সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ১৯

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ১৯
লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

শ্রেয়া ভয়ার্ত দৃষ্টিতে নিজের হাতের দিকে তাকাল। অনুভব করল আজ হৃদস্পন্দন একদম স্বাভাবিক। গতি নিয়ন্ত্রণ হারা হয় নি একটাবারও। কিন্তু মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। ভিতরে ভয়ের রেশ পর্যন্ত নেই, যা আছে সব বাহ্যিক অংশে। জীবনে প্রথমবার এমন পরিস্থিতির,অনুভূতির,ভয়ের মুখোমুখি হলো সে। তূর্য তাড়া দিয়ে বললো,’ চলো। ‘

সামলে ওঠার সুযোগ দিল না বরঞ্চ হাত ধরে স্টেজে নিয়ে আসে তূর্য। সকলের উৎসুক চাহনি নিবদ্ধ দু’জনের দিকে। অনেকেই ইতমধ্যে ফুসুরফাসুর শুরু করে দিয়েছে। এটাই হবার ছিল। যখন কাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফলন না হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে যায়, মানুষের মুখে মুখে সেই বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা টাও যেন শ্রেয়।
মেহরিমা চৌধুরীর মুখে বিস্ময়ের ছাপ বিশদ। এগিয়ে এসে বললেন,’ এসব কি তূর্য?এই মেয়ের হাত ধরে এখানে নিয়ে আসলি কেন?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তূর্য স্মিত হাসে মায়ের দিকে তাকিয়ে। শ্রেয়ার হাত টা ধরে রেখেই বিলম্ব বিহীন সিধা জবাব দেয়,’ বউকে আবার বিয়ে করতে নিয়ে আসলাম। ‘
মেহরিমা আঁতকে উঠলেন,’ বউ?তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?এই মেয়ে তোর বউ হবে কেন?কি আবল তাবল বকছিস?’
‘ মা বিয়েটা হয়ে যাক,তারপর বলব সুস্থ আছি কিনা। আর বউ কিভাবে হলো সেটা আমার চেয়ে তুমি ভালো জানো। অভিনেত্রীর ট্যাগ টা দিতে পারছি না। কারণ আমার কাছে মা যেমনই হোক কঠোর,মিথ্যেবাদী, ছলনাময়ী এসবে মাথা ব্যাথা নেই। সত্য একটাই তুমি আমার মা এবং আমার কাছ থেকে যথেষ্ট সম্মান, ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। ‘
কথাগুলো অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বললো তূর্য। মেহরিমা ছেলের অপর হাত টা হাতের মুঠোয় নিয়ে কেঁদে উঠলেন। নরম কন্ঠে বললেন,

‘ বিয়েটা করিস না। তোর জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে যাবে। তুই জানিস না এই মেয়ে কেমন। তোকে ফেলে বিয়ের পরদিন পালিয়েছিল ও। আবারও ধোঁ-কা দিবে তোকে। ‘
তূর্য হাত বাড়িয়ে মা’য়ের গালে লেগে থাকা জলবিন্দু মুছে দিল। বললো,’ বিয়ে হয়ে গেছে, ভাঙ্গে নি কখনও। বউকে ছাড়ার প্রশ্নই আসে না মা। ওই যে বললাম মা অপরাধ করলেও তার প্রতি সম্মান কমে যাবে না,তেমনি বউ করলেও ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। অবশ্য সে আরেকটা সুযোগ ডিজার্ভ করে। এছাড়া প্রত্যেক মানুষের নেওয়া পদক্ষেপের পেছনে কোনো না কোনো কারণ লুকায়িত থাকে। বাঁধা দিও না প্লিজ। ‘

