সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৪

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৪
লেখনীতে: মাশফিত্রা মিমুই

আজ রাতেও মায়ের সঙ্গে শোয়ার পরিকল্পনা করল জ্যোতি। ঘরে শোভনের জন্য এক জগ পানি রেখে মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। আচমকা পেছন থেকে তার ডান হাতটা টেনে ধরলো শোভন।জ্যোতি স্বামীর দিকে চমকায়িত দৃষ্টিতে তাকালো। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। শোভন প্রশ্ন করল,

“কোথায় যাচ্ছো এখন?”
“মায়ের কাছে।”
“সন্ধ্যে পর্যন্ত তো মায়ের কাছেই ছিলে এখন আবার ওখানে কী?”
“কাল না আপনাকে বললাম মায়ের কাছে ঘুমাবো।”
“তো?”
“আজও ঘুমাবো।”
“গতকাল মায়ের কাছে ঘুমিয়েছো বলে আজও ঘুমাতে হবে নাকি?আজ তুমি আমার কাছে ঘুমাবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো জ্যোতি। জ্যোতির দৃষ্টি অনুসরণ করে থতমত খেয়ে গেলো শোভন। বললো,”তুমি হয়তো আমার কথাটা বুঝতে পারোনি। আমি বলতে চেয়েছি তুমি আজ এখানেই শুয়ে পড়ো। অযথা তোমার মা’কে বিরক্ত করার কী দরকার? ওষুধ খাওয়ার পর তো উনি এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়েন।”

জ্যোতি নিঃশব্দে শোভনের হাতের দিকে তাকালো। শোভন এখনো জ্যোতির হাত পূর্বের ন্যায় ধরে রেখেছে। জ্যোতির চাহনি দেখেই দ্রুত হাতটা ছেড়ে দিলো শোভন। জ্যোতি গিয়ে দরজা আটকে দিলো তারপর বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।
শোভন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। জ্যোতি বললো,
“লাইট নিভিয়ে ঘুমাতে আসুন।”

লাইট নিভিয়ে বিছানায় এলো শোভন। স্ত্রীর পাশে এসে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ নিরবতার পর পাশ ঘেঁষে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তাকে।ঘাড়ে মুখ গুঁজে বললো,”রাগ করেছো?”
কোনো উত্তর দিতে পারলো না জ্যোতি।জড় পদার্থের মতো স্থির হয়ে রইলো। ইতোমধ্যেই ঘেমে গেছে সে। চোখমুখ ভিজে গেছে ঘামে। শোভন তা টের পেলো। উত্তেজিত হয়ে বললো,”তোমার কী গরম লাগছে?”
এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না জ্যোতি। বললো,”পানি খাবো। গলা শুকিয়ে গেছে।”

শোভন এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো। লাইট জ্বালিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে জ্যোতির হাতে দিলো। এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সম্পূর্ণ পানিটুকু পান করল সে। জ্যোতির ওড়না দিয়ে তারই ঘাম মুছে দিতে লাগলো শোভন। মুছতে মুছতে প্রশ্ন করল,

“হঠাৎ করে কী হলো তোমার?”
“মনে হয় প্রেশার বেড়ে গেছে।”
“তোমার প্রেশারের প্রবলেম আছে?”
“এতদিন ছিলো না তবে আজ থেকে না না এই মুহুর্ত থেকে শুরু হয়েছে।”
“কিছুক্ষণ আগেই তো ঠিক ছিলে। তাহলে?”
“আপনি থাকলে কী আর ঠিক থাকা যায়? আমার প্রেশার বাড়িয়েছেন আপনি। সব দোষ আপনার।”

কথাটা বলেই উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল জ্যোতি।শোভন বোকা বনে গেলো। বুঝতে পারলো না, সে করেছেটা কী? আলমারির উপর থেকে হাতপাখা নিয়ে এসে বাতাস করতে লাগলো স্ত্রীকে। জিজ্ঞেস করল,”খুব খারাপ লাগছে?”
“না। আপনি শুয়ে পড়ুন। উপরে ফ্যান চলছে তো। হাতপাখার বাতাসের দরকার নেই।”
“ফ্যান চলার পরেও তো তুমি ঘেমে ভূত হয়ে গেছো এখন বাতাস লাগবে না, বললেই হলো?”

