লুকানো অনুরক্তি পর্ব ৭

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ৭
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

মাহফুজের রুম থেকে এসে মাত্রই শুয়েছে অবনি। আচমকা নাদিয়া বলে উঠলো,
‘বাব্বাহ্! প্রেম তো জমে খির। ভাই আমার রাত বিরাতে কেক বানাচ্ছে। প্রেমিকাকে ডেকে নিয়ে খাওয়াচ্ছে। তা মাকে বলবো নাকি তার ঘরে বউ আসার সময় হয়েছে? নাকি বলবো, আমার ফুপি হওয়ার মন চাইছে খুব? শিখিয়ে দে না প্লিজ!’
অবনি জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। কথা বাড়ালেই নাদিয়া মজা নেওয়া শুরু করবে।

একটা ডিল কনফার্ম করতে এসেছে সাইফুল আর মাহফুজ। মিটিং ফিক্স করা হয়েছে রেস্টুরেন্টে। ক্লায়েন্ট আসতে অনেক দেরি। দু’কাপ কফি অর্ডার করে দুজনেই আলোচনা করতে লাগল কিভাবে প্রজেক্টটা প্রেজেন্ট করবে। কিভাবে প্রেজেন্ট করলে ক্লায়েন্টদের পছন্দ হবে। বস বিশ্বাস করে দুজনকে দায়িত্ব দিয়েছে। ডিলটা কনফার্ম করতেই হবে।
আচমকা অবনির কন্ঠস্বর পেয়ে চমকায় মাহফুজ। মনে ভুল ভেবে ফাইলে মনোযোগ দিলো। অবনির হাসির শব্দ পুনরায় কানে আসতেই আশেপাশে নজর বুলায় সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অদূরে বসে আছে অবনি। সূঁচালো হয় মাহফুজের চাহনি। ভাবলো হয়তো নাদিয়ার সাথে খেতে এসেছে। কিন্তু পরক্ষণে সেদিনের সেই ছেলেকে দেখে স্থির হয় চাহনি। শান্ত চোখে নিনির্মেষ তাকিয়ে রইলো। চোখে না আছে রাগ না আছে ক্রোধ। জোয়ারের আগে নদী যেমন শান্ত থাকে ঠিক তেমন।
নিজের মতো বকবক করে যাচ্ছে সাইফুল। মাহফুজের সাড়াশব্দ না পেয়ে বলে,

‘কিরে কথা বলছিস না কেন?’
মাথা তুলে তাকাতেই দেখল মাহফুজ অন্যদিকে স্তিমিত চোখে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে নেত্রপাত করতে নজরে এলো অবনিকে। অবনির পাশে ছেলেটা কে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে।
‘অবনি না এটা?’

প্রশ্নটা শুনলো না মাহফুজ। তার মন এখানে নেই। তার মন খিলখিল করে হাসতে থাকা অবনির দিকে।প্রানখোলা হাসিতে মেয়েটাকে কেমন মিষ্টি লাগে। অথচ তার মুখোমুখি হলেই মেয়েটা মুখটা গম্ভীর করে রাখে। তার সাথে এভাবে কখনো হাসেনি।সাইফুল কাঁধে হাত রাখতেই চমকায় সে।
‘অবনির পাশে ছেলেটা কে? চিনিস?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহফুজ জবাব দেয়, ‘চিনি না।’

মোবাইল বের করে ডায়াল করে নাদিয়ার নাম্বারে। সাথে সাথেই রিসিভ করে সে। মাহফুজ কোনো ভণিতা ছাড়াই প্রশ্ন করল,
‘অবনি কোথায়?’
মাত্রই বাসায় ফিরেছে নাদিয়া। ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে মুখ টিপে হাসল সে।
‘অবনির নাকি কি কাজ আছে। কাজ শেষ হতে নাকি দেরি হবে আমার ভালো লাগছিল না। তাই বাসায় চলে এসেছি।’
‘জিজ্ঞেস করিসনি কি কাজ?’

