শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩৭

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩৭
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

পুষ্প নিহিত পালংকে হাত পা গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে পুতুল। নিদারুণ লজ্জা আষ্টেপৃষ্ঠে যেন জড়িয়ে ধরেছে তাকে। এই বাড়ি, এই ঘর, আর ঐ মানুষটা সবই তার পূর্ব পরিচিত। অথচ, আজ সবকিছু কেমন যেন নতুন মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে সে কোনো অজানা এক রাজ্যে চলে এসেছে। যার চারদিকে পুষ্পের সমারোহ। আর সে সেই পুষ্পের রাণী। আর তার একমাত্র সুদর্শন রাজা সারাজ।

কীসব বাচ্চাদের মতো উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় আসছে। পুতুল একবার নিঃস্পৃহ হচ্ছে তো একবার হাসছে। আবার একবার আকাশচুম্বী ব্রীড়ায় হচ্ছে কুন্ঠিত। ঠিক সেই মুহূর্তেই আগমন ঘটল সেই কাঙ্খিত ব্যক্তির। দরজাটা অতি সন্তর্পনে আটকে দিয়ে সারাজ এসে দন্ডায়মান হলো ঠিক পুতুলের সম্মুখে। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল পুতুল। উদ্যত হলো সালাম করতে। পুতুল উঁবু হয়ে বসে সারাজের পায়ে কোমল হস্তে স্পর্শ করতেই অধর কোণে চমৎকার হাসি ফুটে সারাজের। মনে মনে আওড়ায়,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমার পুতুল বউ। একমাত্র আমার।’
সারাজের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে ভ্রু কুঁচকে উপর দিকে তাকায় পুতুল। বিরক্ত গলায় বলে উঠে,
‘কী হলো? দেখছ না, আমি পা ধরে বসে আছে। উঠাও আমাকে।’
ঈষৎ হাসল সারাজ। পুতুলের দুই বাহুতে হাত রেখে তাকে দাঁড় করাল। সঙ্গে সঙ্গেই তখন তার সামনে ডান হাত মেলে ধরল পুতুল। উৎফুল্ল সুরে বলল,

‘এবার আমার গিফ্ট দাও।’
সারাজ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘গিফ্ট? কীসের গিফ্ট?’
‘কীসের গিফ্ট মানে? এই যে তোমাকে সালাম করলাম, তার গিফ্ট। আর বাসর রাতে তো এমনিই বউকে গিফ্ট দিতে হয়।’
সারাজ বিছানার এক পার্শ্বে পা তুলে বসল। অতঃপর পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘আচ্ছা, কী গিফ্ট চাই বল।’

কোমরে হাত দিয়ে গরম চোখে চাইল পুতুল। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘মানে আমি বললে তুমি আনবে? এখন নিয়ে আসোনি?’
‘না। বিয়েতে খরচ করতে করতে বর্তমানে আমি ফকির। বল কী লাগবে, পরে নিয়ে আসব।’
নাক মুখ কুঁচকে বিদ্বেষে জ্বলে উঠল পুতুল। গটগট করে হেঁটে গিয়ে বিছানার আরেক পার্শ্বে বসল। তেতে উঠে বলল,
‘থাক, কিছু লাগবে না আমার।’

বিছানায় হেলান দিয়ে বসল সারাজ। তীক্ষ্ণ চোখে চাইল পুতুলের পানে। তবে পেছন থেকে কেবল তার পৃষ্ঠদেশ’ই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আধভেজা খোলা কুন্তলে চোখ আটকাল তার। এগিয়ে এসে সেই মসীবর্ণ কেশে নাক ডুবিয়ে বলল,
‘এমন তীব্র ঘ্রাণওয়ালা শ্যাম্পু আর কখনো দিবি না। আমার বড্ড নাকে লাগছে।’

ঘুরে চাইল পুতুল। অকস্মাৎ সারাজকে এত নিকটে দেখে ভড়কে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তোমার জন্য আর কী কী করতে হবে, তার একটা লিস্ট করে দিও। মুখে বললে আমার মনে থাকবে না।’
হাসল সারাজ। পুতুলের কন্ঠের তেজ যথেষ্ট। আবারও হেলান দিল পূর্বের জায়গায়। বলল,
‘সামান্য একটা গিফ্টের জন্য এত রাগ?’
পুতুল রাগ দেখিয়ে বলল,

‘এটা সামান্য গিফ্ট না। বাসর রাতের গিফ্ট স্পেশাল হয়। অবশ্য তোমার মতো নিরামিষ মানুষ কি আর সেসব বোঝে!’
সারাজ নিমীলিত চক্ষে প্রগাঢ় শ্বাস নির্গত করে। পুতুল এসে শুয়ে পড়ে তার জায়গায়। গম্ভীর সুরে বলে,
‘লাইট’টা অফ করে দিও।’
চোখ মেলে চাইল সারাজ। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘আজ রাত কি ঘুমানোর জন্য?’

