অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১৮

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১৮
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

‘এটা তোমার দক্ষিণ দিক মনে হল?’ দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ সংবরন করে বলল রুদ্র। প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে আরেকবার তাকাল চারপাশে। পাঁচ ফুট চওড়া কাঁচা রাস্তাটা বহুদূর গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। পেছনে জঙ্গল, সামনে খাল। কয়েকটা পাখির আর পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। উজ্জ্বল চন্দ্রিমার আলোটুকুর কারণেই চারপাশটা চলনসই দেখা যাচ্ছে। এর আশেপাশেও যে কোথাও হাইওয়ে নেই সেটা না বোঝার কোন কারণ নেই। প্রিয়তা কম্পমান কন্ঠে বলল, ‘আ-আমার মনে হয়েছিল এট-এটাই দ-দক্ষিণ দিক। আমি বুঝতে পারিনি।’

শেষের শব্দদুটো মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল। রুদ্রর এখন ইচ্ছে করছে প্রিয়তাকে ঠাটিয়ে আরও দুটো থাপ্পড় মারতে। এতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কেউ এমন ভুল বলতে পারে সেটা এই মেয়েকে না দেখলে ওর জানাই হতোনা। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু এই মেয়েকে কিছু বলেও এখন আর লাভ নেই। তার ওপর হাতের দিকটা কেমন অবশ হয়ে আসছে, মাথা ঝিম ধরেছে। কিন্তু তাকিয়ে দেখতেও ইচ্ছে হচ্ছেনা। শরীর দুর্বল লাগছে। সেই দুটোর দিকে এক পিছ স্যান্ডউইচ আর কফি খেয়েছিল তাজওয়ারের বাড়িতে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এরপর পেটে একফোঁটা পানিও পড়েনি। জঙ্গলের এতোটা পথ পেরিয়ে আসতে কিছুটা হলেও বেগ পেতে হয়েছে ওকে। রুদ্র ঝাড়ি দিয়ে ছেড়ে দিলো প্রিয়তার বাহু। কোমরে হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবছে এখন কী করা যায়? প্রিয়তা মুখ কাঁচুমাচু করে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সামনে যেভাবে পরপর কতগুলো খু’ন করল, রাগের মাথায় যেকোন মুহূর্তে ওকেও ওপরে পাঠিয়ে দিতেই পারে। কোন গ্যারান্টি নেই। কিন্তু প্রিয়তা চুপ থাকতেও পারছেনা। লোকটা এরপরে কী করতে চাইছে সেটাও জানা প্রয়োজন। তাই মনে একরাশ ভয় নিয়ে হলেও বলল, ‘এখন কী করবেন?’

‘ ভাবছি।’ রাস্তা দেখতে দেখতে স্বাভাবিকভাবেই বলল রুদ্র।
‘ কী ভাবছেন?’
রুদ্র ভাবা থামাল। কিন্তু প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘তোমাকে মে’রে লা’শটা কোথায় গুম করা যায় সেটাই ভাবছি।’

চমকে উঠল প্রিয়তা। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে একবার চোখ বুলালো রুদ্রর হাতে থাকা পি’স্তলের দিকে। তখনই চোখে পড়ল রুদ্রর বা হাতের বাহু দিয়ে র’ক্ত বের হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। একহাতে বাঁধার ফলে ঠিকভাবে বাঁধা যায়নি। ঐসময় প্রিয়তার সামনেই বেঁধেছিল নিজের হাত। কিন্তু চোখের সামনে এতোগুলো খু’ন দেখে ও জমে গিয়েছিল। এসব নিয়ে ভাবার অবস্থা ছিলোনা ওর। এখন ঢিলে হয়ে গেছে রুমালটা। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে সেই র’ক্ত। মুহূর্তেই প্রিয়তা ভুলে গেল কিছুক্ষণ আগে দেওয়া রুদ্রর প্রাণনাশের হুমকির কথা। সব ভয় যেন মুহূর্তেই কেটে গেল। দ্রুতপায়ে মেয়েটা এগিয়ে গেল রুদ্রর কাছে। ওর হাত ধরে ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনার হাত থেকে কতো র’ক্ত বের হচ্ছে। ঢিলে হয়ে গেছে বাঁধনটা। আপনি এটা নিয়ে এতক্ষণ হাঁটছিলেন?’

