সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৬

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৬
লেখনীতে: মাশফিত্রা মিমুই

“শুনুন আমি কালই বাড়ি চলে যেতে চাই। আপনার সময় না থাকলে শুধু টিকিটটা কেটে দিয়েন আমায়। আমি নিজেই চলে যেতে পারবো।”
স্ত্রীর এমন সোজাসাপ্টা একটি কথায় অবাক হলো শোভন। প্রতিত্ত্যুরে বললো,”গতকালই তো ভাইয়ের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে এলাম। তাহলে আবার কেন যাবে?”
“এবার আর ঘুরতে কিংবা বেড়াতে যাবো না। এখান থেকে একেবারে চলে যাবো। কারণ আমি আর আপনার সংসার করবো না।”

শোভন বিস্ফোরিত চোখে তাকালো জ্যোতির দিকে। তার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলো।নম্র স্বরে জিজ্ঞেস করল,”হঠাৎ করে কী হলো তোমার? এভাবে কথা বলছো কেন? সংসার করবে না মানে? বললেই হলো?”
জ্যোতি দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। স্ত্রীর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে শোভন মৃদু হেসে বললো,”নিশ্চয়ই মজা করছো তুমি, তাই না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যোতি গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”মোটেও আমি মজা করছি না। আমি আজ সিরিয়াস।”
শোভন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল জ্যোতিকে। না সে মোটেও মিথ্যে বলছে না। শোভন প্রশ্ন করল, “হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন?

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না জ্যোতি। তনিমার এখানে আসা থেকে শুরু করে তার বলা প্রতিটি কথাই বলে দিলো শোভনকে। অনেক আশ্চর্য হলো শোভন। এই মুহূর্তে কী বলা উচিত বুঝতে পারলো না। এতটা নিচে নেমে গেছে তনিমা? ভাবতেই অবাক লাগছে তার। খানিকক্ষণ নিরবতার পর শোভন শান্ত কণ্ঠে বললো,”তোমার কী মনে হয় আমি এমন? আমার প্রতি বিশ্বাস নেই তোমার?তোমায় রেখে আরেকটা মেয়ের সঙ্গে? ছিহ এসব ভাবতেই তো আমার ঘৃণা লাগছে।”

“মোটেও আমি আপনাকে অবিশ্বাস করিনি। আমি জানি আপনি কখনোই এসবে জড়াবেন না। ওই মহিলাকে তো আমি সঙ্গে সঙ্গেই এখান থেকে বের করে দিয়েছিলাম।”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শোভন। পরক্ষণেই প্রশ্ন করল,”তাহলে বললে কেন চলে যাবে?সংসার করবে না?”
জ্যোতি হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তরে বললো,”কারণ আপনি আমায় ভালোবাসেন না।”

মেঝে থেকে উঠে বিছানায় নিশ্চিন্তে বসলো শোভন। শোভনের এমন খাপছাড়া ভাব দেখে খুব কষ্ট হলো জ্যোতির। কান্না পাচ্ছে। জোরপূর্বক কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করে বললো,”আপনি আমায় ভালোবাসেন না। আপনি নিজ ইচ্ছায় আমায় বিয়ে করেননি এমনকি এখানে আমায় সঙ্গে করে নিয়ে আসারও কোনো ইচ্ছে ছিলো না আপনার। শুধু মায়ের কথায় বাধ্য হয়েই নিয়ে এসেছেন। হয়তো সম্পর্কটাও এ কারণেই টিকিয়ে রেখেছেন এখনো।এমন নড়বড়ে ঝুলন্ত একটা সম্পর্কে আমি আর থাকতে চাই না। তাই চলে যাবো আমি।”

“কিসের ভালোবাসা ভালোবাসা করছো? আমি কী বাচ্চা ছেলে যে আমায় কেউ জোর করে বিয়ে দিয়ে সংসার করাবে?”
দম ফেলে শোভন আবারো বললো,”সারাদিন ভালোবাসি ভালোবাসি বলে তো প্রেমিকাকে ইম্প্রেস করতে হয়। বউকেও কী ইম্প্রেস করার কোনো প্রয়োজন আছে?”
“তাহলে কী বলতে চাইছেন আপনি আমায় ভালোবাসেন?”

