়ে দিলো তার সারা মুখে, সারা গায়ে।
বৃষ্টির আওয়াজে ওর চিৎকার চেঁচামেচি কেউ শুনতে পায়নি।

‘কেমন লাগে এখন?আমি একটু লাগিয়েছিলাম আর আপনি পুরা সারা শরীরে কাদা মাখিয়ে দিলেন?এটা ঠিক করেননি।’
‘সবাই দেখলে বলবে পড়ে গেছিলে’
‘পড়ে গেলে এমন লেপটে লেপটে কাদা লাগে?সবাই কি বাবু যে কথা বুঝবেনা?’

বাসায় এসে মৃদুল জ্বালাবে বলে জুথি আজ তার এক বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে এসেছে।মণিতার বাসায়।মণিতা ওকে রেখে টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা বাসায়,কিসব রান্না করছে।তার বাসায় তার মা- বাবা আর বড় ভাইয়া থাকে।কিন্তু তারা সবাই যার যার অফিসে এখন।বাসায় মণিতা একা।সারাদিন একা থাকা হয় না,ছোটখাটো একটা জব করে সে।
আজ শুক্রবার বলে অফিস ও বন্ধ।এই সুযোগ জুথি হাত ছাড়া করেনি।শান্তিতে মণিতার বিছানায় বালিশ জড়িয়ে ঘুম দিয়েছে।

কলিংবেল বাজার আওয়াজ পেয়ে মণিতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো মৃদুলকে।
মণিটা আর জুথি দুই বান্ধুবী হলেও পড়েছে আলাদা ভার্সিটিতে, যার কারণে সে মৃদুলকে চেনে নাই।
‘কাকে চাই?’
‘জুথি আপনার বাসায়?’
‘হুম।আপনি কে?ওকে চিনেন কিভাবে?’

‘ওর উড বি হাসবেন্ড আমি।এইবার ভিতরে আসতে বলবেন নাকি বাহিরে থেকে বিয়ের কার্ড কোন কারখানায় ছাপা হয়েছে সেটারও ডিটেইলস জানতে চাইবেন?’
মণিতা লজ্জিত হয়ে ওকে ভেতরে আসতে বললো।মৃদুল সোফায় বসে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বললো,’মহারাণীকে ডাকুন,একটু মুখ দর্শন করি তার’

‘সে তো ঘুমাচ্ছে।আচ্ছা আপনার কথা তো জুথি আমায় বললোনা কখনও,আপনি কে আসলে?’
‘বলবে বলবে।কফি খাওয়াবেন না??নিজের বান্ধুবীর হবু বরকে মানুষ এত প্রশ্ন করে?আচ্ছা আপনি কফি নিয়ে আসুব,আমি আমার বউয়ের ঘুম তাড়াচ্ছি,সে নাহয় পরিচয়টা দেবে’
কথাটা বলে সে সোজা চলে গেলো সামনের রুম গুলোর দিকে।দরজা খোলা ছিল বলে জুথিকে দেখলো রুমে উঁকি মারতেই।সে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমে কাতর।

মিশু ভাবী দরজা খুলে দেখলেন কাদা মাখামাখি করে দুই ভূত এসে দাঁড়িয়েছে দরজার ওপারে।অর্ণবকে দেখে চিনতে পারলেও কুসুমকে চিনতে কষ্ট হলো।সে বেশি মাখো মাখো হয়ে গেছে কাদায়।
হাসতে হাসতে ভাবী সাগর ভাইয়াকে ডাকতে চাইলেন সেসময়ে অর্ণব তাঁকে থামিয়ে বললো যেন না ডাকে।
এরপর দুজনে চুপিচুপি রুমে চলে আসলো।কুসুম মাথার চুল থেকে কাদা হাত দিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে বাথরুমে গেছে।ঢুকে দরজা লাগানোর আগ মূহুর্তে অর্ণবও এক দৌড়ে ওর সাথে বাথরুমে ঢুকে গেলো।

