সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১০+১১+১২

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১০+১১+১২
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

-“তুয়া আপু, বউ বউ খেলবা?”
ইচ্ছে তুয়াকে কথাটা বলে দাঁত বের করে হাসল। তুয়া ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়াল। তুয়া খেলবে না বলায় ইচ্ছের মুখের হাসিটা মলিন হয়ে গেল।
আজকাল তুয়ার কিছু ভালো লাগে না৷ ওর জীবনটা যেন অদ্ভুত এক গোলক ধাঁধায় আঁটকে গেছে। কষ্টগুলো বেহায়ার মতো এসে তুয়ার জীবনে ভিড় জমিয়েছে। এক সপ্তাহ হলো তুয়া রুম থেকে হয়নি। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলেনি। তুয়ার এখন রাতজাগা পাখির মতো র্নিঘুমে রাত কাটে। ওর ঘরবন্দী জীবন বিষাদের ভরপুর থাকলেও এভাবেই ওকে বাঁচতে হবে, কারণ সে ধর্ষিতা।
ইচ্ছের মলিন মুখ দেখে তুয়া উঠে ইচ্ছের কাছে গেল। ইচ্ছে মন খারাপ করে ওর পুতুলটাকে নিয়ে সিঁড়ি অবধি চলে গেছে। তুয়া গিয়ে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল। ইচ্ছে একরাশ অভিমান জমিয়ে বলল, “বাসায় যাব।”
তুয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই না বললি আমার সঙ্গে খেলবি?”

ইচ্ছে কোনো কথা বলছে না, গাল ফুলিয়ে রেখেছে। তুয়া ইচ্ছের গাল টেনে বলল, “বাসায় চানাচুর আছে। কেউ কি খাবে?”
ইচ্ছে তুয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। তুয়া ইচ্ছেকে নিয়ে বাসায় ঢুকতে যাবে, ঠিক তখন তিন তলার ভাবি তুয়াকে থামিয়ে বললেন,
-“সেদিন আমার রুমের কোণে বীর্যসহ প্রোটেকশন পড়ে ছিল। তাই তুমি লোক দেখিয়ে বমি করে আমাদের অপমান করে তবেই ক্ষান্ত হয়েছিলে। আর গত সপ্তাহে ধর্ষকরা এসে তোমার শরীর নিয়ে তাদের খায়েশ মিটিয়ে গেল। তা এখন তোমার এই শরীর নিয়ে ঘৃণা হচ্ছে না, বমি পাচ্ছে না, নাকি নিজের শরীর বলে ঘৃণার জায়গায় মিষ্টতায় পরিণত করেছ?”
তুয়া অশ্রুসিদ্ধ চোখে মাথা তুলে তাকাতে পারল না। প্রিয়ম বের হওয়ার সময় উনার পুরো কথা শুনে তুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
-“সেই রাগ এতদিন তুলে রেখেছিলেন? তা বেশ ভালো করেছেন। আমিও মানছি সব দোষ তুয়ারই ছিল। সেদিন তুয়া বমি না করে যদি আপনাকে বলত প্রোটেকশনটা আলমারিতে তুলে রাখতে। তাহলে হয়তো আজ আপনার খুশির কমতি থাকত না, তাই না?”
ভাবিটা চোখ গরম করে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে উনি চোখ দিয়ে প্রিয়মকে গিলে খাবেন। প্রিয়ম ভাবির দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“সে যাই হোক, আপনাকে আমার কি বলে ডাকা উচিত জানি না, আর জানার ইচ্ছেও নেই। তাই কোনো সম্বোধন ছাড়াই কথা বলছি। ওহ হ্যাঁ! যেটা বলছিলাম, সেদিন তুয়া আপনাকে কিছু না বললেও আজ আমি বলছি। আপনি ওগুলো আলমারিতে তুলে রেখে বিল্ডিং তৈরী করুন। মনে হয় বেশ ভালো মানের বিল্ডিং হবে।”
ভাবিটা আর কথা না বাড়িয়ে রেগে চলে গেলেন। তুয়া চলে আসতে যাবে তখন প্রিয়ম বলল, “তুমি তো জানো, তুমি ধর্ষিতা নও। তাহলে তোমার এত অভিনয়ের কারণ কি?”
প্রিয়মের কথা শুনে তুয়া হতবাক হয়ে তাকাল। প্রিয়ম ওর মাকে বের হতে দেখে চুপ করে নিচে চলে যায়। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে দেখে একপ্রকার জোর করেই উনার বাসায় নিয়ে গেলেন। ইচ্ছেও তুয়ার সঙ্গে নাচতে নাচতে গেল।
চাঁদ ড্রয়িংরুমে বসে নুডুলস খাচ্ছিল আর মুভি দেখছিল। চাঁদের কথা এই বিল্ডিংয়ের কেউ এখনও জানে না। প্রত্যয়ের আম্মুর সঙ্গে তুয়াকে দেখে চাঁদ বলল, “হ্যালো আপু! আমি চাঁদ! এবার ক্লাস টেনে উঠেছি আর তুমি?”
তুয়া জোরপূর্বক হেসে বলল, “আমি তুয়া, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী।”
তুয়া চাঁদকে ওদের বাসায় যেতে বলল। চাঁদও হেসে জানাল, সে যাবে। তুয়া চাঁদের সাথে টুকটাক কথা বলে উঠে দাঁড়াল।
প্রত্যয় এসে পেছন থেকে ইচ্ছেকে কোলে তুলে বলল, “ইচ্ছেমণি, আমার কাছে আসো না কেন, হুম? আমি কি খুব পঁচা?”
ইচ্ছে প্রত্যয়কে দেখে বলল, “আমাকে ছালো, আমি সূচ দিব না।”
প্রত্যয় মিটিমিটি হাসতে হাসতে প্রিয়মকে ডেকে ইনজেকশন আনতে বলল। ইচ্ছে বাঁচার জন্য ছটফট করে তুয়ার কাছে যেতে চাচ্ছে। কারো সাহায্য না পেয়ে ইচ্ছে চিৎকার করে বলল, “প্রিউুম বাঁচাও! প্রিউুম! আমাতে প্রত্তুয় মেলে ফেলবে।”
ইচ্ছে প্রিয়মকে ডাকতে ডাকতে কেঁদে দিল। প্রত্যয় ইচ্ছেকে ওর কোলে বসিয়ে মিষ্টি করে বলল, “সরি রাজকন্যা। আমি খুব সরি, আর কাঁদে না।”

ইচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “না! না! সলি না। তুমি মেলা পঁচা, খুব পঁচা। তুমি আমাতে মেলা দুঃখু দিছো।”
ইচ্ছের কথা শুনে চাঁদ আর প্রত্যয়ের আম্মু হাসছেন। প্রত্যয় মন খারাপ করে বলল, “সরি ইচ্ছেমণি! আমি তোমাকে আর দুঃখ দিব না।”
ইচ্ছে তাও ফুপাচ্ছে। প্রত্যয় উঠে চানাচুরের পুরো প্যাকেট এনে ইচ্ছেকে দিয়ে বলল, “আমি তোমাকে সূচ দিব না, ইচ্ছেমণি। আমি শুধু দুষ্টুদের সূচ দিব।”
ইচ্ছে চোখ মুছে চানাচুরের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল, “সুত্ত্যি?”
প্রত্যয় হেসে বলল, “হুম! একদম সত্যি।”
ইচ্ছে এতক্ষণে দাঁত বের করে হাসল। প্রত্যয় হেসে ইচ্ছের গালে আদর দিয়ে বলল, “ইচ্ছেমণি, তোমার বিয়ে দিব চানাচুর কোম্পানির ছেলের সাথে।”
ইচ্ছে লজ্জা পাওয়ার ভাব করে বলল, “আতথা।”
ইচ্ছের কথা শুনে সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। এর মধ্যে তুয়া যে কখন চলে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। ইচ্ছে আর প্রত্যয়ের আবার ভাব হয়ে গেছে। তাই ইচ্ছে তুয়ার কাছে না গিয়ে প্রত্যয়ের কাছেই থেকে গেল।
রনিত অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কেবল বসল। পলক রনিতের পাশে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “সবাই বলছে আমাদের বাচ্চা নিয়ে নিতে।”

রনিত শান্ত ভাবে পলককে বলল, “এখন বাচ্চার চিন্তা করা যাবে না। আর সবাই বললেই যে নিতে হবে, এমন তো না।”
পলক রেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যে কেউ এসে বাচ্চার জন্য আমাকে খোঁচায়, এসব আমার অসহ্য লাগে।”
রনিত উঠে পলককে ওর পাশে বসিয়ে সুন্দর ভাবে বলল, “তোমার অল্প বয়স। অপরিপক্ব বয়সে বিয়ের কুফল তো টের পেয়েছ। তার উপরে এখন বাচ্চা নিলে তোমার জন্য রিস্কি হয়ে যাবে।”
পলক জেদ করে বলল, “না, আমি কিছু জানি না। আমি এবার বাচ্চা নিয়েই সবার মুখ বন্ধ করবো।”
পলক কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আজকে এক পাড়াতো দাদী এসে পলককে বলেছেন,
-“হ্যা লো রনিতের বো। তোরা ছৈল নিচ্ছিস না ক্যানে লো? ছৈল না হইলে ব্যাডা ম্যাইনষের মুন ঘরে টিকে না, লো। বিয়ের পরও কয়েক খান মাইয়া পোলা দেখলে ছুঁকছুঁক কইরা বেড়ায়। পরে আবার অন্য ব্যাডার লগে ভাইগ্গা যায়। তোরা তারাতারি ছৈল নিয়া নে। তাইলে দু’জনেরই মুনডা ঘরেই বান্ধা রইব নি, লো।”
পলকের এসব কথা শুনতে খুব বিরক্ত লাগে। এজন্য মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য পলক রনিতকে বাচ্চার কথা বলল। কিন্তু যত যাই হোক, রনিত দ্বিতীয় ভুল করবে না। কারণ ওর যা শিক্ষা পাওয়ার, প্রথম অঘটনে সে পেয়ে গেছে। দ্বিতীয় ভুল করে রনিত পলককে হারাতে পারবে না। এখন পলক রাগ করেছে। কিন্তু পরে ঠান্ডা মাথায় বুঝালে সে নিশ্চয়ই বুঝবে।
অন্যের খোঁচা মারা কথা থেকে বাঁচতে, অনেক মেয়ে রাগের বশে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তাদের জীবনের রিস্কের কথা দু’বার ভাবে না। ঠান্ডা মাথায় একবারও চিন্তা করেৎনা, জীবন গেলে তার যাবে অন্য কারো আসবে যাবে না। তাই চোরের ভয়ে কলাপাতায় ভাত খাওয়ার কোনো মানেই হয়।

রাত আটটার দিকে প্রত্যয় তুয়ার রুমের দরজায় নক করে বলল, “তুয়া, আমি তোমার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলতে চাই।”
প্রত্যয় সচরাচর আগ বাড়িয়ে কারো বাসায় ঢুকে না। হয়তো জরুরী কিছুর জন্য এসেছে। তাই তুয়া দরজা খুলে দিল। প্রত্যয় তুয়ার রুমে প্রবেশ করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বেডে বসল। তুয়া এখনও রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের পর থেকে তুয়া একবারও বের হয়নি, খাইও নি, কারো ডাকে সাড়াও দেয়নি। প্রত্যয়ের ডাকেই দরজা খুলল।
প্রত্যয় তুয়াকে বলল, “আমার সামনে এসে বসো।” তুয়া প্রত্যয়ের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে বসল। প্রত্যয় শান্তভাবে বলল,
-“তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে এসেছি। তুমি কি আমার কথা গুলো শুনবে? উহুম! আমি আদেশ, উপদেশ, ভাষণ কোনোটাই দিতে আসিনি।”
তুয়া প্রত্যয়ের দিকে না তাকিয়ে বলল, “বলুন।”
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আছো কেন? চোখ তুলে তাকিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলো।”
তুয়া মাথা নিচু করে একই ভাবে বসে রইল। প্রত্যয় বলল, “তুমি একজন ধর্ষিতা, তাই না?”
তুয়া অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তবুও ওর বেহায়া চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। প্রত্যয় ওর ক্ষতটা নতুন করে খোঁচাতে এসেছে জানলে, সে কিছুতেই দরজা খুলত না। প্রত্যয় তুয়াকে আবারও বলল,

