সবটাই তুমিময় পর্ব ১০ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ১০
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

কেবিনের জানালার ওপারে পুকুর দেখা যায়।মনিমাকে নার্স ঘুমের ঔষুধ দিয়ে গেছে।ঘুমোচ্ছে সে।জানালার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বাইরে দৃষ্টিস্থির করে আছি।পুকুরের স্বচ্ছ পানির অনেকটা জুড়ে ক্ষুদিপানা।সবুজ হয়ে আছে উপরের দিকটা।কোথথেকে এক মাছরাঙা উড়ে এসে ছো মেরে মাছ তুলে নিয়ে গেলো।টনক নড়লো আমার।ওই ক্ষুদিপানার আড়াল থেকেও মাছরাঙাটা ঠিক খুজে নিয়েছে মাছটাকে।যাকে বলে শিকারী ঠিক তার শিকার খুজে নেয়।অজান্তেই বিরবিরিয়ে বলে উঠলাম,

-কিভাবে খুজে পেলো?
-সত্যিই আন্নু,দেশ বিদেশের এতো মেয়ের ভীড়ে এএসএ তোকেই কিভাবে খুজে নিলো?
খুজে নেওয়া।শিকারীর শিকার খুজে নেওয়া।কথাটা ভুল নয়।সত্যিই আমি শিকার।অঙ্কুরের স্বার্থের শিকার।তার শাস্তির শিকার।চোখ বন্ধ করে কান্না আটকালাম কোনোমতে।পিছনে না তাকিয়েই বললাম,
-তুই বাসায় যাসনি?
তানহা এগিয়ে এসে আরো জানালা ঘেষে দাড়ালো একদম।মাথা নিচু করে মৃদ্যু হাসলো।বললো,
-পার্কিং এরিয়া পাস করে যাওয়ার সময় তিহান দেখলো আমার গাড়ির টায়ার ঠিকাছে।বললো গাড়ি ঠিক আছে তোর,ওতেই চলে যা!রিকশা নিয়ে চলে গেছে ও।আমিও চলে যাচ্ছিলাম।কিন্তু গাড়ি স্টার্ট দিতেই এএসএ’র মতো কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম বলে মনে হলো।আস্থা তো দাত ক্যালাতে ক্যালাতে আগেই বেরিয়ে গেছে।তুই একা,তাই…

-বিয়েটা কিভাবে হলো আন্নু?
-কথা বলছিস না কেনো?
-সব নিয়মকানুন মেনেই হয়েছে।
-প্রশ্নটা এটা ছিলো না।যাই হোক,সোজা প্রশ্ন করছি।তুই কেনো করলি বিয়েটা?
-স্পিক আপ আন্নু!
-ওনার প্রোপোজাল ফেলতে পারি নি।
-কেনো?
একটা জোরে শ্বাস নিয়ে গরগর করে বলতে লাগলাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-এএসএ এতো ফেমাস একজন ক্রিকেটার,গুড লুকিং,অনেক বড়লোক আর….
-স্টপ ইট আন্নু!এইসব বুলশিট অন্তত আমার কাছে বলিস না!আমি চিনি তোকে!
-তান্নু আস্তে,মনিমা জেগে যাবে!
-গেলে যাক!সেও তো জানুক,তার আন্নু সবাইকে না জানিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে।
-নাহ্!
-হ্যাঁ,জানুক মনিমা।শুনুক সবটা।তুই তো জানতি আন্নু,মনিমা তিহানকে পছন্দ করে।তারপরেও তুই….
তানহাকে টেনে কেবিনের বাইরে নিয়ে আসলাম।বিরক্তি,রাগ নিয়ে বুকে হাত গুজে অন্যদিক ফিরে তাকালো ও।ওর হাত মুঠো করে বললাম,
-তুইও তো জানিস তান্নু,মনিমা চাইলেও তিহানকে কোনোদিনও আমি মানতে পারতাম না!তবে কেনো তিহানকে এসবে জড়াচ্ছিস?

