সিক্ত সুভানুভব গল্পের লিংক || লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

সিক্ত সুভানুভব পর্ব ১
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

-“রাজ্যহীন রাজকন্যা আমি
সিংহাসন বিহীন আসন।
সুখের কিনারে ভাসব আমি
দিবারাত্র স্বপ্ন দেখে আমার দু’টি নয়ন।”

আমি আলো, বাবা মায়ের আদরের একমাএ রাজকন্যা। আমার বাবার নাম নুরুল ইসলাম। আমি বাবার কলিজা টুকরো তাই বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে আমার নাম রাখা হয়েছে। বাবা মা আর আমি মিলে আমাদের সুখের পরিবার। আমার বাবা একজন দিনমজুর। বাবা যা রোজগার করে তাতে কোনো রকম আমাদের দিন কাটে। মাঝে মাঝে না খেয়েও থাকার অভ্যাসও আমাদের আছে। কারন আমরা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর ছা- পোষা মানুষ। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোই। আমাদের নিজস্ব জায়গা জমি নেই তাই দু’টো রুম নিয়ে সীমিত খরচে ভাড়া থাকি। আমার মা হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে দুষ্ট মা, উনি সারাদিন আমার কড়া নজরে রাখেন। আর আমার বাবা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। কারন বাবাই আমার সকল আবদারের ঝুলি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গরীবের ঘরে যখন রাজকন্যা জন্ম নেয়। তাকে আমরা রাজকন্যা ধরি না। কারন তার বাবার রাজত্ব নেই। আলোও ঠিক তেমন। এখন আলোর বয়স সতেরো। আলো দেখতে নজরকাড়া আর প্রাণোজ্বল একটা মেয়ে। আল্লাহ মনে হয় আলোকে সব সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। যেমন চোখ,নাক, ঠোঁট আর গায়ের রং,আর তার এলোকেশ। কোনো কিছুতেই যেন কমতি নেই তার।
সে সহজ সরল বোকা টাইপের একটা মেয়ে। বাইরের পৃথিবীরটা কতটা নিষ্ঠুর তার ধারনা নেই। আর ধারণা রাখার প্রয়োজনও মনে করেনা। কারন ওর বাবা মা ওর কাছে পৃথিবী। আলোকে ওর মা একা রেখে কোথাও যায়না। এখানকার বখাটে কয়েকটা ছেলে ওর পেছনে লেগে আছে। বাড়িতে হুমকি দিয়ে যায়,বাজে বাজে কথা বলে। আলোর বাবা মা কিছু বলতে পারে না কারন তারা নিম্নবিও তাদের কথার দাম নেই। তাদের জন্য শাস্তির কোনো ধারা এখনও তৈরি হয়নি।তাদের পাশে দাড়ানোর মত কেউ নেই, থাকলেও দাড়ায় না কারন তারা নিম্নবিও।

আজ আলো ওর বাবার কাছে এক ডজন লাল চুরি আবদার করছে। বাবা নিশ্চয়ই আনবে ভেবে সে সারাদিন খুব খুশিতে আছে। কিন্ত সবার ভাগ্যে সব সুখ সয় না তেমনি আলোরও।

সেদিন সন্ধ্যায় বেলা খবর আসে, আলোর বাবা ট্রাকের সাথে accident ওখানেই সাথে সাথে মারা গেছে। একথা শুনে ওদের মাথায় আকাশ যেন ভেঙে পড়েছে। তাদের পাশে দাড়ানোর মত কেউ নেই, আজ আবার বাবাও মারা গেল।আলো আর আলোর মায়ের আহাজারি কেউ শোনার মানুষ নেই, কারন তারা নিম্নবিও।আলো বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বাবার রক্তাত মুখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কেদে উঠলো,,

আলোঃবাবা ও বাবা তুমি আমাকে রেখ যেও না বাবা। আমি তোমার থেকে লাল চুড়ি চাইবো না বাবা। তুমি ফিরে এসো বাবা,আমাকে এখন কে মায়ের হাত থেকে বাঁচাবে বাবা। আমি কার কাছে মায়ের নামে নালিশ করবো? আমার কিছু চায় না। আমাকে রেখে যেও না বাবা। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। আমাদের কেউ নেই তুমি ছাড়া। তাহলে কেন আমাদের রেখে তুমি চলে গেল? আমাদের এখন কে দেখবে? আমি কাকে বাবা বলে ডাকবো? তুমি আমার উপর রাগ করে যেও না। আমি কার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমাবো? বাবা! ও বাবা তুমি ফিরে এসো বাবা।তুমি যা বলবে আমি তাই করবো বাবা। আমি আর কোনকিছু নিয়ে আবদার করবো না,ওহ্! বাবা তুমি কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছো না?আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি তোমাকে ছাড়া কি করে থাকবো? হে আল্লাহ! তুমি আমার বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও, বাবা!

আলোর আর ওর মায়ের কান্নাতে আজ আকাশ বাতাস থমকে গেছে। কিন্তু নিষ্ঠুর সমাজ পাশে এসে দাঁড়াল না।কারন তারা গরীব, তাদের কেউ শান্ত না দেওয়ার মত কেউ নেই। এলাকার কয়েকজন মিলে আলোর বাবাকে দাফন করে আসলো। কারো তো কিছুই গেল না। যার গেল শুধু তারাই জানে তাদের কত মূল্যবান জিনিস হারাল।আলো চিৎকার করে বাবা বলে কেঁদে আঁকুতি মিনুতি করে ডাকতে থাকে।
আজ দুইদিন ওদের বাড়িতে রান্না হয়নি। আলোর মা ঠিক করলেন বাসা বাড়িতে কাজ করবে। আলোর মা আলোর মাথায় হাত রেখে কেঁদে কেঁদে বললেন,,

-“মা! তুই যেমন বাবা হারালি আমার তেমন স্বামী হারালাম।এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। আমাদের বাঁচতে হলে শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। আগে তোর বাবা ছিল কিন্ত এখন নেই। এখন আমরা দু’জন মা মেয়ে। আমরা যদি এভাবে ভেঙে পড়ি তাহলে আমাদের কে সবাই ছিঁড়ে খেতে আসবে।আমি ঠিক করছি আমি কারো বাসায় কাজ করবো। কর্ম কোনটাই ছোট নয়। তোকে আমি রুমে তালা দিয়ে যাবো।আমাদের খেয়ে পড়ে বাচতে হবে তাই না? দেখ মা তোকে শক্ত থাকতে হবে, না হলে কিভাবে হবে? আমি আছি! আমি আমার রাজকন্যাটাকে খুব ভালবাসি তো।

কথাটা বলে মা মেয়ে কাঁদতে লাগল। আলো ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা একজন বলেছিলো না, আমার উচু কপাল। আর কপালের দুইপাশের কপাল ভর্তি চুল থাকা নাকি শুভ লক্ষণ। আমি নাকি খুব সুখে থাকবো।আমি নাকি রাজরানী হবো? কিন্ত মা আমার জীবনে আলোর কোনো ছিঁটেফোটা নেই কেন? আমার এত সুখী তাই বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেলাম। আমি এই সুখ চাই না মা, এত সুখ মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে, মা।”

সিক্ত সুভানুভব পর্ব ২