সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৪

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৪
লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

নেত্রযুগল উঁচানো হলো না আর শ্রেয়ার। সেদিন রাতের কথা মনে পড়ে যায়। তূর্য তাহলে সত্যিই সত্যিই সেই মুহুর্তের রেশ ধরেই রেগেমেগে চলে এসেছে। ভাবনা কি নিছক নয়?ওর বাঁধা দেওয়াতে হয়ত একটু বেশিই আহত হয়েছে মানুষ টা। নয়ত এমন করে খোঁচা মা’রত আজ?

আলোকশূণ্য আঁধারিতে সেদিন তূর্য ওর এতই সন্নিকটে আসে যে অবলীলায় উভয়েই একে অপরের হৃদস্পন্দন মেপে নিতে পারে। ধীরে ধীরে শ্রেয়ার অনুভূত হয় পেটে রাখা হাত টা মৃদু মৃদু চাপ সৃষ্ট করছে। বাড়িয়ে তুলছে ভিতরের অস্থিরতা,গতিহীন অনুভূতিদের। কাঁধ হতে আঁচল টা কিঞ্চিৎ সরতেই মনে মনে জন্ম নেওয়া বাক্য টা বাস্তবায়ন করে শ্রেয়া,’ এটা কি মোহ স্যার?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিস্তব্ধ কক্ষে আরো কঠিন নির্জীব ভাব চলে আসে প্রশ্নটা শ্রেয়ার নিচু স্বর হতে বেরিয়ে আসতেই। তূর্য বিনা বার্তায় সরে যায়। মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে হাত মুঠো করে জিজ্ঞেস করে,
‘ তোমার এটা মোহ লাগলো?

কন্ঠে প্রবল ক্ষোভ, জেদ,রাগের সংমিশ্রণ। তার সঙ্গে আরও একটা জিনিস রয়েছে এবং তা হলো তাচ্ছিল্য ভাব। একে অভিমান নামক শব্দে রূপান্তরিত করলেও খুব একটা ভুল বলে বিবেচিত হবে না। শ্রেয়া এমন করে প্রশ্নটা করতে চায় নি। কিভাবে যে মুখ ফোটে বেরিয়ে এলো তাতে ও নিজেই বিমূঢ়, হতবাক। অল্পস্বল্প, আবছা আলো তে কেঁপে কেঁপে ওঠে ওর কন্ঠনালি,

‘ আপনি ফুলশয্যার রাতে যেসব বলেছিলেন সেগুলো সত্য নাকি এখন যা হচ্ছিল সেগুলো ভুলবশত, আমি বুঝতে পারছিলাম না। ‘
‘ তোমার মতো গাধা বিয়ে করে আজ, এক্ষুণি আরো একবার পস্তালাম। আগে পাগল ছিলাম,সামনেও আবার হতে হবে মনে হচ্ছে। আমি কি নে’শা-খোর যে মাতাল হয়ে কিংবা ভুল করে তোমার কাছে যাবো?অন্য কোনো মেয়ে হলে হাবভাবে, কথার ধরনে এতদিনে সব বুঝে যেত। ঘুমাও। এখন যদি না ঘুমিয়েছ তাহলে পঁচা পানিতে ডুবিয়ে বুদ্ধি বাড়াবো। বেক্কল,গাধী। এই মেয়ে কটা প্রেম করেছো জীবনে? ‘

‘ একটাও না। ‘– বিরস মুখে উচ্চারণ করে শ্রেয়া।
‘ প্রেম করো নি ভালো কথা। মানলাম আমার সাথে প্রেম করার দৃঢ় ইচ্ছে তোমার। তাও বেশ সুন্দর বিষয়। কিন্তু রসায়নে এত কাঁচা হলে চলে?ভিতরে ভিতরে ভালোবেসে ম’রছো, উল্টো স্বামীকে দূরে সরিয়ে দিলে। আমার এতদিনকার কান্ডকলাপে আমাকে অনুভব না করে সবটা মোহ বলে চালালে। ইচ্ছে করছে কষিয়ে থাপ্পড় মা’রি। কিন্তু বউকে মা’রা যাবে না। কষ্ট হলেও সহ্য করতে হবে। ‘

কথাগুলো বলে বেলকনিতে চলে যায় তূর্য। শ্রেয়া সেদিকে চেয়ে থাকে এক দৃষ্টে। কখন দু চক্ষে ঘুম নামে টের পায় না। তবে সকালে ওঠে তূর্যর চলে যাওয়ার বিষয়টা ভাবায় ওকে। দূরত্বে ও বুঝে তূর্যর গাঢ় অভিমানে বলা প্রত্যেক টা বাক্য। পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনও কখনও ছোট্ট একটা প্রশ্নও তীক্ষ্ণ আ-ঘাত হানে কারো কারো অন্তঃস্থলে। শ্রেয়া তো অনুভব করেছিল হৃদয়ের মিলন তবুও কেন থেকে গেল এত সংশয়। তাহলে অনুভূতি কি পরিপূর্ণ ছিল না?
লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ও। ক্ষুদ্র স্মৃতিচারণের অন্ত করে। তূর্য ততক্ষণে দূরত্ব ঘুচিয়ে আরও নিকটস্থে এসে দাঁড়িয়েছে। শ্রেয়া আজ জানে মানুষ টা শুরু থেকেই ওকে চায়। অতিরিক্ত চায়। শুধু তার প্রকাশের ধরন টা ত্যাড়া বাঁকা। তন্মধ্যে তূর্য কড়া কন্ঠে বলে ওঠে,