জ্যোতি আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণ বাদে শোভন জ্যোতির কপাল,গাল, গলায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করল। ঘাম শুকিয়ে গেছে। প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাখাটা রেখে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। আজ আর তাকে নির্ঘুম রাত পার করতে হবে না। আজ তার শান্তিতে ঘুম আসবে।

জ্যোতি-শোভন যে এখানে এসেছে প্রায় দুদিন হয়েছে।মিহাদকে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে শোভন। দুজনের মধ্যে অনেক ভাব জমে গেছে এই দুদিনেই। মোবাইলটা বেজে উঠল। স্ক্রীনে চোখ বুলালো শোভন। পরিচিত নাম্বার ভাসছে, চাইলেও উপেক্ষা করতে পারলো না। অগত্যা কল রিসিভ করে সালাম দিলো। অপরপাশ থেকে সালামের জবাব নিয়ে কড়া কণ্ঠে আনোয়ারা বেগম বললেন,”মন দিয়ে শুনো, শ্বশুর বাড়ি বেড়ানো হলে কিন্তু বউকে সঙ্গে নিয়ে এ বাড়িতে চলে আসবে।”
চমকে গেলো শোভন। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

“আপনি জানলেন কীভাবে আমরা যে এখানে এসেছি?”
“তা তোমার জেনে কাজ নেই। যা বলছি তাই করো।”
“ও বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। অফিস থেকে অল্প কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছি। কালই ফিরে যাবো।”
“তুমি আজ কালের মধ্যেই এখানে আসবে। এটাই আমার শেষ কথা। আশা করি আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না।”
সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিলেন আনোয়ারা বেগম। ছেলের কোনো কথা শোনার প্রয়োজন মনে করলেন না। শোভনের মুখে মলিনতা ভর করল। মিহাদের উদ্দেশ্যে বললো,”তোমার ফুপিকে একবার ডেকে আনবে?”

“কেন?”
“একটু দরকার আছে। গিয়ে বলো ফুফা ডাকছে।”
মিহাদ দৌড়ে চলে গেলো সেখান থেকে। জ্যোতি বসে আছে জায়েদা খাতুনের ঘরে। সর্ষের তেল দিয়ে মায়ের হাত-পা মালিশ করছে। মিহাদ সেখানেই এলো। জ্যোতির উদ্দেশ্যে বললো,”ফুপি ফুপি তোমাকে ফুফা ডাকছে।”
“কেন ডাকছে?”

জায়েদা খাতুন বিরক্তির সুর তুলে বললেন,”স্বামী ডাকছে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইয়া যাবি। এত প্রশ্ন কিসের?”
জ্যোতি সেখান থেকে শোভনের কাছে চলে এলো। প্রশ্ন করল,”ডাকলেন কেন?”
“আমরা যে এখানে এসেছি তা মা জানলেন কীভাবে?”

“মা আমায় গতকাল ফোন করেছিলেন। কথার এক ফাঁকে আর কী এখানে আসার কথা বলে দিয়েছি।”
“এত মুখ পাতলা মেয়ে কেন তুমি? বলার আগে আমার অনুমতি নেওয়া উচিত ছিলো না তোমার?”
“এতটুকু বলার জন্যও অনুমতি নিতে হবে? বলাতে কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হুম। আমায় ফোন করে বলেছেন এখানে বেড়ানো শেষ হলে সোজা ওই বাড়িতে যেতে।”
ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠল জ্যোতির। স্ত্রীর আনন্দ দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল শোভনের।বললো,

“খুব খুশি লাগছে মনে হচ্ছে?”
“তা তো লাগবেই কতদিন পর শ্বশুর বাড়িতে যাবো।”
“ওখানে গিয়ে কী লাভ? স্বামী তো সঙ্গেই আছে।”
“যখন স্ত্রীর কথা স্বামীর মনে ছিলো না তখন ওরাই কিন্তু পাশে ছিলো। তাই সম্পর্কে কখনো লাভ-ক্ষতি খুঁজতে নেই।”
চলে গেলো জ্যোতি। শোভন কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। মাঝেমধ্যে শোভনের মুখায়ব দেখেও তার মনে কী চলছে বোঝা বড়ো দায়। কীভাবে পারে অনুভূতি গুলো সবার থেকে আড়াল করে রাখতে?

