শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪৬
নূরজাহান আক্তার আলো
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা পার্টি অফিসে এসেছে সায়ন। আজম তখন
দলের ছেলেপুলেদের সাথে নিয়ে হইহই করে ক্যারাম খেলছিল। বাজি ধরেছে আজকে যে হারবে সেই কাচ্চি খাওয়াবে। তাদের দুই দলের মধ্যে চলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই৷ খেলার মাঝে সায়নকে আসতে দেখে আজম গলা ছেড়ে ডাকল। সায়ন থমথমে মুখে একবার তাকিয়ে মাথা ব্যথার কথা ইশারায় জানিয়ে অফিসরুমে রুমে ঢুকে গেল। ভাইয়ের মাথা ব্যথা করছে যেহেতু ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে ভেবে আজমও আর কথা বাড়াল না।তাছাড়া সায়ন যখন ডাকতে বারণ করে তখন জোর খাটিয়ে ডাকলে ভীষণ রেগে যায়। তখন চমৎকার চমৎকার গালি কপালে জোটে। যেসব গালি আবার দিনের বেলা বললে পাপ হয়। তাও আবার বড় বড় পাপ!
এরচেয়ে ক্ষ্যাপা পাগল আপাতত ঘুমাক একটুপরে নাহয় ডেকে দেওয়া যাবে। একথা ভেবে তারা হইহই করে খেলাটা শেষ করল। আজমের দল বাজিতে জিতে গিয়ে বিপক্ষ দলকে খুব করে পঁচালো। এরপর দলবেঁধে কাচ্চি কিনে এনে সকলে একসাথে খেতে বসল। সবার হাতে খাবারের প্লেট। কাচ্চির ঘ্রাণে ম-ম করছে চারদিক। আজম খেতে বসে হঠাৎ মনে পড়ল সায়ন রুম থেকে এখনো বের হয় নি। এত সময় রুম বন্দিও থাকে না কখনো। তাহলে কি শরীর কি বেশি খারাপ করছে? মেডিসিন আনতে হবে? একথা ভেবে সে খাওয়া ছেড়ে উঠে দরজা বন্ধ দেখে ডাকল,
-‘ভাই? ও ভাই? আহেন আমগো লগে খাবেন।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বেশ কয়েকবার ডাকার পরও সায়নের জবাব পেল না। ততক্ষণে সবাই খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছেও চলে এসেছে। ডাকছে একে একে। এত ডাকাডাকি শুনে সায়ন কপালের উপর থেকে হাত না সরিয়ে বিরক্ত হয়ে দরজার দিকে তাকাল। ভেজা চোখজোড়া না মুছে মলিন স্বরে জবাব দিলো,
-‘তোরা খা।’
মিনমিনে সুরে জবাব পেয়ে আজম পুনরায় বলল,
-‘আহেন না ভাই হগ্গলে মিলে একলগে খাই?’
-‘ঘুমাব একটু, দুই ঘন্টা পর ডেকে দিস।’
-‘ এবা করেন ক্যান? কত খাওন-দাওন আনছি আসেন একলগে খাই?’
-‘মা’দা’রচো’দ যাবি এখান থেকে? বলছি ঘুমাব তাও খাওন খাওন কইরা ফ্যাল পাড়তাছোস? আর একটা বাড়তি কথা কইলে জিন্দা কবর দিমু শা’লা। আসছে ভালোবাসা দেখাতে..তোদের ভালোবাসায় সায়ন মুতে না আর। লাগব না কারো ভালোবাসা…..যেশালায় ভালোবাসা দেখাইতে আসবি তারেই কুপামু।’
-‘ভাই..!’
-‘আজম্য মাথা মুথা ঠিক নাই যা কইতাছি।’
-‘ওষুধ আইন্না দিমু?’
-‘যাবি তুই!’
