সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৩+১৪+১৫

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৩+১৪+১৫
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

তুয়া ওর ডায়েরিতে লিখল, “এক টুকরো আকাশ সেজে তোমাকে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। একদম আমার সুদর্শন শঙ্খচিলের মতো।”
কথাটা লিখে তুয়া লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ডেকে নিল। তুরাগরা ফিরলে দুপুরে একসঙ্গে খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। তুয়ার আম্মু তুয়াকে একবার দেখে চলে গেলেন।
প্রত্যয়রা সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। প্রিয়ম চাঁদের সঙ্গে খেতে বসে না। তাই চাঁদ খাবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে গেল। প্রিয়ম একটু পরে খেতে আসলো। সবাই খেতে খেতে কিছু নিয়ে আলোচনা করছিল, হঠাৎ চাঁদের অট্রহাসির হাসির শব্দে সবাই কথা থামিয়ে ওর দিকে তাকাল। চাঁদ মুভি দেখে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
প্রিয়ম রাগী চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর একটা টু শব্দ আমার কানে আসলে খবর আছে।”
প্রিয়মের কথা শুনে চাঁদের হাসিটা মলিন হয়ে গেল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “চাঁদ, হাসি আটকাবে না। যারা বেশি হাসে তাদের মন ভাল থাকে।”

চাঁদ হেসে বলল, “সত্যি?”
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “একদম সত্যি।”
চাঁদ প্রত্যয়ের সাপোর্ট পেয়ে আগের ন্যায় মুভি দেখে হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে প্রিয়ম বাদে বাকিরাও মিটিমিটি হাসতে লাগল।
প্রিয়ম কোনো রকমে খেয়ে উঠে চলে গেল। প্রত্যয়ের আব্বু বললেন, “প্রত্যয়, প্রিয়মের সঙ্গে সরাসরি কথা বলো, প্রিয়ম নিশ্চয় তোমার কথা শুনবে।”
প্রত্যয় পানি খেয়ে গ্লাস রেখে মুচকি হেসে বলল, “আব্বু, ভাই পড়াশোনা না করলে বুঝিয়ে বলা যায়। সিগারেট খেলে বা অন্যায় কাজে লিপ্ত হলে দু’টো মেরে শাসন করা যায়। কিন্তু ভাইয়ের জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের দায়িত্ব-সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। আর অধিকার আছে বলে তো অনধিকারচর্চা করতে পারি না।”
প্রত্যয়ের কথা শুনে কেউ আর কথা বাড়ালেন না। চাঁদও প্রত্যয়ের কথা গুলো শুনল। সবাই নিজের খাওয়া সমাপ্ত করে রুমে চলে গেল। প্রত্যয় রুমে গিয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে লাগল। হঠাৎ দরজার কাছে ছোট ছোট দু’টো পা দেখে প্রত্যয় চোখ বন্ধ করে নিল। ইচ্ছে উঁকি মেরে দেখল প্রত্যয় ঘুমাচ্ছে। সে সর্তকতার সাথে রুমে প্রবেশ করে পরখ করল প্রত্যয় সত্যি ঘুমাচ্ছে।
ইচ্ছে দুষ্টু হেসে প্রত্যয়ের ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার আগেই, প্রত্যয় ওর হাত ধরে বলল, “এগুলো কি দিচ্ছ?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইচ্ছে ভয়ে ঢোক গিলে বলল, “তোমাকে বউ সাজাব, তাই নিমিষ্টিক দিচ্চি।”
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “প্রিয়ম বউ সাজতে পছন্দ করে, ওকে গিয়ে সাজাও।”
ইচ্ছের চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে উঠে নিমিষেই মুখটা মলিন করে বলল, “যদি না দেয়?”
প্রত্যয় ইচ্ছের কানে কানে কিছু বলল। ইচ্ছে দাঁত বের করে হাসল। প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে প্রিয়মের রুমে নক করল। প্রিয়ম দরজা খুলে প্রত্যয়কে দেখে বলল, “ভাইয়া, ভেতরে এসো।”
প্রত্যয় রুমে প্রবেশ করে বলল, “প্রিয়ম, শুয়ে পড়ো। ইচ্ছে তোমার হার্ট চেক করবে।”
প্রিয়ম ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে হেসে শুয়ে পড়ল। ইচ্ছে প্রিয়মের বুকে হাত রেখে বলল, “রুগী মারা গেছে, রুগীকে সূচ দিতে হবে।”
প্রত্যয় হেসে বলল, “তাহলে পেশেন্টের হাত বাঁধতে হবে, যাতে নড়াচড়া করতে না পারে।”
প্রিয়ম শুয়ে শুয়ে দু’জনের কান্ড দেখছে। ইচ্ছে গিয়ে চাঁদের একটা ওড়না এনে বলল, “প্রত্তুয়, হাত বাঁদো।”
প্রত্যয় প্রিয়মের হাত বেঁধে ইচ্ছেকে প্রিয়মের বুকের উপর বসিয়ে দিল। প্রিয়ম ইচ্ছের হাতে লিপস্টিক দেখে বলল, “না! ভাইয়া এটা ঠিক না। আমার হাত খুলে দাও, ভাইয়া।”
প্রত্যয় হাসতে হাসতে বলল, “ট্রিটমেন্ট চলছে, কথা বলিও না।”
ইচ্ছে প্রিয়মের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে গেলে, প্রিয়ম মাথা নড়াচ্ছে দেখে ইচ্ছে প্রিয়মের গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলল, “চুপ, একদম চুপ।”
প্রিয়ম করুণ চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “আম্মু! আম্মু! আমাকে বাঁচাও।”
ইচ্ছে আরেকটা থাবড় দিয়ে বলল, “চুপ! চুপ বলছি!”
প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে প্রিয়মকে ফাঁসিয়ে চলে গেল।‌ প্রিয়মের ডাক শুনে ওর আম্মু এসে এসব দেখে হাসতে হাসতে বললেন, “ইচ্ছে, আর সাজগোজের জিনিস লাগবে?”