– “তুয়া তোমার শরীরটা অপবিত্র, নোংরা হয়ে তুমি কলুষিত হয়ে গেছো। তুমি বেঁচে থেকে কি করবে? তার চেয়ে তুমি মরে যাও! তুমি মরতে চাইলে আমি নিজে তোমাকে সাহায্য করবো। তুমি ধর্ষিতা! ধর্ষণ হওয়ার পর ধর্ষিতাদের বাঁচার কোনো অধিকার থাকে না।”
তুয়া অবাক চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয় তুয়াকে কথা গুলো বলতে বলতে ওঠে তুয়ার একটা ওড়না এনে ফাঁস বাঁধিয়ে তুয়ার হাতে ধরিয়ে দিল। প্রত্যয় ওর পকেট থেকে ছোট্ট একটা বিষের বোতল বের করে তুয়াকে দিল। রুমের বাইরে গিয়ে সিরিঞ্জে কিছু এনে তুয়া সামনে রেখে বলল, “কিভাবে মরতে চাও চুজ করো।”
তুরাগ সহ তুয়ার আব্বু-আম্মু এসে রুমে দাঁড়াল। প্রত্যয় তুয়ার পাশে বসে বলল,
-“নাও! এবার তুমি সুইসাইড করো। আমরা দাঁড়িয়ে শুধু দেখব, কথা দিচ্ছি আমরা কেউ তোমাকে বাঁধা দিব না। তবে তুমি এখন না সুইসাইড করলে আর কোনোদিনও সুইসাইড করতে পারবে না। এটাই তোমার ফাস্ট এ্যান্ড লাস্ট চান্স। নাও! নাও! দ্রুত সুইসাইড করো। আমার আবার একটু পরে ওটিতে ঢুকবে হবে । আজকে ধর্ষিতা তুয়াকে দাফন করে তারপরেই নাহয় ওটিতে ঢুকব।”
একটু পরে, প্রত্যয়ের আব্বু-আম্মু আর চাঁদ এসে রুমে উপস্থিত হলো। তুয়া ওড়নার ফাঁসটা ছুঁড়ে ফেলে শব্দ করে কেঁদে উঠল। তুয়ার আম্মু তুয়াকে ধরতে গেলে প্রত্যয় উনাকে আঁটকে দিল। প্রত্যয় তুয়ার হাতে বিষের বোতল তুলে দিয়ে বলল, “এটা খাও। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এটা খেলে তুমি সিওর মরবে।”

তুয়া বিষের বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে কেঁদে বলল, “না! আমি মরবো না। মরবো না আমি।”
প্রত্যয় এবার সিরিঞ্জটা তুলে তুয়ার হাতে পুশ করতে গেল। তুয়া প্রত্যয়ের থেকে দুই পা পিছিয়ে উচ্চ শব্দে কেঁদে বলল, ” না! আমি সুইসাইড করবো না। আমি বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই।”
প্রত্যয় ওর হাতের সিরিঞ্জটা রেখে তুয়ার কাছে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, “তাহলে বাঁচার মতো বাঁচো। ঘরকুনো হয়ে নিজেকে কষ্ট দিয়ে গুটিয়ে নেওয়াকে বেঁচে থাকা বলে না।”
তুয়া কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যয়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল। সবাই একে একে রুম থেকে চলে গেল। প্রত্যয় তুয়ার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “তুমি বলেছিলে, একজন ধর্ষিতাকে সান্ত্বনার বাণী দেওয়া যায়, কটু কথা বলা যায়, গালমন্দ করা যায়। আজ আমি বলছি তাকে ভালবেসে আপনও করা যায়। আমি এখন তোমাকে আমার ঘরের ঘরণি করার দাবি নিয়ে এসেছি। তুমি কি আমাকে সেই সুযোগটুকু দিবে?”
তুয়া প্রত্যয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয়ের চোখ বলছে সে মোটেও মজা করছে না। তুয়া মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকল। প্রত্যয় তুয়াকে আটকাল না বরং প্রাণ খুলে কাঁদতে দিল। প্রত্যয় আবারও বলল, “তুমি আমাকে বলেছিলে, ধর্ষিতাকে দয়া করা গেলেও বউ করা যায় না। আজকে দয়া নয় বরং ভালবেসে বউ করে নিতে এসেছি।”
তুয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, “পরে আপনার আফসোস হলে?”
প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “শরীরের আত্মাকে ছুঁড়ে ফেলে কেউ কখনও বাঁচতে পারে, তুমিই বলো?”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১১]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “শরীরের আত্মাকে ছুঁড়ে ফেলে কেউ কখনও বাঁচতে পারে, তুমিই বলো?”
তুয়া মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “চলো, তাহলে আমার সামনে সুইসাইড করবে।”
তুয়া প্রত্যয়কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “না! আমি সুইসাইড করব না। আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?”
প্রত্যয় মাথা নাড়িয়ে বলল, “উহুম! আমি শুনতে পাচ্ছি না। তুমি তো ভীতু, তাই ওয়াদা করেও বলছ না। তাহলে আমি কেন তোমার কথা বিশ্বাস করব?”
প্রত্যয়ের কথা শুনে তুয়া কান্নারত সুরে বলল, “আমি সত্যিই সুইসাইড করব না। আমাকে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আচ্ছা! আমি ওয়াদা করেই বলছি, আমি সুইসাইড করব না।”
-“হুম! এবার বিশ্বাস হলো।”
প্রত্যয় তুয়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জোর দিয়ে আবারও বলল, “তুমি সুইসাইডের কথা ভুলেও মাথাতে আনবে না। তুমি বাঁচবে, আমার জন্য তোমাকে বাঁচতে হবে।”
তুয়া কাঁদতে থাকল। কিছুতেই ও চোখের অশ্রু ঝরা থামাতে পারছে না। তুয়ার এই কান্না হচ্ছে অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়ার কান্না, দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়েও নতুন উদ্যমে এক টুকরো ভরসা নিয়ে বাঁচার প্রবল ইচ্ছে পোষণের কান্না।
মানুষ শুধু কষ্টেই কাঁদে না, কাঁদে তো চরম খুশিতেও। মানুষের হৃদয়টাকে যখন অপ্রত্যাশিত কিছু আকাঙ্ক্ষা এসে ছুঁয়ে দেয়, তখনই একজন মানুষ সুখে দুঃখে আপ্লুত হয়ে দু’নয়নের অশ্রু ঝরায়।
তুয়াকে কাঁদতে দেখে প্রত্যয় মুচকি হেসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কি আরও কাঁদতে ইচ্ছে করছে?”
তুয়া বোকার মতো মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে আরও কাঁদবে। তুয়ার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ানো দেখে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “আমার বুকটা তোমার জন্য উন্মুক্ত। তুমি চাইলে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে পারো।”