-‘রাইগেন না ভাই। বাহিরে আহেন, ভুল করলে আম্রে দুই’ঘা মারেন তাও
কন কি হইছে আফনার?’
-‘কিছু হয় নাই। তবে আমারে উঠতে হইলে আমার হাতে খুন হবি তুই।’
কোনো কারণে সায়ন মাত্রারিক্ত রেগে আছে বুঝে আজম কথা বাড়াল না। নয়তো সত্যি সত্যি মাইর নিশ্চিত তাই শুধু বিড়ালসুরে বলল,
-‘আচ্ছা ভাই আপনে তাইলে ঘুমান। কিছু লাগলে আমারে ডাইকেন আমি এইহানেই আছি।’
একথা বলে ছেলেপুলেকে শব্দ করতে বারণ করে অন্যদিকে বসল। যত খুশি নিয়ে খেতে বসেছিল তত খুশি আর রইল না কারো। কিন্তু সায়নের সমস্যার কথা সে নিজে থেকে না বললে জানারও উপায় নাই কোনো।এসব ভেবে সে প্রথম লোকমা মুখে পুরতে যাবে তখনই ফোনে রিংটোন বেজে উঠল। অসময়ে কল আসায় বিরক্ত হয়ে ডিসপ্লেতে তাকাতেই ভ্রুঁ কুঁচকে গেল। এই নাম্বার থেকে অযথা কল আসে না। আর যখনই আসে তখনই বুঝতে হবে ঘটনা সিরিয়াস। তাই সে সর্তক হয়ে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে একটু সাইডে সরে গেল। তারপর দ্রুত কল রিসিভ করে বলল,
-‘হ্যালো শুদ্ধ ভাই!’
-‘ভাইয়া কোথায়, আজম?’
-‘অফিসরুম থিকা বাইর হয় নি তয় কি লইয়া জানি খুব রাইগ্গা আছে।’
-‘বের হলেও একা ছেড়ো না।’
-‘কোনো সমস্যা ভাই?’
-‘একটু, তবে যতটুকু বললাম মনে রেখো। চোখ, কান খোলা রেখো আর হ্যাঁ আবারও বলছি, ভাইয়াকে একা ছেড়ো না।’
-‘জ্বি ভাই। কিন্তু আপনি কুথায় গাড়ির শব্দ শুনতাছি?’
-‘ আছি আশেপাশেই। আপাতত ভাইয়ার দিকে খেয়াল রেখো, রাখছি।’
একথা বলে শুদ্ধ কল কেটে দিলো।আজম ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে আরেকবার তাকাল বন্ধ অফিসরুমের দিকে। তখন তাদের দলের এক ছেলে দৌড়ে এসে জানাল চৌধুরী নিবাসে ঘটে যাওয়া ঘটনা। শীতলরাও চলে গেছে
সাথে শারাফাত চৌধুরী সায়নকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। একথা
শুনে আজম হতবাক হয়ে মাটির দিতে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগল তার। তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর পরিবারটিও এভাবে ভেঙে গেল? এবার কি হবে? আর স্বর্ণ ভাইকে ছেড়ে চলে গেল?
ভাই মানবে কিভাবে? মানার চেয়েও বড়কথা বাঁচবে কিভাবে? কেউ না জানুক সে তো জানে স্বর্ণের জন্য তাদের ভাই কতটা পাগল। ঠিক কতটা ভালোবাসে স্বর্ণ আপাকে! আজম আর ভাবতে পারল না তবে এই ঘটনা জানাজানি করতে বারণ করল। এবং আপাতত ভিড় করতে মানা করে নিজেও বন্ধ রুমের দরজার কাছে দুই পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। দেওয়ালে
মাথা ঠেঁকিয়ে বিরবির করে বলল,
-‘সব সুন্দর জিনিসের স্বায়ীত্বকাল এত অল্প সময় দাও কেন গো মাবুদ?
