শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৪

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৪
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

‘এতকিছুর পরও সাদরাজ আহমেদকে কোর্ট কেবল জরিমানা করল, কোনো শাস্তি দিল না; আমি তো এই ব্যাপারটাই মেনে নিতে পারছি না। অথচ শাস্তি পেল কে? ঐ লোকটা, যাকে সে ভয় দেখিয়ে এতকিছু করিয়েছে। আপনিই বলুন এখানে কোনো দিক দিয়ে ন্যায় বিচার হয়েছে?’

রাবীর উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে যেন। কোর্টের রায় শোনার পর থেকেই সে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এই রায় একদমই ঠিক হয়নি। যে শাস্তি পাওয়ার কথা তাকে কিছু টাকার জরিমানা দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ যার শাস্তির প্রয়োজন নেই, তাকে দু বছরের কারাদণ্ড দিয়ে বসে আছে। এটা কেমন ন্যায় বিচার হলো। রাবীর প্রচন্ড রকম বিরক্ত। গরমে ঘেমে একাকার। তবুও গাড়িতে গিয়ে বসছে না। ফোনে মেহুল বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ঐ লোকটা আবার আগে থেকেই জর্জকে টাকা দিয়ে রাখেনি তো? বা ঐ লোকের কোনো কাছের কেউ এসব করেছে?’
‘হতেও পারে। আমিও তাই ভাবছিলাম। নয়তো এত প্রমানের পরও জর্জ কী করে এই রায় দিতে পারেন? আমার তো রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।’
‘শান্ত হোন। এখন আর আপনি রাগ দেখিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। দুনিয়াটাই এমন। খারাপ মানুষগুলো এভাবেই সবসময় পার পেয়ে যায়। তবে চিন্তা করবেন না, একদিন না একদিন ওদের ঠিক ধরা পড়তে হবে। শুধু সেই সময়ের অপেক্ষা।’

‘মেহুল, এই অপেক্ষা আমি আরো কয়েকবছর আগে থেকেই করছি। কিন্তু, আর কত? এই সাদরাজ আহমেদ শুধরানোর লোক না। ওকে আর এভাবে ছেড়েও দেওয়া যায় না। ওকে ছেড়ে দিলে ও এখন আপনার ক্ষতি করতে চাইবে। আর তেমনটা হলে আইনের আগে আমি নিজেই ওকে খুন করে ফেলব।’

‘আপনি আছেন না? ঐ লোকটা আমার কিছুই করতে পারবে না। এখন আপনি কোথায়? বাসায় আসুন। আমাদের বাসায় আপনার মা এসেছেন। আমাদের অনুষ্ঠানের ডেইট ফিক্সড করার জন্য।’
‘আচ্ছা, আসছি আমি।’

রাবীর আসার পর মেহুল বসার রুমে যায়। এতক্ষণ যায়নি। তার শাশুড়ি মা এতক্ষণ তার মা বাবার সাথে কথা বলছিলেন। তিনি মেহুলকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কেমন আছো, মা?’
মেহুল সালাম দিয়ে জবাব দেয়। রাবীর তার দিকে তাকায়। একটা সুতি কমলা রঙের বাটিক শাড়ি পরেছে সে। রাবীরের চোখে মুখে যত ক্লান্তি, বিষাদ, আর বিরক্তভরা ভাব ছিল তা যেন নিমিষেই হাওয়া গেল। সে অবাক হয়ে ভাবল, একটা মানুষ এত স্নিগ্ধ হয় কী করে।

এই মাসের শেষ শুক্রবার রাবীর আর মেহুলের অনুষ্ঠানের ডেইট ঠিক করা হয়। যদিও মেহুল চেয়েছিল ঈদের পর হোক। কিন্তু, রাবীরের একটু বেশিই তাড়া ছিল। তাই তার কথা মতোই তারিখ ঠিক করা হয়েছে।
‘না খেয়ে চলে এলেন যে?’
‘খেয়েছি তো।’
‘এত তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ?’
‘হ্যাঁ। আপনি বসছেন না কেন?’
‘আমার এখন খিদে নেই। সকালে নাস্তা বেশি খেয়েছি।’
রাবীর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে মেহুল জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি খুব ক্লান্ত, তাই না?’
‘না, ক্লান্ত না। তবে খুব বিরক্ত। চিন্তা হচ্ছে খুব।’
‘এখানে বসুন।’
একটা চেয়ার দেখিয়ে মেহুল বলল। রাবীর জিজ্ঞেস করল,
‘কেন?’
‘বসুন’ই না। বলছি।’
রাবীর চেয়ারে বসে। মেহুল তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাবীর জিজ্ঞেস করে,
‘কী করছেন?’

