সুখতারার খোজে পর্ব ৭

সুখতারার খোজে পর্ব ৭
লেখক:আর আহমেদ

মুখ থমথমে! এক রক্তি বিষাদ মন ঘিরেছে তারার মনে ভির দেখেই। তার কলিজা কেমন ছ্যাত করে উঠলো। তারা ধির পায়ে ভির ঠেলে এগিয়ে যায়। সামনে আসতেই বুক চিড়ে ডেকে ওঠে তারা,
-মাআআআআ!
তারার এক চিৎকারে পুরো পরিবেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। কেউতো কেঁদেই ফেলেছে! চালিতে চিত করে শোয়ানো তারার মা! লতিফা নিথর শরীরটার পাশে তার চাচী বসে মাথায় পানি দিচ্ছেন। তারও চোখে পানি! তারার বুকে যেন ছুড়ি বসালো কেউ! রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কষ্টে শ্বাস প্রশ্বাস ভারি হয়ে আসছে ক্রমশ তারার। বুকে ব্যথা করছে। ব্যাগ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারার। চোখে নোনাজল! এক ছুটে মায়ের পাশে বসে পড়ে তারা। চিৎকার দিয়ে ডাক দেয়,
-মায়ায়ায়া! ও মা! মা কথা বলো কি হয়েছে? ওঠো না, মা!
মেয়ের কাতরতাসূচক আকুতিতে কিছু মহিলা মুখে হাত গুজলেন। তাদের চোখে বাধ ভাঙলো! তারা এক নাগাড়ে মায়ের মুখ নাড়িয়ে ডাকতে লাগছে,

-মা। কিছু হয়নি তো! কি হলো ওঠো না মা! মাহ্!
আধোআধো চোখ খুলে তাকান লতিফা। তার চোখ আজ দেখা যাচ্ছে না। মেয়ের জন্য তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। নিশ্বাস তার কঠিন হয়ে উঠছে। তারা লতিফার মাথা কোলে রাখে। মুজ ভিজে গেছে তারার। আজ কত কত মানুষ তারার বাড়িতে। তারা সকলকে লক্ষ করে বলে উঠলো,
-মা দেখো,সবাই তোমায় দেখতে এসেছে! তুমি সবাইকে ছেড়ে যেতে পারো না। তুমি সুস্থ হবে। হতেই হবে।
লতিফা শেষ হাসি হাসেন। কেন তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে? কেন তারার আকুতি তাকে বাঁচতে ইচ্ছে করায়? লতিফা এতদিন তো দুটো জিনিসই চেয়েছেন সৃষ্টিকর্তার থেকে, মেয়ের ভালো ভবিশ্যত, আর তার মৃত্যু! আজ কেন তাকে দুনিয়ার মিছে মায়া টানছে বড্ড? তারা মাকে বুকে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে। তারার চাচী কঠোরতা আজ ভুলে গেছেন। তার মন চাইছে, সময়টা পিছিয়ে যাক, মহিলাটার একটু যত্ন করার সময় যেন পান তিনি! কিন্তু দেড়ি হয়ে গেছে।
তারার কান্না থামে না! এই বুঝি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন লতিফা! তারা বারবার বলছে, কেউ ডাক্তার ডাকো! আজ এতো নিষ্ঠুর হয়ো না! অন্তত আজ একটু সাহায্য করো কেউ!