আমারে সুন্দর পরিবার দাও নাই মাইন্না নিসি। কিন্তু চোখে দেখার মতো সুন্দর একটা পরিবার দিসিলা তাও কাইড়া নিলা? আমার শাহরিয়ার ভাইয়ের ধৈর্য্য দাও খোদা। মানুষটা উপরে শক্ত হইলেও ভেতরে যে নরম মাটি। পরিবারটাকে উনি বুক দিয়ে আগলে রাখত। সেই পরিবার ভাইঙ্গা গেছে, ভাইয়ে না জানি কত কষ্ট পাইতাছে আর আমি কী না কাচ্চি নিয়া এতক্ষণ পইড়া আছিলাম।’
একথা ভেবে সে দুইহাতে মুখ ঢেকে অঝরে কাঁদতে লাগল। তার চোখের পানি দুই হাতের ফাঁক গলে পড়তে লাগল। এভাবে অনেকক্ষণ আজম সেখানেই বসে রইল। রাত বাড়ছে দেখে দলের অনেক ছেলেপুলেরা বাড়ি চলে গেল। কেউ থাকতে চাইলে আজম ওদের বারণ করে দিলো।
এভাবে ঘন্টা তিনেক পার হওয়ার পর সায়ন বেরিয়ে এলো। কঠিন মুখে আজমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ কাঁদছিস কেন? কে মরেছে তোর?’
-‘ভা…ই, এতকিছু ঘইট্টা গেছে আমি তহন কিছু বুঝি নাই ভাই।’
-‘এখন বুঝেছিস?’
-‘জ্বি ভাই।’
-‘বুঝে কার বা’ল ছিঁড়লি?’
একথা শুনে আজম মাথা নিচু করে নিলো। তার দু’চোখ তখনো ভেজা। ওকে কাঁদতে দেখে সায়ন কেবল হাসল। তারপর আজমের কাঁধজড়িয়ে ধরে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-‘পুরুষ মানুষের এত সহজে হারলে চলে না রে পাগলা। আমাদের বুকটা তৈরি কষ্ট লুফে নেওয়ার জন্যই। পুরুষ হয়ে জন্মেছি, একবার বাপে কষ্ট দিবে, মায়ে কষ্ট দিবে, ভাই-বোনরাও আঘাত পাচ্ছি নাকি খোঁচা মেরে দেখবে, যাকে ভালোবাসি তাকে বাদ রাখাও যাবে না বুঝলি এতে পাপ হবে, পাপ!’
এভাবে হাসতে হাসতে সায়ন অনেক কথা বলল। বাঁচাল আজম চোখের পানি লুকাতে লুকাতে শুধু শুনে গেল। অতঃপর তারা হাঁটতে হাঁটতে এক সময় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কোথায় যে গেল আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
ইরানের রাজধানী তেহরান, সকাল ১০:৩০ মি.
