লুকানো অনুরক্তি পর্ব ১৬

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ১৬
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

উত্তর শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল মাহফুজের। শুনতে চাইলো কি আর শুনতে হলো কি। কঠিন গলায় কিছু শুনাতে গিয়েও পারে না। আজকের সুন্দর রাতে মেজাজ দেখাতে চাইছে না সে। সে চাইছে না নতুন জীবনের সূচনাতেই অবনির মন খারাপ হউক। নিজের রাগটা প্রশমিত করে প্রস্তুতি নিলো অবনিকে ভড়কে দেওয়ার জন্য। অপ্রস্তুত করে তোলার জন্য। অবনির কথায় অবনিকে ঘায়েল করার জন্য। ভ্রু নাচিয়ে রগড় গলায় শুধায়,

‘খিদে কি পেটের নাকি মনের? আই মিন ভালোবাসা দিলে খিদে মিটবে? দিবো একটু ভালোবাসা?’
মাহফুজের কন্ঠে রসিকতা। চঞ্চল, দূরন্ত চোখ জোড়া অবনিতে নিবদ্ধ।
দৃষ্টি নামিয়ে নেয় অবনি। প্রগাঢ় লজ্জায়, ত্রপায় আড়ষ্ট সে। মাহফুজের বাঁধন থেকে মুক্ত হতে চাইল। কিন্তু মাহফুজ হাতের বাঁধন ঢিলে করল না। বরং বাঁধন শক্ত করল আরো। অবনি ব্যর্থ হয়ে নত স্বরে বিড়বিড় করে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমার সত্যি খিদে পেয়েছে।’
‘এইরাতে মানুষের খিদেও পায় জানা ছিলো না। মানুষ তো নাকি অন্যকিছুর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে।’
লজ্জা কে দূরে রেখে মাহফুজের চঞ্চল, দুষ্টু চোখে নিজের চাহনি নিবদ্ধ করে অবনি। চোখে চোখ রেখে বলে,
‘কারো রাগের উত্তাপ সহ্য করার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আজ সারাদিন খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছি। মানুষটার রাগ নেমেছে। রাগের উত্তাপ কমেছে। ব্যপারটা টের পেতেই আমার খিদে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর সহ্য করতে পারছি না।’

একটু স্বাভাবিক হয় মাহফুজ। নমনীয় স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘খিদে কি বেশি?’
মাথা ঝাকায় অবনি। মাহফুজ অবনির কপালে ওষ্ঠ জোড়া ছুঁয়ালো আলতো করে।
‘দেখি রান্না ঘরে কি আছে। তুই এসব ভারী পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।’ বলেই হাতের বাঁধন আলগা করে মাহফুজ।
লাগেজ হাতরে সুতি একটা থ্রি-পিস বের করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই মাহফুজ পুনরায় বলল,

‘ মুখের ওপর তিন ইঞ্চি প্রলেপ দেওয়া রূপ দেখলেই যে আমি তৃপ্তি পাবো ভুল ধারণা তোর। তুই আমার সামনের এলেই আমার চোখের তৃপ্তি। মনের শান্তি। আমি তো তোর সজ্জিত রূপ দেখে প্রেমে পড়িনি। সাজ সজ্জাহীন, স্নিগ্ধ তোকে দেখলেই আমি ঘায়েল হই বারংবার। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত চেহারা নিয়েও যদি আমার সামনে আসিস আমি তোর সেই রূপের প্রেমে পড়বো হাজার বার। প্রেমে পড়ার জন্য আমার তুই হলেই যথেষ্ট। আমাকে মুগ্ধ করার জন্য কিংবা ঘায়েল করার জন্য কৃত্রিম সজ্জার প্রয়োজন নেই। কখনো প্রয়োজন পড়বেও না।’

সকালে রান্নাঘরে এঁটো প্লেট দেখে মুচকি হাসেন আফসানা খানম। চুলোয় চায়ের পাতিল বসালেন তিনি। প্লেট ধুয়ে রুটি বানানোর আয়োজন করতেই পিছনে এসে দাঁড়ায় অবনি।
‘আমাকে দাও রুটি আমি বানাই।’
‘বিয়ের পরদিনই গিন্নি হতে চলে এসেছিস?’
তাক থেকে পিঁড়ি বেলুন নিয়ে অবনি বলে,

‘আজ হউক আর কাল গিন্নি তো হতেই হবে। তাহলে আজ থেকে নয় কেন?’
‘গিন্নি গিন্নি ভাব নেওয়ার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে। নতুন বউ তুই এখন। সবাই দেখবে তোকে। যা এখান থেকে।’
‘সাহায্য করতে এলাম। আর তাড়িয়ে দিচ্ছো। পরে তো বলবে বউ কোনো কাজ করে না।’
আফসানা খানম হাসলেন অবনির কথা শুনে। বড় স্নিগ্ধ সেই হাসি।

