সুখতারার খোজে পর্ব ৮

সুখতারার খোজে পর্ব ৮
লেখক:আর আহমেদ

কেটে গেছে এক সপ্তাহ। তারার সূদুর আকাশপানে তাকিয়ে। একঝাক পাখি উড়ে যাওয়া দেখছে তারা। যদি সেও পাখি হতো। তারও দুটি ডানা থাকতো? থাকতো আকাশ বেড়ানোর ক্ষমতা! তাহলে বোধহয় ভালো হতো। এই পৃথিবীতে কাটাতে হতো না তাকে। নরকের মতো কষ্ট গুলো সে উড়িয়ে দিতো! তবুও ভালো হতো। সুখ নামক কিছু একটা তার হাতে থাকতো অন্তত!
তারা এখন তার চাচার বাড়িতেই থাকে। সেদিন কবিতার কত ঝগড়া তাকে না নিয়ে যেতে দেওয়ায়, ভাবলেই হাসি পায় তারার। শ্যামবর্ন মুখখানা দিনদিন কাঠ কয়লা হয়ে উঠছে তারার। চোখের কোনে কালসিটে দাগগুলো জেকে বসেছে। ঠোঁটগুলো,যারা কিনা একদম জিবন্ত লাল আভা সম্পূর্ণ ছিলো তা এখন কুঁচকে গেছে। তারা জিভ দিয়ে একবার ভিজিয়ে নেয় ঠোঁট! তারার চোখের সামনেই কেমন পুরো আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। হয়তো আজ বৃষ্টি হবে। তারার সাধ জাগছে সে বৃষ্টি দেখবে। জানালার রডগুলোয় জং ধরেছে। হাত দিলেই অক্সাইড অরফে লাল মরিচা হাতে আটকে আসে। তারা তবুও হাত দেয়। জানালা ধরে সে দেখবে বৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে ভেজাবে। দোয়া করবে মায়ের জন্য! মাগফিরাত কামনা করবে। দীর্ঘসময় পর তারা বৃষ্টির দেখা পায়! আকাশ ভেঙে নামতে থাকে বৃষ্টি। কিন্তু তারার আরাম স্থায়ী হয়না। কারো বীভৎস আওয়াজে হকচকিয়ে উঠে তারা।

-কি রে? বৃষ্টি চোখে দেখিস না তারা? কাপড়গুলা তুলবি তো!
ঘার আধঘোরা করে ঘুরতে চেয়েও ঘোরে না তারা। এতকিছুর মাঝেও সে মুচকি হাসে। বৃষ্টিবিলাস হয়না তারার। বিছানা থেকে নেমে ছুটে বাইরে আসে। উঠোনে দড়ি বাধা সব কাপর তুলে চালিতে দাড়িয়ে সশব্দে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয় তারা। ডান পার্শে চোখ যেতেই তারা দেখে চাল ফুটো, টপে টপে পানি পড়ে মাটির চালি ভিজছে। কাপড়গুলো ঘরে রেখে একটা বর বাটি দেয় সেখানে। পানি মাটিতে না পড়ে বাটিতে পড়ছে। তারার চাচীবাড়ির সবথেকে বড় পেঁপে গাছটার পেঁপেগুলো হলদে রঙা হয়ে উঠেছে, পেঁপেতে সংগঠিত জৈব-রাসায়নিক প্রকিয়ায় হলুদ বর্নের নতুন যৌগ সৃষ্টি করেছে। তাই সেগুলো হলুদ হচ্ছে।
তারা আবারো হাসে। আজকাল সব কিছুতে তার হাসি পায়। মায়ের কথা মনে পড়লেও হাসে তারা। আবারো হেসে পেছন ফিরে ঘরের দিকে হাটতে থাকলো তারা। হঠাৎ তূর তার সামনে এসে দাড়ায়। তারা ভ্রুক্ষেপহীন পাশ কাটাতে চাইলে আবারো সামনে এসে দাড়ায় তূর। ঠোঁটজোরা বাঁকিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-এখনো তোর ট্রমা কাটেনি?
-কিসের ট্রামার কথা বলছেন তূর ভাই?
তারা জিজ্ঞেস করলো। উত্তরে বেখায়ালি হাসলো তূর। যেন এতটুকু কথা জোক্স মনে হলো তূরের। বললো,
-ওহ্হো ওটাতো ড্রামা হবে তাইনা,তারা?
বলেই হো হো করে হসতে লাগলো তূর। তারা বুঝলো না। হয়তো বুঝতেই চাইলো না। তারা বললো,
-আর কিছু বলবেন?
-হুম, অবশ্যই।
সিরিয়াস হয়ে বললো তূর। তার মুখ দেখেই স্পষ্ট সে তারাকে খোঁচা দিতে এসেছে। সয়তানি হাসিটাই তার প্রমান। তারা এক চিলতে হেঁসে বললো,
-বলেন..
-অভ্রকে বিয়ে করতে চাইছিলি না তুই? তাহলে যে আমি আরেকটা মেয়েকে দেখলাম ওর পাশে..
-কবে?
-আরে ওইযে…সে কি’না ঝগড়া! বেশ তো বলছিলো,’ওকে আমরা নিয়ে যাবোই! তারাদের তো আপনারা কোনদিন খেয়াল রাখেননি! আর আজও রাখবেন না! আমি নিয়ে যেতে চাই ওকে। দরকার পড়লে লাশ ফেলে দেবো। তাও নিয়ে যাবো! ‘ তা নিয়ে গেলো না কেন?
কবিতার মতো ব্যাঙ্গ করে বললো তূর! এটা সত্যি কবিতা সেদিন সবটা দিয়ে লড়েছে তূরের সঙ্গে। কিন্তু অভ্রের এক ঝাড়ি দমিয়ে দেয় কবিতাকে। ভেজা বেড়ালের মতো চলে গেছিলো সেদিন।
তূরের কতাগুলোতেও তারা হেঁসে বলে,

