শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি পর্ব ৯

শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি পর্ব ৯
রোকসানা আক্তার

আজ তিনদিন কেঁটে গেল,শাশুড়ী মা কারো সাথেই কথা বলছেন না।আমার সাথে কথা বলেন না তা আগ থেকেই,কিন্তু খালা শাশুড়ীর বাড়ি থেকে আসার পর থেকে আকাশের সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন।একমই বন্ধ করে দিয়েছেন।কথাই বলেন না কোনো।আকাশ কিছু বলতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।সুবর্ণার সাথে কথা বলেন তবে।সন্ধের দিকে আমি চা বসিয়ে দিলাম চুলোয়।এমন সময় সুবর্ণা ঢু মারলো রান্নাঘরে এসে।তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললাম,

“কিছু বলবে?”
সুবর্ণার চোখমুখে কৌতূহলীকর।কিছু বলবে আমাকে।আর তা এখনই।বললো,
“ভাবী?একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলবো।শুনলে হাসবে।”
“বল?”
“ভাবী মা যে কেনো উনার বোনের বাড়ি থেকে চলে এসেছে তার কারণ জানো?”
“নাহ।”
“আরেহ শুনো শুনো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এ বলে সুবর্ণা মুখ টিপে হাসতে হাসতে আরো আমার কাছে আসে।ফিসফিস কন্ঠে বলে,
“খালামণির সাথে ঝগড়া করে।খালামণি নাকি বলেছে মায়ের দোষ সব।ভাইয়ার তোমার দোষই নাই।”
“তুই কীভাবে জানলি?”

“সেও ইন্টারেস্টিং একটা কথা।শুনো তাহলে আমি যখন মায়ের রুমে গিয়ে চিরুনি আনতে গেলাম মা আমাকে কাছে ডাকেন।বলেন ক্লাসে প্রিয়ার সাথে চলাফেরা করি কিনা।যখন বললাম করি।তখনই ত্যাজত্যাজ গলায় বলেন ওর সাথে যেনো আর না চলি।ক্লাসে।ওরসাথে যেনে আর একবেঞ্চে না বসি।ওর থেকে দূরে দূরে থাকতে।ওদের সাথে কোনো সম্পর্কই রাখবেন না আর।ওর খালামণি নাকি তোমার হয়ে কথা বলেছে তাই।”

বলে সূবর্ণা খিলখিল করে হেসে উঠলো।আমার হাসি এলো না।মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।খারাপ হলো এই ভেবে খালা শাশুড়ী মা জেনে ফেললেন আমার শাশুড়ি মায়ের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না।কিন্তু দিনশেষে একদিন না একদিন আত্মীয়দের থেকে এর খোঁটা ঠিকই শুনা লাগবে।আমি গোপনে শ্বাস ত্যাগ করলাম।তারপর সূবর্ণাকে বললাম,

“সুবর্ণা?”
“হু?”
“হেসে না আর।গিয়ে পড়ো এখন।কাল না পরিক্ষা?”
“হু।”
সূবর্ণা আর দাঁড়ালো না।চলে গেলো।আমি তার কিছুক্ষণ পর এককাপ ধোঁয়া উড়া চা নিয়ে টেবিলের উপর নিয়ে রাখি।চা টা শাশুড়ী মায়ের জন্যে।উনি আবার বিকেলে দুধ চা খেতে পছন্দ করেন।শাশুড়ী মা তখন সোফায় বসে বসে তসবি গুনতেছেন।আমাকে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে দৃষ্টি আবার অন্যদিক করে ফেলেন।আগে তো রাগে ওঠাসেঠা বলতেন।এখন দেখলে রাগটা প্রকাশ করেন ঠিকই তারপর কিছু না বলে মুখ অন্যদিক ঘুরিয়ে নেন।তবে উনি কথা না বললেও আমি বলি।আমি এগিয়ে গেলাম,

“আপনার চা।খেয়ে নিয়েন।ঠান্ডা হয়ে যাবে।পরে ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার আমার উপর কটমটা হবেন।”
এ বলে পা ফেলে চলে এলাম।সাথে মুচকিও হাসলাম কিছুটা।সন্ধায় আকাশ বাসায় ফিরেই সোঁজা রুমে ঢুকে আমাকে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।আর ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে।এভাবে অনেকক্ষণই থাকে।তবে কিছু বলছে না।চুপচাপ জড়িয়ে অনবরত প্রগাঢ় শ্বাস ফেলে যাচ্ছে।বললাম,
“কি হয়েছে?এভাবে ধরে আছেন যে?মন খারাপ?নাকি শরীর খারাপ?”
আকাশ জবাব দিল না।ওভাবেই রইলো।বললাম,
“কথা যে বলছেন না?”