‘এসব নিয়ে আমার মোটেও মাথা ব্যথা নেই। আমার যথেষ্ট বল আছে। প্রথম থেকেই আমি আমার সংসারকে একা হাতে সামলে আসছি। তুই আসায় এমন না যে কাজ বেড়েছে। বউ হয়েছিস অবশ্যই এই সংসারটা সামলাবি। আজ হউক কাল হউক দায়িত্ব তোর কাঁধেই পড়বে। শুধু এইটুকু বলবো শেষ বয়সে পর করে দিস না।’
অবনি কিছু বলতে যাবে তার আগেই উনি এক চা ওর হাতে দিয়ে বলে,

‘যা তোর শ্বশুরকে দিয়ে আয়।’
অবনি ভালো করে গোমটা টেনে দরজায় এসে দাঁড়াল। বাবা বলে ডাকবে নাকি ফুফা বলে ডাকবে ইতস্তত করতে লাগল সে।
শহিদুল হক নিউজপেপারের পাতা উল্টে হাঁক ছেড়ে ডাকেন আফসানা খানম কে।
‘কি গো চা হলো?’

দরজায় দৃষ্টি ফেলতে নজরে এলো অবনিকে। তিনি একগাল হাসলেন।
‘তোমায় পাঠিয়েছে? দেখেছো বিয়ে হওয়ার পরদিনই কাজ করাচ্ছে। এটা তো মোটেও ঠিক না। আমি যে তোমার বাবাকে বলে এসেছি তোমায় মেয়ে করে রাখবো। আমার কথার কি হবে?’
অবনি চায়ের কাপটা উনার হাতে দিয়ে বলে,

‘মেয়েরাই তো ঘরের কাজ বেশি করে।’
উত্তর শুনে তিনি আবারও হাসলেন। তবে কিছু বললেন না। আয়েশ করে চুমুক দিলেন চায়ের কাপে। ঘুমের রেশ কাটানোর জন্য।
অবনি পুনরায় রান্নাঘরে পা রাখতেই আফসানা খানম বলেন,

‘একটু পরে এ ও করে হাজার মানুষ আসবে। বিশ্রাম নিতে পারবি না। মানুষ আসার আগে একটু বিশ্রাম নিয়ে নে। তাহলে সারাদিন আর খারাপ লাগবে না।’
‘থাকি না আমি।’
‘একটা সময় এসব তুইই করবি। আজকে না হয় তোর শ্বাশুড়ি তোকে ছুটি দিলো।’

আফসানা খানমের কথার সাথে পেরে উঠলো না অবনি। তাই বাধ্য হয়ে রুমে এসেছে। দরজা আটকে দেখল মাহফুজ গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। সারারাত ঘুম হয়নি কারো। মাহফুজ কে ঘুমোতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। ওড়না বালিশের পাশে রেখে খাটের একপাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করবে ঠিক এমন সময় মাহফুজ আচমকাই অবনিকে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্টে। মুখ ডুবায় গলায়। মাহফুজের গরম নিঃশ্বাসে একেবারে স্থির হয়ে গেল অবনি। বরফের ন্যায় জমে গেল তার শরীর।
‘ঘুমোচ্ছি আমি। একদম বিরক্ত করবি না।’

ফিরানিতে এসেছে অবনি আর মাহফুজ। সাথে এসেছে নাদিয়া।
জামাই আসার আনন্দে পুকুরে জাল ফেলেছেন মামুনুর রশীদ। জালে আটকা পড়া বড় কাতল মাছটা এনেছেন মেয়ে জামাইর জন্য।

উঠোনে বসে মাছ কাটছেন ফাতেমা আমিন। সকালে নাস্তার পর জমে থাকা থালা বাসন আর হাঁড়ি পাতিল পরিষ্কার রাফিয়া খাতুন। হাতের কাজ শেষ করে অবনির রুমের দিকে গেলেন তিনি।
আধশোয়া হয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছিল মাহফুজ। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দরজায় দৃষ্টিপাত করে সে। রাফিয়া খাতুন বড় করে ঘোমটা টানলেন। আমতা আমতা করতে লাগলেন তিনি।
মাহফুজ হাতের মোবাইল রেখে দিল। উনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

‘কিছু বলবেন?’
তিনি মাথা ঝাকালেন। মাহফুজও তাকিয়ে রইল কি বলে শুনার জন্য।
সেইদিনের সেই ছোট্ট বক্সটা মাহফুজের সামনে রাখে।
‘বিয়ার দিন দিবার চাইছি। কিন্তু সাহসে কুলায় নাই।’
উনার কথা শুনে বক্স হাতে নেয় মাহফুজ। ততক্ষণে অবনি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালে ঠেস দিল। দেখতে লাগল মাহফুজ কি করে।

বক্সটা খুলে আংটিটা নজরে এলো মাহফুজের। বিস্তর হাসল সে।
‘বাহ্! দারুণ তো। আপনার পছন্দের তারিফ করতে হয়।’
‘আপনের পছন্দ হইছে?’
মাথা ঝাকায় মাহফুজ।
‘এতো সুন্দর জিনিসটা আর পছন্দ হবে না?’