রুদ্র এতক্ষণ পরে তাকাল নিজের হাতের ক্ষতটার দিকে। সত্যিই অনেকটা র’ক্ত বের হচ্ছে। এইজন্যই এমন অবশ অবশ হয়ে আসছে তাহলে? কিন্তু প্রিয়তার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মুখে বলল, ‘এটুকুতে আমার কিছু হয়না।’
প্রিয়তার বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘ বললেই হলো?’

কথাটা বলে প্রিয়তা কিছুক্ষণ চারপাশে তাকাল। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা চোখে পড়তেই প্রায় দৌড়ে গেল সেদিকে। কিছু দুর্বাঘাস তুলে নিয়ে আবারও একইভাবে ছুটে এসে হাঁফানো কন্ঠে বলল, ‘আপাতত এটা ছাড়া আর কোন বিশেষ পাতা নেই আশেপাশে। এতেই চলবে।’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে একবার প্রিয়তার দিকে তাকাল একবার দুর্বা ঘাসের দিকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘এসবের দরকার নেই। আমি ডক্টর দেখিয়ে নেব।’

‘ সে যখন দেখাবেন, দেখাবেন। এখন র’ক্ত বন্ধ করা ইম্পর্ট্যান্ট।’
কথাটা বলতে বলতেই রুদ্রর হাত ধরে টেনে নিয়ে একটা গাছের মোটা উঁচু শেকড়ের ওপর বসিয়ে দিল। নিজেও বসল রুদ্রর বাঁ পাশে। রুদ্র বোকা চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আস্তে করে খুলে ফেলল রুদ্রর হাতে বাঁধা রুমালটা। কালচে র’ক্তে চুবচুবে হয়ে গেছে প্রায়। র’ক্ত দেখেই কেমন গা গুলিয়ে এলো প্রিয়তার।
চোখ-মুখ বিকৃত করে দু আঙুলে ধরে একপাশে রাখল রুমালটা। এরপর দুর্বাঘাসগুলো দুই হাতে পিষে নিল। তারপরে রুদ্রর হাতে ক্ষতের দিকে করুণ চোখে তাকাল একবার। রুদ্র একদৃষ্টিতে দেখছে প্রিয়তার কার্যকলাপ। ওকে দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ও এসব র’ক্ত কা’টা’কা’টি দেখে অভ্যস্ত নয়। খুব সহজ-সরল মেয়ে। প্রিয়তা খুব সাবধানে পেষা দুর্বা লাগিয়ে দিচ্ছে রুদ্রর বাহুর ক্ষতে। কিছুক্ষণ পরপর আঁতকে উঠছে কেমন যেন। মনে হচ্ছে ব্যথাটা ওরই লাগছে।

সেটা বুঝতে পেরে রুদ্রর হাসি পেল সামান্য। তবে হাসল না। প্রিয়তা রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখল। রুদ্রর মুখ একদম স্বাভাবিক। যেন কিছুই হচ্ছেনা। প্রিয়তা অসহায় কন্ঠে ক্ষতে দুর্বা চেপে ধরে রেখে বলল, ‘এই, আপনার ব্যথা লাগছে না? ইশ! এতোটা আঘাত পেলে আর এতো র’ক্ত বেরিয়ে গেলে আমিতো এতক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। আর আপনি? এই অবস্থায় এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?’

‘ এইজন্যই আমি তুমি নই।’ নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দিল রুদ্র। কিন্তু দুর্বার রস পড়ার সাথেসাথেই আরও ভয়ানকভাবে জ্বলে উঠেছে জায়গাটা। অসহনীয় যন্ত্রণা। কিন্তু ওর চেহারায় কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলোনা। গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। প্রিয়তা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর মুখের দিকে। লোকটার মনের সাথে সাথে শরীরও পাষাণ না-কি? অসহ্য ব্যথা হওয়ার কথা হাতে। সহ্য করছে কীকরে?

র’ক্ত বন্ধ হওয়ার পর হল আরেক ঝামেলা। জায়গাটা বাঁধা দরকার। কিন্তু ঐ রুমালটা দিয়ে আবার বাঁধা ঠিক হবেনা। একটু ভাবার পরেই নিজের কুর্তিটার দিকে তাকাল। বেশ লম্বাই কুর্তিটা। কাজ হবে। প্রিয়তা রুদ্রকে হালকা ঠেলে বলল, ‘শুনছেন?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে চোখ খুলে বিরক্তি নিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা ওর কুর্তির নিচের অংশটা রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি একপাশ টেনে ধরছি। আপনি একটু ছিঁড়ে দেবেন? আপনার তো অনেক শক্তি।’
রুদ্রর বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল প্রিয়তা কেন কথাটা বলছে। বুঝতে পেরে বলল, ‘এসবের দরকার নেই।’
‘আপনি চাইছেন জায়গাটা ইনফেকশন হয়ে যাক?’