অপ্রস্তুত হয়ে গেলো শোভন। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। এদিকে উত্তরের আশায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে জ্যোতি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও কোনো উত্তর না পেয়ে আশাহত হলো। উঠে গেলো বসা থেকে। আলমারির কাছ থেকে লাগেজ তুলে নিলো।
শোভন ভ্রু কুঁচকে নিলো জ্যোতির কর্মকাণ্ডে। প্রশ্ন করল,”কী করছো?”
“জামা-কাপড় গোছাতে হবে।”
“কেন?”

“বললাম তো চলে যাবো। আপনার টিকিট কাটার দরকার নেই। আমি নিজেই স্টেশন থেকে টিকিট কেটে চলে যাবো। কাউকে দরকার নেই আমার।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শোভন এগিয়ে গিয়ে জ্যোতির হাত ধরলো। লাগেজ যথা স্থানে রেখে দিলো। বললো,”কী শুরু করলে এই রাতের বেলা? একবার বলছো তনিমা ম্যামের কথা বিশ্বাস করোনি আবার এদিকে যা শুরু করেছো এতে তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে উনার সব কথা বিশ্বাস করে তুমি আমায় ভুল বুঝছো।”

“বললাম তো কোনো ভুল বুঝিনি আমি।আপনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন আপনি চান আমার সঙ্গে থাকতে? বলতে পারবেন আপনি আমায় ভালোবাসেন? আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি তা পারবেন না। এত অবহেলা অনাদরের মধ্যে আমি আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না।”

কী এক বিপদে পড়ল শোভন? না পারছে সইতে না পারছে কিছু বলতে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এ আবার কেমন কথা? বুকে হাত দিয়ে ভালোবাসি বলতে হবে মানে? জ্যোতি কী চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে! ও কী মনে করে, আমি ভিতু? আমি কী পারবো না বলতে? আলবাদ পারবো। কিন্তু বলবো না কারণ আমার লজ্জা করে।
শোভনের থেকে এবারো আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে রেগে গেলো জ্যোতি।এ আবার কেমন ধারার লোক? মনের কথা স্বীকারও করবে না আবার যেতেও দিবে না? বিরক্ত কণ্ঠে বললো,”ছাড়ুন আমার হাত।”

শোভন ছাড়লো না। আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কোনো কিছু না ভেবে জড়িয়ে ধরলো স্ত্রীকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,”শান্ত হও জ্যোতি। মেয়ে মানুষের যে যখন তখন মুড সুয়িং হয় তা আমি জানি। তোমারও মুড সুয়িং হয়েছে নইলে কী আর এভাবে কারো রূপ বদলে যায়?”
“মোটেও আমার মুড সুয়িং হয়নি। ছাড়ুন বলছি। যার স্বামী তাকে ভালোবাসে না তার যন্ত্রনা আর কেই বা বুঝবে?”
“এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।ভালোবাসি না বললেই হলো? আমি তোমাকে কখনো এমন কথা বলেছি? কখনো তোমার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছি? তাহলে এতকিছু কেন ভেবে নিলে তুমি?”

শোভনের বক্ষ থেকে মাথা তুলে জ্যোতি আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধালো,”তার মানে আপনি আমায় ভালোবাসেন?”
“না বাসার কী আছে? তুমি আমার বউ। বউয়ের জন্য ভেতরে আলাদা একটা জায়গা তো থাকেই। একসময় না একসময় সেই জায়গা সে নিজেই দখল করে নেয়। ভালোবাসাও জন্মে যায় সেখানে। এ আবার ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলতে হবে? ভালোবাসা কী প্রকাশ করার কিছু? আজব।”

“আমি ওই একটা জায়গায় থাকতে চাই না। আমার আপনাকে পুরোপুরি ভাবে লাগবে। আপনার সব জায়গায় শুধু আমি থাকতে চাই। আর সেখানে শুধু আমিই থাকব।”
মুচকি হাসলো শোভন। বললো,”আমি তো পুরোপুরি ভাবেই তোমার।”
স্বস্তি পেলো জ্যোতি। রাগ গলে পানি হয়ে গেলো। শোভনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। জ্যোতির হাবভাব বোধগম্য হতেই শোভনও স্বস্তি পেলো।জ্যোতি বললো,”তাহলে ঠিক আছে আপাতত যাচ্ছি না আমি। না হয় করলাম আপনার সংসার। তবে একটা শর্ত আছে।”

“কিসের আবার শর্ত? যা বলবে সবকিছুতেই আমি রাজি।”
অধরে হাসি ফোটে উঠল জ্যোতির। বললো,”এখানে আমরা আর থাকব না। বাড়ি ফিরে যাবো তারপর সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকব।”
ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠল শোভন। জ্যোতির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বললো,”এ সম্ভব নয়।এখানে আমি একটা চাকরি করি। চলে গেলে এই চাকরির কী হবে?”

