সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৫

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৫
লেখনীতে: মাশফিত্রা মিমুই

খাঁন বাড়িতে এক রাত পার করেই ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে শোভন। জ্যোতি মুখ ভার করে তার উদ্দেশ্যে বললো,”ফেরার জন্য এত তাড়া কেন আপনার? চলুন না আরো দুদিন থেকে যাই এখানে।”
শোভন খুব সহজ ভাবে উত্তরে বললো,”অনেক বেড়ানো হয়েছে আর নয়। অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করে এত ছুটি কাটানো সম্ভব নয় বুঝলে?”

মন খারাপ হলো জ্যোতির। এই মুহূর্তে তার মোটেও ইচ্ছে করছে না ফিরতে। আবার শোভনকে ছাড়াও একা একা থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে। কয়েক মাসেই যে শোভন নামক পুরুষটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। বাধ্য হয়েই যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। কাপড়ের ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে নিচে নামলো শোভন।জ্যোতি তার পেছনে।
আনোয়ারা বেগম ছেলে এবং ছেলের বউকে দেখে শান্ত কণ্ঠে শুধালেন,”কী ব্যাপার?চলে যাচ্ছো নাকি? এলেই তো গতকাল সন্ধ্যায়।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শোভন বললো,”আসলে এখানে আসার কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না। সে অনুযায়ী ছুটিও নেওয়া হয়নি তাই আজই চলে যেতে হবে।”
“ওহ। তাহলে আর কী করার? নাস্তাটা অন্তত করে যাও।”
“সময় নেই হাতে। বাইরে করে নিবো।”
আনোয়ারা বেগম শোভনের কথায় পাত্তা দিলেন না। হাঁক ছেড়ে ডেকে বললেন,”মেজো বউ ওদের খাবারটা টিফিন বাটিতে ভরে ব্যাগে দিয়ে দাও। আর ছোটো বউ তোমায় গতকাল যা বলেছিলাম সে কাজটা কী হয়েছে?”
শাশুড়ির প্রশ্নের প্রতিত্ত্যুরে এলিনা হেসে জবাব দিলো,”হ্যাঁ মা। সব ব্যাগে ভরে রেখেছি। নিয়ে আসবো?”

“হ্যাঁ আনো।”
এলিনা চলে গেলো ভেতরের ঘরে। নিলা দ্রুত হটপটে রুটি তরকারি ভরে দিলো। শোভন বিরক্ত কণ্ঠে বললো,”বললাম তো বাইরে নাস্তা করে নিবো।”
আনোয়ারা বেগম তীক্ষ্ম কণ্ঠে বললেন,”খাঁন বাড়ি থেকে কেউ খালি পেটে বের হয় না। বাড়ির বড়ো ছেলে হিসেবে তোমার উচিত নিয়ম কানুন গুলো মেনে চলা।”

জ্যোতি মনে মনে হেসে নিলো। আর কেউ না পারলেও শাশুড়ি তার স্বামীকে ভালোই জব্দ করতে পারে। এলিনা বেশ বড়ো সাইজের একটা ব্যাগ এনে শাশুড়ির সম্মুখে রাখলো।আনোয়ারা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,”গাড়ি কী চলে এসেছে?”
“হুম। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা।”
“আচ্ছা। ছোটো বউ শাফিনকে গিয়ে বলো এই ব্যাগটা যাতে গাড়িতে গিয়ে উঠিয়ে দিয়ে আসে।”
শোভন তা নাকোচ করে দিয়ে বললো,”কী আছে ব্যাগে? এত বড়ো ব্যাগ এতদূর পর্যন্ত বয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

“কেন সম্ভব নয়? শরীরে কী জোর নেই? জোর থাকুক বা না থাকুক ব্যাগ তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেই হবে।”
রাগে কপাল কুঁচকে নিলো শোভন। আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ হেঁটে হল ঘর পেরিয়ে সদর দরজার দিকে চলে গেলো। এলিনা তখনি শাফিনকে ডাকতে গিয়েছিল। শাফিন হল ঘরে এলো।ব্যাগ হাতে গাড়ির কাছে গেলো। শোভন তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো যেনো কাউকে সে দেখেইনি। গাড়ির ডিকিতে ব্যাগ রেখে ভেতরে চলে এলো শাফিন। দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো কথাই হলো না। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে জ্যোতিও গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি ছেড়ে দিলো চালক।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়েছে শোভন আর জ্যোতির। খাওয়া শেষে মন খারাপ করে বারান্দার দোলনায় বসে আছে জ্যোতি। শোভন তার পাশে এসে বসলো। কিছুক্ষণ স্ত্রীর মুখশ্রীর পানে চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করল,”এখনো মন খারাপ?”
জ্যোতি কোনো উত্তর দিলো না। হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খোলা আকাশের দিকে। স্ত্রীর থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে দমলো না শোভন। আরো পাশ ঘেষে বসলো। যতটুকু দূরত্ব ছিলো তাও এখন আর নেই। সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুটির কুঁচকে নিলো জ্যোতি। পাশ ফিরে তাকালো। শোভন বললো, “এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকলে হবে?”