প্রত্যয় কথাটা বলতেই তুয়া প্রত্যয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে নিল। তুয়া চাচ্ছিল এখন কোথাও মুখ লুকিয়ে মন ভরে কাঁদতে, চোখের পানির সঙ্গে ওর কষ্টের যাত্রাপথ এখানেই সমাপ্ত করতে। তুয়া প্রত্যয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে আগের তুলনায় দ্বিগুন শব্দে কাঁদতে লাগল। প্রত্যয় তুয়াকে ওর বাহু ডোরে আবদ্ধ করল না। বরং তুয়া নিজেই প্রত্যয়ের শার্ট খামছে ধরে প্রত্যয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। প্রত্যয়ের মুখ তখন তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।
ড্রয়িংরুমে সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। তুয়া দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে। সে ঠিক মতো খায় না, কথা বলে না, রাত হলে শব্দ করে কেঁদে ওঠে, পাগলামি করে। মেয়ের এত কষ্ট উনারাও সহ্য করতে পারেন না। তুয়ার আম্মু প্রত্যয়ের আম্মুকে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা জানায়। প্রত্যয় নিজেও এসব শুনে তুয়ার বাসায় আসে আর তুয়াকে সুইসাইডের পথ দেখায়। আমাদের মস্তিষ্কে একবার সুইসাইডের কথা ঢুকে গেলে, সেই চিন্তায় মাথাতে বার বার ঘুরপাক খায়। তখন মনে হয় সুইসাইড-ই সব সমস্যার একমাত্র সমাধান। নিজে থেকে এই চিন্তা মস্তিষ্ক থেকে না সরালে মানুষ এই পদক্ষেপই গ্রহন করে। প্রত্যয়ও টেকনিক ব্যবহার করে তুয়াকে এমন ভাবে কাবু করল। নিজে একা থাকাকালীন সুইসাইড করলেও, কারো সামনে করা যায় না। বাবা-মা, ভাইয়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে তো নয়ই। তুয়া যখন বলল সে সুইসাইড করবে না, তখন প্রত্যয় তুয়াকে ওয়াদাবন্ধ করে নিল।
একটু পরে প্রত্যয়ের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। তুয়াকে না সরিয়ে প্রত্যয় জামিলের কল দেখে রিসিভ করল। জামিল বলল, “স্যার, আপনাকে দ্রুত হসপিটালে আসতে হবে। ইমারজেন্সি হার্টের পেশেন্ট এসেছে, খুব গুরুতর অবস্থা ।”
প্রত্যয় তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “তুমি ডক্টর সোহেলকে বলো প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করতে। আমি এক্ষুণি আসছি।”

-“জ্বি স্যার।”
তুয়া প্রত্যয়ের কথা শুনে কান্না বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। প্রত্যয় বলল, “এখন আমার যেতে হবে।”
তুয়া মাথা নাড়িয়ে যাওয়ার সম্মতি জানাল। প্রত্যয় তুয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “উহুম! একদম কাঁদবে না। এখন লক্ষী মেয়ে হয়ে খেয়ে সময় মতো ঘুমিয়ে পড়বে, মনে থাকবে?”
তুয়া মাথা নাড়াল। প্রত্যয় হেসে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। প্রত্যয় ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সবাইকে বলল, “আপনারা চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ! সব ঠিক হয়ে যাবে। আম্মু, আমি এখন হসপিটালে যাচ্ছি। আমার ফিরতে অনেক রাত হবে।”
-“আব্বু কিছু তো খেয়ে যা।”
-“সময় নেই, আম্মু।”
কথাটা বলে প্রত্যয় আর দাঁড়াল না। সে লিফ্টের অপেক্ষা না করে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল। ইচ্ছে ওদের দরজার সামনে বসে খরগোশ নিয়ে খেলছিল। ইচ্ছের বাবা ইচ্ছকে সাদা ধবধবে একটা খরগোশের বাচ্চা এনে দিয়েছে। ইচ্ছে প্রত্যয়কে দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল, “প্রত্তুয়, দেকো আমাল খগরোশ কত্ত সুইটুফুল।” প্রত্যয় একবার তাকিয়ে দ্রুত পায়ে যেতে যেতে বলল, “হুম! খুব সুন্দর, ইচ্ছেমণি।”
ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে কোমরে হাত রেখে বলল, “তুমি একতা পঁচা মানুছ।”
প্রত্যয় ইচ্ছের কথাটা শুনল না। সে গাড়িতে উঠে দ্রুত ড্রাইভ করে চলে গেল।
প্রত্যয় একজন দায়িত্ববান ডক্টর। আল্লাহর রহমতে সে মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। প্রত্যয় কখনই চায় না, তার পারসোনাল লাইফের জন্য কারো প্রাণনাশ হোক। প্রত্যয়েরও ইচ্ছে করছিল তুয়াকে ওর বুকে আবদ্ধ করে রাখতে। কিন্তু সে যে পেশাতে আছে, সে চাইলেও দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। তার বিবেক তাকে দায়িত্ব এড়াতেও দিবে না।
রনিতের উপর রাগ করে পলক অন্য দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। রনিত পলককে একটানে ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল, “আচ্ছা! আমরা বাচ্চা নিব। তবে একটা শর্ত আছে।”