“ছেড়ে দিবেন।”
“হ্যাঁ তুমি বললে আর আমি ছেড়ে দিবো। এত সহজ? তোমার কোনো ধারণা আছে চাকরির বাজার নিয়ে? এই দিনে সহজে চাকরি পাওয়া যায়? তার উপর এত সুযোগ সুবিধা। জানো কোম্পানি থেকে নিজেদের একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য ঋণ পেয়েছি আমি। এখন ছেড়ে দিলেই হলো?”

“তাহলে আর কী? দেখুন ট্রান্সফার হতে পারেন কিনা। আর যাই হোক আপনি ওই ফালতু মহিলার সঙ্গে এক অফিসে বসে কাজ করতে পারবেন না। আমি থাকতে এ কখনো হতেই দিবো না। এখন কী করবেন ভেবে দেখুন আপনি। আপনার বউ চাই নাকি চাকরি?”

“সম্ভব হলে তো আমি নিজেই ছেড়ে দিয়ে চলে আসতাম। মোটেও এসব টর্চার সহ্য করতাম না।”
“ওহ তারমানে বউয়ের থেকে চাকরি গুরুত্বপূর্ণ? তার মানে আপনি আমায় ভালোবাসেন না। আবারো মিথ্যে বললেন?”
শোভন হতাশ হলো। বললো,”তুমি তো অবুঝ নও জ্যোতি। কেন এমন করছো বলো?”
“আমি চাই না আমার স্বামীর দিকে কেউ কুদৃষ্টিতে তাকাক। দরকার হলে আমি নুন ভাত খেয়ে থাকবো। ছেঁড়া কাপড় পরবো তবুও আপনাকে এখানে থাকতে দিবো না।”

জ্যোতি আবারো বললো,”সব আপনজনরা পড়ে আছে সেই কত মাইল দূরে আর আমরা পড়ে আছি এখানে।চাইলেও কাউকে সহজে দেখা যায় না।বিপদ হলেও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার মতো লোক নেই। কেন এত সুন্দর একটা পরিবার রেখে এখানে এত দূরে এসে পড়ে থাকতে হবে? আপনার কী ইচ্ছে করে না বাকি ভাইদের মতো বাবা-মায়ের কাছে একসঙ্গে থাকতে?”

শোভন গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,”না একদম ইচ্ছে করে না।আমার কেউ নেই।মা-বাবা ভাই-বোন কেউ নেই। আমি একা। এ কারণেই তো এতটা দূরে এসে একা একা পড়ে আছি যাতে জীবনে কারোর প্রয়োজন না হয়।কেউ চাইলেই আমার দেখা না পায়। যোগাযোগ করতে না পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি জড়িয়েই গেলে আমার এই ছোট্ট জীবনের সঙ্গে।”

চমকে গেলো জ্যোতি।এতক্ষণ তো শোভনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলোই জানার জন্য অপেক্ষা করছিল।শুধু ভয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। যদি শোভন উত্তর না দেয়? যদি কথা ঘুরিয়ে ফেলে? রাগ করে? কিন্তু এখন আর ভয় নেই। এখন তো শোভন নিজেই কিছুটা হলেও বলে দিয়েছে। জ্যোতি প্রশ্ন করল,”আপনাদের মধ্যে কিছু যে একটা হয়েছে তা আমি শুরুতেই বুঝতে পেরেছি কিন্তু কী এমন হয়েছে যে নিজের পরিবারকে অস্বীকার করছেন? একসঙ্গে থাকলে ভুল বোঝাবুঝি হয়েই থাকে তাই বলে?”

শোভন মৃদু হাসলো। যেই হাসিতে লুকিয়ে আছে অজস্র বেদনা। বললো,”যার সঙ্গে ঘটে সেই বুঝে অন্যরা তো শুধু গল্প শুনে। রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো। মাথা থেকে আজেবাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলো।”
জ্যোতি শুনলো না সে কথা। আগ্ৰহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,”সেদিন জ্বরের ঘোরে কেন আপনি বলেছিলেন আপনার মা আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে? মা তো আপনার কাছেই আছে শুধু আপনিই দূরে সরে আছেন। কেন বড়ো আপু খাঁন বাড়িতে আসে না?বাবার সঙ্গেই বা কেন আপনার এত দূরত্ব? শাফিন আর আপনি কেন একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন না?”