নগ্ন শরীরের কোমরের কাছটায় পাতলা একটি তোয়ালে রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ইয়াসির। লম্বা হাত দুটো দু’দিকে মেলে রাখা।তার মাথা ও দুপায়ের কাছে দাঁড়িয়ে চারজন লাস্যময়ী তরুণী। চারজনই বিদেশী।
গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। মাথাভর্তি সোনালি চুল। পরনে কালো রঙের দুটো টুকরো ছোটো পোশাক। যদিও স্থান, কাল, দেশভেদে এই পোশাক এখানে স্বাভাবিক। তরুণীদের উভয়ের হাতে বডি ম্যাসাজ ওয়েল। তারা
নিজ নিজ ভঙ্গিমায় ইয়াসিরের সারা শরীর ম্যাসাজ করছে। কখনো বা দুষ্টু হেসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে ইয়াসিরের শরীরের একেক অংশ। এতে শক্ত পুরুষালি শরীরে নরম হাতের ছোঁয়ায় ইয়াসিরের যে শুধু ভালো লাগায় কাজ করছে তা নয়। বরং তার দেহ খানাও একটু একটু জেগে উঠছে। চাচ্ছে নারীদেহের সংস্পর্শ। কিন্তু শরীর চাইলেও তার মনটা পড়ে আছে অন্যকিছুতে। তার শরীরের চাওয়া সুন্দরী নারীদেহ হলেও তার মন অন্য গান গাইছে। সে আচমকা বন্ধ চোখ খুলে হাতের কাছে থাকা তরুণীকে
হ্যাঁচকা টানে কাছে আনল। তারপর উল্টো গড়নে নিজের বুকের নিচে পিষে ফেলে একটা কালো ওড়না রাখল মেয়েটার মুখের উপর। চোখ দুটো খোলা রেখে কপাল আর নাক ঢেকে দিয়ে ভালো করে দেখল। না মিলছে না, এই চোখ দুটোও নয়। যেই চোখ সেদিন রাতে সে দেখেছিল সেই চোখদুটো ছিল একেবারেই অন্যরকম। অদ্ভুত রকমের সুন্দর ছিল।
চোখের ভাষা ছিল ধ্বংস করে দেওয়ার মতো। এমনি এমনি সেই চোখের মালিককের নাম দেয় নি __অগ্নিকন্যা।
এই তরণীর চোখের সাথে মিলছে না দেখে ইয়াসির খুব বিরক্ত হলো। সে
মেয়েটিকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে তোয়ালে কোমরে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার জিম করা পেটানো দেহে তেল চপচপ করছে। এখনই শাওয়ার নেওয়া প্রয়োজন ভেবে শিষ বাজাতে বাজাতেই এগোল সুইমিং পুলের দিকে। সুইমিং পুলের নীল জল টলমল করছে। মাথার উপরে মস্ত বড় আকাশের ছবি ভাসলে স্বচ্ছ জলে। সে একলাফে দিতে জল ছিঁটকে পড়ল আশেপাশে। পরপর বেশ কয়েকটা ডুব দিয়ে মাথা নাড়তেই চুলের পানি ছিঁটকে পড়ল আশেপাশে। দম বন্ধ করে পানিতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখল মিনিটের কাঁটা ধরে, রোজকার চর্চা থাকায় খুব একটা কষ্ট হলো না। তবে সে প্রচন্ড অস্থির অন্য কারণে, আগে তার শরীরে ক্ষুধা জাগলে মেয়ের নিয়ে শুয়ে পড়তো আর এখন শরীর জাগলে মেয়ে আনে ঠিকই তবে যখনই কাছে যায় কিংবা পার্টনারের চোখে চোখ পড়ে তখনই কিছু একটা মনে পড়ে মুডটাই চলে যায়।
যা অতি মাত্রায় অসহ্য। কয়েকদিন যাবৎ এসব ঘটছে তার সাথে, মানে হয় এসবের? কে সেই কন্যা? কেনই বা খোঁজ মিলছে না তার? সামান্য দৃষ্টির বান ছুঁড়ে তার মনের সুখ কেড়ে নেওয়ার মানে হয়? শুরুর দিকে মেয়েটাকে খোঁজার জন্য এতটা আগ্রহ
দেখায় নি। তবে আজকাল মনে হচ্ছে মাফিয়াগিরি ছেড়ে সেই মেয়েটার সন্ধানেই বের হতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে সাঁতার কাটতে লাগল সে। ঠোঁটে ফিচেল হাসি। মনে দুষ্টু ভাবনা। মেয়েটা যদি বেঁচে থাকে মুখোমুখি হবেই সে। আর যখন তাকে পাবে একদন্ড শান্তি দেবে না, না শারীরিক ভাবে আর না মানসিকভাবে। তাকে এত প্যারা দেওয়ার শোধ হারে হারে তুলবে।
ইয়াসির যখন এসব ভাবনায় মশগুল তখন তার সহকারী বুরাক দৌড়ে এলো সুইমিংপুলের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঝরঝরে ইংলিশ বলল,
-‘ স্যার, এক্ষুণি আমাদের বাংলাদেশে ফেরা উচিত।’
সহকারী বুরাকের কথা শুনে ইয়াসির ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকিয়ে পুনরায় সাঁতার কাটাতে লাগল। বুরাক নিজেও বুঝল ইয়াসির সিরিয়াস ভাবে নিচ্ছে না তার কথা। তাই পুনরায় আমতা আমতা করে বলল,
-‘শোয়াইব শুদ্ধর ভাই শাহরিয়ার সায়ন আমাদের ডেরায় কাল হামলা করেছিল। মুখোশ পরে হামলা চালানোয় প্রথমে কেউই চিনতে পারে নি পরে জানা গেছে সে সায়ন ছিল।’
ইয়াসিরের হাত-পা ততক্ষণে থেমে গেছে। সে তীরে এসে ভেজা চুল ব্যাক ব্রাশ করতে করতে শীতল কন্ঠে বলল,
-‘হঠাৎ আমাকে সুড়সুড়ি দিলো কেন শালায়?’