জবাব দিল না পুতুল। সারাজ উঠে দাঁড়াল। আলমারির কাছে গিয়ে কিছু একটা নিয়ে আবার ফিরে এল তার স্থানে। পুতুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘ওঠ।’
পুতুল অগ্রাহ্য করল তার সেই হুকুম। সারাজ ফের বলল,
‘উঠতে বলেছি, পুতুল।’
অগত্যাই উঠে বসল পুতুল। বিমুখ হয়ে বসে রইল। সারাজ তার দিকে ছোট্ট একটা বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘তোর গিফ্ট।’

চমকে চাইল পুতুল। অবাক কন্ঠে বলল,
‘তার মানে এতক্ষণ তুমি মজা করছিলে?’
‘না, তোর গাল ফুলানো দেখে ম্যাজিক করে নিয়ে এসেছি।’
সরু চোখে এক পল সারাজকে দেখে হাসল পুতুল। অতঃপর হাতের ছোট্ট বক্সটার দিকে চাইল। কী আছে এতে? হয়তো আংটি। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বক্সটা উন্মুক্ত করল সে। তবে ভেতরের জিনিসটা দেখে মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় ছেয়ে গেল পুরো চিত্ত জুড়ে। সারাজের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বলল,

‘চাবি? কীসের চাবি এটা?’
‘স্কুটির।’
পুতুলের চোয়াল ঝুলল। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল কেবল। সারাজ নিজ থেকেই বলল,
‘ছোট বেলায় একবার এক স্কুটি দেখে অনেক কেঁদেছিলি তুই। ছোট বলে বাবা তোকে আর স্কুটি কিনে না দিয়ে সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেদিনই তোর কান্না দেখে মনে মনে ঠিক করেছিলাম, একদিন নিজের আয়ে তোর এই ইচ্ছে পূরণ করব। অবশেষে পেরেছি। খুশি হয়েছিস?’

মুখে কিছু না বলে সারাজকে সহস্তে জড়িয়ে ধরল পুতুল। প্রতুল খুশিতে আত্মহারা সে। বাসর রাতে যে এমন একটা গিফ্ট পাবে সেটা তার কল্পনাতীত ছিল। সারাজও দু হাতে আগলে নিল তাকে। মাথায় গাঢ় এক চুম্বন করে বলল,
‘এবার আমার গিফ্ট।’

ঈষৎ লাজে গাল রাঙিয়ে পুতুল বলল,
‘এই যে পুরো আমিটাকেই আজ থেকে তোমায় দিয়ে দিলাম।’
অন্তঃস্থলে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হলো ততক্ষণাৎ। হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় করে সারাজ শুধাল,
‘সত্যি বলছিস?’
মাথা নাড়িয়ে পুতুল বলল,
‘হ্যাঁ, একদম।’

পুতুলকে সোজা করে বসাল সারাজ। তার নববধূকে সাধারণ এই লাল রঙা শাড়িতে অমায়িক লাগছে। তার অবাধ্য চোখের দৃষ্টি আর এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। পুতুলের সমস্ত মুখাবয়ব জুড়ে তার বিচরণ শুরু হয়। ঘোরে লাগে সারাজের। অন্য এক নেশায় বুঁদ হয় মস্তিষ্ক। লজ্জায় সংকুচিত পুতুল। কুন্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘এভাবে কী দেখছ?’

এগিয়ে এসে পুতুলের আরো নিকটস্থ হয় সারাজ। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,
‘তোকে ভীষণ আবেদনময়ী লাগছে, পুতুল।’
লজ্জায় শিহরণ জাগে শরীরে। প্রতিটি লোপকূপ দাঁড়িয়ে যেন তারই ইশারা দিচ্ছে। বক্ষঃস্থলের কম্পন তীব্র হয়। সারাজের তপ্ত নিশ্বাস চোখে মুখে আছড়ে পড়তেই সে কম্পন আরো প্রগাঢ় হয়। শরীর শীতল হয়ে আসে। আচমকা ওষ্ঠযুগলের উপর সারাজের পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেতেই শরীর কেঁপে উঠে তার। তার কম্পিত ওষ্ঠে নজর বরাদ্দ রেখেই সারাজ বলে উঠল,
‘এভাবে কাঁপছিস কেন, পুতুল? আমি কি কিছু করেছি?’

অসহায় চোখে তাকায় পুতুল। ভগ্ন সুরে বলল,
‘কিছু করোনি বলেই তো কেবল কাঁপছি। আর কিছু করলে তো মরেই যাব।’
ঠোঁট কামড়ে হাসল সারাজ। মোহিত সুরে বলে উঠল,
‘তবে আজ তোকে মেরেই দেই, কী বলিস?’