বাধ ভাঙা নদীর মতো ডুকরে কেঁদতে থাকে তারা। মায়ের মৃত্যু দেখাটা কত কঠিন শুধু সে’ই বুঝছে! তারার চাচী ইলিমা বেগম উঠে ছুট দিলেন নিজ ঘরের দিকে। তূর বেশ দামি মোবাইলটা টিপছে! ইলিমা ছুট দিয়ে ছিনিয়ে নিলেন ফোন। তূর ভ্রু নামিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
-উফফ! মা কি হয়েছে?
-একছুটে সরকারি হাসপাতালে ছুটে যা। ডাক্তার ডেকে আন জলদি!
-ডংগিটা(তারা) কি করে?
ইলিমা রাগি গলায় বললেন,
-তূর! যা বলছি চুপচাপ তা কর গিয়ে!
-আজ তেজ গেছে? আরে সেদিনতো একটু কথাই বলতে গেছিলাম, সে তার কিনা তেজ?
-তুই যাবি না ফোন ট্রাংকে ভরে রাখবো?
-যাচ্ছি!
তূর ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। ইলিমা ভাবছিলেন একবার ভালো ডাক্তার ডাকবেন। কিন্তু বলার বেলায় আর বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ আগের জোস কেমন তলিয়ে গেলো!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ডাক্তার চেকাপ করে চলে গেছেন কিছুক্ষণ আগে। মায়ের একপাশে বসে নিরবে অস্ত্রুবিসর্জন দিচ্ছে তারা। লতিফার দেহ নিথর হয়ে গেছে। শুধু শ্বাসটুকুই চলছে! ডাক্তার তেমন কিছুই করতে পারেনি। একে একে সবাই চলে গেছে। ভির আর নেই! দু মুহুর্তে আবারো একলা তারা। তারার চাচা আজ শহরে গেছে। চাচী তারার পাশে বসে। তনয়াকে একবারের জন্যেও দেখা যায়নি আজ! তূর সে একবারই বের হয়েছিলো। তনয়া এমন স্বার্থপর ছিলোনা! খুব ছোট থাকতে আসতো এ বাড়িতে। কিন্তু এখন সে আসে না। তূর,তারার তিন বছরের বড়। সে আগে অনেক জ্বালাতো তারাকে। হঠাৎ দমে গেছে! আজকাল সামনেই আসেনা।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। তারা যেন মৃদু কাঁপছে। তার থেকে দু হাত দূরে ফোনটা৷ অথচ তারার মনে হচ্ছে কয়েক ক্রশ দূরে। ভরহীন ভাবে হেটে ফোনটা রিসিভ করে তারা।
– কি করছিস তুই?
মন অন্যকোথাও তারার। এদিকে কবিতা আবারো জিজ্ঞেস করলো,
-তারা কথা কেন বলছিস না?
তারা অস্ফুটস্বরে বললো,
-কে আপনি?
কবিতা যেন বৈদ্যুতিক শর্ট খেলো কথাটায়। আপাদমস্তক বলে দিলো কে আপনি? তারা চমকানো সুরে তারাকে ডাকতে লাগলো,
-তারা কি হয়েছে তোর? কি রে..ওই তারা!
সজ্ঞানে আসতেই বুক চিড়ে কান্না আসতে লাগলো তারার। চোখ ফেটে পানি পড়তে লাগলো চোখ বেয়ে। কান্নার স্বর পেতেই কবিতা আরো উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলো,