‘হবে হয়তো কোনো দরকারী কাজ। তাই আর জানতে চাইনি।’
আর কথা না বাড়িয়ে কল কে’টে দেয় মাহফুজ। শুকনো গলায় বলল,
‘দরকারী কাজ রেস্টুরেন্টে। তাও একটা ছেলের সাথে। ভালো।’
‘কিচ্ছু বলবি না তুই ওকে?’
‘কি বলবো? ও তো আর ছোট না। যার যার পছন্দ থাকতেই পারে। কাজে কন্সেন্ট্রেট কর। ডিলটা আমাদের কনফার্ম করতেই হবে।’

মিটিংয়ের সময় বদলেছে। এখন হবে না। রাতে আসবে তারা। আর রাতেই মিটিং হবে। বিরক্ত হয় দু’জনই।
‘শা*লার বড় বড় কোম্পানি গুলো নিজেদের কি ভাবে কে জানে। সবকিছু রেডি করলাম আর এখন বলে আসবে না।’ সাইফুলের কন্ঠে রাগের আভাস।
ফাইলগুলো ব্যাগে নিয়ে মাহফুজ বলে,

‘সে যাই বল আরো একটু সময় পেলাম প্রজেক্টটাকে আরো একটু গোছানোর। এই প্রজেক্টটা কিন্তু তোর আর আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট। প্রমোশনের ব্যপার আছে।’
তারপর আশেপাশে ওয়েটারকে খুঁজলো। দুই টেবিল পরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। মাহফুজ বড় গলায় ডাকল
‘এক্সকিউজ মি!’

সোহেলের সাথে কথা বলার মাঝখানে সহসা মাহফুজের আওয়াজ পেয়ে চমৎকৃত হয় অবনি। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো তার। যদি তাকে আবারও সোহেলের সাথে দেখে কোনো সিনক্রিয়েট করে মাহফুজ? ভয়ে বুকের ধুকপুকানি শুরু হলো। চোখেমুখে ভর করে আতঙ্ক।
‘এনিথিং রং অবনি? এমন করছো কেন?’
ভয়ে গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না তার। তবে এই ভয়টা কেন পাচ্ছে? মানুষটা কষ্ট পাবে বলে?
‘আরে তুই ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?’

র*ক্তশূণ্য হয়ে পড়ে অবনির মুখ। ওদিক বলতে তাদের দিকেই বুঝিয়েছে তা আর বুঝার বাকি নেই অবনির। ঘামতে লাগল সে। মাহফুজ কি তবে রাগারাগি করবে?
তবে অবনিকে চমকে দিয়ে রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল মাহফুজ।
‘কি হয়েছে অবনি? শরীর খারাপ লাগছে? কিছু বলছো না কেন? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো?’

অসহায় চোখে তাকায় অবনি। তার অন্তঃস্থলে অদৃশ্য ঝড়ের যে তান্ডব চলছে তা সে কাউকে বলতে পারবে না।
ক্ষণকাল বাদে তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় মাহফুজ। গলা শুকিয়ে এলো অবনির। ভয়ার্ত চোখে তাকায় একবার মাহফুজের দিকে। চোখে চোখ পড়ে দু’জনের।
অবনির চোখে ভীতি থাকলেও মাহফুজের দৃষ্টি একেবারে শান্ত। দু’জনের দিকে এক পলক তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল সে।

মাহফুজের এমন নীরবতা অবনির ভয়টাকে আরো দ্বিগুণ করে দিল। রাগ ঝাড়লেও এতটা ভয় হতো না যতটা ভয় না তার নিস্তেজ চাহনি দিয়ে গেছে। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায় সে। ব্যাগটা কাঁধে নিতে সোহেল বলে,
‘ওমা চলে যাচ্ছো? আমার কথা শেষ হয়নি তো।’
‘অন্য একদিন কথা হবে। আমায় এখন উঠতে হবে।’
একছুটে বাইরে গেল। মাহফুজকে বলতে হবে তাদের মাঝে কিছু নেই। কিন্তু সে বেরুতে বেরুতে মাহফুজ চলে গেছে।