ইচ্ছে দাঁত বের করে হেসে বলল, “দাও।”
প্রিয়মের আম্মু ইচ্ছেকে উনার মেকাপ বক্স দিয়ে চলে গেলেন। ইচ্ছে ওর মনমতো প্রিয়মকে সাজাতে লাগল। প্রিয়ম করুণ চোখে ওর আম্মুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। সে কিছু বলতেও পারছে না, কিছু বললেই ইচ্ছে ওকে মারছে।
প্রত্যয় রুমে এসে দেড় ঘন্টার মতো ঘুমাল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে কলিকে খেতে দিতে বেলকনিতে গেল। তুয়া তখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। হঠাৎ কলির চেচাঁমেচি শুনে তুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কলি অনবরত বলে যাচ্ছে, “তুয়া! বউ! তুয়া! বউ!” তুয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তুয়ার মুখভঙ্গি দেখে প্রত্যয় মিটিমিটি হাসতে হাসতে চলে গেল।
সন্ধ্যার পর ইচ্ছে দৌড়ে এসে তুয়াকে বলল, “আপু, প্রত্তুয়ের বুকে দুঃখু! চল! চল।”
তুরাগ এসে বলল, “তুয়া দ্রুত প্রত্যয়দের বাসায় চল।”
তুয়া কিছু বলতে পারছে না, অজানা ভয়ে ওর বুক কাঁপছে। ওর মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে, প্রত্যয় ঠিক আছে তো?
ইচ্ছে তুয়ার হাত ধরে টানতে টানতে প্রত্যয়দের ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসলো। সবাই গোল হয়ে বসে আছে কিন্তু প্রত্যয় নেই। তুয়া ঢোক গিলে তুরাগকে বলল, “প্র প্রত্যয় কই, ভাইয়া?”
প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন। বিকেলে প্রত্যয় হসপিটালে গিয়েছিল। টানা দুই ঘন্টা পেশেন্ট দেখে উঠতে যাবে, তখন তুরাগের কল পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ছুটে আসল। ওদের ড্রয়িংরুমের সোফাতে লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিত তুয়াকে দেখে প্রত্যয় দাঁড়িয়ে গেল।