-‘ যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হচ্ছে চৌধুরী নিবাসে দুটো সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিলেন সেটার কথা জেনে গেছে। বড় কথা হলো ক্যামেরা সবার প্রথমে নজরে পড়েছিল ওই বাড়ির ছোটো গিন্নির। অবাক করা ব্যাপার,
উনি একথা কাউকে না জানিয়ে দুই মেয়ে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
তারা যাচ্ছে সেনা হাউজে। ‘
-‘ও আই সি…এবার দেখি ফিরতেই হবে। এই নাটকীর পোলাপান নিয়ে আর পারা গেল না। এরা দুভাই আমার পেছনে সুড়সুড়ির না দিলে শান্তি পায় না বোধহয়।চৌধুরীদের ছোটো কন্যা কে যে মধু দিয়ে কত শখ করে খেতে চাইলাম। আবার আমার মুখের খাবার কেড়ে নিলো জাওরা পোলাপান। এবার ফুলটাকে সেনা হাউজ থেকে তোলা রিস্কি হয়ে যাবে।’
-‘কেন স্যার?’
-‘কারণ সেনা হাউজের প্রতিটা গেটে বন্দুক হাতে তোমার বাপরা দাঁড়িয়ে থাকে। তোমার বাপদের টপকে মেয়ে তোলা কি এত সোজা ভেবেছো?’
-‘সরি স্যার।’
-‘যাই হোক, জেট রেডি করো লাঞ্চ সেরে বের হবো।’
-‘জ্বি স্যার।’
একথা বলে বুরাক দ্রুতপায়ে প্রস্থান করল। ইয়াসির জুসের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। হাতের কাছে ওর আরেকটা শুকনো তোয়ালের নিচে থাকা পিস্তলটা নিয়ে শ্যাুট করল বডি ম্যাসেজের করা এক তরুনীর দিকে। নিঁখুত নিশানায় তরুনীর কপাল ফুটো হয়ে বুলেট গিয়ে লাগল পাশের দেওয়ালে। টুং করে শব্দ করে সেটা ছিঁটকে পড়ল আশেপাশে। মেয়েটা সাথে সাথে মেঝেতে ধপ করে পড়ল আর তখনই তার ছিঁটকে পড়ল একটি ক্যামেরা। যেটা দিয়ে এতক্ষণ ইয়াসিরের গতি বিধি রেকর্ড হচ্ছিল। এবং সেটা বাংলাদেশের কেউ নিঁখুতভাবে দেখছিল
এবং নোট করছিল। কিন্তু ধরা পড়ে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তুলের মাত্র একটা বুলেট মেয়েটির প্রাণ কেড়ে নিলো। মেয়েটি খোলা চোখে অদুরে দাঁড়ানো ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। এদিকে, মেয়েটিকে ধরা পড়তে দেখে শুদ্ধ বাংলাদেশে বসে শান্ত চোখে তাকিয়ে শুধু দেখে গেল।
পরেরদিন সকাল সাড়ে আটটা। শীতল থম মেরে বসে আছে তার রুমের সঙ্গে লাগলো বেলকনিতে। চোখজোড়া অশ্রুতে টইটম্বুর। নীবর কান্নায়