‘আপনি চোখ বন্ধ করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।’
রাবীর ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘কী করতে চাইছেন বলুন তো।’
‘আহা, আপনি আগে চোখটা বন্ধ করুন না।’
রাবীর চোখ বন্ধ করল। মেহুল পেছনে দাঁড়িয়ে রাবীরের কপালে ম্যাসাজ করে চুল টানতে লাগল। সে এত আরাম করে রাবীরের চুল টেনে মাথা ম্যাসেজ করে দিচ্ছিল যে রাবীরের ঘুমই চলে আসছিল। সে নরম সুরে বলল,

‘ইশ, এভাবে যত্ন নেওয়ার জন্য তো অনুষ্ঠানের ডেইট’টা আগামী শুক্রবারেই ফিক্সড করা উচিত ছিল।’
‘তাই, না? আমি অবশ্য এই কাজে খুব এক্সপার্ট। আপনার একটু ক্লান্তি লাগলেই বলবেন। আমি এভাবে যত্ন করে আপনার মাথা টিপে দিব।’
মেহুল অনেকক্ষণ রাবীরের মাথা টিপে দিল। কাজ শেষ করে সে রাবীরের সামনে এসে একটা হাত মেলে দাঁড়ায়। রাবীর তা দেখে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হলো?’
‘ওমা জানেন না? স্বামীর যত্ন করলে বউকে বকশিশ দিতে হয়।’
রাবীর মৃদু হেসে বলে,
‘না, আগে জানতাম না।’
‘এখন তো জেনে নিয়েছেন। এবার দিন।’
রাবীর তার মানিব্যাগ বের করে পাঁচটা এক হাজার টাকার কচকচে নোট বের করে মেহুলের হাতে দিয়ে বলল,
‘নিন, আপনার বকশিশ।’
মেহুল টাকা দেখে অবাক হয়ে বলল,

‘এত বেশি বকশিশ দিলে কিন্তু একসময় আপনি ফকির হয়ে যাবেন।’
‘আপনাকে এইভাবে বকশিশ দিয়ে ফকির হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।’
মেহুল টাকাটা হাতে নিয়ে বলে,
‘আচ্ছা দাঁড়ান, বকশিশ বেশি পেলে সার্ভিসও একটু বেশি দেওয়া লাগে।’
এই বলে সে আবার রাবীরের চুলে বিলি কাটতে আরম্ভ লাগল।

রাবীর তার মা’কে নিয়ে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে যায়। মেহুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, এই লোকটা এত অসভ্য কেন। মেহুল যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছিল তখন। এমনিতে কত নিরামিষ। কিন্তু, হুটহাট আবার এমন সব কাজ করে বসে যে রীতিমত হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার রুমের দরজাটা আটকে দেয় শাড়ি চেঞ্জ করার জন্য।

অনুষ্ঠানের আর বেশি দিন নেই। তাই দুই পরিবারের বেশ কেটাকাটা চলছে। কাবিনের সময় খুব বেশি কিছু কেনা হয়নি। রাবীরের মা তাই এবার মন ভরে ছেলের বউয়ের জন্য বিয়ের কেনা কাটা করছেন। আর রাবীর খুব একটা সময় দিতে না পারলেও মেহুলকে তিনি এতে সবসময়ই সাথে রাখেন। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। মেহুলের জন্য গয়না কিনবেন। তাই তার পছন্দ অপছন্দ ভীষণ প্রয়োজন।