“আমার মন খারাপ দিয়ে আপনার কী কিছু আসে যায়? আপনি গিয়ে ঘুমান। কাল তো অফিসে যেতে হবে।”
“আমার বউ এদিকে মন খারাপ করে বসে থাকবে আর আমি কিনা ঘুমাবো? তাও কী হয়? এতটা নিষ্ঠুর স্বামীও আমি নই।”
“আপনি নিষ্ঠুর হবেন কেন? আপনি তো পাষাণ লোক। সরুন এখান থেকে ভালো লাগছে না।”

শোভন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জ্যোতির মুখের দিকে। জ্যোতির তাতে কোনো হেরফের নেই। তার মুখে তো মলিনতা ভর করে আছে। তৎক্ষণাৎ শোভন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর একটু ঝুঁকে জ্যোতির কপালে আলতো করে চুম্বন করল।শরীরে এক শীতল শিহরণ খেলে গেলো জ্যোতির। চমকায়িত দৃষ্টিতে তাকালো স্বামীর পানে।

শোভন মুচকি হাসলো। বাতাসে স্ত্রীর মুখের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আবারো পূর্বের স্থানে এসে বসলো। বললো,”এবারও যদি মন খারাপ ভালো না হয় তাহলে কিন্তু আরো দিবো। স্ত্রীর রাগ ভাঙানোটাও তো একটা দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে পড়ে নাকি? এই দায়িত্ব কর্তব্যে হেলা ফেলা করার লোক আমি নই।”
মুহুর্তেই অস্বস্তি বোধ করছে জ্যোতি। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সঙ্গে সঙ্গে। শোভন যে এমন একটা কাজ করবে তা ভাবতেও পারেনি সে। স্ত্রীর নিরবতা দেখে শোভনের ঠোঁটের কোণের হাসি মিলিয়ে গেলো। আবারো প্রশ্ন করল,”কী হলো? কী ভাবছো? এখনো মন খারাপ?”

আঁতকে উঠল জ্যোতি। শুকনো ঢোক গিলে জোরপূর্বক হাসলো। যদি আবারো শোভন একই কাজটা করে ফেলে! তখন কী হবে? কারো কিছু না হলেও জ্যোতির অনেক কিছুই হবে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে উত্তরে বললো,”না তো। আমার মন তো ভালো হয়ে গেছে।”
“ওহ তাহলে টেকনিক কাজে দিয়েছে।”

জ্যোতি উঠে গেলো বসা থেকে। চলে এলো ঘরে। উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মিনমিনে গলায় বললো,”আমি ঘুমাবো। লাইট নিভিয়ে দিন।”
শোভন সঙ্গে সঙ্গে লাইট নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এলো। বললো,”তুমি ঘুমালে আমি কী জেগে জেগে মশা মারবো নাকি? আজব!”
জ্যোতি কোনো প্রতিত্ত্যুর করল না। নিশ্চিন্তে আঁখি বন্ধ করে নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেলো।

রাত পেরিয়ে আবারো নতুন একটি দিনের সূচনা হলো।অনেকক্ষণ আগেই অফিস চলে গেছে শোভন। হাতের কাজ শেষ করে বিছানায় এসে বসলো জ্যোতি। শ্বশুর বাড়ি থেকে সঙ্গে করে আনা ব্যাগটির ভেতরে কী আছে দেখার জন্য তা খুললো। আচারের কয়েকটা বয়াম দেখেই অধরে হাসি ফোটে উঠল জ্যোতির। সঙ্গে সঙ্গে একটা বয়াম খুলে আঙুল দিয়ে কিছুটা চালতার আচার মুখে পুরে নিলো।