-বেশ।জড়ালাম না।কিন্তু তাই বলে এভাবে বিয়ে করে নিবি তুই?এসবের কি মানে?মনিমা জানতে পারলে কি হবে ভেবে দেখেছিস?নিজের মা না হলে কি?তার সবটা তো তোকে ঘিরে।তোকে নিয়ে তারও কিছু আশা আকাঙ্ক্ষা,সাধ আহ্লাদ আছে ইয়ার!এখন যদি সে জানতে পারে এভাবে বিয়ে করে নিয়েছিস,তাকে সামলানো…আর এএসএ কে তুই পার্সোনালি কতোটুকোই‌ বা চিনিস?হুট করে সেই বা কেনো প্রোপোজ করে বসলো তোকে?আর তুইও…মানে ডিরেক্ট বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি?রাজি হলেও সেটা একপর্যায়ের ছিলো।তোরা তো বিয়েটাও করে নিয়েছিস আন্নু!
আর সহ্য হলো না আমার।ওকে জরিয়ে ধরে হুহু করে কেদে দিলাম।ফোপাতে ফোপাতে বললাম,

-তান্নু,আ্ আমি বাধ্য হয়ে….
আমাকে ছাড়িয়ে সামনে দাড় করিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ও।বললো,
-মানেহ্?বাধ্য হয়ে মানে কি আন্নু?
আরো জোরে কাদতে লাগলাম আমি।ওউ বাধা দেয়নি।অনেকটা সময় পর চোখ মুছিয়ে দিলো ও আমার।বললো,
-সবটা বল আমাকে আন্নু।কি হয়েছিলো?
চোখমুখ মুছে নাক টেনে নিজেকে সামলে নিলাম।তারপর প্রদীপ সরকারের ওখানে যাওয়া,অঙ্কুরের ম্যাচ ফিক্সিং,আমার ধরা পরে যাওয়া,শাস্তি হিসেবে সেরোগেশনের জন্য আমাকে অঙ্কুরের আটকে রাখা,মনিমার অসুস্থ্যতার কথায় বিয়েটা করতে বাধ্য করা সবটা বললাম ওকে।পাথর হয়ে গেছিলো অনেকটা সময় ওউ।একসময় আস্তে করে বললো,

-এ কেমন শাস্তি?
-ওই যে,ওনার আসল রুপটা জেনে গেছি আমি।উনি প্রদীপ সরকারের মতো জঘন্য একটা মানুষের,মানুষ কেনো বলছি?জুয়ারু!জুয়ারুর সাথে চলাফেরা করেন।টাকার বিনিময়ে ম্যাচ হারবেন।নিজেও খারাপ খেলবেন,টিমকেও মিসলিড করবেন উনি।
-কিন্তু তোর কাছে তো কোনো প্রমান নেই আন্নু।তুই কিচ্ছু প্রমান করতে পারবি না তার বিরুদ্ধে।তবুও কেনো তোকে শাস্তি দিতে যাবে সে?
-হয়তো ভয়।সবটা জেনে অদ্রি কখনোই চুপ থাকবে না।এই চিন্তায়।তার বাচ্চার মা বানিয়ে,তারপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে,চরম শাস্তি দিয়ে নিস্তেজ করে দিতে চান আমাকে।
-আন্নু?
-ওনার দ্বারা সব সম্ভব।সব!

-এএসএ এতোটা খারাপ একজন লোক?এতো বাজেভাবে অপমান করতে চাইছে তোকে?আর যদি অপমানই করবে,তাহলে বিয়েটা কেনো?জোর করতে পারতো তোকে!কি জানি?তোর থেকে লুকোতে পারবো না।তাই বলছি।আজ অবদি তোর সব কাজে,সিদ্ধান্তে একমত ছিলাম তোর সাথে।কিন্তু আজ কেনো যেনো মানতে পারছি না শুধুমাত্র তোর মুখ বন্ধ করবেন বলে এএসএ এসব করছেন।একদমই মানতে পারছি না!
চুপ রইলাম।আর কোনোভাবেই বাইরে থেকে তাকে বিচার করার ভুলটা আমি করছি না।তার সবটা বোঝা শেষ আমার।তানহা আমার কাধে হাত রেখে বললো,

-ডোন্ট ওয়ারি ইয়ার!যা কিছু হয়ে যাক,আমি সবসময় তোর পাশে ছিলাম,আছি,আজীবন থাকবো।মনে রাখবি,আহানিতা দুর্বল ছিলো,অদ্রি নয়।ইউ আর‌ স্ট্রং।হুম?
আবারো জরিয়ে ধরলাম ওকে।তানহা আলতোভাবে কাধে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-কি করবি এবার?কিছু ভেবে দেখেছিস?
কাটকাট গলায় বললান,
-নিজেকে বিসর্জন দেবো।
-মানে?