গালজোড়া ভিজে আছে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে না মুছতে পরক্ষণেই গাল ভিজে একাকার। হেঁচকিও উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। গতকাল রাতে গাড়িতে খাওয়ার পর কী মরণ ঘুম দিয়েছিল একবারও সজাগ হয় নি। সারারাত বেহুঁশের মতো পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। সকালে সেনা হাউজে প্রবেশের পর নাকি শুদ্ধ পুনরায় ফিরে গেছে। ইশ,মানুষটা সারারাত কষ্ট করে এলো অথচ একবার হাসিমুখে বিদায় জানাতেও পারল না। আবার কবে দেখা পাবে ঠিক নেই। তারা কবে ফিরবে তাও জানে না। এতদিন সে কিভাবে থাকবে মানুষটাকে না দেখে? ফোনে দেখে কি মনে ভরে? না ছুঁয়ে পারে? এভাবে নি থাকা যায়? এমন তো না যে চুপিচুপি করে দেখা করতে আসতে পারবে। এসব ভেবে তার কান্না দ্বিগুন বাড়ল। স্বর্ণ ফ্রেশ হয়ে কান্নারত বোনের কাছে এসে বলল,
-‘ফ্রেশ হয়ে খাবি চল।’
শীতল বোনের কথা শুনে অশ্রু টলটল করা চোখে তাকিয়ে বলল,
-‘শুদ্ধ ভাই কি যাওয়ার সময় আমাকে ডেকেছিল?’
-‘না, আমিই ডাকতে বারণ করেছিলাম। ‘
-‘কেন বারণ করেছিলি? এখন আমার কষ্ট হচ্ছে না? তোকে বলেছিলাম এত পন্ডিতি করতে? না জানি কত কষ্ট পেয়ে ফিরে গেছে মানুষটা।’
-‘বুঝদার মানুষ কষ্ট পাবে কেন শুধু শুধু?’
কথাটা শীতলের পছন্দ হলো না। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘বাবা-মায়ের ভালো মেয়ের অভিনয় তো ভালোই করলি আপু। মেয়ে হিসেবে তুই সর্বেসবা হলেও প্রেমিকা হিসেবে খুব জঘন্য তা কি জানিস?’
-‘জানি।’
-‘তোর কষ্ট হচ্ছে না সায়ন ভাইয়ের জন্য?’
-‘না।’
-‘তুই আসল পাষাণ। তুই জানিস ভাইয়া তোকে ছাড়া থাকতে পারে না তবুও কেন এত কষ্ট দিলি ভাইয়াকে? ভাইয়া কত বড় মুখ করে বলল তুই ভাইয়ার হাত কখনো ছাড়বি না। অথচ তুই কী না সবার আগে ভাইয়ার হাত ছেড়ে দিলি? বাবা-মায়ের ভালো মেয়ে হওয়ার লোভ সামলাতে পারলি না?’
স্বর্ণ বোনের কথা শুনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ বলল,
-‘ধর, এখন খবর পেলি তোর শুদ্ধকে কেউ গুলি করেছে কিংবা রাস্তায় পিষে দিয়েছে। কেমন লাগবে তোর?’
-‘আপু!