রুদ্র ভাবল, সত্যিই বেঁধে নেওয়াটা জরুরী। আজ রাতে হাইওয়ে পৌঁছানোর কোন সম্ভাবনা নেই। তাই আর বেশি কথা না বাড়িয়ে প্রিয়তার কুর্তির নিচের অংশটা ছিঁড়ে ফেলল। কাপড়ের টুকরোটা প্রিয়তার হাতে দিয়ে আবার একই ভঙ্গিতে গাছে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। প্রিয়তা ভালোভাবে বেঁধে দিল রুদ্রর হাতটা। রুদ্র চোখ বন্ধ করে আছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন, খুব ক্লান্ত এখন ও। প্রিয়তাও চুপচাপ বসে রইল রুদ্রর পাশে।

হয়তো বুঝতে পেরেছে রুদ্রর অবস্থাটা। তবে ওর করা সেবাটুকুর জন্যে একটা ধন্যবাদও দিলোনা! লোকটা দেখছি ম্যানারলেসও। তারপর এতোকিছুর পরেও হাতে পি’স্ত’লটা ঠিকই আছে আর তর্জনী আঙুলটা ট্রিগারের ওপর। অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব! একা একাই কথাগুলো চিন্তা করতে করতে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল প্রিয়তা। প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছেহ প্রিয়তা রুদ্রর জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে কিছুটা উষ্ণতা পেলেও রুদ্রর গায়ে শুধুই একটা টিশার্ট আছে। ভীষণ শীত করছে ওর। পানি তেষ্টার সাথে সিগারেটের তেষ্টাও পেয়েছে। কিন্তু দুটোর কোনটাই এখানে পাবেনা। রুদ্র চোখ বন্ধ রেখেই বলল, ‘কী নাম যেন বলছিলে তোমার? প্রিয়?’

‘প্রিয় নয় প্রিয়তা। তবে মা আমাকে প্রিয় বলেই ডাকতো।’ অনেকটা আনন্দিত কন্ঠে বলে উঠল প্রিয়তা।
‘এখন ডাকেনা?’
‘উনি বেঁচে নেই।’
‘তোমার বাবা?’
কিছুক্ষণ চুপ রইল প্রিয়তা। এরপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি অনাথ।’
এবার চোখ খুলল রুদ্র। ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল প্রিয়তার দিকে। কয়েকসেকেন্ড চুপ থেকে বলল, ‘তোমাকে ঐ ছেলেগুলো কোথায় পেলো?’

‘একটা জব ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছিলাম। গাড়ি পাচ্ছিলাম না। হঠাৎই কোথা থেকে এসে_’
থেমে গেল প্রিয়তা। বাক্যটা সম্পূর্ণ করার মতো শব্দ খুঁজে পেলোনা হয়তো। রুদ্র আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। আর কিছু জানার ইচ্ছে নেই। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুটা ইতস্তত করে প্রিয়তা বলল, ‘আপনার নাম কী?’
‘রুদ্র। রুদ্র আমের।’

প্রিয়তাও আর কিছু বলল না। আবার নিরবতা চলল। প্রায় পাঁচ মিনিট পর রুদ্র ভাবল এখন এগোতে হবে। এখানে থাকাটা আর ঠিক হবেনা। কথাটা ভেবেই চট করে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ এভাবে উঠে দাঁড়ানোতে চমকে উঠল প্রিয়তা। ওকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে রুদ্র ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘একটা কথাও বলবে না। চুপচাপ চলো।’
বলে প্রিয়তার হাত ধরে পূর্ব দিকে এগোতে শুরু করলো। প্রিয়তা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে রুদ্রকে। কিছুক্ষণ আগেও তো ও সাথে আছে না-কি নেই সেটা নিয়ে রুদ্রর কোন মাথাব্যথাই ছিলোনা। কিন্তু এখন হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে? এটা কী কৃতজ্ঞতা?

কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে অবশেষে লোকালয় দেখতে পেল রুদ্র। ক্ষেতের ওপাশে ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে খেতের মাঝে একশত মিটার দূরে একটা অর্ধেক হওয়া পাকা বাড়ি। রুদ্র দাঁড়িয়ে রইল ওখানে কিছুক্ষণ। প্রিয়তার হাত এখনো ছাড়েনি সে। কয়েক সেকেন্ড দ্রুত চিন্তা করে রুদ্র প্রিয়তার হাত ছেড়ে লাফিয়ে নামল ক্ষেতে। এরপর প্রিয়তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘নামো।’
প্রিয়তা বুঝতে পারছেনা রুদ্র কী করতে চাইছে। কিন্তু রুদ্রর কথামতোই ওর হাত ধরে ক্ষেতে নেমে গেল । এছাড়া এখন অন্যকোন উপায়ও নেই এখন আর।

সম্পূর্ণ ফাঁকা রুমটা চারপাশে দেয়াল থাকলেও নিচে বালি। বাড়িটা অর্ধেক তৈরী করে কাজ আপাতত স্হগিত করা হয়েছে সম্ভবত। পাশের রুমটায় শুকনো খড় আর ভাঙা গাছের ডাল ভর্তি করে রাখা আছে। রুদ্র ডালগুলোর সাহায্যে লাইটার দিয়ে বেশ কষ্টে আগুন জ্বালিয়েছে। লাইটারটা পি’স্ত’লের সাথেই নিয়ে এসছিল। মাঘের শীতে ওদের দুজনের অবস্থাই শোচনীয়। গরম পোষাকও নেই।

এই উষ্ণতাটুকুতে যা হয়। দুজনেরই ক্ষিদে পেয়েছে কিন্তু খাবার পাবে কোথায়। বাইরে একটা টিউবওয়েল ছিল। সেখান থেকে পানি খেয়ে নিয়েছে দুজন। এখন খড়গুলো এনে এনে বালির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে চলনসই শোয়ার জায়গা করে নিল রুদ্র। আজ রাতে ওদের এখানেই থাকতে হবে। এরকম পথ দিয়ে আজ রাতে আর হাইওয়ে পৌঁছনো সম্ভব না। কাল সকালে দেখা যাবে। প্রিয়তা মুখটা ছোট করে নিচে বিছিয়ে রাখা খড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের এভাবে ঘুমোতে হবে?’

রুদ্র প্রিয়তার দিকে তাকাচ্ছেনা। আগুনের হলদে আলোয় অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। বিশেষ করে চোখদুটো। না চাইতেই টানা কালো গভীর চোখদুটোতে বারবার আটকা পড়ছে রুদ্র। থমকে যাচ্ছে সবকিছু। রুদ্র চাইছেনা থমকাতে। রুদ্র চির প্রবাহমান, সে স্হির হতে চায় না। তাই প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘এরচেয়ে ভালো কোন শোবার জায়গা আছে তোমার চেনা?’

প্রিয়তা জবাব দিলো না। সত্যিই এখন এরচেয়ে ভালো শোবার জায়গা আর কোথায় পাবে? রুদ্র গিয়ে খড়ের ওপর বসে পড়ল। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লিসেন, এতক্ষণ বকবক করে আমার মাথা খেয়েছো। এখন আর একটাও কথা বলবে না। আমি ক্লান্ত, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। তারওপর হাতটাও ব্যথা করছে। সুতরাং কোনরকম ডিসটার্ব করবেনা। নিজেও ঘুমাও, আমাকেও ঘুমাতে দাও।’

বলতে বলতে খড়ের ওপর গা এলিয়ে দিয়েছে রুদ্র। প্রিয়তা গাল ফুলিয়ে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। খু’নি লোকটা ওর জন্যে শোবার আলাদা জায়গাটাও বানায়নি। নির্দয়! ওকে নিজেকেই এখন বানিয়ে নিতে হবে। প্রিয়তা খড় আনতে যেতে নিলেই রুদ্র বলে উঠল, ‘যাচ্ছো কোথায়?’
প্রিয়তা এবার বিরক্ত হল। নিজের শোবার জায়গা করে আরামে শুয়ে পড়েছে। সাথে একটা মেয়ে আছে সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। এখন জিজ্ঞেস করছে, কোথায় যাচ্ছো? প্রিয়তা কপাল কুঁচকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘শোবার জায়গা করতে।’