-কি রে তারা? তোর কি হয়েছে? তারা কি হয়েছে বলবি তো!
-ম্া মা..
-আন্টি? আন্টির কি হয়েছে?
-মা..খুব..
কবিতা যেন বুঝতে পেলো! বলল,
-আমি আসছি তারা। আমি আসছি!
ফোন কেটে ফিরতেই পেছনে অভ্রকে দেখতে পেলো কবিতা। অভ্রের চোখ জিজ্ঞেসু! সে অকপট বলে উঠলো,
-আসছি মানে? সন্ধ্যায় কই যাচ্ছো?
কবিতা অপ্রস্তুত এমন প্রশ্নে। কিছুটা সময় নিলো কবিতা। কবিতার পা’ও কেমন মৃদুভাবে কাপছে! সে বললো,
-তারার মা খুব অসুস্থ! আমি ওখানেই যাবো।
বলে কবিতা পাশ কাটিয়ে এগোতেই পেছন থেকে অভ্র বলে উঠলো,
-আমিও যাবো!
থামলো কবিতা! বললো,
-তারাতাড়ি এসো..

ইরাকে বলেই চলে গেলো কবিতা আর অভ্র। কবিতা সামনে না থাকলে উনি যেতে দিতেন না। হয়তো আরও লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে..!
দেড় ঘন্টার আগেই পৌছে যায় কবিতা আর অভ্র। ঘরে ডুকতেই দুজন কাটখোট্টা মানুষ চোখে পরে কবিতার। তারার মুক কেমন শুকিয়ে গেছে। কাট কাট মুখশ্রী ভেজা, স্যাতস্যাতে! কবিতা ছুটে গিয়ে গলা জড়িয়ে নেয় তারার। এদিকে লতিফা খুব বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিচ্ছে তো একটু দমছে। কবিতা তারাকে অভয় দিয়ে বলে,
-কিছু হবে না। কিছু হতে দিবো না আমরা। তুই দাড়া আমি এখনি ডাক্তারকে কল করছি।
কবিতা বাইরে চলে আসে। তারাকে প্রথম দরজার আড়াল থেকে দেখেই বাইরে চালিতে দাড়িয়ে অভ্র। মেয়েটাকে এভাবে মানায় না। খুব খারাপ লাগছে অভ্রের!
কবিতা ফোন করে আসতে বলে দেয় ডাক্তারকে। তারপর ঘরে চলে আসে। ডাক্তার আসতে আসতে রাত আটটা বেজে যায়। তবুও একবার চেকাপ করে ডাক্তার। সব শেষে কবিতা বলে,
-উনি সুস্থ হবে তো ডাক্তার?
না সূচক মাথা নাড়ায় ডাক্তার। তারা হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে। কবিতার চোখেও শেষ পর্যন্ত বাধ ভাঙলো। সে কেঁদে উঠলো। ডাক্তার বললেন,

সুখতারার খোজে পর্ব ৬

-অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। আর সম্ভব নয়। এখন চিকিৎসা করেও লাভ নেই আর।
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই হাউমাউ করে সশব্দে কাঁদতে থাকে তারা। চালিতে শব্দ আসছে, কান চেপে নিজেকে দমে দাড়িয়ে অভ্র!
মধ্যিরাত!
অসহ্য চিৎকরে তারার লাগা চোখ মেলে ওঠে। লতিফা চিৎকার ছাড়ছে! মেয়ের গালে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েও তিনি হাত দিতে পারলেন না। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। তারা লতিফার বুকে জড়িয়ে আর্তনাত করে কাঁদতে লাগলো। কবিতা কঁদছেই! অনেক কস্টে তারাকে ঘুম পাড়াতে চেয়েছিলো কবিতা। তার আগেই শেষ হলো সবটা। অভ্র ভিতরে আসতে চেয়েও আসলো না। তার মন বলছে, দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে নিতে। বুকে জাপটে ধরে বলতে, কেঁদে না! আমার বুকও ঝলসে যাচ্ছে তোমার কান্নায়। কেঁদো
না সুখতারা, কেঁদো না!

ফজরের আগেই লতিফাকে গোসল করিয়ে সাদা কাফনে মোড়ানো হয়েছে। তারাকে ধরে দাড়িয়ে আছে কবিতা। এখনো একফোঁটা পানি পান করেনি তারা। অনেক বুঝিয়েও কিচ্ছু খাওয়াতে পারেনি। সকলে জানাজা পড়ে নিয়ে যান লতিফাকে খাটিয়ায় করে। পর্দাসহ কবর দেয়া হয়।

তারা মাটিতে বসে! অভ্র চালিতে এসে দাড়ালো এখনি। মাটি দিতে গিয়েছিলো সে। দিয়েই এসে দাড়িয়েছে অভ্র।
দুপুর গড়িয়েছে…
তারা একচোখে মাটিতে তাকিয়ে রয়েছে। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে তারার। কবিতা পাশে বসে মাথায় তেল দিচ্ছে। তারার চাচা এখনি আসলো। সবটা শুনে তিনিও স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে আছেন। অভ্র একটিবারও কথা বলেনি তারার সাথে। কবিতা তারার চাচার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো,
-আমরা তারাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চাই। ও এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে। নিয়ে যেতে চাই আমরা।
অভ্র বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। কবিতা হঠাৎ কি বলে উঠলো? তারার চাচার তেমন হেলদোল নেই। তিনি সেদিকে তাকিয়েই রয়েছেন। কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে কটকটে গলায় কথাটা আরেকজন বলে উঠলো,
-তারা কোথাও যাবে না। ও আমাদের কাছে থাকবে। ওর চাচা চাচী কি মরে গেছে?
আড়চোখে তাকালো তারা। তূর দারিয়ে সামনে। তারা মাথা তুলে অবাক চোখে তাকায়! হঠাৎ দরদ?

সুখতারার খোজে পর্ব ৮