শীতল এত জোরে চিৎকার করে আপু বলেছে যেন তার গলার রগ ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বর্ণের দিকে। সামান্য কথাতে বোনকে এভাবে রেগে যেতে দেখে স্বর্ণ শুধু হাসল। তারপর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শীতল বজ্রকঠিন স্বরে বলল,
-‘ সামনে পরিস্থিতি কেমন হবে জানি না। তবে আমি শীতল ওয়াদা করে বলছি, শুদ্ধ ভাই যদি কখনো আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকে আমি তাকে ফিরিয়ে দেবো না। আমার কাছে একদিকে তোরা, আরেকদিকে আমার শুদ্ধ ভাই। আমি তোর মতো করে আমার প্রিয় পুরুষের বুকে ছুরি চালিয়ে ভালো মেয়ে হতে পারব না। বাবা-মায়ের ভালো মেয়ে হতে গিয়ে তার ভালোবাসার দিকে আঙুল উঠাতে পারব না। আর এই মুহূর্তে যা উচ্চারণ করলি ভুলেও আর করিস না আপু, তাহলে আমি ভুলে যাব তুই আমার আপন বড় বোন। যে মানুষটা বর্তমানে আমার মোনাজাতে স্থায়ীভাবে জায়গা দখল করেছে তার মৃত্যুর কথা কল্পনা করতেও পারি না আমি।’
-‘মৃত্যুর কথা বললেই কেউ মরে যায় না বোন।’
-‘না মরুক তবুও তুই বলবি না। আমার শুদ্ধ ভাই, আমার সায়ন ভাইকে নিয়ে তুই কোনো কথা বলবি না। তোর থেকে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না। তুই সেলফিশ, তুই খারাপ, খুব খারাপ। ‘
একথা বলে শীতল কাঁদতে কাঁদতে রুমে চলে গেল। বোনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে স্বর্ণ কেবল হাসল। বাবা আর্মিতে কর্মরত হলেও কখনো সেনানিবাসে আসে নি তারা। ফোনে যতটুকু দেখেছে সেইটুকু তবে আজ স্বচক্ষে ভেতরের পরিবেশ দেখে মনপ্রাণ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। চারপাশটা ছিমছাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানে নারিকেল গাছের সংখ্যা একটু বেশি মনে হচ্ছে। স্বর্নের এসব জায়গা খুব বেশি পছন্দ। সে একা একা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশে দেখে আকাশের দিকে তাকাল। তারপর আকাশের বুকে উড়ে যাওয়া একটা পাখির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
-‘পৃথিবীতে হাজারটা মিথ্যা কথার মাঝে একটা মিথ্যা হলো ‘তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’ আসলে কেউ কারো জন্য মরে না, মরণ এতটাও সোজা না। তুমিও ভাবতে তোমার স্বর্ণকোমলকে ছাড়া বাঁচবে না, শ্বাস
আঁটকে মারা যাবে। কিছুদিন যাক দেখবে তুমি আমাকে ছাড়াই থাকতে
অভ্যস্ত হয়ে গেছো। ভালো থেকো প্রিয়, আমাকে ছাড়াই ভালো থাকতে শেখো।’
একথা বলে স্বর্ণ স্থান ত্যাগ করল। তারপর শীতলকে এত ডেকেও রুমের দরজা খুলাতে পারল না আর না মেয়েটা সারাদিনে মুখে কিচ্ছুটি দিলো। শাহাদত চৌধুরীও ব্যর্থ হয়ে মলিন মুখে চলে গেলেন। এখানে যদি স্বয়ং শারাফাত চৌধুরী হতেন তাহলে মেয়েটাকে দু’বার ডাকতে হতো না। শুধু শারাফাত চৌধুরী যদি দরজায় কড়া নেড়ে বলতেন, ‘মা, আমার শীতল আম্মা কই? খাব তো, এসো মা।’ ব্যস তাতেই কাজ হয়ে যেতো আর হবে নাই বা কেন? বাবাকে কাছে না পেয়ে শারাফাত চৌধুরীর আঙুল ধরেই