-এটাকে ভালোবাসা বলে তূর ভাই। বোঝেন ভালোবাসা কি? বখাটে গুলোর মতো এসে একগাদা গিফট আর একটা আই লাভ ইউ বললে ভালোবাসা হয় না। কবিতা যেটা করেছিলো সেটা মন থেকেই করেছে!
কথাগুলো তূরকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তারা। তূর বুঝেও রাগ দমালো। একটা পেপার তারার হাতে ধরিয়ে বললো,
-এটা এডমিট! মাত্র তিনটে দিন বাকি তোর পরিক্ষার। এতো ট্রামা সরি, ড্রামা না করে পড়! পারলে রাত দিন এক করে পড়। পরিক্ষা টাফ হবে শুনলাম!
তারা এডমিট হাতে অবাক চোখে তাকিয়ে। তাহলে কবিতা কাল এটার’ই কথা বলেছিলো? তারা এডমিটে চোখ বুলায়।
-আপনি এটা আমার জন্য এনেছেন?
আবারো বাকা হেঁসে বলে তূর,
-সেন্টিমেন্টাল হোস না! জাস্ট পরিক্ষাটার জন্যই এনেছি! নাহলে তেমন কিছুই না।
-কিন্তু আপনি তো একদমই সহ্য করতে পারেন না আমায়। আমি ফেল করলে তো আপনার খুশি…
কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত থেকে এডমিট পেপার ছিনিয়ে নেয় তূর। ঠোঁট খিচে বলে,
-ছিড়ে দেবো বলেদিলাম! এনেছি এটা তোর সৌভাগ্য!
আবারো হাতে গুজে দিয়ে চলে গেলো তূর। তারা অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
-আপনি ভালো হওয়ার নন..
তূর আড়ালে গিয়েই ফোন হাতে নেয়। এদিকে তারা পড়ার টেবিলে চলে যায়।

গেম খেলার মাঝে ফোনকল একদমই পছন্দ নয় তূরের। আর নাম্বারটাও অনেকটা বিরক্তিজনক। তূর ফোন রিসিভ করে। ওপার থেকে বলে ওঠে কেউ,
-ও কি করছে এখন?
তূর বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
-নিজে দেখে যান।
তারপর আবার সান্ত হয়ে বললো তূর,
-পড়ছে!
-খায় ঠিকঠাক?
-তেমন একটা খায় না! মুখ শুকিয়ে গেছে আগের থেকে অনেক।
-ওর কি বাস্তবে ফিরতে আরও সময় লাগবে নাকি?
-তা অত কিছু কি কারনে বলবো আমি আপনাকে? বিয়ে হয়ে গেছে চুপচাপ নিজের সংসার করুন। তারার প্রতি আপনার ইন্টারেস্ট না দিলেও হবে। এখন রাখুন।
ফোন কেটে দিলো তূর। অভ্র হতাশার শ্বাস নিয়ে ফোন বিছানায় রাখলো। কবিতাও পড়ার টেবিলে, কিন্তু মন পড়ায় নাই। সে চিন্তাতেই পড়তে পারছে না। একবার এক সাবজেক্ট তো আরেকবার আরেক সাবজেক্ট পড়তে ইচ্ছে করছে কবিতার। মাঝেমাঝে কলমে চুল পেঁচাচ্ছে ও। অভ্র বিছানায় বসে পড়লো। কবিতার মাথায় এখন পড়া বাদে সব ঘুরপাক খাচ্ছে। এই যেমন, তার নক্ কাটতে ইচ্ছে করছে। আবার ঘরটাকে একটু গুচাতেও মন চাইছে। এমন আজেবাজে চিন্তা গুরপাক খাচ্ছেই কবিতার মাথায়। অবশেষে বিরক্তি নিয়ে উঠেই পড়লো টেবিল থেকে। অভ্র ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,