গয়নার দোকানে গয়না দেখার সময় মেহুল বেশ চিন্তাই পড়ে। তার সবসময়ই খুব সিম্পল জিনিস পছন্দ। কিন্তু, অন্যদিকে তার শাশুড়ি পছন্দ করছেন সব গর্জিয়াস জিনিসপত্র। মেহুল সিম্পল কিছু পছন্দ করলে তিনি সেটা সাইডে রেখে একটা গর্জিয়াস সেট হাতে ধরিয়ে বলেন, এটা দেখো।
অনেকক্ষণ দোকানে এতকিছু দেখার পরেও মেহুলের যখন কিছুই পছন্দ হচ্ছিল না তখন তার শাশুড়ি মা রাবীরকে কল করলেন।

‘মা, কিছু বলবে?’
‘তুমি কোথায় আছো? কাজ শেষ হয়ে থাকলে এক্ষুণি স্বর্ণগ্যালারিতে আসো।’
রাবীর ভাবে কিছু হয়েছে হয়তো। তাই সে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন মা, কিছু হয়েছে?’
‘হয়েছে। বিরাট ঘটনা। তোমার বউ এখনো এক পিস গয়না পছন্দ করতে পারেনি। এখন তুমি এসেই তাকে পছন্দ করে দিয়ে যাও। আমার দ্বারা আর হবে না।’

‘এখনই আসতে হবে, মা?’
‘হ্যাঁ, এখনই।’
‘আচ্ছা, তুমি রাখো। আমি আসছি।’
শাশুড়ি মা ফোন রাখতেই মেহুল মুখ কাচুমাচু করে বলে,
‘মা, উনাকে ডাকার কী দরকার ছিল? আমি তো পছন্দ করছিলামই।’
‘তা তো দেখছিলামই কী পছন্দ করছিলে। এটা বিয়ের গয়না? কোনো কাজ নেই কিছু নেই। আমি চাই আমার ছেলের বউকে আমি স্বর্ণ দিয়ে ভরিয়ে দিতে। অথচ আমার ছেলের বউ কিনা তার জন্য এইসব স্বর্ণ পছন্দ করছে। উহু, হবে না। এখন রাবীর এসেই সব পছন্দ করবে।’

রাবীর দোকানের ভেতরে প্রবেশ করতেই সবাই তাকে সালাম দেয়। সে সালামের জবাব দিয়ে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
‘কী সমস্যা, মা?’
তার মা কিছু গয়নার সেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘দেখ তো, এখান থেকে কোনটা বেশি ভালো লাগে।’
রাবীর তখন মেহুলের দিকে এক পলক চেয়ে বলে,
‘মেহুল আছে না, উনাকেই জিজ্ঞেস করো।’
‘করেছি। কিন্তু, ও যা পছন্দ করছে সেটা নেওয়া যাবে না।’

‘কেন মা? বাজেটের বেশি হয়ে যায়? সমস্যা নেই। আমি কার্ড নিয়ে এসেছি।’
‘বাজেটের বেশি হলে তো হতোই। তোমার বউ যা পছন্দ করছে সেই সকল জিনিস বাজেটের ধারে কাছেও আসে না। এই যে দেখো, এই সেট’টা; এত সিম্পল সেট কেউ বিয়েতে পরে?’
রাবীর গয়নাটা হাতে নিয়ে বলল,
‘কেন, তোমার এটা পছন্দ হয়নি?’

‘না, আমার এটা পছন্দ হয়েছে।'(অন্য একটা ভারি গয়না দেখিয়ে)
রাবীর সেটাও খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে। তারপর নরম সুরে বলে,
‘মা, গয়না কে পরবে? মেহুল তো? তাহলে তো আমাদের উনার কম্পফর্টের কথাটা আগে ভাবতে হবে, তাই না। গয়না ভারি বা হালকাতে কী আসে যায়। তুমি মেহুলকে যা দিবে সেটা তো উনাকে ভালোবেসেই দিবে। আর তাই এখানে তোমার ভালোবাসাটাই আসল। গয়নার ওজন না।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৩

রাবীরের মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘আমি জানতাম তুমি আমাকে ঠিক ভুলিয়ে ফেলবে। আচ্ছা, নাও নাও মেহুলের যা পছন্দ তাই নাও।’
মেহুল প্রচন্ড খুশি হয়। সে মনে মনে ভাবে, নিশ্চয় এভাবেই রাবীর তার গানের ব্যাপারেও মা’কে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবে।

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৫