হাঁটতে শিখেছে, উনার হাতে খেয়েছে, উনার বুকেই কত রাত ঘুমিয়েছে।
মায়া, টান, জিনিসগুলো অদ্ভুত রকমের। যখন সবাই ব্যর্থ হলো তখনই শাহাদত চৌধুরীর কাছে কল এলো। বড় ভাইয়ের নাম্বার দেখে শাহাদত চৌধুরীর বুক কেঁপে উঠল। তবুও কল রিসিভ করতেই ভেসে উঠল বড় ভাইয়ের মুখ। তবে উনি ভাইয়ের মুখের দিকে তাকানোর সাহস পেলেন না তাই চোরের মতো মুখ কাচুমাচু করতে লাগলেন। শারাফাত চৌধুরী যেন বুঝলেন ভাইয়ের অবস্থা তাই বললেন,
-‘আমার শীতল আম্মা কই? দূরে গিয়ে বড় আব্বুকে ভুলে গেলে চলবে? এই বুড়ো মানুষটার কথা কেউ না ভাবলে কাদের নিয়ে বাঁচব আমি,হুম? ‘শাহাদত চৌধুরী ভেজা স্বরে আর জবাব দিতে পারলেন না। পাশে থাকা সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন তাই স্বর্ণ এসে বাবার হাত থেকে ফোনটা নিলো। নিজে কথা বলল। তারপর শীতলের রুমের দরজায় কড়া নেড়ে বলল,
-‘বোন, বড় আব্বু কথা বলবে। দরজা খোল।’
একথা বলতে দেরি দরজা খুলে ফোন কেড়ে নিতে দেরি হয় নি। এরপর
সে ঠোঁট ভেঙে শব্দ করে কেঁদে তোতাপাখির মতো বলতে থাকল,
-‘বড় আ…আব্বু! বড় আব্বু..আমাকে নিয়ে যাও।’
শীতলকে এভাবে কাঁদতে দেখে শারাফাত চৌধুরী ক্যামেরা ঘুরিয়ে দিলেন অন্যদিকে। তারপর দ্রুত চোখ মুছে ক্যামেরা ঠিক করে আদুরে সুরে বলতে লাগলেন,
-‘আম্মা! আমার আম্মাজান, কাঁদে না মা। খেয়েছো মা? মুখটা শুকনো লাগছে কেন?’
-‘বড় আব্বু আমাকে নিয়ে যাও। আমি এখানে থাকব না। আমি বাড়ি যাব।’
-‘খুব তাড়াতাড়ি আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব, মা। তোমাকে ছাড়া আমাদের বাড়ি অচল। কাঁদে না মা। তুমি কাঁদলে আমরা কি ভালো থাকব বলো?’
একথা বলতেই সিঁতারা ফোন কেড়ে নিলেন। আঁঁচলে চোখ মুছে জোরে জোরে কাউকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলেন,
শেষ চৈত্রের ঘ্রাণ পর্ব ৪৫
-‘আমি কালই শুদ্ধকে পাঠাব তোরা দুবোনই চলে আসবি। আর কে বাড়ি ফিরল না ফিরল এত দেখার সময় নাই। চলে আয়, আমি নিজে তোদের বিয়ে দেবো। দেখি কোন আর্মি আর আর্মির বউ বাঁধা দিতে আসে। দেশে কি আর আইন নাই? নাকি আমরা আইন বুঝি না? বাড়ির মেয়ে দুটোকে নিয়ে গিয়ে লায়েক সাজছে তারা, লায়েক! মেয়ে ওদের একারই আমরা যেন বানের জলে ভেসে গেছি? আমাদের কোল ফাঁকা করবি তো আগে কেন নিয়ে মেয়ে দুটোকে দূরে নিয়ে যাস নি? কেন হিসেব করে বাড়ির সন্তানদেরকে ভালোবাসতে বলিস নি? পেলেপুষে বড় করলাম আমরা এখন আমাদের বুক ফাঁকা করে দিয়ে তারা ভালো বাবা-মা সাজছে, ভালো বাবা-মা।’