পলক ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি শর্ত?”
রনিত এক হাতে ভর দিয়ে শুয়ে বলল, “তুমি নিজে মেয়ে খুঁজে আমাকে আরেকটা বিয়ে দিলে আমরা বাচ্চা নিব।”
-“কেন? আমি তোমাকে বিয়ে দিব কেন?”
-“কারণ বাচ্চা নিলে তুমি মারাও যেতে পারো। বউ ছাড়া তো আর একা থাকা যায় না, তাই না? তখন তো আমাকে আরেকটা বিয়ে করতেই হবে। তুমি যখন থাকবে ‌না তখন ওই বউকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাব, আদর করব, তাকে ভালবাসব। তাই বলছি মরার আগে তুমি এসব দেখে যাও, আর বাচ্চা নিয়েও যাও।”
পলক ছলছল চোখে রনিতের দিকে তাকিয়ে আছে। রনিত স্বাভাবিক ভাবে পলকের দিকে তাকাল। পলক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে রেগে বলল, “তোর কয়টা লাগে?”
রনিত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,”ইয়া আল্লাহ! ছিঃ! ছিঃ! স্বামীকে কেউ তুই বলে?”
-“অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘুমানোর এত শখ তোর?”
-“বিয়ে করালে ঘুমাব, আদর ক..।”
রনিত পুরো কথা বলতে পারেনি। তার আগেই পলক রনিতের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। এতটাই জোরে কামড়ে ধরেছে যে রক্ত বেরিয়ে গেছে। রনিত পলককে জোর করে ছড়িয়ে হাত দিয়ে ওর ঠোঁট চেপে ধরল। গলগল করে ঠোঁট থেকে রক্ত বের হচ্ছে, পলকের ঠোঁটেও রক্ত লেগে গেছে। তবুও পলকের চোখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। সে যেন এতটুকুই সন্তুষ্টু নয়। পলক রক্তমাখা ঠোঁটে হেসে বলল, “আর বিয়ে করবা?”
রনিত করুণ দৃষ্টি তাকিয়ে বলল, “না! আমার বিয়ের শখ মিটে গেছে।”

পলকের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটল। মেয়ে জাতি বড়ই অদ্ভুত। এরা বাবা আর স্বামীর ভাগ কোনো পরিস্থিতিতেই কাউকে দিতে চায় না। এই দু’টোই মেয়েদের নিজস্ব সম্পদ। বিয়ের পর স্বামী নামক মানুষটার মুখে অন্য মেয়েকে কথা শুনতেও মেয়েরা বড্ড নারাজ।
রনিত পলককে সোজা ভাবে বুঝালে বুঝত না। তাই সে একটু বাঁকা ভাবে বুঝাতে চাইছিল। যাতে পলক একটু হার্ট হলেও রনিতের কথাটা সহজে ধরতে পারে। কিন্তু পলক তো বুঝলই না, বরং উল্টে রনিতের উপরই হামলা করল। সে ভাবল না রনিত তাকে ভালবাসে বলেই তার লাইফ রিস্কে ফেলতে চাচ্ছে না। রনিত পলকের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, “নারী জাতি তোমরা বড়ই অদ্ভুত। নিজের লাইফ রিস্কের কথা একবারও ভাবছ না। কিন্তু স্বামীর ভাগ ছাড়ার কথা ভুলেও কল্পনাতে আনো না।”
[বুকের বা পাশে গল্পের সঙ্গে এই গল্পের কোন মিল নেই। আর যারা রেগুলার গল্পে না দিলে খোঁচা মেরে কথা বলছেন, তাদের বলছি গল্প ঠান্ডা মাথা ভেবে তারপর লিখতে হয়, লিখলাম বললেই লিখা হয়ে যায় না। সুন্দর করে সাজিয়ে লিখতে গেলেও একটু সময়ের প্রয়োজন, ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি বলে সেই সময়টুকু হচ্ছে না। আর যে গ্রুপ গুলো গল্প পোষ্ট করি সেখানে নেক্সট ছাড়া কোন রেসপন্স করেন না। গল্প পড়েন কিন্তু দু’টো ভাল মন্দ লিখেন না। তাহলে কি আমারও উচিত নয়, আপনাদের খোঁচা মেরে অথবা আরো দেরী গল্প দেওয়া? সত্যি কথা হলে দিনে এক পার্ট না দুই পার্ট দিলেও আপনারা সেইম কাহিনিই করেন। গল্পের মাঝে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। নিচে দিলে সবাই পড়ে না।]
প্রিয়ম বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে কেবল বসল। চাঁদ প্রিয়মের দরজার আড়াল থেকে বলল, “আসব?”