আহ! কী স্বাদ। কতদিন পর এই স্বাদটি পেলো জ্যোতি। আচার তার বরাবরই প্রিয় একটা খাবার। শাশুড়ি মা কী সুন্দর কথাটা মাথায় রাখলেন।ভাবতেই আনোয়ারা বেগমের প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে গেলো জ্যোতির।
একেক করে চারটা বয়াম বের করে রাখলো।ভেতরে হাতে বানানো পিঠার থলেও দেখতে পেলো। সবকিছু গোছগাছ করে রান্নাঘরে রেখে এলো জ্যোতি। আনোয়ারা বেগম বারবার বলে দিয়েছিলেন বাড়িতে ফিরে যাতে উনাকে জানানো হয় কিন্তু জ্যোতির আর তা মনে ছিলো না তাই শাশুড়ির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নিলো।

শোভন নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছে। কাজের ফাঁকেই সাজেদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,”নতুন যে একজন বসকে দেখে গেলাম তিনি কোথায়?”
সাজেদ ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই উত্তর দিলো,”তনিমা ম্যাম আসার পরপরই উনি চলে গেছেন।”
“ওহ।”
“কিন্তু আজ তো দেখছি ম্যাম সঠিক সময়ে আসলেনই না। হয়তো আসতে আরো দেরি হতে পারে।”
অতঃপর দুজনে আবারো নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
রাউফুন খাঁন আফসোস করে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“ছেলেটা হুট করে এলো আবার হুট করেই চলে গেলো। দুটো দিন কী থাকা যেতো না?”
“অফিস থেকে কী অতদিনের ছুটি নিয়েছে নাকি? জোর করেছিলাম বিদায় বাধ্য হয়েই এসেছিল।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাউফুন খাঁন। বললেন,”দুটো ছেলেই যদি আমাদের সঙ্গে থাকতো তাহলে কত ভালোই না হতো। ছেলে,ছেলের বউ, নাতি-নাতনি ভরা সংসার থাকতো আমাদের।”

“অতীতের ভুল গুলো যদি না করতে তাহলে হয়তো আজ এই স্বপ্নটাও পূরণ হতো।”
“ভুল যদি না করতাম তাহলে আজ কী তুমি আর আমার শাফিন রেশমী থাকতে?”
“তোমার ভুল কী একটাই ছিলো? শাফিন রেশমীর কাছে হয়তো তুমি একজন আদর্শ বাবা কিন্তু তোমার বাকি দুই ছেলে-মেয়ের কাছে? তাদের কাছে কী আদৌ বাবা হিসেবে তুমি যোগ্য?

তোমার ভুলের পরিমাণ হয়তো গুনে শেষ করা যাবে না।একপাক্ষিক ভাবে কম চেষ্টা তো আর করিনি শোভনকে একেবারের জন্য এ বাড়িতে নিয়ে আসতে। কিন্তু শুরুতে তুমিই তো বাঁধা দিয়েছিলে। সেই যে ছেলেটা আমার রাগ করল আর তার রাগ ভাঙলো না। তবে এখনো সেই চেষ্টাই আমি চালিয়ে যাচ্ছি। পুরোপুরি সফল না হলেও কিছুটা তো হতে পেরেছি। ছেলের জীবন সাজাতে পেরেছি,ছেলে আমার ঘর সংসারে মন দিয়েছে। যখন বলি চলেও আসে এ বাড়িতে এর থেকে আর কী চাওয়ার আছে?”

“হুম। তোমার কপালটা সত্যিই ভালো।”
দুপুরের এ সময়টায় সচরাচর ইভা কখনো জ্যোতির কাছে আসে না। তাহলে এ সময় কলিং বেল বাজছে কেন? এলোটা কে? কলিং বেল বাজার শব্দে জ্যোতি দরজা খুলে দিলো। পরিচিত মুখটি দেখে আশ্চর্য হলো। তনিমা মৃদু হেসে বললো,”ভেতরে আসতে বলবে না?”

“হুম আসুন।” দরজার সম্মুখ থেকে সরে দাঁড়িয়ে তনিমাকে ভেতরে প্রবেশ করার জায়গা করে দিলো।
দরজা আটকে পেছনে ঘুরতেই তনিমাকে সামনে এগিয়ে যেতে দেখতে পেলো জ্যোতি।
তনিমা দুটো ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো।জিজ্ঞেস করল,”তোমাদের বেডরুম কোনটা?”
“বাম পাশেরটা।”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই তনিমা ঢুকে পড়ল ঘরটায়। জ্যোতিও পেছন পেছন গেলো। শোভনের বস এখানে কেন এসেছেন? এভাবেই বা কেন ঘর জুড়ে বিচরণ করছেন? বোধগম্য হচ্ছে না জ্যোতির। পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে তনিমা প্রশংসার সুর তুলে বললো, “বাহ! বেশ সুন্দর করে ঘরটা সাজানো হয়েছে তো। তা কে সাজিয়েছে? তুমি?”
জ্যোতি উত্তর দিলো না।সোজাসুজি প্রশ্ন করল,”উনি তো সময় মতো অফিসে চলে গেছেন তাহলে আপনি এখানে যে? উনি কী জানেন আপনি এখানে এসেছেন? আচ্ছা আপনার কী কোনো কারণে এখানে আসার কথা ছিলো?”