-পরশু পরিক্ষা আর এখন এমন ওঠাউঠি করছো কেন?
কবিতা মাথা বাঁকিয়ে বললো,
-আর ভালো লাগছে না।
-তুমি কিছু পড়ছো আদেও?
-পড়লাম তো!
-কখন? পড়তে বসেছো থেকে দেখছি এদিক সেদিক তাকাতাকি করছো। পড়তে বসো।
-পারবো না।
-কবিতাহ্!
কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো অভ্র। কবিতা যেন বেলুনের মতো চুপসে গেলো এরিমধ্য। অভ্র আবার বলে উঠলো,
-কেন পারবে না?
-করন, আজ অব্দি আমি নিজে নিজে কখনো পড়িনি। তাও আবার একলা!
-তো তোমার জন্য অন্য কেউ পড়ে দিয়েছিলো নাকি?
-তারাই তো আমায় স্বল্প সিলেবাসে খুব পরিপাটিভাবে পড়াতো। একসাথে পড়তাম দুজনে। এতদিনের অভ্যাসে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
-তো ওকে একবার ডাকো!..
হঠাৎ মুখ ফসকে বলে উঠলো অভ্র। তারা না সূচক মাথা নাড়িয়ে বসে পড়লো বিছানায়। অভ্র একটু ক্ষেপে গিয়ে বিছানা থেকে টেনে তুললো কবিতাকে। এক টানে বিছানা থেকে টেবিলে নিয়ে এসে বসালো তারাকে। এরপর পাশের আরেকটা চেয়ারে নিজে বসে পড়লো। পরাতে লাগলো কবিতাকে। তা কবিতার মন মত করে। পড়া দিচ্ছে আর ধরছে। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগছে কবিতার। পড়ায় মন দিলো কবিতা,!

সুখতারার খোজে পর্ব ৭

দেখতে দেখতে পরিক্ষার সময় আগত। খুব ভোরে কবিতাকে টেনে তুলে পড়তে বসিয়েছে অভ্র। এরপর নিজে মর্নিং ওয়ার্কে চলে গেছে। তারাকেও উঠিয়েছে নিজের অজান্তে তূর। তারা ঘুমে থাকা অবস্থায়তেই ব্লুটুথে স্পিকারে ফুল সাউন্ড দিয়ে গান চালিয়েছিলো তূর৷ তার ফলস্বরূপ ঘুম ছেড়েই পড়তে বসে তারা। ভেবেছিলো এই গানের জন্য তার পড়াই হবে না। কিন্তু পরতে বসতেই গান বন্ধ হয়ে যায়। তবুও তারা আগের মত পড়তে পারছে না। পড়ালেখায় কেমন মন নেই তারার।
ঠিক সারে সাতটায় ফোন বেজে উঠতেই টেবিল ছাড়ে তারা। কবিতা ফোন করেছে। তারা রিসিভ করে ফোন। কবিতার তাড়াহুড়ো করে বলে,
-তুই রেডি তো তারা?
-রেডি মানে?
-পরিক্ষা আটটায় শুরু। তুই আসবি কখন? খেয়েছিস তো?
তারার মাথায় যেন বাজ পড়লো। সে তো এখনো খায়ইনি। ওপার তেকে কবিতা আবার বললো,
-জানিস তো পরিক্ষা সিটি কলেজে হবে!
-হ্যা কিন্তু..
-এবার কি করবি তুই?
‘আপু আসলাম’ বলেই তখনি ঘরে প্রবেশ করলো তনয়া। এইপ্রথম সে এ ঘরে আসলো তারা আসার পর। তাও হাতে খাবার। ফোন নামিয়ে অবাক চোখে তাকালো তারা। মাত্র মাসখানেকের ছোট তনয়া। অথচ সে তারার আশেপাশেও ঘেষেঁ না। আর আজ খাবার নিয়ে এসেছে? তনয়া খাবার বিছানায় রেখে বললো,

-খেয়ে নাও। তোমার তো দেড়ি হয়ে গেছে। তাহলে তুমি রেডিও হওনি। যাবে কখন?
তারা নিশ্চুপ হয়ে তনয়ার দিকে তাকিয়ে। তনয়া আবার বলে,
-তুমি বরং একটা কাজ করো, ভাইয়া এখনি মোটর সাইকেল বের করলো। হয়তো কোথাও যাবে। তুমি বরং সেটাতেই না হয় যাও।
-কিন্তু তূর ভাই কি আমায় নেবে?
-আমি বলছি। তুমি রেডি হও।
বলে চলে গেলো তনয়া। তারার ফোনের কথা মনে পড়তেই কবিতাকে বললো সে আসছে। অতপর একটু রেডি হয়ে নিলো তারা। সব গুছিয়ে বাইরে আসতেই তূরকে চোখে পড়লো তারার। সে বাইকে বসে আছে। তারা ওখানে যেতেই তূর কটাক্ষ স্বরে বলে উঠলো,
-নিজের পরিক্ষার টাইমও নিজে জানিস না। আর এসেছিস ছাত্রীগিরি দেখাতে? তারাতাড়ি বস!
বাঁকা কথা না বললে যেন ভালোই লাগে না এই লোকটার। তারা বসে পড়ে। কোনমতে পেছনের হাতল ধরতেই বাইক স্টাট দেয় তূর।
আড়ালে হিংসায় জ্বলতে লাগলো কেউ। এক পশলা ঘৃনা ছুড়লো তারার দিকে।

সুখতারার খোজে পর্ব ৯