শেষটা সুন্দর পর্ব ৫১

শেষটা সুন্দর পর্ব ৫১
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

খালা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদরাজের চোখ মুখ শক্ত। সে খালাকে পুনরায় একই প্রশ্ন করে। খালা ভয় পাচ্ছেন। সাদরাজকে তিনি এই কুৎসিত সত্যটা কী করে বলবেন?
খালার মৌনতা সাদরাজকে আরো রাগিয়ে দিচ্ছে। সে আওয়াজ তুলে বলে,

‘কী হলো, খালা? কিছু বলছো না কেন? কে আমার মা’কে মেরেছে? তুমি কী জানো, বলো আমাকে।’
খালা ঢোক গিলে। ভীতু সুরে বলে,
‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতেন না। উল্টা আরো চেইতা যাইবেন।’
সাদরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তুমি আগে আমাকে সবটা বলো। তারপর অন্য কথা ভাবা যাবে।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

খালা নিজেকে ধাতস্ত করে। আর চুপ থাকলে চলবে না। এবার তাকে বলতে হবে। নয়তো তার জন্য একটা নিরহ মেয়ে কষ্ট পাবে। খালা জোরে নিশ্বাস নেয়। কম্পিত সুরে বলে,
‘বড়ো সাহেব ম্যাডামরে মারছিলেন।’
সাদরাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী?’
‘হ, আপনার বাপেই আপনার মা’র খু নি; রাবীর খান না।’

সাদরাজ এক দৃষ্টিতে খালার দিকে চেয়ে আছে। সে যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। কথাগুলো কানে বাজছে তার। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো সব জট লেগে গিয়েছে। এই ছোট্ট কথার ব্যাখ্যা তারা মেলাতে পারছে না। খালা তার দিকে চেয়ে বললেন,

‘আমি জানি, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু, এডাই সত্যি। রাবীর খান আপনার মা’রে মারে নাই। আপনার মা’রে আপনার বাপ মারছেন। আমি নিজের কানে সব শুনছি। শুধুমাত্র আপনার আর রাবীর খানের মাঝে শত্রুতা তৈরি করার লাইগা বড়ো সাহেব এডি করছেন। আপনার অসুস্থ মা’রে মাইরা লাইছেন। এহানে রাবীর খানের কোনো দোষ নাই। উনারে তো আপনার বাপেই ফাঁসাইছিল।’

সাদরাজ ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। মাথার ভেতরে যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে তার। কী করবে? এসব কথা সে কীভাবে বিশ্বাস করবে? তার বাবা এসব করেছে? না, এটা কীভাবে সম্ভব?
সাদরাজ মাথায় হাত দিয়ে বসে। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। অস্থির লাগছে। বুকে ব্যথা হচ্ছে। সে খালার দিকে চেয়ে বলে,

‘আমাকে এক গ্লাস পানি এনে দাও, খালা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
খালা দ্রুত গিয়ে তার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। সাদরাজ ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি খায়। তারপর সে খালার দিকে চেয়ে বলে,

‘তুমি মিথ্যে বলছো, খালা। তুমিও নিশ্চয়ই রাবীরের সাথে মিলে এসব বলছো। সবাই আমাকে মিথ্যে বলছে। সবাই আমাকে বোকা বানাচ্ছে। আমার বাবা আমার মা’কে কেন মারবে? না না, আমার বাবা খু নি হতে পারে না। তোমার কাছে কী প্রমাণ আছে, খালা? আমি জানি কোনো প্রমাণ নেই। তুমি মিথ্যে বলছো, তাই না?’
সাদরাজ প্রচন্ড অস্থির হয়ে উঠে। খালা নরম গলায় বলে,

‘না, সাহেব। আমি মিছা কইতাছি না। যা শুনছি তাই কইছি। আপনার বাপে নিজের মুখে এডি কইছে। আমি নিজের থেইকা বানাইয়া কিছু কইতাছি না। বিশ্বাস করেন, সাহেব।’
সাদরাজ তার মাথা চেপে ধরে। চেঁচিয়ে বলে,

‘আমি কাকে বিশ্বাস করব? সবাই আমার সাথে অন্যায় করছে। আমি এখন কার কথা মানব? কী করব? বাবাকে বিশ্বাস করব, নাকি রাবীরকে? কে এসব করছে? কেন এসব করছে? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মাথা যন্ত্রণা করছে আমার।’
সাদরাজ জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে থাকে। খালা তখন ভয়ে ভয়ে বলে,
‘একবার রিতা খালারে আনমু? খালাও তো ঐদিক দিয়া কষ্ট পাইতেছে। আপনার এহন খালারে প্রয়োজন। খালা’ই একমাত্র আপনার কষ্ট বুঝব।’

সাদরাজ কিছু বলে না। খালা সাহস করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা চাবি টা নিয়ে সেই স্টোর রুমের কাছে যায়। দরজাটা খুলে দেখে রিতা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে কাঁদছে। খালাকে দেখেই সে কেঁদে বলে,
‘খালা, এমনটা কেন করলেন? কেন আপনি সত্যিটা তখন বললেন না?’
খালাও কেঁদে ফেলেন। বলেন,

‘আমি এহন সব সত্যি কইছি, খালা। সাহেব খুব কষ্ট পাইতেছেন। আপনি গিয়া উনারে সামলান।’
রিতা চোখ মুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে বলে,
‘আপনি সবকিছু বলেছেন?’
খালা বলেন,