খুব বিরক্ত লাগছে শোভনের। যত চায় অতীত থেকে দূরে সরে যেতে। যত চায় এসব ভুলে যেতে ততোই সবাই তাকে এসব মনে করতে বাধ্য করে। আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়ালো না শোভন। চলে গেলো বারান্দায়। বাহিরে কী সুন্দর ঠান্ডা বাতাস। আকাশে মেঘ গুড়গুড় শব্দ করছে মনে হয় বৃষ্টি নামবে।জ্যোতিও পেছন পেছন চলে এলো। শোভনের পাশে এসে বসলো। বললো,”চলুন না এখান থেকে চলে যাই। এখানে তো আমাদের আপন বলতে কেউ নেই। সারাদিন একা একা থাকতে আমার ভালো লাগে না।”

“বলেছি তো যাবো না। তোমাকে আমার সঙ্গে এখানেই থাকতে হবে।”
“বাবা-মায়ের উপর রাগ করে থাকতে নেই। বললাম তো যা সমস্যা সব মিটিয়ে নিন। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবাও আপনায় খুব ভালোবাসে আপনাকে নিয়ে চিন্তা করে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো শোভন বললো,”পৃথিবীতে আমি দুটো মানুষকে খুব ঘৃণা করি আর তারা হচ্ছে আমার বাবা আর জন্মদাত্রী মা। যাদের মুখ দেখলেই আমার রাগ হয়। যাদের দায়িত্ব ছিলো আমার ছোটো বেলা সুন্দর করে গড়ে দেওয়ার সেই তারাই কিনা আমার ছোটো বেলা নিজ হাতে নষ্ট করে দিয়েছে। যাদের কাছে আমার কোনো মূল্যই ছিলো না। এখন শেষ বয়সে এসে বাবা নামক মানুষটি সবার সামনে ভালো মানুষ সাজার নাটক দেখাচ্ছে। ছেলের প্রতি উনার ভালোবাসা উতলে পড়ছে অথচ যখন আমার জীবনে বাবা-মা দুজনেরই দরকার ছিলো তখন উনাদের আমার কথা মনেই ছিলো না।”

জ্যোতি অবাক হলো। শোভনের কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। যে লোকটা কিনা ছেলের জন্য এত চিন্তা করেন ভাবেন সেই কিনা ছেলের শৈশব নষ্ট করেছেন? শোভন আবারো বলতে লাগলো,”আমার বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবন কখনোই সুখের ছিলো না। রোজ রোজ ঘরে ঝগড়া অশান্তি ভাঙচুর লেগেই থাকতো। বোঝ হওয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে কখনো ভালো করে হেসে হেসে কথা বলতে দেখিনি। স্বামী-স্ত্রীর প্রতি যেই সম্মানটা থাকে তাদের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও ছিলো না। রোজ মা আমাকে আর আপুকে মাগরিবের পরপর খাইয়ে দিতেন। কারণ রাতে খাবার টেবিলে খেতে বসেই শুরু হয়ে যেতো অশান্তি।‌ শুরু হয়ে যেতো মায়ের রান্নার দোষ ধরা। এই দোষ ধরতে গিয়ে কত যে খাবারের প্লেট মেঝেতে ফেলে দিয়েছে বাবা তার হিসেব নেই।”

আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জ্যোতি শুধালো,”কেন এমন করতেন? কী সমস্যা ছিলো উনাদের মধ্যে?”
“কারণ আমার মা মোটেও সংসারী নারী ছিলেন না। প্রত্যেক পুরুষই বিয়ের আগে স্ত্রী হিসেবে সুন্দর একজন নারী খোঁজে আর বিয়ের পর খোঁজে গুন। আমার বাবার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। মায়ের সঙ্গে উনার বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিক ভাবে। বিয়ের পরই তিনি মায়ের বিভিন্ন দোষ খুঁজে পায়।

আমার যখন ছয় বছর নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছি তখনি বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেও দাদী কিছুতেই আমাদের যেতে দেননি। কিছুদিন পরই স্কুলের নাম করে আপু বাড়ি থেকে পালিয়ে মায়ের কাছে চলে যায় কারণ সে হয়তো বুঝতে পেরেছে বাবা নামক মানুষটি আমাদের ভালোইবাসেন না। কিন্তু আমি তা পারিনি। ওসব কিছুই বুঝতাম না তখন। মা চলে যাওয়ার মাস পার হতে না হতেই বাবা আবারো বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফেরেন।”