চাইলেও আনোয়ারা বেগমের কথা ফেলতে পারে না শোভন কিন্তু কেন পারে না এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তার। বাধ্য হয়েই জায়েদা খাতুন, জাহিদ,সম্পার থেকে বিদায় নিয়ে জ্যোতিকে নিয়ে খাঁন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
আনোয়ারা বেগম হল ঘরের সোফায় বসে আছেন। পানের পিক ফেলে হাঁক ছেড়ে বললেন,”ছোটো বউ ছাদ থেকে আচারের বয়াম গুলো নামিয়েছো?”

এলিনা দৌড়ে এলো। উত্তর দিলো,”হ্যাঁ মা নামিয়েছি।”
“তা রান্নাবান্না কত দূর?”
“প্রায় শেষের দিকে। তা হঠাৎ এত আয়োজন কেন মা? যদি বলতেন।”
“তোমার ভাসুর আর বড়ো জা আসছে। মনে হয় না দুয়েক দিনের বেশি থাকবে। তাই এত আয়োজন। ওহ হ্যাঁ যাওয়ার সময় আচারের বয়াম গুলো ব্যাগে ভরে বড়ো বউয়ের সঙ্গে দিয়ে দিও কিন্তু।”
“ঠিক আছে মা।”

আনোয়ারা বেগম মৃদু হাসলেন। কিছু একটা ভেবে বললেন,”বড়ো বউয়ের আচার আবার অনেক পছন্দের। নতুন বউ হয়ে যে বছর এ বাড়িতে পা দিলো সে বছরই নিজ হাতে যত্ন করে আচার বানিয়ে ছাদে রোদ শুকাতে দিয়েছিলাম। মজার ছলে বলেছিলাম, বড়ো বউ একটু চেখে দেখো দেখি কেমন হয়েছে শাশুড়ির হাতে বানানো আচার? সেই যে চাখলো তারপর থেকে এই আচারের কথা ও আর ভুলতে পারেনি। এত প্রশংসা আমি আমার ছেলে মেয়ের থেকেও পাইনি। প্রায় প্রায় জিজ্ঞেস করতো মা আবার আচার দিবেন কবে? তাই এ বছর একটু বেশি করেই কয়েক পদের আচার বানিয়েছি।”
কথা শেষ করে এলিনার দিকে তাকালেন আনোয়ারা বেগম। হাসি মিলিয়ে গেলো মুহূর্তেই। মুখে আবারো গাম্ভীর্য ফোটে উঠল। এলিনা গোমড়া মুখে শুধালো,

“বড়ো ভাবীকে খুব ভালোবাসেন তাই না মা? অথচ উনি আমাদের সবার পরে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে।”
“তোমাদের ভালোবাসি না কে বললো? শুনো বউ আমি হচ্ছি একজন মা, মায়ের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি সন্তানই সমান। সন্তানদের প্রতি ভালোবাসাও সমান। তোমাদের কিন্তু কখনোই আমি ছেলের বউয়ের চোখে দেখিনি। তোমরা প্রত্যেকে আমার একেকটা সন্তান তাই তো ভুল করলে শাসন করি। এই যে তোমরা সবসময় আমার কাছেই থাকো তাই হয়তো ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারো না।”

এলিনা কিছু বললো না। শাশুড়ির মুখের উপর কথা বলার দুঃসাহসিকতা কোনো কালেই তাদের ছিলো না। তবে কখনো সখনো কেমন এক টান অনুভব করে,মনে লুকায়িত কথাগুলোও প্রকাশ করে ফেলে। পুত্রবধূর নিরবতা দেখে আনোয়ারা বেগম বললেন,
“তোমার তো আবার আচার পছন্দ নয়। তাই তোমার জন্যে পাকা আম রেখে দিয়েছি।আমার ঘরের খাটের তলায় বস্তার উপর রাখা আছে। রান্না শেষে নিজ দায়িত্বে যতগুলো প্রয়োজন নিয়ে যেও কিন্তু।”