তনিমা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো জ্যোতির দিকে। মুচকি হেসে বিছানার এক কোণে বসলো। বললো, “হাজব্যান্ডকে আপনি বলে সম্বোধন করো? হাহ ব্যাগডেটেড।”
তনিমার কথায় ঠাট্টার আভাস পেলো জ্যোতি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,”সম্বোধন তো সম্বোধনই। কেউ তুমি বলে শান্তি পায় আবার কেউ বা আপনি। আমার আপনি বলতেই ভালো লাগে। আপনি ডেকেই শান্তি পাই। এতে অবশ্য উনারও কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।”

“ভালো কথা বলতে পারো তো দেখছি।”
“মুখ যেহেতু আছে কথা বলাটাই স্বাভাবিক। তা বসুন আমি বরং আপনার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসি।”
“দরকার নেই। আমি এখানে চা খেতে আসিনি।”
“ঠিক আছে। তাহলে ড্রয়িং রুমে চলুন। ওখানেই মেহমানদের বসার স্থান।”

অপমানিত বোধ করল তনিমা। বয়সের থেকেও ছোটো একটা মেয়ের কাছ থেকে অপমানিত হওয়া!বিবেকে বাঁধলো তনিমার।ঘর থেকে বেরিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।জ্যোতিও ঠিক তার সামনে বসেই প্রশ্ন করল,”তা বলুন আপু। কী এমন বলবেন যে একেবারে উনার অগোচরে বাড়ি চলে এসেছেন আমার কাছে।”
তনিমা ভ্রু কুঁচকে নিয়ে বললো,”আপু?”

“এছাড়া আর কী সম্বোধন করবো? আপনি আমার থেকে বয়সে বড়ো সেক্ষেত্রে কিছু একটা বলে তো ডাকতেই হতো। ম্যাম বলে আমি ডাকতে পারবো না কারণ আপনি আমার স্বামীর অফিসের বস আমার নয়।”
“স্মার্ট গার্ল। তা তোমার আর শোভনের বিয়েটা কী এরেঞ্জ ম্যারেজ নাকি?”
“জ্বি।”
“বিয়ের পর থেকেই কী তুমি এখানেই থাকো?”
“কেন বলুন তো?”
“বলতে আপত্তি আছে?”
“না। শ্বশুর বাড়িতে থাকতাম।”
“ওহ। এখানে এসেছো কতদিন হলো?”
“মাস তিনেক হবে।”

মুচকি হাসলো তনিমা। বললো,”তার মানে তোমাদের দাম্পত্য জীবন অতটা ভালো নয়। ওই টিপিক্যাল এরেঞ্জ ম্যারেজ টাইপ। যেখানে স্বামী তার স্ত্রীকে পছন্দ করে না। পরিবারের চাপে বিয়ে।”
জ্যোতির মুখখানা চুপসে গেলো। তনিমা তো ভুল কিছু আর বলেনি। তনিমার অধরের হাসি আরো প্রশস্ত হলো। তীরটা সঠিক নিশানায় গিয়ে লেগেছে। মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললো,”আমি শোভনকে ভালোবাসি।”

চমকালো না জ্যোতি। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তনিমার দিকে। জ্যোতির নিরুৎসাহিত আচরণ পছন্দ হলো না তনিমার। বললো,”শোভনও আমায় অনেক ভালোবাসে। তুমি কী জানো তুমি আমাদের মাঝখানে চলে এসেছো?”
মুচকি হাসলো জ্যোতি। জ্যোতির হাসিতে ভড়কে গেলো তনিমা। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জ্যোতি তার নরম কণ্ঠে বললো,”শোভন আমায় ভালোবাসে না বললেও আমি মেনে নিবো কিন্তু আপনি তো দেখছি উনার চরিত্র নিয়ে কথা বলছেন?এও আবার আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”

“এত বিশ্বাস স্বামীর প্রতি?”
“ভাগ্য করে এত ভালো একটা স্বামী পেয়েছি বিশ্বাস তো থাকবেই। এছাড়া আমার স্বামীর রুচি অতটাও মন্দ নয় যে সে ঘরে স্ত্রী ফেলে আপনার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াবে।”
তনিমা তেতে উঠল। ধমকের সুরে বললো,”তোমার এত বড়ো সাহস! তুমি আমায় অপমান করছো?”