“তার মানে মা আপনার সৎ মা?”
“হুম। বাবার বিয়ের খবর শুনে মাও আর বসে থাকলেন না তিনিও জেদ ধরে তার কিছুদিন পরই বিয়ে করে নিলেন। ব্যস আপু হয়ে যায় একা। এদিকে বাবার বিয়ের দুই মাস পার হতে না হতেই জানা যায় নতুন মা প্রেগন্যান্ট তাও আবার চার মাসের।”
আরো চমকে গেলো জ্যোতি। বললো,”তার মানে উনাদের!”

“হুম। মা থাকাকালীনই সম্পর্ক ছিলো। এ কারণেই আমার জন্মদাত্রী মাকে উনার ভালো লাগতো না। মানসিক অত্যাচার করে নিজের জীবন থেকে আমার মা’কে তাড়াতে চাইছিলেন।তবে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কারণ উনাদের দুজনকেই আমি ঘৃণা করি উনারা কেউ আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেননি বরং নিজেদেরটাই ভেবেছে। বাবা আমার মা’কে ঠকিয়ে নতুন করে আরেকটা বিয়ে করে সংসার সাজিয়ে নিয়েছেন ওদিকে যে মা জন্ম দিলেন তিনিও বিয়ে করে নিলেন। বড়ো বোন নানার বাড়ি থেকেই লেখাপড়া করতো।

তখন থেকেই সে বাবাকে ঘৃণা করতো। ক্লাস টেনে পড়াকালীন একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় একটি ছেলের সঙ্গে। বিয়েও করে নেয় দুজনে। শেষে সম্মানের ভয়ে সবার পরামর্শে বাবা কোনোভাবে তাদের খোঁজে বের করে। তারপর ধুমধাম করে তাদের আবারো বিয়ে দেয়।সেই যে বিয়ে করে স্বামীর হাত ধরে আপু চলে গেলো আর এলো না। কারো সঙ্গে সম্পর্ক রাখলো না। আমার সঙ্গেও নয় অথচ আমি ছিলাম তার আপন ছোটো ভাই।

আমিও তার মতোই অসহায় ছিলাম। আসলে সবাই স্বার্থপর। বিয়ের পর মাও ভুলে গেলো আমায়। নতুন বাচ্চার আগমনি সংবাদ শুনে বাবাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল নতুন বাবা হওয়ার উল্লাসে। এদিকে আমি হয়ে গেলাম একা। নতুন মা আসার পর থেকে কখনো আমায় সৎ ছেলের চোখে দেখেননি সবসময় আদর করতেন খেয়াল রাখতেন কিন্তু দাদী উনাকে পছন্দ করতেন না। আমার কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। প্রথম প্রথম উনার প্রতি আমার রাগ ক্ষোভ থাকলেও একটা সময় আমি বুঝতে পারি আসলে এতে উনার কোনো দোষ ছিলো না। উনি জানতেনই না বাবা বিবাহিত ছিলেন উনার ছেলে-মেয়ে আছে।

দম ফেলে শোভন বললো,”জানো নতুন মায়ের যখন আট মাস চলে তখন বাবা আমায় নিয়ে নানার বাড়ি রেখে আসে।”
“কেন?”
“কারণ উনার মনে হয়েছে আমি বাড়িতে থাকলে উনার অনাগত সন্তানের ক্ষতি হবে। তোমার বাবার ক্ষেত্রেও যখন একই ঘটনা ঘটলো তখন তোমার মা কিন্তু ভেঙে পড়েননি তোমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে লড়াই করে গেছেন আর এদিকে আমার মা নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন। আমার নানা ছিলেন একজন ক্যান্সারের রোগী। বছর ঘুরতেই মারা যান তিনি। এরপরেই মামা আমায় হোস্টেলে রেখে আসেন।

সেই থেকেই হোস্টেলে থাকা। সবাই ভুলে যায় আমায়। আমার খরচ দেওয়াও বন্ধ করে দেয় বাবা নামক লোকটা। মামারাই খরচ দিতেন। ঈদের সময় অথবা উইকেন্ডেতে সবাই তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে যেতো আর আমি পড়ে থাকতাম হোস্টেলে। মাঝেমধ্যে নতুন মা বাবাকে না জানিয়েই দেখতে আসতেন আমায়। তখন না একটু হলেও মনে হতো কেউ তো অন্তত আছে আমার খোঁজ নেওয়ার। হোক না সে সৎ মা কিন্তু মা তো।