প্রিয়ম গম্ভীর গলায় বলল, “আর এক পা বাড়ালে এক কানে মেরে আরেক কান গরম করে দিব। এবার থাপ্পড় খেতে চাইলে আয়।”
চাঁদ ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। সে প্রিয়মের সামনে গেলেই প্রিয়ম ওকে থাপ্পড় মারে। সবার সামনে তুমি করে বললেও সবার আড়ালে তুই করে কথা বলে। এক কথায় সে চাঁদকে সহ্যই করতে পারে না। প্রিয়মের কথা শুনে চাঁদ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, “আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছ কেন ?”
প্রিয়ম বলল, “খুশির ঠেলায়! কোনো কাজ পাচ্ছি না তাই।”
প্রিয়মের কড়া কথা শুনে চাঁদ কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমে চলে গেল। প্রিয়ম চাঁদের মুখ দেখতেও নারাজ, চাঁদ এত চেষ্টা করেও প্রিয়মকে স্বাভাবিক করতে পারছে না। প্রত্যয়ের জন্য প্রিয়ম চাঁদকে বাসা থেকে বের করে দিতেও পারছে না। চাঁদও কম চালাক নয়! সেও কেঁদে কেঁদে প্রত্যয়কে সাপোর্টার হিসেবে পাশে পেয়েছে। এটাই হয়েছে প্রিয়মের রাগের আরেকটা কারণ। প্রিয়ম এত বলেও চাঁদকে ওর বাসায় পাঠাতে পারছে না, চাঁদ জেদ করে এখানে পড়ে আছে। আর প্রিয়মের জেদ সে চাঁদকে বউ হিসেবে মানে না আর মানবেও না।
তুয়া রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে। তুরাগ দরজা অবধি এসে তুয়াকে দেখে চলে গেল। তুয়াকে একা থাকতে দিয়ে, নিজের করা প্রশ্নের উত্তর নিজেকে খুঁজতে দিল। অন্য কেউ এসে কখনও কারো জীবনের সমীকরণ মিলাতে সক্ষম হয় না। নিজের জীবনের সমীকরণ নিজেকেই মিলাতে হয়, সেটা যতই কঠিন অথবা অসম্ভব হয়ে উঠুক না কেন।
আজকে আকাশে চাঁদ-তারা কোনোটাই নেই, শূন্য আকাশটা মেঘে ঢেকে আছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে, চারদিন সুনশান নিরিবতায় ছেয়ে গেছে। এই গভীর রাতে সুখী মানুষ গুলো সুখের নিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে। আর রাত জাগা পাখি গুলো রাত পাহারা দিচ্ছে। তুয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আল্লাহ, আমি ওকে পবিত্র ভাবে তোমার কাছে চেয়েছিলাম। আমাকে যখন দিলেই তাহলে ধর্ষিতার কালিমা লাগিয়ে দিলে কেন?”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

তুয়া ওর পছন্দের ডায়েরিটা বের করেছে। নীল রংয়ের ডায়েরিটা দেখতে বেশ সুন্দর। এখানে তেমন কিছু লিখা নেই। এটা গত দুই সপ্তাহ আগে তুয়া ডায়েরিটা কিনেছিল। তবে তুয়া এই ডায়েরিটা সব সময় লুকিয়ে রাখে। কারন ডায়েরির কয়েকটা পৃষ্ঠায় বিশেষ কাউকে নিয়ে লিখা আছে।
তুয়া ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় হাত বুলালো, সেখানে যত্ন করে লিখা,
প্রথম পৃষ্ঠা,
-“তোমার হাসি দিয়ে আমাকে ঘায়েল করতেই হতো? না করলে বুঝি খুব মন্দ কিছু ঘটত। ”
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা,
-” মুগ্ধতা থেকে কবে ঘটবে পূর্ণতা?”
তৃতীয় পৃষ্ঠা,
-” ইস! এভাবে তাকিও না। তোমার ঘায়েল করা
চাহনিতে লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।”
চতুর্থ পৃষ্ঠা,
-“এই দুষ্টু! আমাকে এতটা বেতাল করে তবেই বুঝি শান্তি পেলে, হুম?
পঞ্চম পৃষ্ঠা,
-“কবে তুমি নাম ধরে ডাকবে, কবে তুমি হাতে হাত রাখবে?”
ষষ্ঠ পৃষ্ঠা,
-“এত ভদ্র হওয়া মোটেও ভাল নয়, স্যার। একটু একটু অভদ্র হবেন, তবে শুধু আমার কাছে। কি মনে থাকবে তো?”
সপ্তম পৃষ্ঠা,
-“কবে শেষ হবে অপেক্ষার প্রহর? আসবে তুমি? বাসবে ভাল, বলবে ভালবাসি?”
নবম পৃষ্ঠা,

-“আমি এখন ধর্ষিতা কালিমায় অভিশপ্ত, ডক্টর সাহেব। তোমার আমার যাত্রাপথ এখানেই সমাপ্ত।”
পরের পৃষ্ঠা গুলোতে আর কিছু নেই। তুয়ার একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নবম পৃষ্ঠার লিখাটার উপরে। তুয়া ভেবেছিল ওর ভালবাসার প্রকাশ আর ঘটবে না। ধর্ষিতাকে মানুষ বলেই তো গণ্য করা হয় না, তার ভালবাসার দাম আর কে দিবে? তুয়া ভেবেই নিয়েছিল সে প্রত্যয়কে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ভাগ্য প্রত্যয়কে তুয়ার কাছে এনে দিল। হয়ত এটাই তুয়ার মোনাজাতে প্রত্যয়কে শুদ্ধ মনে পবিত্র ভাবে চাওয়া ফল।
পরেরদিন ভোরে প্রত্যয় বাসায় ফিরল। একজন পেশেন্টের জন্য সারারাত জেগে ছিল। প্রত্যয়ের আম্মু নামাজ পড়ার জন্য উঠে প্রত্যয়কে দেখে বললেন, “আব্বু, আজকাল তোর খুব ধকল যাচ্ছে। এভাবে চললে তো তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি।” প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “আমি ঠিক আছি, আম্মু।”
প্রত্যয়ের আম্মু আর কথা বাড়ালেন না, উনি চলে গেলেন। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। ডাক্তারী পড়ার প্রথম ধাপ থেকেই রাত জাগাটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর কথাতেই আছে মানুষ অভ্যাসের দাস। তাই এখন প্রত্যয়ের খুব একটা সমস্যা হয় না।
প্রত্যয় একটু পরে চোখ খুলে বুকের বা পাশটায় হাত রাখল। কালকে যেখানটাই তুয়া মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল। কালকের কথা ভেবে প্রত্যয় মুচকি হেসে আবার ওর চোখ দু’টো বন্ধ করে নিল।
**!!
“আমাকে ভালবাসলে কি তোর হৃদয়টা পঁচে যাবে?”