তূর্যর এত নরম কন্ঠস্বরে চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেক সদস্য অবাক। এত বড় একটা সত্য জানতে পারল অথচ নিস্তেজ আছে তা যেন অবিশ্বাস্য। বাড়ির সবাই বিয়ের কথা লুকাল,বিয়ের পরের সকালে বউ উধাও হয়ে গেল সব জেনেও রাগের বহিঃপ্রকাশ করল না সে। এমনকি চেহারার আকৃতিতে কিঞ্চিৎ ক্রোধ ফোটে ওঠে নি। আয়ুশ ও প্রিয়ু একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। ওরা আজ অন্য কল্পনা করে রেখেছিল কিন্তু তা ভেস্তে দিয়ে তূর্য এভাবে সত্য টেনে হিঁচড়ে সামনে আনবে কস্মিনকালেও ভাবে নি। দু’জনেই আজ যেমন করে হোক তূর্য শ্রেয়ার স্বামী এটা সবার সামনে বলে দিত। হলুদের রাতেই বিয়ে হবে এটা জানতেই প্রিয়ু ইশারায় কথা অব্দি সেড়ে নেয় আয়ুশের সঙ্গে। তূর্য বিয়ে করতে বসলেই ও বলে দিবে তূর্য বিবাহিত। ভরা আসরে বললে তো মেহরিমা এবং অন্যরা বিষয়টা ধামাচাপা দিতে পারবেন না সেটা ভেবেই সিধান্ত নেয়। কিন্তু তূর্য এভাবে জেনে গেল!কিভাবে,কবে মনে হাজারো প্রশ্ন জাগছে।

আয়ুশ তূর্যর মেজাজ,স্বভাব সবকিছুর সাথে একশত ভাগ না হোক অল্পবিস্তর হলেও পরিচিত। এত শীতল ব্যবহার কেমন যেন বাঁধছে মনে। তবুও একদিক থেকে দু’জনের কল্পনা -জল্পনা সফল হলো। ধরণ ভিন্ন ছিল কিন্তু লক্ষ্য ঠিকি নিজের গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে।
তূর্য হাতের বাঁধন টা শক্ত করে অহমিকার উদ্দেশ্যে বললো,
‘ উঠো। ‘
অহমিকার ভয় ভয় কন্ঠ, ‘ আমি কেন উঠব তূর্য? এখন আমাদের বিয়ে না?’
‘ তুমি এতক্ষণ কানে শুনো নি?বয়রা?আমি বিবাহিত। দুই বিয়ে করে দুই বউ পালার টাকা নেই আমার। তাছাড়া দু’সতীনের চুলোচুলি সহ্য করতে পারব না। পরে দেখা যাবে মাথায় রক্ত চড়ে গেছে, যেকোনো একটাকে মাটিতে পুঁতে দিয়েছি। তাই রিস্ক নিতে চাই না। জলদি উঠো। ‘

অহমিকা গোঁ ধরে বসে রইল। কন্ঠে তেজ ঢেলে বলে,’ তুমি এত স্বার্থপর হতে পারো না তূর্য। আমি তোমাকে দিন রাত এক করে মানসিক রোগী থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছি। ভালোবাসি আমি তোমাকে। শ্রেয়া তুমি পাগল বলে ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমাদের তো তুমি অসুস্থ হওয়ার আগেই বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল। তুমি নিজের মুখে বলেছ আমাদের সুন্দর সংসার হবে। আজ তোমার কথার অদলবদল কেন হচ্ছে তূর্য? ‘

‘ কারণ আজ আমি অন্য কারো স্বামী। আর তুমি আমার বুকে লা-থি মেরে যাওয়া প্রথম নারী। ‘
তূর্য প্রতি উত্তর করতেই অহমিকা দাঁড়িয়ে পড়ে। দ্বিধাহীন কন্ঠে বললো,’ তোমার বউও তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাহলে আমার বেলায় অবিচার কেন?’
মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়া। সবকিছু স্বপ্ন ঠেকছে তার নিকট। তূর্য ওর দিকে একবার তাকিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠল,’ প্রেমিকা একবার ছেড়ে গেলে বার বার যেতে পারে কিন্তু বউ!সে একবার বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে গেলেও তাকে দ্বিতীয় বার ধরে বেঁধে আনার ক্ষমতা থাকে। কারণ সে তার স্বামীর বৈধ সম্পদ। ‘