এলিনা চমকে গেলো। চোখের কোণে পানির অস্তিত্ব টের পেলো। বর্তমান সময়ে যৌথ পরিবার টিকিয়ে রাখা খুবই শক্তপোক্ত একটা কাজ। সেখানে বলতে গেলে পুরো খাঁন বাড়ির মানুষরা এই একজন মানুষের জন্যই এখনো এক শিকড়ে আবদ্ধ রয়েছে। বাড়ির কে কোথায় যাচ্ছে, কে কী করছে, রান্নাবান্না, সবার পছন্দ অপছন্দ সবকিছুর খবরই আনোয়ারা বেগম রাখেন।এতকিছুর মধ্যেও পুত্রবধূর এই সামান্য পছন্দ অপছন্দের কথাটা মনে রেখেছেন তিনি?ভাবতেই কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করল এলিনার মনে।

অথচ সেই কিনা এই শাশুড়ির থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছে,হতে চেয়েছে আলাদা, শুধু কাজ আর জবাবদিহিতার ভয়ে? ভেতরে ভেতরে অনুতপ্ত হলো এলিনা। শাফিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল মনে মনে। ভাগ্যিস শাফিন সেদিন তার অন্যায় আবদার মেনে না নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল তাই তো এখনো এই ভালোবাসা, মমতা থেকে বঞ্চিত হয়নি সে। এলিনা আবারো রান্নাঘরে চলে গেলো।

শোভন আর জ্যোতি পৌঁছে গেছে খাঁন বাড়ি। শোভন গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে পেছন ঘুরতেই জ্যোতির দেখা পেলো না। জ্যোতি গাড়ি থেকে নেমেই ভেতরে প্রবেশ করল। সদর দরজা পেরিয়ে হল ঘরে পা রাখতেই শাশুড়ির দেখা পেলো। দ্রুত সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। লম্বা করে সালাম দিলো,”আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু মা।”
আনোয়ারা বেগম খুব স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলেন”ওয়া আলাইকুমুসসালাম।”

“কেমন আছেন মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
ততক্ষণে শোভনও ভেতরে প্রবেশ করল। আনোয়ারা বেগমকে সালাম দিলো। উনি সালামের জবাব নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য বললেন,”এখন ঘরে যাও। বাইরের কাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে নাও। বিশ্রাম করো। পরে না হয় কথা হবে।”

আর বিলম্ব না করে শোভন ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। জ্যোতি তার পেছন পেছন যাওয়া ধরলো। ঘরে এসে পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে আবারো ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো জ্যোতি। পেছন থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শোভন স্ত্রীর দিকে তাকালো। গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,”এখন আবার কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
জ্যোতি পথেই দাঁড়িয়ে পড়ল। বললো,”নিচে।”

“সবে একটা জায়গা থেকে এলে একটু তো জিড়িয়ে নাও।”
“আমার তো একটুও ক্লান্ত লাগছে না।”
“তোমাকে বোঝা তো দেখছি খুবই কঠিন একটা কাজ। একেক সময় একেক কথা বলো।”
“আপনি বিশ্রাম নিন আমি আসছি।”
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না জ্যোতি। চলে গেলো নিচে।শোভন ভাষাহীন হয়ে গেলো।ভাবতেই নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করল,”কেমন স্বামী আমি? নিজের এই একটামাত্র বউয়ের মতিগতিই ঠিকমতো বুঝতে পারি না!”
জ্যোতি সোজা রান্নাঘরে এলো। নিলা এবং এলিনার দেখা পেয়ে গেলো সেখানেই। স্মিত হেসে ওদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,”কেমন আছো তোমরা?”

এলিনা মৃদু হেসে উত্তর দিলো,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাবী। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
নিলা শুনেও না শোনার ভান করল। ছেলের বাড়ি ফেরার সংবাদ শুনে রাউফুন খাঁনের চোখমুখে আনন্দের রেশ ফোটে উঠেছে। ছেলেকে দেখার জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠেছে।
স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,”তা তোমার বড়ো ছেলে এখন কোথায়?”
“ঘরে আছে।”
“ওহ।”

সন্ধ্যায় বাহিরে বের হয়েছিল শোভন।ফিরতে ফিরতে নয়টা বেজে গেছে।ঘরে প্রবেশ করতেই স্ত্রীর সম্মুখীন হলো। জ্যোতি স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,”এত দেরি হলো কেন আসতে? কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?”
“তোমায় বলবো কেন?”
“অবশ্যই বলতে হবে কারণ আমি আপনার ওয়াইফ।”
“বাহ! ওয়াইফগিরি দেখানো হচ্ছে?”
“ওয়াইফগিরি কোথায় দেখালাম?”