তখন আকাশ আমাকে ছাড়িয়ে মুখটা কেমন মলীন করে তাকিয়ে থাকে আমার।চোখে যেন উনার পানিকণা ভাসতেছে।টোকা দিলেই ঝরঝর করে উপচে পড়বে।আমি ভ্রু রাঙ্গালাম খানিকটা।এবার বলে উঠলো,
“সুপ্রভা?আমাকে সাত মাসের জন্যে নিউজিল্যান্ড যেতে হবে!আমি তোমাকে ছাড়া এই সাতমাস একদমই থাকতে পারবো না।আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে!আমার ব্যবস্থাপক পদ লাগবে না।আমি এমপ্লয়ি আছি এতেই ভালো।তোমাকে নিয়ে সামান্য ডালভাত খেয়ে কাটাতে পারলেই হলো।”

আমি আকাশের কথার মানে বুঝলাম না।পাগলের মতন কিসব বলতেছেন উনি।বললাম,
“বুঝলাম না।নিউজিল্যান্ড যাবেন মানে?কোনো অফার পেয়েছেন?”
আকাশ এবার চুপ করে গেলো।ওর মুখের হাবভাবে বুঝাই গেল-হ্যাঁ অফার পেয়েছে।কিন্তু এটা তো খুব ভালো খবর!নিউজিল্যান্ড যাবে।বস ব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দিয়ে দিবেন এর চেয়ে খুশি আর কি।এটা তো অনেক বড় একটা এ্যাচিভমেন্ট!হেসে দিলাম,

“আরেহ পাগলামো করতেছেন কেন!এত ভালে একটা অফার!উফস আল্লাহ!শুকরিয়া আদায় করেন।এরকম অফার কেউ পায়?আপনার বস সবার মধ্যে যে আপনাকে সিলেক্ট করেছে এটাই তো অনেক!সবাই তো পায়নি আর।”
“কিন্তু এই সাতটা মাস!তুমি বুঝতেছো আমার অবস্থা কি হবে?আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো সেখানে!?তারউপর আবার তোমার সাথে বেশি কথাও বলতে পারবো না।ওখানে যেই কেম্পানিতে ডিলটা করবো ওদের সিকুয়েন্স মেনে চলতে হবে।সপ্তাহে একদিন অতি প্রয়োজন হলে কথা বলতে পারবো এর বেশি না!আরেহ আমিতো একঘন্টারও বেশি হলে তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারি না,সেখানে এক সপ্তাহ!অসম্ভব!”

হেসে বললাম,
“সাতদিন ই তো।সাতদিন পরতো মনভরে কথা বলতে পারবেন।তাছাড়া সাতমাস মাত্র।তারপর তো আবার চলে আসবেন।এতটা হাইপার হবেন নাতো?ভালে কিছু পেতে হলে প্রিয় কত কি ছাড়তে হয় জানেন?তাছাড়া আমিতো কোথাও যাচ্ছি না!”
আকাশ চুপ করে রইলো।কিছু বললো না।এভাবে প্রায় দুই মিনিটের মতন।আমি আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।বুঝলাম কিছুটা মন খারাপ হয়েছে।মন খারাপ মুখটা লাল টকটকে হয়ে আছে।নাকের ঢগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

সামনে-পেছনের শার্টের অর্ধাংশেরি বেশি ঘামে লেপ্টে আছে।খুবই বিধ্বস্ত মুখ-শরীরে ভীষণ ভয়ংকর ভালো দেখাচ্ছে।তাকিয়ে থাকতে আমার ভেতরটাও ঢু করে উঠলো।আসলে আমিও কি উনাকে ছাড়া থাকতে পারবো?যার প্রতিটি সকালে ঘুম ভাঙ্গে উনার মুখ দেখে!মনের ভেতরের যাতনা সামলালাম খুব কষ্টে।হেসেই বললাম,
“যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেন।তারপর খেতে আসবেন।”

আগামীকাল খুব সকালেই আকাশকে বাসা থেকে বেরুতে হবে।ফ্লাইট ১০ টার দিকে।তাই সবকিছু গোছগাছ করতেছি।উনার জামাকাপড়,কিছু খাবার,আরো প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র।উনি
ল্যাপটপে কাজ করতেছেন।একটা ফাইল বানিয়ে বারোটার আগেই সাবমিট করতে হবে।ফাইলটা নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার একটা চুক্তিপত্র যা ম্যানেজারকে পাঠাতে হবে।আমার গোছগাছ প্রায় শেষ হয়ে এলে বাম দিকে ফিরে দেয়ালে ঝুলন্ত টি-ঘড়িটির দিকে তাকাই।ঠকঠক গতিতে শব্দ করে একের পর এক কাঁটা অতিক্রম করতেছে।এখন বারোটা বাঁজে।