শ্রেয়ার হৃদযন্ত্র টা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। ‘ বৈধ সম্পদ?’ ও তূর্য স্যারের সম্পদ?তবে প্রশ্নের ঝুলি বড় করতে পারল না,তার পূর্বেই তূর্য ওকে নিয়ে আয়ুশ ও প্রিয়ুর সামনে উপস্থিত হলো। আয়ুশের দিকে চেয়ে বললো,’ আমরা আগে বিয়ে করে নিই,তোদের আপত্তি নেই তো?অহমিকার সাথে প্যাঁচাল করতে চাইছি না আপাতত। ‘
আয়ুশের সাবলীল জবাব,’ জিজ্ঞেস করতে হয় ভাই?যেহেতু তোর কয়েকদিনের ছোট আমি তাই তুই-ই আগে বিয়েটা করে নে। ‘
পরক্ষণেই প্রিয়ুকে আদেশের সুরে ডাকে,’ শ্রেয়াকে জায়গা দাও বসতে। ‘

প্রিয়ু খুশিতে গদগদ হয়ে শ্রেয়াকে পাশে বসাল। নিজে উঠল না। বান্ধবী ‘কবুল’ বলবে ও পাশে থেকে শুনবে এটা চিন্তা করেই মন মেজাজ পুলকিত হয়ে উঠছে। নুরুল চৌধুরী ছিলেন এখানে উপস্থিত সব থেকে নিরব দর্শক। তিনি ছেলের কর্মকান্ড দেখে যাচ্ছেন অপলক। আজ যেন ছোট ছেলের মাঝে বড় ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু পার্থক্য সেদিন কার মতোন ছেলের গায়ে হাত তুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন,হারিয়ে ফেলছেন মুখ দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষমতা। অথচ বাড়ির বড় ছেলেকে,ছেলের বউকে বাড়ি হতে বিতাড়িত করা হয়েছে ঠিক এমনই এক কারণবশত। শুধু তিনি নয়,ত্রিহা,ফাতেমা প্রায় সকলেই মেয়েটাকে কখনই বাড়ির বড় বউ বলে পরিচয় দেয় নি,এখনো দেয় না। সময়ের স্রোতে তোহাশও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম যেমন করে ফোন দিয়ে ফিরে আসতে চাইত তা এখন আর হয় না।

তূর্য বাবার সামনে এসে দাঁড়াল। কোনো প্রকার ইতস্তত না করে নম্র গলায় বলে,’ পারমিশন প্রয়োজন নেই, বিয়ে টা আগেই হয়ে গেছে। তবুও একবার অনুমতি চাইছি। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। স্ত্রী,,’
নুরুল সাহেব হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,’ জন সমুখে সিন ক্রিয়েট চাইছি না। আমার বিশ্বাস তুমি তোহাশের মতো ভুল কাউকে জীবনসঙ্গী বানাবে না৷ বিয়েটা সেড়ে নাও। যত কথা হবে সব চৌধুরী বাড়ির চার দেয়ালের মাঝে। ‘

মেহরিমা,ফাতেমা ভয়ে সেঁটে আছেন। রহিমা ওনাকে খোঁচা দিয়ে বললো,’ আম্মা নুরুল ভাইয়ে এবার আপনেরে ছাড়ব না। পানি যে ঘোলা করছেন তার দায় ভার কিন্তু আপনের।’ ফাতেমা শুকনো ঢোক গিললেন। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। না জানি পুনরায় শ্রেয়ার আগমনে কোন ঝড় উঠে চৌধুরী বাড়িতে। তূর্য ও নিজের ছেলের নিশ্চুপতা এই প্রথম দেখলেন। প্রচন্ড ভীত হয়ে আছেন। বাড়ি গিয়েই রোগের বাহানা ধরে পড়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ন্তর আছে বলে মনে হলো না।
কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কিভাবে?কত শত প্রশ্ন!এগুলো শ্রেয়ার মুখের নয়,মনের প্রশ্ন। সকল প্রশ্ন দূরে ঠেলে শ্রেয়া ‘ কবুল’ টা বলেই দিল। আরো একবার!আরেকবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ল নতুন করে। এবার মানুষ টা সামনেই আছে। কবুল বলে বিয়ের আসর ছেড়ে যায় নি। স্পষ্টত দেখছে ও তূর্যকে। কাজী সাহেব রেজিস্ট্রার পত্র সামনে দিয়ে বললে,’ সাইন করে দাও। ‘