বিস্ফোরিত চোখে চাইল পুতুল। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে কিন্তু, তার আগেই যা ঘটার ঘটে গেল। তাজ্জব বনে বসে রইল পুতুল। শরীর ইতিমধ্যেই অসাড় হয়ে এসেছে তার। খেয়াল করল সারাজ অল্পতেই উন্মাদ হয়ে ওঠেছে। এতেই শরীর আরো ছেড়ে দিল তার। সারাজের বুকে ঢলে পড়তেই হাসল সে। ফিচেল স্বরে বলল,
‘পুরোপুরি মরার আগে এমন এক দু বার বেহুঁশ হওয়া কোনো বড়ো ব্যাপার না, পুতুল। আই’ল হ্যান্ডেল ইট।’

মার্তন্ডের তীক্ষ্ণ আলোকছটা চোখে মুখে আপতিত হতেই ঘুম ছুটে যায় পুতুলের। চোখ পিটপিট করে তাকায়। মস্তিষ্ক জাগ্রত হতেই টের পায় ভয়ানক লজ্জার কিছু। বড়ো বড়ো চোখের পল্লব ফেলে সারাজের দিকে তাকায়। সে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পুতুল এতক্ষণ তার সুঠাম বক্ষকেই বালিশ বানিয়ে শুয়েছিল। আশেপাশের এলোমেলো জিনিসপত্রগুলো দেখে তীব্র এক অস্বস্তি ঝেঁকে বসল অন্তঃস্থলে। কোনো রকমে নিচ থেকে অযত্নে পড়ে থাকা শাড়িখানা গায়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়াল সে। ব্যাগ হাতড়িয়ে যা পেল তা নিয়েই ছুট লাগাল ওয়াশরুমে।

গোসল শেষে ফিরে এসে জোরে জোরে দম নিল পুতুল। বিছানায় চেয়ে দেখল, ঐ অভদ্র অসভ্য লোকটা এখনও গভীর তন্দ্রায় নিমজ্জিত। তাকে এত আরামে ঘুমাতে দেখে চটে যায় পুতুল। আরো বেশি চটে যায় আয়নায় স্বীয় প্রতিবিম্ব দেখে। রাতে কি লোকটা নেশা টেশা করে এসেছিল নাকি? এমন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল কেন?
রাগে বিড়বিড় করতে করতে আয়নার সামনে দাঁড়াল পুতুল। নিজেকে দেখে রাগের চেয়ে লজ্জা পাচ্ছে বেশি। আবারও ফিরে চাইল সারাজের দিকে। বিদ্বিষ্ট সুরে বলল,

‘দেখে মনে হয়, এনার মতো ভদ্র ছেলে আর দুটি হয়না। অথচ ভেতরে ভেতরে একটা আস্ত রাক্ষস বৈ আর কিছু না।’
‘আমি কিন্তু সব শুনতে পাচ্ছি, পুতুল।’
আকস্মিক সারাজের কন্ঠস্বর শুনে আঁতকে উঠল পুতুল। সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘এই, তুমি না ঘুমাচ্ছো?’

‘তো, ঘুমালে কি মানুষ কালা হয়ে যায়? আর তোর কত বড়ো সাহস তুই আমার রুমে দাঁড়িয়ে আবার আমাকেই রাক্ষস বলছিস? এর জন্য তোকে কঠিন একটা শাস্তি পেতে হবে, পুতুল।’
বলতে বলতেই উঠে বসল সারাজ। পুতুল ভেবেছিল এখনই বোধ হয় সে এসে ঝাপ্টে ধরবে তাকে। তাই আগে ভাগেই দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু সারাজ তেমন কিছুই করল না। সে নির্লিপ্ত ভঙিতে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। খানিকটা অবাক হয়ে পুতুল ভাবল, ‘শাস্তি না দিয়েই চলে গেল যে?’

সারাজের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া কি এতই সহজ? পুতুলও পেল না। সারাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই চেঁচিয়ে উঠল পুতুল। দুহাতে মাথা চাপড়ে বলল,
‘সারাজ ভাই, এটা কী করলে?’
ক্ষুব্ধ হলো সারাজ। তেতে উঠে বলল,
‘আমার ভাই বলছিস?’

দ্বিগুণ তেতে উঠল পুতুল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
‘যতদিন পর্যন্ত না তোমার আগের মতো দাঁড়ি হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আমি তোমাকে ভাই’ই ডাকব। আর এটাই হলো তোমার ক্লিন শেভ করার শাস্তি।’

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩৬

গটগট করে রুম ছাড়ল পুতুল। সারাজ বোকার মতো চেয়ে তার যাওয়া দেখে বলল,
‘এটা কেমন হলো? যাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি ক্লিন শেভ করলাম, উল্টো সে’ই এখন আমাকে শাস্তি দিচ্ছে? আচ্ছা ধড়িবাজ মেয়ে তো!’

শেষটা সুন্দর সিজন ২ পর্ব ৩৮