শেষটা সুন্দর পর্ব ১৯

শেষটা সুন্দর পর্ব ১৯
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

‘আপনাকে নিয়ে আজকে এখানেই থেকে যেতাম যদি বেডরুমে একটা বিছানা থাকত। তবে আপনি চিন্তা করবেন না, আমি এক সপ্তাহের মধ্যেই সমস্ত ফার্নিচারের ব্যবস্থা করে ফেলব।’
মেহুল তার সিটে হেলান দিয়ে বসে। ঘাড় কাত করে রাবীরের দিকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। রাবীরও সেটা টের পায়। সে মৃদু সুরে,

‘কাউকে এভাবে দেখতে নেই, তার নজর লাগে।’
‘লাগুক, একটু নজর লাগা ভালো। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো বউয়ের নজর লাগলে স্বামীর শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে।’
‘আচ্ছা, তাই?’
‘জি।’
‘আপনার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নতুন অনেক কিছুই শিখছি।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘হ্যাঁ, তা তো শিখবেন’ই। এমন ট্যালেন্টেট মেয়ে বিয়ে করেছেন, ভবিষ্যতে আরো কত কিছু শিখবেন।’
রাবীর ঠোঁট গুঁজে হাসে। মেহুল বলে,
‘এই যে আজ আপনার এত টাকা গেল, আপনার মায়া লাগছে না?’
রাবীর কপালের ক্ষুদ্র ভাঁজ ফেলে। জিজ্ঞেস করে,
‘টাকার মায়া?’
‘হু।’

‘না। টাকার প্রতি মায়া দেখিয়ে কী হবে? এটা তো আর পারমানেন্ট কিছু না। আজকে আছে কালকে নেই। যেই জিনিস ক্ষণস্থায়ী সেই জিনিসের প্রতি মায়া থাকতে নেই।’
মেহুল নিশ্বাস ফেলে। বলে,

‘আপনি বড়োলোক মানুষ। এই টাকা হয়তো আপনার জন্য কিছুই না। তবে আমার মায়া লাগছিল। আমি দেখেছি, টাকা হাতে না থাকলে মানুষকে কত কষ্ট করতে হয়। আবার বাবা যখন প্রথম অসুস্থ হোন, তখন বাবার চাকরিটাও চলে যায়। আমি তখন দেখেছিলাম কীভাবে মা কিছু টাকার জন্য খেয়ে না খেয়ে টিউশনি করিয়েছেন। মা কে তখন খুব একটা বাসায়ই পেতাম না। এই বয়সে কতদিকে ছুটেছেন। কষ্ট হতো মা’কে দেখে। পরে আমিও দুই একটা টিউশনি নেই। তবে মা আমাকে সেটা বেশিদিন কন্টিনিউ করতে দেননি। মা একাই সবকিছু সামলান। এর মাঝে বাবার অফিস থেকে বলা হয়, বাবার শারিরীক অবস্থার কথা বিবেচনা করে উনারা বাবার পেনশনের ব্যবস্থা করে দিবেন। এখন মাসে মাসে মা বাবার এই পেনশনের টাকা তুলেই সমস্ত খরচ মেটান। তবে এতকিছুর পরও আমাকে কিছু করতে দেন না। আমার নাকি খালি একটাই কাজ, পড়াশোনা করা। তাই সেই সময়ে আমি বুঝেছিলাম টাকার কী মূল্য।’

রাবীর এক হাত দিয়ে মেহুলের হাতটা এনে তার কোলের উপর রাখে। সামনের দিকে চেয়েই বলে,
‘টাকা তখনই মূল্যবান যখন আপনি সেটার সঠিক ব্যবহার করবেন। আমার কাছেও টাকা দামি বস্তু। কারণ, এর জন্য আমাকেও কষ্ট করতে হয়। আমাকেও পরিশ্রম করতে হয়। তাই আমি জানি টাকার মূল্য কতখানি। তবে আরেকটা কথাও বিশ্বাস করি, টাকা ততক্ষণ পর্যন্তই মূল্যবান যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা ব্যবহার করার মানুষ থাকে।

এই যেমন ধরুন, আপনার কাছে কোটি কোটি টাকা আছে, অথচ আপনিই নেই। তাহলে এই টাকার কী হবে। কী হবে এত টাকা থেকে? কিছুই হবে না। আপনি ছাড়া আপনার এই টাকারও কোনো মূল্য নেই। সেই জন্যই সঠিক সময়ে টাকার ব্যবহার করতে হয়, হোক সেটা যতই বড়ো অংকের। আপনার প্রয়োজনে আপনি সেটা অবশ্যই ব্যবহার করবেন। আর হ্যাঁ, এখন থেকে মা বাবার সমস্ত দায়িত্ব আমার। আপনি মা’কে বলবেন, উনাদের ছেলে উনাদের দায়িত্ব নিতে চাইছে। উনারা যেন অনুমতি দেন।’

মেহুলও রাবীরের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। মিহি সুরে বলে,
‘নেতা সাহেব, আপনি এত ভালো কেন?’
রাবীর তার দিকে এক পলক তাকায়। মৃদু হেসে বলে,
‘আপনি আমাকে ভালো চোখে দেখছেন বলে।’
মেহুল তখন ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘তাহলে কি আপনি খারাপ?’
রাবীর জবাব দেয় না। তার দিকে চেয়ে কেবল মুচকি হাসে।