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল,আগের বার বিয়েতে রেজিস্ট্রি হয় নি,শুধু ধর্মীয় মতে হয়েছিল। কিন্তু কাবিননামা তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র,তথ্য কোথায় পেল তূর্য?তাকিয়ে দেখল বার্থ সার্টিফিকেট নামটাও ঠিক আছে হুমায়রা তাসনিম। কিন্তু এসব কোথায় পেল?ভার্সিটি থেকে কালেক্ট করেছে?ঠিক কতদিন ধরে জানে তূর্য? তাহলে কি এতদিন যা বলত,কাছে আসত সবকিছু জেনেশুনে? এ মুহুর্তে শ্রেয়ার মাথা ঝিমঝিম করছে। ব্যাথা করছে খুব। বিলম্ব না করে ঝাপসা দৃষ্টিতে কোনোরকমে স্বাক্ষর সম্পন্ন করলো।

চারদিকে হৈচৈ লেগে আছে। রাশেদা তাড়া দিচ্ছেন যত দ্রুত সম্ভব শ্রেয়া ও প্রিয়ু যেন বউ সেজে তৈরি হয়ে থাকে। রাতে এক মুহুর্তের জন্যও চোখে ঘুম নামে নি শ্রেয়ার। চিন্তায় হাত পা কাঁপছিল। ওর মন বলছে আগামীতে কিছুই ভালো হবে না। মেহরিমা,ফাতেমা কেউই মানবে না ওকে। তার চেয়ে বড় কথা তূর্য এত সহজে কেন মানল?কেমন সন্দেহাতীত সবকিছু। বিয়ে হবার পর তূর্য একবারও কাছে আসে নি। কথা বলে নি। সর্বক্ষণ মনে হলো একজন আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে স্ত্রী কে সমাজের সামনে স্বীকৃতি দিয়েছে।
শ্রেয়া ধরফর করে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। সত্যিই কি তাই?তূর্য স্বামীর দায়িত্ব পালন করছে?তাহলে ভালোবাসা কোথায়?ভালো কি আদৌ বাসে?প্রচন্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্ট হচ্ছে মস্তিষ্কে। তূর্যকে বুঝা কঠিন হতে কঠিনতর লাগছে। ভালোবাসা নাকি দায়িত্ব?

বাহিরে রোদে ঝলসে যাবার অবস্থা সবুজ গাছগাছালির। মধ্যাহ্নের প্রহর চলছে। শ্রেয়া ঘুমিয়েছে ভোরের দিকে। এক ঘুমে পুরো সকাল পার করে জাগলো দুপুরে। গতকাল যা ঘটেছে তা ভেবে রাশেদা, প্রিয়ু কেউ ডাকে নি। টেবিলের উপর নাস্তার প্লেট টা পড়ে আছে অবহেলিত হয়ে। প্রিয়ু ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
‘ খেয়ে নে শ্রেয়া তারপর গোসল দিয়ে আয়। এখনই পার্লারের লোক এসে পড়বে। ‘
খিড়কির ধারে দাঁড়িয়ে তপ্ত পরিবেশ অবলোকন করছিল শ্রেয়া। ঘাড় বাঁকিয়ে মৃদুস্বরে আওড়ায়,’ স্যার কে দেখেছিস?’
‘ দেখলাম তো। সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে গেলেন। ওহ্ হ্যাঁ! আয়ুশীর মাধ্যমে তোর বিয়ের বেনারসি অর্নামেন্টস সব পাঠিয়েছেন। রাতে মা বললো, ‘হলুদের কাপড় যা দিয়েছিল তোকে ওইগুলো নাকি তুই পড়িস নি,তার মানে তোর পড়নের গুলো মা’য়ের দেওয়া ছিল না। স্যার দিয়েছিল?’