ওকে ছেড়ে হাত মুঠো করে অন্যদিক ঘুরে দাড়ালাম।ও আবারো সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,
-নিজেকে বিসর্জন দিবি মানে?কি বলতে চাইছিস তুই?
-অঙ্কুরের বেবি চাই তাইতো?দেবো তাকে বেবি।হবো তার বাচ্চার মা।ওই বাসায় যাবো আমি।তাকে বিশ্বাস করাবো,আমি হার মেনে নিয়েছি তার কাছে।আত্মসমর্পন করেছি তার কাছে।ওই বাসায় থেকেই তার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমান যোগাড় করবো।আর তারপর তার ভালোমানুষির মুখোশ সবার সামনে টেনে খুলে দেবো আমি।তার সবটা এক্সপোজ করে দেবো!বিধ্বস্ত করে‌ দেবো তাকে।যেমনটা আমার সুন্দর,সরল,স্বাভাবিক জীবনটার সাথে করতে চেয়েছেন উনি।ঠিক সেভাবে তাকে ভেঙে গুরিয়ে দেবো আমি তান্নু!ক্ষতবিক্ষত করে দেবো তাকে আমি!ক্ষতবিক্ষত করে দেবো!
কাদতে লাগলাম আবারো।তানহা কিছু না বলে শুধু শক্তহাতে জরিয়ে রইলো আমাকে।

মাঝে একটা পুরো দিন কেটে গেছে।মনিমাকে বাসায় নিয়ে এসেছি আগেরদিন।এরমধ্যে অঙ্কুরের কোনো খোজ পাইনি।চাইনিও।মনিমা মোটামুটি সুস্থ্য।তবুও কিচেনে যেতে দেইনি তাকে।তানহাই সকালসকাল ওর বাসায় সার্ভেন্টদের করা রান্না নিয়ে এ বাসায় চলে এসেছিলো।সারাদিন সেগুলোই খাওয়া হয়েছে।আস্থা এসে ফিসফিসিয়ে অঙ্কুরের কথা বলেছে বারবার।তানহা সামলেছে ওকে।সন্ধ্যার কিছুটা পর খাবারসহ তানহার ড্রাইভার এসেছিলো।রাত আর সকালের খাবারটা প্যাক করে দিয়ে তানহাকে নিয়ে গেছে।এ নিয়ে মনিমা বা আমি কেউই কিছুই বলি নি ওকে।ওর এক কথা,আমরাই ওর ফ্যামিলি।রাতে মনিমাকে নিয়ে খাবার খেয়ে শুয়ে পরলাম তাকে জরিয়ে।মনিমা বললো,

-আন্নু?তিহান আসলো না যে?ওকে কিছু বলেছিস তুই?
-না।কিছুই বলিনি।
-এলো না কেনো ছেলেটা?
-ওর বাবা অসুস্থ্য।এজমা বেড়েছে।
-বলিস কি?তাহলে তো….
-তুমি এতোটা হাইপার হয়ো না মনিমা।ঘুমোও।আমি ভার্সিটি থেকে যাবো কাল ওনাকে দেখতে।
মনিমা মুচকি হেসে কপালে চুমো দিলো আমার।তারপর চোখ বন্ধ করে নিলো।অনেকটা সময় পর দেখলাম মনিমা ঘুমিয়ে পরেছে।আস্তেধীরে উঠে আসতে যাবো,সে হাত ধরে ফেললো।চোখ বন্ধ করেই বললো,
-কোথায় যাচ্ছিস?