চাঁদ কথাটা বলে অঝরে কাঁদতে লাগল। কালকে রাতে চাঁদ জোর করে প্রিয়মকে জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু ফলস্বরুপ প্রিয়ম ওকে চারটা থাপ্পড় মেরে রুম থেকে বের করে দিয়েছে। চাঁদ এত আঁকুতি করেও প্রিয়মের মন গলাতে সক্ষম হয়নি। শক্ত পুরুষালী হাতের থাপ্পড় খেয়ে চাঁদের জ্বর চলে এসেছে। সে যতই কষ্ট পাক তবুও থামবেনা। সে প্রিয়মের থেকে ভালবাসা আদায় করে তবেই ছাড়বে। চাঁদ তো প্রিয়মকে পাগলের মত ভালবাসে, তাহলে প্রিয়ম কেন ওকে ভালবাসবে না?
চাঁদ বালিশ আঁকড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল, “তোমার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোমাকে বিয়ে করে, আমার বিন্দুমাত্রও আফসোস নেই। আজ আমাকে কষ্ট দিচ্ছো দাও, কালকে নাহয় ভালবেসে পুষিয়ে দিও।”
চাঁদ এসব মনগড়া কথা বলে নিজেকে শান্তণা দিলে, ওর মনে ভয় এসে বাসা বেঁধেছে। আর ভয়টা হল প্রিয়মকে চিরতরে হারানোর ভয়। চাঁদও বুঝে গেছে প্রিয়ম মারাত্মক জেদি ছেলে। ওকে বশে আনা মোটেও সহজ হবেনা, কিন্তু সেও হাল ছাড়বেনা। প্রিয়মের ভালবাসা পেতে কষ্টকেই সঙ্গী করে সে লড়ে যাবে। তবুও এত সহজে সে প্রিয়মকে কিছুতেই
হারাতে দিবেনা।
প্রিয়মের প্রতি চাঁদের ভালবাসাটা হল কাটাযুক্ত গোলাপ মত। আর এখানে চাঁদও হাজার বার কাঁটার খোঁচায় রক্তাক্ত হতে প্রস্তুত। তবুও প্রিয়মকে এক চুল পরিমাণ ছাড়তেও, সে রাজি নয়।
**!!

আজকে শুক্রবার এজন্য রনিত এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। পলক এই নিয়ে চার বার রনিতকে ডেকে গেল। কিন্তু রনিত, “হুম! হুম! উঠছি আর একটু!” এসব বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে।
ওই দিকে রনিতের মা পলককে বলছেন, “পলক রনিতকে ডেকে বাজারে যেতে বল।” পলক আবার রুমে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এই! এই লোক উঠছেন না কেন আপনি? মা আপনাকে বাজারে যেতে বলছেন। কি হলো উঠুন!”
রনিত পাশ বালিশটাকে বুকে জড়িয়ে বলল, “তুমি যাও, আমি আসছি।”
বেশ কিছুক্ষণ পর রনিতকে বাজারে যেতে না দেখে রনিতের মা পলককে বলল, “কেমন মেয়ে তুমি যে স্বামীকে ডেকে তুলতে পারছ না? এত গিলেও গলার জোর বাড়েনা?”
পলক মাথা নিচু করে নিল। সে কারো মুখে মুখে তর্ক করতে পারেনা। রনিতের মা নিজের ছেলের দোষ দেখল না, পরের মেয়েকে ঝেড়ে চলে গেলেন।
পলক সয়া সসের বোতলটা নিয়ে রুমে ঢুকে রনিতের বুকের উপর বসল। রনিত এখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পলক শক্ত করে রনিতের নাক চেপে ধরল। নাক চেপে ধরায় রনিত হা করার সঙ্গে সঙ্গে পলক রনিতের মুখে সয়া সস ঢেলে দিল। এমন ঘটনায় রনিত মুখ ভর্তি সস দিয়ে হতভম্ব হয়ে চোখ খুলে তাকাল। পলক রাগে হনহন করতে করতে স্থান ত্যাগ করল।
রনিত দ্রুত উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে বমি করতে লাগল। সকালবেলা সসের গন্ধে ওর বমিও হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর রনিত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলল, “এই মেয়ে মানুষ যে কি দিয়ে তৈরী আল্লাহ মাবুদই জানে। আর আমার রেস্ট করার দিনই মেহমানদের আসতে হবে, উফ! অসহ্য লাগে। ”
**!!