আর মাত্র ৬ ঘন্টা পর আকাশ বাসা থেকে বেরুতে হবে।ভাবতেই বুকটা ভারী হয়ে এলো খুব!চোখের কোণে কান্না যেন সিক্ত হয়ে উঠলো।আমি আঁচলের কোণা টেনে নিজেকে কোনোমতে সামলিয়ে দরজার কাছে এলাম।তারপর বাইরে এলাম।কিচেনে কিছু কাজ এঁটো থালাবাসন ছিল।তা পরিষ্কার করতে হবে।কিন্তু বাইরে এসে দেখি এখনো পাশের ফ্ল্যাটের সেই আন্টি শাশুড়ী মায়ের সাথে গুজগুজ করতেছেন।কি এত কথা বলেন!ভ্রু যুগল কুঁচকে শোনার চেষ্টা করলাম,

“ছেলে তো তাহলে কালকেই নিউজিল্যান্ডে যাচ্ছে।তা একেবারেই যাচ্ছে নাকি আপা?একেবারে গেলে তো আবার বউয়ের জন্যে কয়দিন পর টিকেট করে বউকেও নিয়ে যাবে।পরে আপনার আর খবরই নিবে না।এখনকার বউরা তো জানেনই একবার হাত করতে পারলেই..!”
শাশুড়ী মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন,

“শুনলাম তো সাতমাস।এখন সত্য নাকি মিথ্যা ওরাই ভালো জানে।আমাকে কি আর সব বলে নাকি?”
“দেখছেন?মনে মনে এটাই ভাবছি।একটু হুশিয়ার থাকবেন আর কি।একটা ছেলে তো…!”
আমার রাগ উঠে যায়!রান্নাঘর থেকে দ্রুত পায়ে উনাদের দিকে হেঁটে যাই।আমাকে দেখে পাশের বাসার আন্টি থতমত খেয়ে যান।টগবগ চোখে বলেন,

“আরে বউমা,মন খারাপ না?আসলে কি আর করা বলো?স্বামী তো আর ইচ্ছে করে যাচ্ছে না?!তোমাদের সুখের জন্যেই যাচ্ছে।তা মায়া করে লাভ নাই।”
আমি সোঁজা বলে উঠলাম,
“আমিতো আপনাকে আন্টি এসব কিছু বলতে জিজ্ঞেস করি নি।রাত তো অনেক হলো…বাসায় যান।তাছাড়া আমরা ঘুমাবো।বাসার বাতি বন্ধ করা লাগবে।বাতি জ্বালানো থাকলে ঘুমতে পারবো না।তাছাড়া উনার ছেলে ভোরেই রওনা করবেন।ঘুম কম হলে সমস্যা হবে উনার।”
উনি মুখটা কেমন ভেংচামো করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন,

“আচ্ছা যাচ্ছি গো আপা।আপনার বউ বের করে দিচ্ছে আমাকে!আপনিও একটু…!”
এতটুকু বলেই চলে যায়।শাশুড়ি মা রাগমুখে উঠে দাঁড়ান!কিছু বলতে যেয়েও যেন আমাকে পারলেন না।কারণ আমি উনার মুখের দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।একটু হাসি হাসি মুখ করে।যাতে কিছুই বলার সুযোগ না পান।পেলেনও না।পাশ কেঁটে চলে গেলেন নিজের রুমের দিকে।আমি আবার রান্নাঘরে যাই।
সবকিছু ঠিকঠাক করে বাতি অফ করে আঁচল টেনে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রুমের দিকে আসি এবার।আকাশ সবে ল্যাপটপের সাটার বন্ধ করেছে।সাবমিট করেছে ফাইলটা হয়তো।আমাকে দেখে একগাল হেসে দেয়।সাদা ফ্রেমের চশমা টা চোখ থেকে খুলে পাশে পাশে রাখতে রাখতে বলেন,

শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি পর্ব ৮

“এত ঘামিয়েছে?পাশে এসে বসো।”
বসলাম।আমার দিকে সজীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।তাকিয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ দুইহাতে আমাকে জোরে টেনে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলেন।খুব শক্ত করে।আমার কেনজানি কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো!আমি জানি না এই মানুষটিকে ছাড়া থাকবো কীভাবে?কীভাবে কাটবে আমার রজনী?কার মুখ থেকে এখন প্রতিটি সকাল আমার শুরু হবে!এই মিষ্টি,সজীব,নিষ্পাপ মুখখানা না দেখলে যে আমার দিনটা ভালো কাঁটে না।কিছুটা কুঁকড়ে উঠলাম।আকাশ বুঝলো আমার মনখারাপ।তার নিজেরও মন খারাপ।তবে বুঝতে না দিয়ে আমাকে বুঝাতো লাগলো….

শূণ্যতার পূর্ণতা তুমি পর্ব ১০