গাড়ি থেকে নেমে মেহুল বলল,
‘আপনিও ভেতরে চলুন। মা না হলে আমাকে বকবে।’
‘না না, মেহুল। আমার এখন গিয়ে একটা মিটিং এ যেতে হবে। দেখছিলেন না কতবার করে কল আসছিল। আবার অন্যদিন আসব। মা’কে বুঝিয়ে বলবেন।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।’
‘আচ্ছা, আপনি আগে ভেতরে যান। তারপর আমি যাব।’
মেহুল হেসে তাকে বিদায় জানিয়ে বাসার ভেতরে গেল। রাবীরও তারপর আর দাঁড়ায়নি। মিটিং আছে বলে সে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে।

রামিনা বেগম বললেন,
‘জামাইকে বাসায় নিয়ে আসতি পারলি না?’
‘মা, আমি উনাকে বলেছিলাম। কিন্তু, উনার নাকি মিটিং আছে। তাই আসতে পারেননি। বলেছেন অন্য একদিন আসবেন।’
তিনি আশ্বস্ত হয়ে বিছানায় বসলেন। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
‘হে রে, কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলি?’
মেহুল বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে দু পা তুলে মায়ের মুখ বরাবরি বসে। বড়ো বড়ো চোখ করে বলে,

‘তোমার জামাই আজকে কী করেছে, জানো?’
‘কী করেছে?’
‘দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।’
এই বলে সে ব্যাগ থেকে একটা দলিলের কাগজ এনে মায়ের হাতে দেয়। রামিনা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
‘কী এটা?’
‘খুলেই দেখো না।’

তিনি দলিল খুলে পড়তে আরম্ভ করলেন। পড়া শেষ করে হা করে মেহুলের দিকে চাইলেন। অবাক হয়ে বললেন,
‘মেহুল, এটা সত্যি? এত বড়ো জমি তোর নামে?’
‘হ্যাঁ, মা। আজ তো সারাদিন উনি এসবই করেছেন। খালি জমি না, ঐ জমির উপর বিশাল এক ডুপ্লেক্স বাড়িও আছে। সেটাও আমার। তুমি বুঝতে পারছো মা, উনি কী করেছেন?’
রামিনা বেগম আবার দলিলের দিকে চাইলেন। তারপর মেহুলের দিকে চেয়ে আফসোসের সুরে বললেন,
‘কতগুলো টাকা!’

‘হ্যাঁ, আমিও তো সেইজন্য উনাকে বারণ করেছিলাম। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আজকে সব ফাইনাল করে তবেই ফিরবেন। এই দলিলও তাই আগেই বানিয়েই রেখেছিলেন।’
রামিনা বেগম বুকে হাত দিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেললেন। বললেন,
‘রাবীর তোকে কত ভালোবাসে দেখেছিস? তুই কোনোদিন ছেলেটাকে কষ্ট দিস না। ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করিস না। ওর মতো তোর কথা কেউ এত ভাববে না, মা। ওকে তুইও আগলে রাখিস।’
মেহুল মাথা নিচু করে স্মিত হাসল। বলল,
‘আচ্ছা।’

সকাল বেলা মায়ের চিৎকারে মেহুলের ঘুম ভাঙে। সে উঠে বসে এদিক ওদিক তাকায়। কী হয়েছে বুঝতে পারছে না। মা এত সকালে চেঁচাচ্ছেন কেন? ঘড়িতে চেয়ে দেখে দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। মেহুল বালিশের পাশ থেকে উড়নাটা নিয়ে গায়ে দেয়। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে আস্তে করে দরজা মেলে বাইরে যায়। বাবা মায়ের রুমের কাছে গিয়ে একটু উঁকি দিয়ে দেখে, মা তার ভীষণ চটে আছেন। কিন্তু, হঠাৎ উনার হলো কী। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বাবার উপর আর উনি কখনোই রাগ দেখাননি। এখন একমাত্র এই বাড়িতে পড়ে আছে সে নিজেই, যার উপর উনি এত রাগ দেখান। কিন্তু, মেহুলের জানা মতে সে তো এমন কিছু করেনি, যার জন্য একদম সকাল হতে না হতেই এমন চিল্লা ফাল্লা শুরু হয়ে যাবে।
মেহুল তাই ভয়ে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যাওয়ার আর সাহস পাচ্ছে না। রামিনা বেগম এর মাঝেই আবার চেঁচিয়ে উঠেন,

‘এই মেহুল, তোর ঘুম হয়নি এখনো। উঠবি, নাকি কিছু উত্তম মধ্যম খেয়ে তোর ঘুম ভাঙবে?’
মেহুল এক ছুটে ভেতরে গিয়ে বলে,
‘না না মা, আমার ঘুম ভেঙে গেছে।’
রামিনা বেগম চোয়াল শক্ত করে তার দিকে চাইলেন। কর্কশ স্বরে বললেন,
‘এদিকে আয়।’

মেহুল ঢোক গিলে। এমন ভয়ংকর ভাবে মা কেন ডাকছেন? সে কী করেছে? মেহুল এক জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। রামিনা বেগম আবার বলেন,
‘কী হলো, কথা কি কানে যাচ্ছে না? বললাম না, এদিকে আসতে।’
মেহুল ভয়ে ভয়ে দু কদম এগিয়ে গেল। রামিনা বেগম তখন তার মুখের উপর একটা পেপার ছুঁড়ে মারেন। ক্ষিপ্ত সুরে বলেন,
‘এসব কী?’

শেষটা সুন্দর পর্ব ১৮

মেহুল বুঝতে পারে না কিছু। পেপারটা নিচ থেকে তুলে চোখের সামনে মেলে ধরে। নিউজ পেপারে ফ্রন্ট পেইজটা চোখে পড়তেই সে যেন আঁতকে উঠে। বিস্ময়ে রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে সে।

শেষটা সুন্দর পর্ব ২০