‘আপনি এখানে কেন?’
‘সাগর ভাইয়া আমাকে ডাকতে আসতেছে এদিকে।এই হালে দেখলে এক ঘন্টা ধরে হাসবে’
এদিকে সাগর ভাইয়া ওদের বিছানায় বসে অর্ণবের অপেক্ষা করছেন
কুসুম আর অর্ণব দুজনে চোরের মতন দাঁড়িয়ে আছে ভেতরে।
কুসুম মোড়া একটা টেনে সেটাতে বসে আঁচল বালতির পানিতে ভিজিয়ে মুখ থেকে কাদা তুলছিল।অর্ণব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেখছে সেসব।

সাগর ভাইয়া এইবার মিশু ভাবীকে নিয়ে বাদাম খাচ্ছে আর ওদের নিয়ে কথা বলছে ওখানে বসে বসেই।মানে তারা এখান থেকে যাবেই না বলে ঠিক করেছে।তারা জানেও না এই বাথরুমে সেই দুইজন একসাথে যাদের নিয়ে তারা আলাপ করছে এখন।
অর্ণব গাল ফুলিয়ে ঝর্না ছেড়ে দিলো।কুসুম একটু দূরে গিয়ে বসে হাত থেকে কাদা তুলছে এবার।কি কাদা এগুলো কে জানে।অল্প সময়েই শুকিয়ে গেছে।উঠছেও না।

অর্ণব দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ঝর্ণার পানিতে ভিজছে।কুসুম গাল থেকে কাদা তুলে নিয়ে ওর দিকে ফিরে বললো,’এত যে ভিজছেন আজ আপনার কত জ্বর আসতে পারে সে বিষয়ে জানেন?’
‘জ্বর হবেনা।রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি আমার।তুমি নিজেরটা ভাবো’
কুসুম উঠে বললো,’আমার তো এখন গোসল করতে হবে।আপনি না বের হলে কেমন করে গোসল করবো?কি দরকার ছিল এখানে ঢুকে পড়ার?বারান্দার দিকেও তো গিয়ে লুকাতে পারতেন’

‘বারান্দার দরজা আটকানো ছিল,ওটা খুলতে খুলতে ভাইয়া এসে পড়তো’
ওদিকে রুমে এবার বাবা মায়ের ও কথা শোনা যাচ্ছিল।অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে কুসুমের থেকে মোড়াটা কেড়ে সেটাতে বসে পড়েছে।কুসুম দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে সবাই কি বলে।
অর্ণব বসে বসে মগ দিয়ে পানি নিয়ে মাথায় ঢেলে মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা চালায়।
কুসুম ঝর্নার কাছে এসে ঝর্ণাটাকে আবার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।যেন এক বন্দি জীবন,অথচ কিসের এক ভাললাগা গায়ে এসে হেসে খেলে যায়।

যেন এক সুন্দর মূহুর্ত তাদের সামনে অথচ তারা সেটাকে উপভোগ করার উপায় জানেনা।সত্যি তাই!
অর্ণব ভেজা চুল চিপে চিপে পানি টেনে নিলো মাথা থেকে।তারপর হাঁচি একটা দিয়ে গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ফ্লোরে রেখে বললো,’আমার হাঁচি কি জোরে শোনা গেলো?’
‘নাহ,আমি তো আওয়াজই শুনে ভাবলাম কি যেন বললেন,ওটা হাঁচি ছিল আসলে?’
অর্ণব এবার হাত দিয়ে গায়ের থেকে পানি ঝরানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে।কিন্তু কুসুম তো আর ওর মতন করতে পারবেনা।ঝর্ণা অফ করেছে,তার গোসল ও শেষ কিন্তু ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।তাড়াহুড়োতে শুকনো শাড়ী নেওয়া হয়নি।