শ্রেয়া তৎক্ষনাৎ প্রতুত্তর করতে পারে নি। কিয়ৎক্ষণ পর দু’ অধর নড়ে উঠল, ‘ হয়ত। ‘
প্রিয়ু এবার নাস্তার প্লেট থেকে একটা পিঠা হাতে নিয়ে বললো,’ স্যার তোকে ভালোবেসে ফেলেছে শ্রেয়া,নয়ত আড়ালে আবডালে এত যত্ন?’
শ্রেয়ার অন্তঃকরণে বৃষ্টি নামল। শীতল হলো হৃদপিণ্ড। কপোলের উষ্ণতা অনুভব করে নিমেষে। প্রিয়ুর উচ্চারিত বাক্যখানা ফেলে দেবার নয়।

আবারও টুকটুকে লাল বেনারসি জড়িয়ে হাজির হলো শ্রেয়া চৌধুরী বাড়ির সদর দরজায়। পার্থক্য আজ সাথে বধূ বেশে প্রিয়ুও রয়েছে। মেহরিমা,ফাতেমা কাউকেই দেখতে পায় নি ও। শুধু ত্রিহা চৌধুরী ওদের হাসি মুখে বরণ করে নেয়। তূর্য ও আয়ুশ আসে খানিক্ষন পর। আয়ুশী ও রহিমা ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে দিল সবাইকে। শ্রেয়ার পানি পান করতে ইচ্ছে করছিল। গাড়িতে তূর্যর পাশে বসে থাকতে থাকতে কন্ঠনালি শুকিয়ে কাঠ। শব্দহীন ছিল পুরো যাত্রা। তূর্য না চাইল ফিরে,না বলল কিছু। তবে শ্রেয়ার বিদায়ের মুহুর্ত টা জীবনের অনেক বড় পাওয়া ছিল।

বাবা-মা নেই বিধায় প্রথমবার আশ্রমের কেউ ওর জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেলে নি। দ্বিতীয় বার পুরো উল্টো হলো। প্রিয়ুর মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল অনেক। বলল,’ তুই আমাদের বাড়ির মেয়ে,আজ থেকে কখনও বাবার বাড়ি নেই বলে মন খারাপ করবি না। ‘ প্রিয়ুর বাবা তূর্যর হাত ধরে বিনয়ী স্বরে বলে দিলেন,’ আমার মেয়েটাকে এতিম ভেবো না,কখনও মনে করো না তোমার শশুড় বাড়ি নেই। ওকে নিয়ে বেড়াতে আসবে। ‘ আচ্ছা একটু একটু করে কি সব পাওয়া হয়ে যাবে?জীবনের অপূর্ণতার ঘর পূর্ণতায় ভরে উঠবে?ভালোবাসা, সুখ,সংসার সব মিলবে?শ্রেয়ার ধ্যান ভাঙলো আয়ুশী হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিতে।

এক চুমুক দিতেই কর্ণে আসে ত্রিহার কন্ঠস্বর,’ ভাবী কে ডেকে আন আয়ুশী। ‘
সাথে সাথেই আয়ুশীর উত্তর,’ একবার ডাকতে গেলাম না আম্মু? আসবে না বড় আম্মু। সোজাসাপটা ভাবে বলে দিয়েছে। ভাবীদের রুমে দিয়ে আসি?সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে। ‘
ত্রিহা ধিমে যাওয়া কন্ঠে বলল,’ তাই কর। মাও এসেই শুইয়ে পড়লেন। শরীর নাকি ভালো লাগছে না। ওদের বিশ্রামের দরকার। পরে ডাকা যাবে খাবারের জন্য। ‘