‘ কি ভেবেছিলে বাঁধা দিয়েছো বলে রেগে চলে এসেছি? তাই মনমরা হয়ে থাকতে সারাক্ষণ?ঠিক মতো না খেয়ে শুকিয়ে হাড্ডি। আমি একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেই তো তোমার সকল হাড্ডি মটমট করে ভেঙে যাবে। ‘
অতীব বিস্ময়াবিষ্ট শ্রেয়া। এ লোক কেমন করে জানলো ও মনমরা থাকত সর্বক্ষণ? এসব রহিমা খালা বলত নাতো?তাহলে ওনার যোগাযোগ থাকত রহিমা খালার সাথে?কিন্তু একটা থেকে যায়। বাড়ির বাদ বাকি কারোর সঙ্গে কেন কথা বলত না?এমনকি আয়ুশের সঙ্গেও না। নাকি স্রেফ ওর সাথেই যোগাযোগ করে নি?প্রচুর পরিমাণে প্রশ্নের জোয়ার শ্রেয়ার অন্দরমহলের ছোট্ট সমুদ্রে। তবে সাহসের অত্যধিক অভাব বোধ করছে ও। কারো সান্নিধ্যে এমনতর ঘটে না। শুধুই এই এক পুরুষের সামনে ভয় ভয় হয়ে ওঠে সবকিছু। স্বাভাবিক গলায় বললো,

‘ আপনি আমার উপর রেগে আসেন নি?’
‘ না। ‘
তূর্য গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। শ্রেয়া এতক্ষণে শ্বাস ফেলতে মোক্ষম সুযোগ পায়। গুটি গুটি, টালমাটাল পা ফেলে সোফার কাছে এসে দাঁড়ায়। তূর্য মাথা এলিয়ে চক্ষুদ্বয় বুঁজে আদেশ স্বরুপ গলায় বললো,’ বসো। ‘
শ্রেয়া সামনের সোফায় বসে। ওর মনের বিষন্নতা কেটে গিয়েছে তূর্যর তার প্রতি কোনো রাগ নেই শুনে। তবে চলে কেন এলে?কিছু একটা তো হয়েছে। এ নিয়ে ওর মনের পাতায় খচখচ আওয়াজের সৃষ্ট হচ্ছে বারংবার।
‘ এলে সেই দুপুরে,আর আমার কাছে আসলে বিকেলে?পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?’

শ্রেয়ার বলতে মন চায়,’ আর প্রস্তুতি?কবে আপনার চেহারা টা দেখবো,গায়ের গন্ধ নাকে মাখবো,গম্ভীর স্বরের আওয়াজ শুনবো সেই চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল প্রতিনিয়ত। ভালোবাসা খুব খারাপ স্যার। তার চেয়েও খারাপ আপনি। আঠারো বছর বয়স থেকে প্রেমে ফেলে দিনের পর দিন হেঁয়ালিপনা। ‘
একটা কথাও শ্রেয়ার মন ভেদ করে কন্ঠনালি পর্যন্ত আসলো না। সংকোচ জড়তা লজ্জা কাটিয়ে এবার আঁখি যুগল মেলে ধরে তূর্যর পানে। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর টা আঁতকে উঠলো। মোচড় দিয়ে উঠলো অন্তর। চোখের সম্মুখে ভাসছে তূর্যর হাতের সাদা ব্যান্ডেজ টা। বসা থেকে ওঠে ব্যগ্র কন্ঠে প্রশ্ন করতে লাগল,

‘ আপনার হাতে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেন?কি হয়েছে? স্যার?’
তূর্যর কপালে ভাঁজ পড়লো। নড়চড় হলো না বিন্দু মাত্র। শুধু হাত বাড়িয়ে ডাকলো,’ এদিকে এসো। ‘
শ্রেয়ার কষ্টে বুক ফেটে জলবিন্দু বেরিয়ে আসবার উপক্রম। চক্ষু কোলও ভিজে ভিজে ওঠেছে। একটু কাছে আসতেই তূর্য হাত টেনে পুরো দেহ টা নিজের বক্ষে চেপে ধরলো। পুতুলের ন্যায় পড়ে আছে শ্রেয়া। ওকে ঠিকঠাক নিজের সাথে জড়িয়ে একপাশে বসালো তূর্য। ঘাড় হেলিয়ে কন্ঠে কাঠিন্য ভাব এনে বললো,