আমার এই জীবনে আমি একটা ব্যাপার খুব উপলব্ধি করতে পেরেছি। শুধু জন্ম দিলেই অথবা রক্তের সম্পর্ক হলেই কেউ আপন হয় না। নতুন মা অনেকবার চেয়েছিলেন আমায় বাড়ি নিয়ে যেতে কিন্তু পারেননি বাবার কারণে। উনার ধারণা ছিলো আমি ওখানে থাকলে উনার সন্তানদের সমস্যা হবে। তাই আমারো আর যাওয়া হয়নি। এভাবেই স্কুল কলেজ জীবন পার হয় একাকীত্বে তারপর ভার্সিটির নাম করে ওই বিভাগ থেকেই চলে আসি আমি।

আমার লেখাপড়া শেষ হলো এখানে চাকরি নিলাম একটা। আর এরপরই বাবার ভালোবাসাও হুট করে বৃদ্ধি পেলো। ভাই নিজেই আমার সঙ্গে কথা বলে না কারণ সে জানে আমি তার সৎ ভাই। আমিও বলার প্রয়োজন মনে করি না তবে রেশমীর মনে ওসব নেই সে একেবারে নতুন মায়ের মতোই হয়েছে। খাঁন বাড়ির এই দুটো মানুষ ছাড়া কেউই আমার আপন নয় আর না আমি কাউকে চিনি।

কোনো কালেই আমার ইচ্ছে ছিলো না সংসার জীবনে জড়ানোর। স্ত্রী-সন্তান, সংসারের প্রতি ছিলো আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা যার ফলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনটা একাকীত্বে কাটানোর কিন্তু মা আর তা হতে দেননি। মিথ্যে বলে বাড়িতে নিয়ে যান। তোমার সম্পর্কে জানান। তখন আর চেয়েও পিছু হটতে পারিনি কারণ ততদিনে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছিল। রাত পোহালেই বিয়ে। শেষে বাধ্য হয়েই বিয়েটা করতে হয়েছে। উনি চাননি আমি আর একা থাকি। কিন্তু তাই বলে তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা আমি কখনো ভাবিনি।”

“মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয়? ওই ভালো বাবার মুখোশের আড়ালে এত ভয়ানক একটা সত্য লুকিয়ে আছে? নিজের বাবা হয়ে কীভাবে এমনটা করতে পারলেন তিনি?”
“জানি না।”
“আচ্ছা আপনার আপন মা উনার কী খবর?”
“শুনেছি বছর খানেক আগে মারা গেছেন। মামা একবার ফোন করে ডেকেছিল যাতে শেষবারের মতো দেখতে যাই।”
“গিয়েছিলেন?”
“প্রয়োজন মনে করিনি।”

কিছুক্ষণ নিরবতার পর শোভন বললো,”তোমার কী এখনো মনে হয় আমার সবকিছু ভুলে গিয়ে ওদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা উচিত? আমার জায়গায় তুমি হলে কী করতে?”
জ্যোতি মিনমিনে স্বরে বললো,”আমি তো সবটা জানতাম না। জানলে কখনোই এসব বলতাম না। তবে যাই বলুন না কেন মা খুবই ভালো মনের মানুষ। উনাকে দেখে কেউ বলতেই পারবেন না যে উনি একজন সৎ মা।”
“হুম। ওই একটা মানুষের জন্যই তো খাঁন বাড়িতে পা রাখি নাহলে কখনো যেতাম না ওই বাড়ি আর না ওই বাবা নামক মানুষটার মুখ দেখতে হতো।”

সাতরঙা প্রজাপতি পর্ব ১৫

জ্যোতি এ ব্যাপারে আর কথা বললো না শোভনের সঙ্গে। সে বুঝতে পারছে স্বামীর মনের অবস্থাটা। খুব কষ্ট হচ্ছে শোভনের তিক্ত অতীত সম্পর্কে জেনে। তবে ভেতরে এক প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে, শোভন তাকে ভালোবাসে। তার জন্য শোভনের ভেতরে এক সুপ্ত অনুভূতি আছে।

সাতরঙা প্রজাপতি শেষ পর্ব