রহিমা ও আয়ুশী মিলেঝুলে প্রিয়ু ও শ্রেয়াকে যার যার রুমে দিয়ে আসল। তন্মধ্যে প্রিয়ু এক উদ্ভট নির্লজ্জ কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। শ্রেয়ার কানে কানে বলে ওঠে,’ জা বলে মাফ নেই। সকাল হলেই কিন্তু মধুচন্দ্রিমার কথা শুনব বলে দিলাম। আমিও শুনাবো আমারটা। ‘ শ্রেয়ার তখন লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। মনে পড়ে যায় তূর্যর সেদিন সিঁড়ি ঘরে বলা মধুচন্দ্রিমা নিয়ে বলা একেকটা শব্দাংশ। দেহ শিউরে ওঠে। বুকে দ্রিমদ্রিম শব্দ হয় সেসব কল্পনা করে যা কিছু সময় পেরুলেই বাস্তবে রূপ ধারণ করবে।

অকস্মাৎ বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে শ্রেয়ার সুন্দর, মধুময় ভাবনার জগৎ টা ভেঙে গেল। তিন বছর পূর্বের কথা উদয় হয় মস্তিষ্কে। এমনই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত ছিল,বৃষ্টি ছিল,লাল বেনারসি, ফুলের সৌরভ সবকিছু ছিল। সব একইরকম। আবারো কি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে?আজ সারাদিন, সন্ধ্যা,রাত ভ্যাপসা গরমে পরিপূর্ণ। ঝড় আসতেই পারে। আগের সাথে মিলানো নিছক বোকামি। কি সুন্দর ঘরে বাতি জ্বলছে,রশ্মি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখনো গভীর রাত হয় নি। মুখে পানি ছিটাতে পারলে বেশ শান্তি মিলত। ভেবে নিল তূর্য বললেই ফ্রেশ হয়ে নিবে। অনেক কথা,প্রশ্ন জমে আছে। সেগুলোও বলতে হবে তাকে।

শ্রেয়ার প্রতীক্ষার, মরিয়া অবস্থার অবসান করে তূর্য ঘরে ঢুকে। কোনো প্রকার চাহনি নিক্ষেপ না করেই বলে,’ তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীর শুভেচ্ছা তোমাকে মিসেস শ্রেয়সী। ‘
শ্রেয়া কিংকর্তব্য বিমূঢ়। আজ তাদের বিবাহ বার্ষিকী?কই ওর তো মনে নেই। ভুল গেল। কিন্তু তূর্য কেমন করে জানল? পা গুটিয়ে আরেকটু জড়োসড়ো হয়ে বসে। আঁড়চোখে চেয়ে দেখে তূর্য আলমারি খুলে টি শার্ট বের করে নিচ্ছে সাথে একটা শাড়ি। বড় বড় পা ফেলে শাড়িটা রাখে ঠিক শ্রেয়ার উন্মুক্ত পায়ের কাছে। শ্রেয়া পা আরও গুটিয়ে ফেলে। তূর্য ক্রুর হেসে বলে,

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ১৮

‘ ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আজ আমি পাগল না। তোমাকে চাওয়ার, এই কক্ষে ফিরিয়ে আনার পিছনে শুধু দু’টো কারণ আছে। ‘
চক্ষুদ্বয় তুলে তাকাল শ্রেয়া। প্রশ্নসূচক চাহনি নিক্ষেপ করলো। কেমন ভয়ংকর লাগছে তূর্যর হাসিটা। অভ্যন্তরেের কম্পন বাড়িয়ে চলেছে অনবরত। কারণ নিঃশব্দের হাসিতে ভয় থাকে?এত মারাত্মক হয়?কি হতে পারে কারণগুলো?তূর্য ওর সামনে বসে বিছানার উপর রাখা কোমল হাত টা আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। গাঢ় স্বরে বলে,
‘ এক– তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী।
দুই–হৃদয়ের টান। ‘

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ২০