খুশিতে চকচক করে উঠে উনার চোখ। মাহফুজ আংটি টা আঙুলের কাছে এনে বলে,
‘আপনি আমার মায়ের থেকেও বয়সে বড়। আমাকে আপনি আপনি করবেন না। আপনি আমায় আপনি করে বললে মনে হয় আমি আপনার সাথে বেয়াদবি করছি।’
‘মাইয়ার জামাইরে সবাই আপনে কইরা এ কয়।’
‘মেয়ের জামাই না ভেবে সন্তানের মতোও তো ভাবতে পারেন।’

রাফিয়া খাতুনের চোখ ঝাপসা হয়। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগে আঁচল কোণে মুছে ফেলেন তা।
হাত ভাঁজ করে মাহফুজকে পর্যবেক্ষণ করছে অবনিকে। মুখে তার মিষ্টি হাসি। সে কি না এই মানুষটাকে হারিয়ে ফেলতে বসেছিল?

ভাবনার মাঝে নাদিয়ার চিৎকার কানে সবার। দেরি না করে সবাই ছুটলো বাইরে। বাইরে গিয়ে চোখ কপালে সবার। আবিদ নাদিয়া চুল ধরে ঝুলে আছে। ফাতেমা আমিন আবিদকে ছাড়াতে যায়।
‘এসব কি করছো বাবা? এগুলো তো পঁচা কাজ। মেহমানের সাথে এমন কেউ করে?’
অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে আবিদ কে ছাড়ালেন ফাতেমা আমিন।

‘ব্যথা পেয়েছো?’
চুল ঠিক করতে করতে নাদিয়া জবাব দেয়,
‘আমার চুল।’
আবিদের মুঠোভর্তি চুল। ফাতেমা আমিন চোখ রাঙানি দিতেই আবিদ গুটিগুটি পায়ে দৌড়ে চলে গেল। আবিদকে মা’রার জন্য লাঠি হাতে নিতেই নাদিয়া বাঁধা দেয়।
‘ও ছোট মানুষ মামি বাদ দাও।’
বলে অবনির কাছে এলো সে।

‘তোরা দুই ভাইবোনের এতো তেজ কেন বলতো? ধরাও যায় না ছোঁয়াও যায় না।’
অবনির পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল মাহফুজ। অবনিকে পিঞ্চ মে’রে বিড়বিড় করে বলে,
‘ওদের সহজে ছোঁয়া যায় না। ছুঁতে গেলে আগে পুড়তে হয়। পুড়ে পুড়ে তবেই পাওয়া যায় ছোঁয়ার অনুমতি।’
কথাটা নাদিয়া না শুনলেও অবনি ঠিকই শুনেছে।
‘আমার ভাই তো শুধু শুধু তোর চুলে ধরবে না। আগে আমার ভাইকে কি করেছিস সেটা বল।’
নাদিয়া ক্যাবলাকান্তের মতো হাসে।

‘একটু গাল টেনেছি। আসলে গুলুগুলু গাল দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। তাই আরকি।’
বলে নাদিয়া দাঁড়ায় না তাড়াতাড়ি করে প্রস্থান করে।
অবনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মাহফুজের দিকে। নাদিয়ার কথা শুনে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে।
‘আমরা অকারণে পুড়াই না। কারনে পুড়াই। আর আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বে এটা স্বাভাবিক নয় কি?’
মাহফুজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে সে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। সেখানে দুপুরের রান্নার আয়োজন চলছে।

অবনি চলে যেতেই মাথা চুলকে মাহফুজ বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘ বউ আমার আসলেই আগুন। আর আমি এই আগুনে হাজারবার পুড়তে রাজি আছি।’

লুকানো অনুরক্তি পর্ব ১৫

আগামীকাল বড় করে একটা পর্ব দিতে চেয়েছিলাম। অর্ধেক করে আজ একটু দিলাম। কাল আরেকটা পর্ব দিবো। কেউ আবার ছোট বলবেন না।

লুকানো অনুরক্তি শেষ পর্ব