‘ তোমার চোখে পানি জমেছে কেন?কান্না ভীষণ প্রিয় নাকি আমি?যদি আমি হই তবে তুমি কাঁদতে পারবে না। কারণ তোমার ওই চোখ দু’টি আমার প্রিয়। প্রথমবার তোমার প্রতি সন্দেহ জাগিয়েছিল এ কাজলমাখা আঁখি দু’টো। মনে আছে?বাড়িওয়ালার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান? সেদিনই তোমার চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে ফেলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও। হয়ত আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। তা নাহলে বউকে খুঁজে বের করতাম কিভাবে?তোমার ছোট বেলার ছবিতে চোখ গুলো বেশ আকর্ষণ করে আমাকে। সেদিন ছাঁদে তোমার দুই চোখ ভালো করে না দেখলে এখনও বউ খুঁজতেই থাকতাম। অথচ বউ আমার পাশেই থাকত,কাছাকাছি এসে নিঃশ্বাস ফেলত নিঃশব্দে। ‘

শ্রেয়ার বুক চিরে তীব্র আর্তনাদ আসতে চাইছে। ঘুরেফিরে দৃষ্টি তূর্যর ব্যান্ডেজ মোড়ানো হাতের দিকে গিয়ে থামছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেয় সেই স্থান। তূর্য বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
‘ সামান্য তে ভেঙে পড়ো কেন? এটা ছোট্ট একটা এক্সিডেন্টে হয়েছে। লুক এট মি। আ’ম ফাইন। ডিমের বাহানায় ছুটে আসলে আমাকে দেখতে,তা না করে ফ্যাচফ্যাচ করছো। আদর পাওয়ার জন্য ইশারা?’
চট করে হাত সরিয়ে নিয়ে আসে শ্রেয়া। লজ্জায় তবলা বাজছে শ্রবণগ্রন্থিতে। এই মানুষ টা ওর সব ভাবনা বুঝে যায়। মিহি স্বরে বললো,

‘ সত্যি ঠিক আছেন?’
তূর্য এটার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
‘ প্রিয়ু কোথায়?’
‘ আছে,বাসায়ই। ‘
‘ তুমি কি ওর সাথে থাকবে?’
‘ ও তো একা স্যার। ওখানেই থাকি?’
‘ বউ থাকতে একা থাকবো?ইম্পসিবল। প্রিয়ুসহ এই ফ্ল্যাটেই থাকবে। ওটা ছেড়ে দিতে বলবো। রাতে রেডি থেকো দু’জন। বাহিরে যাবো। ‘

শ্রেয়ার এতক্ষণে একটা কথা মনে পড়ে গেল। তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ বাবাকে ফোন দেন না কেন?উনি কথা বলতে চায় আপনার সাথে। ‘
তূর্যর ক্ষিপ্র চাউনিতে মিইয়ে যায় ও তৎক্ষনাৎ। ধ্বক করে ওঠে বুক টা। পাশে বসা মানুষ টার নির্বিকার, নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি,
‘ আমি চাই না। ‘
কিঞ্চিৎ সাহস জোগালো শ্রেয়া। সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘ উনি আপনার বাবা। আপনার ক্ষোভ টা ওনার প্রতি কতটুকু যুক্তি সঙ্গত একদিন বাবা হলে ঠিক বুঝতে পারবেন। ‘
তূর্য ফিচেল হাসলো। অসম্ভব সুন্দর সেই হাসি৷ নিমেষে কোমরে দৃঢ় বাঁধন অনুভব করে শ্রেয়া। নিজেকে আবিষ্কার করে তূর্যর মুখের কাছাকাছি। তূর্যর নেত্রের চাহনি প্রগাঢ়, নির্নিমেষ। আরেকটু নিজের সঙ্গে চেপে নিয়ে লহু স্বরে বলে উঠলো,
‘ তাহলে বাবা বানিয়ে দাও। ‘

ঝক্কি দিয়ে ওঠে শ্রেয়ার সমগ্র কায়া। সেকি ভুল শুনলো?কম্পনের তাড়নায় তূর্যর গলার পিছনে গলিয়ে রাখা হাতের বাঁধন শক্ত করে। তূর্য ওর ওষ্ঠের সন্নিকটে ঠোঁট দুটো নাড়ালো। কন্ঠটা মাদকতায় ভরপুর,
‘ এখান থেকেই তাহলে বাবা হওয়ার প্রসেস টা শুরু হোক। ‘
যতক্ষণে কথাটা কর্ণে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে ধারণ করেছে অত্যন্ত বিলম্ব হয়ে যায়। শিরায় শিরায় বইতে থাকে দমকা হাওয়া। না চাইতেও নখ বিঁধিয়ে দেয় তূর্যর ঘাড়ে। প্রথম ভালোবাসার প্রথম ছোঁয়া আজ ওর দুই অধরে। সেই স্পর্শর প্রখরত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিয়ন্ত্রণহারা স্পন্দনেরা।

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৩

তূর্য ঠোঁটের দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। রক্তিম মুখ খানা লুকালো শ্রেয়া সোফার উপর। এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে এসে তূর্য ফের পাশে বসলো। নরম গলায় বললো,
‘ মুখ তুলো। পানি খেয়ে ভালো করে শ্বাস নাও। ‘

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৫