“এই যে কৈফিয়ত চাইছো।”
“আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কিন্তু। তাড়াতাড়ি বলুন কোথায় ছিলেন।”
“বলেছি তো বলবো না।”
“আপনি তো দেখছি চরম।” এতটুকু বলেই থেমে গেলো জ্যোতি।
শোভন ভ্রু কুঁচকে বললো,”চরম কী? বেয়াদব?”

ভড়কে গেলো জ্যোতি‌। ভিতু কণ্ঠে বললো,”না না আমি মোটেও এটা ভাবিনি আর বলিওনি।”
“আলবাদ তুমি বলেছো। ছি ছি স্বামীর প্রতি কোনো সম্মান নেই।”
মুখখানা চুপসে গেলো জ্যোতির।শোভনকে সে জেদি বলতে চেয়েছিল কিন্তু উল্টো পিঠে যদি শোভন রাগ করে সে জন্য কথার মাঝেই থেমে গেছে কিন্তু এ তো অন্যদিকে মোড় নিলো। শোভন ভুল বুঝলো তাকে? জ্যোতি অপরাধী কণ্ঠে বলতে লাগলো,”বিশ্বাস করুন আমি এ কথাটা বলা তো দূরে থাক মনে মনেও ভাবিনি।”

শোভন তার তর্জনী আঙুল জ্যোতির ঠোঁটে রাখলো। বললো,”হুস। এত সিরিয়াস নেওয়ার কী আছে?আমি তো জানি তুমি আমার সম্বন্ধে এসব ভাবতেই পারো না। এতক্ষণ তো আমি মজা করছিলাম তোমার সঙ্গে।”
শোভনের স্পর্শে বরফের মতো জমে গেছে জ্যোতি। নড়চড় বিহীন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।শোভন হয়তো স্ত্রীর অবস্থা বুঝতে পারলো তাই আঙুল সরিয়ে নিয়ে বিছানায় গিয়ে আরাম করে বসলো। জ্যোতির তাতেও নড়চড় নেই। শোভন দম ফেলে আফসোস করে বললো,”এতটুকুতেই যদি তোমার আধমরা অবস্থা হয়ে যায় তাহলে তুমি আমার সঙ্গে সারাটা জীবন সংসার করবে কী করে জ্যোতি?”

বেশ লজ্জা পেলো জ্যোতি। দ্রুত স্থানটি ত্যাগ করল। স্ত্রীর এহেম কান্ডে মুচকি হাসলো শোভন। জ্যোতির এই লাজুক মুখশ্রী কেন জানি খুব ভালো লাগে তার। এই ভালো লাগাটাই কী ভালোবাসা? হয়তো।তবে এই ভালোবাসায় নেই কোনো খাদ,নেই কোনো পাপ আর না আছে নিষেধাজ্ঞা। এ তো হালাল সম্পর্কের হালাল ভালোবাসা। যে ভালোবাসার মানুষটি স্বয়ং মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এসেছে। তাই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো রবের নিকট ছেড়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। একমাত্র রব-ই তো আমাদের থেকেও আমাদের সম্পর্কে ভালো জানেন। একমাত্র রব-ই তো জানেন কিসে আমাদের ভালো আর কিসে আমাদের মন্দ। শোভন মনে মনে শোকর আদায় করল।

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৩

(নোটস: জ্যোতি চরিত্রটি মোটেও বোকা অথবা ভিতু কোনো মেয়ের নয়। জ্যোতি হচ্ছে এমন একটি মেয়ে যে নিজের অনুভূতি গুলো সহজে প্রকাশ করতে পারে না। যে বাস্তব জীবন নিয়ে ভেবে নিজের চঞ্চলতা গুলো প্রকাশ করতে পারে না। এই চরিত্রটি এমন ভাবেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি তবে কতটা সফল হতে পেরেছি তা পাঠকরা জানেন। )

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৫