-পাশের ঘরে।কাল ভার্সিটি যাবো,বইখাতা একটু ছুয়ে দিয়ে আসি?তুমি ঘুমোও নি?
চোখ বন্ধ রেখেই মনিমা হাত ছেড়ে দিলো আমার।বললো,
-বেশি রাত জাগিস না।
গায়ের চাদরটা টেনে দিয়ে চলে এলাম পাশেরুমে।দরজা লাগিয়ে দিলাম।টেবিলের হিডেন ড্রয়ার থেকে নন ট্র্যাকার ফোনটা বের করলাম।কল লাগালাম ভোরের বাংলার এমডি স্যারকে।কল রিসিভ করে ঘুমোঘুমো কন্ঠে উনি বললেন,
-হ্যালো?
-স্যার আমি অদ্রি।
-অ্ অদ্রি?ত্ তুমি?কোথায় তুমি?
-বাসাতেই।আমার কিছু প্রশ্ন আছে স্যার।
-কোথায় ছিলে তুমি?আইমিন এ কয়দিন….
-প্রশ্ন আমি করবো স্যার।বেশি সময় নেবো না আপনার।শুধু এটুকো বলুন,দীপক তালুকদারের নিউজটা ভোরের বাংলা ছেড়ে টিভি চ্যানেলে দেখানো হলো কেনো?

-চুপ করে থাকবেন না স্যার!ওই রিপোর্ট আমি নিজে কভার করেছি।ওটা শুধু আপনার কাছেই থাকার কথা!তাহলে?ভোরের বাংলায় না এসে চারদিন পর ওটা টিভি চ্যানেলে কেনো প্রচার হলো?ওরা কোথায় পেলো রিপোর্টগুলো?
-রিপোর্টগুলো আমিই ওদের দিয়েছি অদ্রি।
-জানি।নইলে আমার করা রিপোর্ট ওরা আর কোথায় পাবে?আপনিই দিয়েছেন এটা বুঝতে বাকি নেই আমার।কিন্তু প্রশ্নটা সেখানেই!কেনো?

-উত্তর আশা করছি আপনার।
-তোমার করা আর কোনো রিপোর্ট ভোরের বাংলা প্রিন্ট করবে না অদ্রি।
-মানেহ্?
-ইটস্ সিম্পল।তুমি আর কোনো রিপোর্ট ভোরের বাংলার জন্য লিখবে না।ইনফ্যাক্ট কোনো রিপোর্টই লিখবে না তুমি।
-কেনো?
-এতে তোমার লাইফরিস্ক আছে অদ্রি!
-এটা আজ নতুন জানছি না আমি স্যার।এটা জেনেই এ প্রফেশনে জরিয়েছি আমি।এ কারনে পিছিয়ে আসার মেয়ে অদ্রি নয়।সত্যিটা বলুন।
-বেশ।তবে এটাই ধরে নাও,এতে আমার লাইফরিস্ক আছে।
-তারমানে কেউ আপনাকে আবারো থ্রেট দিয়েছে?

সবটাই তুমিময় পর্ব ৯

-কিন্তু স্যার,সত্যিটাকে সামনে আনা নিয়ে আপনি তো কোনোদিনই আপোষ করেননি।আজ কেনো এভাবে….
-ভয় পেতে শেখো অদ্রি।এতেই সবার ভালো।ভোরের বাংলা কেনো,কোনো নিউজেই আর জড়িও না নিজেকে।এসব…এসব থেকে দুরে থাকো।আমার সাথে আর কন্টাক্ট করো না।দোয়া রইলো তোমার জন্য।ভালো থেকো।
কলটা কেটে গেলো।তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলাম খানিকটা সময়।মানুষ এতো অল্প সময়ে এভাবে পাল্টে যায় কিভাবে ভাবতেও অবাক লাগে।এবার আমার ফোনটা বেজে উঠলো।নাম্বার না দেখেই রিসিভ করলাম কলটা।ওপাশ থেকে শান্ত আওয়াজ এলো,

-ব্যালকনির দরজাটা খোলো অদ্রি।
ফোন কান থেকে নামিয়ে নাম্বারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।সেইভড্ না,আননোন নাম্বার।কিন্তু গলার স্বরটা অচেনা নয়।কাপাকাপা গলায় বললাম,
-ক্ কে?
-অঙ্কুর।

সবটাই তুমিময় পর্ব ১১