বাহিরে থেকে সবার হট্টগোল কমে গেলো মনে হয়।আওয়াজ নেই বললেই চলে।তাই সে লুকিয়ে দরজাটা একটু খুললো।কেউ নেই দেখে বেরিয়েও পড়েছে।অর্ণব ওকে বেরুতে দেখো সেও দরজার কাছে গেলো দেখতে,যদিও এখনও বের হয়নি।

বিছানা থেকে গামছাটা নিয়ে কুসুম পেছনে তাকাতেই দেখলো সবাই একসাথ হয়ে এদিকেই আসতেছে আবার।
আজ ওরা এই রুমটাকে আড্ডাঘর বানিয়ে তুলবে মনে হয়।কুসুম এক ছুটে আবার বাথরুমে ঢুকে পড়েছে,সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের সাথে খেলো জোরেশোরে এক ধাক্কা।

‘আরে কি হলো আবার!বুকে ব্যাথা পেলাম,হাঁড় মনে হয় নড়ে গেছে,এমন করতেসো কেন?’
‘আবার সবাই আসছে দেখেই তো দৌড় দিলাম,আচ্ছা আপনি ও বলিহারি! আমি বের হলাম সাথে সাথে বের হতে পারলেন না?তবে তো আর একসাথে বন্দি হয়ে এখন থাকতে হতো না আবার’

‘আমি তো বের হতেই যাচ্ছিলাম,তুমিই তো ঝড়ের গতিতে আবার ঢুকে পড়লে।সব দোষ এখন আনার?’
কুসুম গাল ফুলিয়ে গামছা গায়ে জড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে কোনো কথা না বলে।অর্ণব নিজের গায়ে ফু দিয়ে পানি শুকানোর চেষ্টা করছে আগের মতন।ওর এই কাজে হাসি পেলো কুসুমের কিন্তু কিছু বললোনা।কিছু বললে দেখা গেলো ওর গায়ের থেকে গামছাটা কেড়ে নিয়ে যাবে সে।

গালের নিচে কারোর নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে জুথি মুচকি হেসে বললো,’মণিতা সুড়সুড়ি কেন দিচ্ছিস?হাত সরা!কাতুকুতু লাগে আমার,’
সুড়সুড়ির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জুথি বাধ্য হয়ে চোখ খুললো।খুলে দেখলো মৃদুল ওর হাত গোল করে চেয়ে আছে।এতক্ষণ হাত দিয়ে ওর গালে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল সে।মৃদুলের হাত নরম এটা জুথি জানতোনা,ছেলেদের হাত শক্ত হয় এটা সে জানে,কিন্তু কিছু কিছু ছেলের হাত যে এতটা নরম হয় এটা সে জানতোনা বলেই গুলিয়ে ফেলেছিল।হন্তদন্ত হয়ে পিছিয়ে যাওয়া ধরতেই খাটের স্ট্যান্ডের সঙ্গে ধুরুম করে বাড়ি খেয়ে তার ঘুমের রেশ একেবারে কেটে গেলো।বলতে গেলে বাপ বাপ করে পালালো।

লীলাবালি পর্ব ৮৬

‘আরে আরে এত ভয় পাও কেন,আমি মৃদুল,তোমার হাসবেন্ড!?’
‘আপনি এখানে কি করে!’
‘তোমার ভাই ফরহাদকে ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিয়েছি,বাজারে দেখা হয়েছিল।ওই তো আমাকে মণিতার চৌদ্দ গুষ্টির ঠিকানা দিয়ে দিলো।হেহে!যেখানেই লুকিয়ে থাকবেনা কেন,আমি তোমার আশেপাশে রয়ে যাবো সারাটাজীবন ‘
‘সরুন সামনে থেকে’
‘উহু!আজ আমি এখানেই থাকবো।যতক্ষণ না তুমি বেরুবে ততক্ষণ, এরপর বাসা থেকে বের হলে তুমি যেখানেই যাবে আমিও সেখানে যাব’

লীলাবালি পর্ব ৮৮