এবারো জ্যোতি নরম স্বরেই উত্তর দিলো,”আপনি আমার বাড়িতে বসে আমার সঙ্গেই গলা উঁচু করে কথা বলছেন? বড়ো সাহস তো আপনার হয়েছে। প্রথমদিন যেদিন আপনার সঙ্গে উনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তখনি আপনার হাবভাব দেখে বুঝেছিলাম আপনার নজর ভালো না।মেয়ে মানুষের এতটা ছ্যাচড়া হওয়া মোটেও উচিত নয়। সেলফ রেসপেক্ট বলেও তো দুটো শব্দ আছে নাকি? শিক্ষিত মানুষের যদি এটা না থাকে তাহলে কী হয়?”

“এবার সত্যি সত্যি তুমি আমায় অপমান করছো। সরাসরি একটা কথা বলছি তোমায়।আমি শোভনকে অনেক ভালোবাসি। এ কদিন অনেক চেষ্টা করেছি ওকে ভুলে যেতে কিন্তু পারিনি আর পারবোও না।তাই তুমি ওকে ছেড়ে দাও। এর বিনিময়ে যা চাইবে আমি তাই দিবো তোমায়।”

“হয় আপনার মাথায় নয় আপনার চরিত্রে সমস্যা আছে। নয়তো কেউ বিবাহিত কোনো ছেলের পেছনে জোকের মতো লাগে? আবার তা কিনা সেই ছেলের স্ত্রীর কাছে প্রকাশ করে? এই হাঁটু সমান বুদ্ধি আর খারাপ চরিত্রে এত বড়ো চাকরি আপনায় দিলো কে? যাই হোক আপনার সঙ্গে কথা বাড়াতে চাইছি না। এখন এখান থেকে বিদায় নিলে ভালো হয়।”

“বিরাট ভুল করছো তুমি।”
“তিন কবুল বলে সবাইকে স্বাক্ষী রেখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি আমরা। হালাল একটি সম্পর্কে আছি সেখানে আপনি কে যে আমাদের মাঝখানে আসতে চাইছেন?কে আপনি যে আপনার জন্য আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে দিবো?মাথা মোটা মহিলা। যান এখান থেকে।”

সবকিছু যে হাতের বাহিরে চলে যাবে মোটেও বুঝতে পারেনি তনিমা। জ্যোতি নামক মেয়েটিকে দেখেই তার সরল সোজা একটা মেয়ে মনে হয়েছে অথচ আজ তার উল্টো রূপ দেখছে। মাথা ঠান্ডা করে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলো তনিমা কিন্তু পারলো না। জ্যোতি তার হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে সদর দরজার সামনে নিয়ে এলো‌। বের করে দিলো ফ্ল্যাট থেকে। তনিমা জ্যোতির দিকে ফিরে বলতে লাগলো,

“শুনো জ্যোতি, তুমি কিন্তু __”
তনিমাকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়েই মুখের উপর দরজা আটকে দিলো জ্যোতি। তার এমন একটা কাজে রাগে তনিমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। এই জীবনে এত অপমানিত হয়তো তাকে আর কখনো হতে হয়নি।

উদাস ভঙিতে বিছানায় বসে আছে জ্যোতি। তনিমার একটা কথায়ও কিছু যায় আসে না তার কারণ সে তার স্বামীকে চিনে, স্বামী সম্পর্কে জানে আবার এও জানে শোভন তাকে মোটেও পছন্দ করতো না। সংসারটাও হয়তো করতে চায়নি।এর পেছনে কোনো কারণ তো অবশ্যই আছে তবে তা মেয়ে ঘটিত নয় বরং অন্য কোনো কারণ। কিন্তু কী সেই কারণ? জ্যোতির মনে একটা প্রশ্ন এলো,”আচ্ছা উনি কী এখনো আমায় ভালোবাসতে পারেননি?”

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৪

উত্তর নেই তার কাছে। তবে আর কষ্ট পাবে না সে। আজ শোভন বাড়ি ফিরলে একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যাবে। আজ সে সরাসরি সব প্রশ্নের উত্তর চাইবে। তাতে যদি শোভন রাগ করে করুক। জ্যোতি মোটেও ভিতু মেয়ে নয়। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর উপর পূর্ণ অধিকার আছে তার।

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৬