আজকে পড়ায় মনোযোগ নেই অবনির। নখ খুঁটছে সে। সন্ধ্যা পেরিয়েছে সেই কখন। কিন্তু মাহফুজের আসার নাম নেই। সে উৎকন্ঠা হয়ে আছে মাহফুজকে সবটা বলার জন্য।
আফসানা খানম ওদের রুমে এলেন।
‘আজ মাহফুজের আসতে দেরি হবে। আমিও একটু পরে ঘুমিয়ে যাবো। শরীরটা ভালো লাগছে না। নাদু কলিং বেল বাজলে দরজা খুলে দিস আর তোর ভাইকে খাবার গরম করে দিস। আমি গেলাম। মনে হচ্ছে এখন একটু না ঘুমালে মাথা ফে*টে যাবে ব্যথায়।’

বলে তিনি চলে গেলেন।
একটু একটু করে সময় বাড়ছে। ঘড়ির ডংডং শব্দে ধ্যান ভাঙে অবনির।বারোটা বাজে। কিন্তু এখনো মাহফুজ আসেনি। পরপর কয়েকবার হাই তুলে নাদিয়া।
‘বইটা হাতে নিলে আমি আর চোখেমুখে পথ দেখি না। কোথা থেকে যে এতো ঘুম আসে।’
‘তোর ভাইকে কল করে দেখ কোথায় আছে।’

নাদিয়া দুইবার কল দিলেও রেসপন্স করেনি মাহফুজ।
‘বোন আমি গেলাম ঘুমের দেশে। আর পারছি না। বইয়ের লেখায় নিশ্চয়ই ঘুমের ঔষধ আছে। তোর লাভার আসলে দরজা খুলে দিস। তোদের মাঝে আর হাড্ডি হলাম না।’
‘তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস নাদিয়া।’

অবনির কথাকে তোয়াক্কা করলো না নাদিয়া। বালিশ জড়িয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে। ঘুম নেই অবনির চোখে। টেনশনে ঘুম আসছে না তার। মিনিট দশেক যেতেই নাদিয়ার ফোন বেজে উঠলো।
অবনি ডাকে নাদিয়াকে। ঘুম জড়ানো চোখে তাকায় সে। চোখ দুইটা টকটকে লাল।
‘তোর ভাই ফোন করেছে। ফিরেছে নিশ্চয়ই।’
নাদিয়া ‘হুম’ বলে আবারও ঘুমিয়ে গেল।
ততক্ষণে কল কে’টে পুনরায় বাজতে লাগল মোবাইল। অবনি ভয়ে ভয়ে রিসিভ করে।
‘নাদু দরজা খোল। আমি এসেছি।’

ব্যস এইটুকু বলেই কল কে’টে দেয় মাহফুজ।
অবনি গুটি গুটি পায়ে গিয়ে দরজা খুলল। মাহফুজ উবু হয়ে জুতো খুলছে।
‘তাড়াতাড়ি খাবার গরম কর। পেটে ভীষণ খিদে।’
মাথা তুলে তাকাতেই চমকায় মাহফুজ। তপ্ত শ্বাস ফেলে পুনরায় বলে,
‘ওহ্ তুই? আমি ভাবলাম নাদু বুঝি। যা ঘুমিয়ে পড়। খিদে নেই আমার।’
‘একটু আগেই তো বললে,,,
‘ভুল বলেছি।’
বলে গটগটিয়ে নিজের রুমে চলে গেল মাহফুজ।

বিশ মিনিট পরে মাহফুজের দরজায় টোকা দেয় অবনি। রিনরিনে গলায় প্রশ্ন করল,
‘হয়েছে তোমার?’
ভেতর থেকে জবাব এলো না। অবনি পুনরায় বলে,
‘আসবো ভেতরে?’
এবারেও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
সাহস করে রুমে ঢুকে পড়ে অবনি। মাহফুজ মশারী টানাচ্ছে।
‘খাবার গরম করেছি। খাবে চলো।’

‘বলেছি না খাবো না। আমার জন্য খাবার গরম করতে গেলি কেন?’
‘গরম যখন করেই ফেলেছি। অল্প খেয়ে নাও।’
নিজের ভেতরকার চাপা অভিমান অবনিকে দেখাতে চাইছে না মাহফুজ। মেয়েটাকে দেখলে অভিমানটা তাজা হয়ে উঠছে।
‘রাতে না খেয়ে থাকতে নেই।’
মাহফুজ রাশভারী স্বরে বলে,
‘তুই যা আমি আসছি।’