‘হ, যা জানি সব কইছি। সাহেবের কাছে যান। উনি সব শুইনা অস্থির হইয়া উঠছেন। উনার এহন আপনারে প্রয়োজন।’
রিতা ধীর পায়ে সাদরাজের রুমে যায়। গিয়ে দেখে সাদরাজ দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। রিতা এগিয়ে যায় তার দিকে। তারপর আস্তে করে সাদরাজের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। সাদরাজের হাত দুটোকে নিজের হাতের মুঠোয় আগলে নেয়। সাদরাজ তার দিকে তাকাতেই সে দেখে, সাদরাজের চোখ দুটো টলমল করছে। রিতা নরম সুরে বলে,

‘কষ্ট লাগলে কেঁদে ফেলুন, মন হালকা হবে।’
সাদরাজ ঠোঁট শক্ত করে নিজেকে সামলে নেয়। কষ্ট পেলেও কাঁদবে না সে। রিতাকে বলে,
‘তোমরা সবাই মিলে আমাকে মিথ্যে বলছো, তাই না? ইচ্ছে করে এসব করছো, যেন আমাকে শাস্তি দিতে পারো। আমি সব বুঝতে পারছি, রিতা। এই সবকিছু তোমাদের প্ল্যান।’
রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সাদরাজের দিকে চেয়ে নরম গলায় বলে,

‘সাদরাজ, আমিও এতকিছু জানতাম না। খালা আমাকে সব বলেছিলেন। আপনি আজ যা করছেন, সব আপনার বাবার প্ররোচনায়। নিজের বিবেক খাটিয়ে কিছু করছেন না। আর তাই, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সেটাও আপনি এখন বুঝতে পারেন না। আপনার বাবা আপনাকে উনার হাতের পুতুল বানিয়েছেন। যেমন উনি চান, আপনিও তেমন ভাবেই নাচেন। কথাগুলো খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। আর আপনাকেও এই সত্যি মেনে নিতে হবে।’

সাদরাজ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
‘আমার বাবা আমার মা’কে মারেননি।’
‘সেটা তো উনিই ভালো বলতে পারবেন। আপনি গিয়ে সরাসরি উনার সাথে কথা বলুন।’
‘না। আমি বাবার সাথে এই ব্যাপারে কীভাবে কথা বলব? আমি আমার বাবাকে অবিশ্বাস করতে পারি না।’

‘তাহলে নিজের বন্ধুকে কিসের ভিত্তিতে অবিশ্বাস করছেন? এত যে প্রমাণ খুঁজেন, রাবীর ভাইয়াই যে আপনার মা’কে মেরেছেন তার কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে? দেখান আমাকে। কী প্রমাণ আছে, আমিও দেখি।’
সাদরাজ অন্যদিকে চেয়ে বলে,
‘একটা ভিডিও। আমার ফোনে এখনো আছে।’
‘কোথায়, আমাকে দেখান সেটা।’

সাদরাজ ফোন বের করে একটা পুরোনো ভিডিও বের করে রিতার হাতে দেয়। দু সেকেন্ডের একটা ভিডিও হবে হয়তো। যেখানে দেখা যাচ্ছে, একটা ছেলে একজন অসুস্থ মানুষের মুখ থেকে তার অক্সিজেন মাস্ক’টা খুলছে। ব্যস এইটুকুই। রিতা মনোযোগ দিয়ে ভিডিও টা দেখে। বারবার দেখে। ছেলেটা রাবীর, সে চিনতে পারে। হয়তো বেডে শুয়ে থাকা অসুস্থ মহিলাটা সাদরাজের মা। রিতা ভিডিও টা দেখে বলে,

‘এটাতে কি প্রমাণ হয়, রাবীর ভাইয়া আপনার মা’কে মেরেছেন, তাই তো?’
‘হ্যাঁ, ভিডিও তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, রাবীর মায়ের মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খুলেছে। এবং তারপরই মা শ্বাস কষ্টে মারা যান।’

রিতা তখন জিজ্ঞেস করে,
‘আর এই ভিডিও টা তখন কে করেছিল?’
‘বাবার একজন কর্মচারী।’
‘সেই কর্মচারী ঐ মুহূর্তে রাবীর ভাইয়াকে না আটকিয়ে ভিডিও বানাচ্ছিল, আশ্চর্য।’
‘আসলে সে বলেছিল, সে নাকি ভয়ে তখন রাবীরের কাছে যেতে পারেনি, যদি রাবীর তাকেও কোনোভাবে মেরে দেয়।’
‘বাহ, ভালো তো। তাই সে কাউকে না ডেকে বসে বসে ভিডিও বানাচ্ছিল।’

‘এর জন্য ওকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। রাবীরের সাথে ওর নামেও বাবা মামলা করেছিলেন।’
‘তাতে লাভ কী হয়েছে? খু নি তো আর কোনো শাস্তি পায়নি। শাস্তি পেয়েছে সব নির্দোষেরা। তবে একটা কথা জানেন কি, আপনি ভীষণ বোকা। আপনাকে সবাই খুব সহজেই বোকা বানাতে পারে।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ৫০

সাদরাজ চোখ মুখ কুঁচকে চেয়ে আছে। রিতা বলে,
‘ভিডিও টা ভালোভাবে দেখুন তো। দুই সেকেন্ডের একটা ভিডিও। যেটাতে দেখা যাচ্ছে, রাবীর ভাইয়া মাস্কটা খুলেছে। আর তার আগে পিছে কিছু নেই। এইটুকুই। দিন এবার, মোবাইলটা আমাকে দিন। আমি আপনাকে ভিডিওটা অন্যভাবে দেখাই।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ৫২