কিন্তু রুদ্র এবার সেটাই বলল যেটা শোনার জন্যে প্রিয়তা মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। রুদ্র অতি স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘তুমি আমার পাশেই শোবে। এসো!’
চোখদুটো বিষ্ফোরিত হয়ে গেল প্রিয়তার। কী বলছে লোকটা? পাগল-টাগল হয়ে গেছে না-কি? নিশ্চয়ই বেশি রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার ফল। কিন্তু রক্তশূন্যতায় মানুষ পাগল হয়? ব্যপারটা নিশ্চিত হতে ও হতভম্ব হয়ে বলল, ‘কী?’

‘আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ো। আমার কোলবালিশ ছাড়া ঘুম হয়না। তোমাকে দিয়ে আজ কোলবালিশের কাজ চালাব।’
প্রিয়তার হাত-পা এবার জমে যেতে শুরু করল। লোকটা খু’নি, পাষাণ, নির্দয় হওয়ার সাথেসাথে চরিত্রহীনও না-কি? প্রিয়তা একটা ঢোক গিলে আটকে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘আ-আমি করে নেব শোবার জায়গা।’
রুদ্র কঠোর স্বরে বলল, ‘তুমি নিজে আসবে না-কি আমি উঠে আসব?’

প্রিয়তা উত্তর না দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝে উঠতেঘ পারছেনা। এ কোন স’ন্ত্রা’সীর পাল্লায় এসে পড়ল? আর কিছু ভাবার আগেই রুদ্র বলে উঠল, ‘কী হল? আমি উঠলে কিন্তু ব্যপারটা আরও বেশি খারাপ হবে। যে খু’ন করতে পারে সে কিন্তু সব করতে পারে।’

ভয়ে কেঁপে উঠল প্রিয়তা। রুদ্রর কথাগুলোকে কিছুতেই ফাঁকা আওয়াজ ভেবে উড়িয়ে দিতে পারল না ও। কোন উপায় না পেয়ে গুটিগুটি পায়ে রুদ্রর পাশে গিয়ে বসল আস্তে করে। রুদ্র ডান হাত কপালের ওপর দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এক মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরেও শুতে পারল না প্রিয়তা। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। কী চাইছে কী রুদ্র? কেন এমন করছে ওর সাথে? ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বসে আছে চুপচাপ। হঠাৎই রুদ্র প্রিয়তার হাত ধরে টেনে নিজের হাতের ওপর শুইয়ে দিল। প্রিয়তা কিছু বলতে নিলেই রুদ্র একহাতে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘চুপ, ঘুমিয়ে পড় চুপচাপ। একটা আওয়াজ করলে কিন্তু খারাপ কিছু হয়ে যাবে।’

প্রিয়তা শক্ত হয়ে গেল একদম। আগুন নিভু নিভু করছে। উষ্ণতা কমছে। ঘর অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আরও অন্ধকার গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যাবে চারপাশ। মাঘের কনকনে শীত, তারওপর রুদ্রর এমন অদ্ভুত কাজে থরথর করে কাঁপছে প্রিয়তা। প্রিয়তার কাঁপুনি অনুভব করতে পারল রুদ্র। তাই একহাতে পাশে খুলে রাখা রুদ্রর সেই জ্যাকেটটা নিয়ে প্রিয়তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল রুদ্র।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১৭

প্রিয়তা চোখ খিঁচে বন্ধ করে শুয়ে আছে। সে এখন কিছু জানেনা, বোঝেনা। বুঝতে চায়না। ঘুম চলে আসুক, তাড়াতাড়ি চলে আসুক। এই অস্বস্তির অবসান হোক। রুদ্রও এবার নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে ফেলল ঘুমানোর উদ্দেশ্য। শান্তির একটা ঘুম প্রয়োজন এখন। রুদ্রর এই অদ্ভুত আচরণের কারণ প্রিয়তা বুঝতে না পারলেও রুদ্র জানে ও যা করছে তা কেন করছে। বড্ড বেশি নাটকীয় সব ঘটনা ঘটে গেল আজ রাতে। কিন্তু কাল সকালে যে আরেক নতুন নাটকীয়তা ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে সেটা কী কেউ জানতো?

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১৯

1 COMMENT

Comments are closed.