খাবার বেড়েছে অবনি। মাহফুজ এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা এসেই খাওয়া শুরু করলো। অবনি হাত কচলে আমতাআমতা করতে লাগে। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা কথা গুলো গলায় এসে আটকে আছে।
এমন উশখুশ করতে দেখে এক পলক অবনির দিকে তাকিয়ে আবার খাবারে মনোযোগ দেয় মাহফুজ।
অবনি অপরাধীর স্বরে বলে,

‘আসলে দুপুরের ব্যপারটা নিয়ে তুমি যা ভাবছো তা সত্যি নয়।’
খাওয়া থেমে যায় মাহফুজের। নিস্তরজ চোখে চাইলো অবনির মুখপানে।
‘আমি কিছু ভেবেছি তোকে বলেছি কি? নাকি জানতে চেয়েছি ওই ছেলের সাথে তোর কি চলছে? তোর লাইফ তোর মর্জি। এখানে তো আমার হস্তক্ষেপ নেই।’
‘না মানে,,,,,,’

‘মানে টা তাহলে কি? আমি তোকে বলেছি আমায় কৈফিয়ত দে? বলিনি তো। তাহলে আমাকে সত্যটা বলার তোর কিসের এতো তাড়া? আমি কি ভাবলাম না ভাবলাম এসব নিয়ে তো তোর মাথা ব্যথা থাকার কথা না। আমার ভাবনা নিয়ে তোর এতো পরোয়া কিসের? সত্যটা বলার দায়বদ্ধতা কেন? নাকি আমি একবারও প্রশ্ন করেছি রেস্টুরেন্টে ওই ছেলের সাথে কি করেছিলি? যেখানে তোর আর আমার মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই সেখানে সত্য মিথ্যা বিশ্লেষণ করার কোনো মানেই দেখতে পাচ্ছি না আমি। আমার ভাবনাটা না হয় আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকুক।’

হাত ধুয়ে উঠে পড়ে মাহফুজ। খাবার আর গলা দিয়ে নামবে তার।
‘আমার মন জানান দিয়েছে তোকে আমি ভালোবাসি। আমার মনে হয়েছে আমার অনুভূতির কথা তোকে জানানো উচিত। বলা উচিৎ ঠিক কতটা আমি তোকে চাই। বলেছি তোকে। অনেক ভাবে বুঝিয়েছি। তুই বুঝেও না বুঝার ভান করলে তো এতে আমার হাত নেই। অবুঝ কে বুঝানো যায়। কিন্তু যে বুঝেও বুঝে না তাকে বুঝানোর সাধ্য আমার নেই। তুই যেমন আমার থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছিস আমিও না হয় আরো একটু বাড়ালাম দূরত্ব। এক জীবনে কি আর সব পাওয়া হয়?’
দূরত্ব বাড়ানোর কথা শুনে টলমলে চোখে তাকায় অবনি। ঠোঁট কামড়ে কান্না নিবারনের চেষ্টা চালালো। সে তো এটাই চায়। তবে এতো কষ্ট কেন হচ্ছে?

‘একতরফা প্রণয়ের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়েছি আমি বারংবার। আর তুই আমার দগ্ধ হওয়াকে দূর থেকে কেবল উপভোগ করছিস। আমাকে ঝলসে যাওয়া অনুভূতির আর্তনাদ কখনো অনুভব করতে পারিসনি। হয়তো আর পারবিও না। তুই দূরত্ব চেয়েছিস। তবে বাড়ুক দূরত্ব।’

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ৬

কথাগুলো বলে দাঁড়ায় না মাহফুজ। নিজের রুমে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে পিঠ ঠেকায়। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘এবার দগ্ধ হওয়ার পালা তোর। সোজা পথে যা আদায় করা যায় না। তার জন্য উল্টো পথ ধরতে হয়। দেখি কতদিন মনের সমস্ত আবেগ, অনুরক্তি লুকিয়ে রাখতে পারিস।’

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ৮