ইচ্ছে তুয়াদের বাসায় সোফায় বসে চানাচুর খাচ্ছে। তুয়া ইচ্ছের পুতুলকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। তুরাগ এসে ইচ্ছের পাশে বসে বলল, “ইচ্ছেপাখি তুমি একটা কথা শুনেছ? ইচ্ছে মুখ ভর্তি চানাচুর নিয়ে বলল, ” তি কঠা?”
তুরাগ আড়চোখে তুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ” তুয়া কালকে সারারাত কেঁদেছে।” ইচ্ছে তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে তুরাগকে বলল, “কাঁদছিল ক্যানো?” তুরাগ দাঁত বের করে হেসে বলল, “প্রত্যয়কে বিয়ে করার জন্য।”
তুয়া হাতের পুতুলটা রেখে তুরাগকে দৌড়ানি দিল। তুরাগ দরজা খুলে সিঁড়ির কাছে গিয়ে বলল, “টুপা, আমাকে মারলে আমি সব কথা প্রত্যয়কে বলে দিব।” তুয়া রেগে তুরাগের দিকে তাকিয়ে আছে।
তখনই প্রিয়মকে বের হতে দেখে ইচ্ছে দৌড়ে গিয়ে বলল, “প্রিউুম! প্রিউুম! কালকে তুয়া আপু এত এত কেঁদেছিল।”
প্রিয়ম ইচ্ছের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “কেন?” ইচ্ছেও তুরাগের মত দাঁত বের করে হেসে বলল, “প্রত্তুয়কে বিয়ে কলাল জন্য।” তুয়া উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। তুরাগ পেটে হাত দিয়ে এখনও হো হো হাসছে। ইচ্ছেও খিলখিল করে হাসছে।
প্রিয়ম উচ্চশব্দে প্রত্যয়কে, “ভাইয়া! ভাইয়া! করে ডাকল। প্রত্যয় কেবল ঘুম উঠে ফ্রেশ হয়ে মুখ মুছছিল। প্রিয়মের ডাক শুনে প্রত্যয় টাওয়াল গলায় ঝুলিয়ে প্রিয়মের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ” প্রিয়ম, কিছু বলবে?” প্রিয়ম বলল, “কালকে সারারাত তুয়া কেঁদেছিল।”
প্রত্যয় তুয়াকে উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে থাকতে দেখল, ততক্ষণে দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত হয়ে গেছে। প্রত্যয় প্রিয়মের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ” কাঁদছিল কেন?” প্রিয়ম তুরাগ আর ইচ্ছের মত দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমাকে বিয়ে করার জন্য।”
প্রিয়মের কথা শুনে প্রত্যয় বাদে সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। প্রত্যয় শব্দ করে না হাসলেও ওর মুখে মুচকি হাসি। এদের কথা শুনে তুয়া যে দৌড়ে পালাবে সেই সুযোগটুকু ওর নেই। ওর আব্বু আম্মু ওদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “এ তো আমার সৌভাগ্য।”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৭+৮+৯

তুয়া আর দাঁড়াল না। মাথা নিচু করে ওর আব্বু আম্মুকে সরিয়ে দৌড়ে চলে গেল। প্রত্যয়ও হাসতে হাসতে রুমে ডুকে গেল।
প্রত্যয়ের আম্মু হাসতে হাসতে বলল, “প্রিয়ম এই খবর কে ভাইরাল করল?” প্রিয়ম আঙ্গুল দিয়ে ইচ্ছেকে দেখিয়ে দিল। ইচ্ছে তুরাগকে দেখাতে যাবে, তখন দেখে তুরাগ ওখানে নাই। ইচ্ছে বলল, “আমাকে তুলাগ জানপাখি বলেছে।” তুয়ার আব্বু হাসতে হাসতে বললেন, “আজকে তুরাগ আর ইচ্ছের খবর আছে।”
**!!
আজকে শুক্রবার তাই প্রত্যয় দুই ঘন্টার জন্য ওর সার্জারির পেশেন্টদের দেখতে গেল। প্রত্যয় হসপিটাল থেকে ফিরে শাওয়ার নিয়ে নামাজের জন্য রেডি হল। শুক্রবারের অন্যতম মুহূর্ত হল, যখন বাসার সব ছেলেরা একসঙ্গে নামাজের জন্য বের হয়। প্রত্যয়ের আব্বুসহ ওরা দুই ভাই বের হওয়ার সময় দেখল, তুয়ার আব্বু দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রত্যয়ের আব্বু বললেন, “ভাই দাঁড়িয়ে আছেন যে?” তুয়ার আব্বু বললেন, “তুরাগের জন্য,ওই যে ভাই বোন মারামারির শুরু করেছে।”
তুরাগ তুয়ার পেছন পেছন ঘুরছে পান্জাবীর বোতাম লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তুয়া চুপ করে বসে নখ কাটছে। যেন সে কিছু শুনতেই পাচ্ছে না।
তুরাগ করুণ সুরে বলল,” মসজিদে জিলাপি দিলে এনে দিব, এবার তো দে বোন আমার।”

তুয়াদের দরজা খোলা থাকায় সবাই ওদের কাহিনী দেখছে। তুয়া নখ কেটে আঙ্গুলে ফু দিতে যাবে তখন দেখল প্রত্যয়রা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তুয়া ভদ্র ভাবে উঠে তুরাগের পান্জাবীর বোতাম লাগিয়ে দিল। তুরাগ তুয়ার গাল টেনে হেসে প্রত্যয়দের সঙ্গে চলে গেল।
তুয়া পর্দার আড়ালে থেকে নিচে তাকাল। পাঁচজন একসঙ্গে নামাজে যাচ্ছে। প্রত্যয় আর তুয়ার আব্বু সাদা, প্রিয়ম হালকা গোলাপি, তুরাগ মেরুন, আর প্রত্যয় আকাশি আর সাদার সংমিশ্রণের পান্জাবী পরিহিত।
পাঁচজনের মাথায় শুভ্র চওড়া টুপি। তুয়ার কাছে এই মুহূর্তটা দেখতে বেশ ভাল লাগছে। তুয়া ওর ডায়েরি বের করে লিখল, “এক টুকরো আকাশ সেজে তোমাকে দেখতে বেশ ভাল লাগছে। একদম আমার সুদর্শন শঙ্খচিলের মত ।”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৩+১৪+১৫