প্রত্যয় জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। সে যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিল। তুরাগ ওকে বলেছে, তুয়া আবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। কিছুতেই ওর সেন্স ফিরছে না। ওর হৃৎস্পন্দনের গতি কমে যাচ্ছে। এসব শুনে প্রত্যয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। সাদা শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। পরিপাটি ছেলেটার এই অবস্থা দেখে সবাই হেসে উঠল।
প্রত্যয় নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, “হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে সম্পর্কিত ফান বুকে গিয়ে বিঁধে। দম আঁটকে আসে, মনে হয় এক্ষুণি মারা যাব।”
প্রত্যয়ের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। তুয়া প্রত্যয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তুরাগ এসে প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমাদের দু’জনের টান পরীক্ষা করছিলাম। এখন কেউ কারো থেকে অনুভূতি আড়াল করতে পারবে না।”
প্রত্যয়ের আব্বু এসে বলল, “যাও, রেডি হয়ে এসো।”
প্রিয়ম প্রত্যয়কে নিয়ে ওর রুমে গেল। প্রত্যয় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পড়ে তুয়ার পাশে বসল। কাজী এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করল।
তুয়া ভাবতেও পারেনি ওর জীবনে এমন সুখময় মূহুর্ত আসবে। তুয়ার চোখের পানি অঝরে ঝরে যাচ্ছে। প্রত্যয় সবার আড়ালে তুয়ার এক হাত শক্ত করে ধরল। তুয়াও প্রত্যয়ের হাতটা আঁকড়ে ধরল।
তুয়ার শাড়ির আঁচলে ওদের হাতের শক্ত বন্ধনটা ঢেকে আছে। যেটা গভীর ভাবে পরখ না করলে কেউ বুঝতেও পারবে না। তুয়া তিনবার কবুল বলে প্রত্যয়কে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করল।

“আল্লাহ, পরিপূর্ণ ভাবে ওকে ভাল রাখার তৌফিক দান করো।” প্রত্যয় মনে মনে কথাটা বলে কবুল বলল।
তুয়া এখনও শক্ত করে প্রত্যয়ের হাত ধরে আছে। মোনাজাতের সময় ওরা হাত ছাড়ল। দু’জনেই সাইন করে বিয়ের বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হল। বাসার সবাই যে ওদের এভাবে সারপ্রাইজ দিবে, ওরা ভাবতেও পারে নি। মোনাজাত শেষে কাজী খাওয়া-দাওয়া করে চলে গেলেন। দুই পরিবার মিলে খাওয়ার পর্ব শেষ করলেন।
তুয়া প্রত্যয়ের পাশে চুপটি করে সোফাতে বসে আছে। তুরাগ এসে বলল, “তুলা, এবার বাসায় চল।”
তুয়া প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “যাও।” তুয়া মাথা নিচু করে নিল। সবাই মিটিমিটি হাসছে। প্রত্যয়ের আম্মু বললেন, “এ তো বর পাগল মেয়ে।”
উনার কথা শুনে সবাই অট্রহাসিতে ফেটে পড়ল। ইচ্ছের আম্মু, চাঁদ আর প্রিয়ম প্রত্যয়ের রুম সাজিয়ে বের হলো। ইচ্ছের আম্মু বলল, “কি রে তুয়া, বাসায় যাবি না?”
তুয়া করুণ চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় স্বাভাবিক ভাবে বসে আছে। কিন্তু পা দিয়ে তুয়াকে আঁটকে রেখেছে, এটা কেউ টেরও পাচ্ছে না। প্রত্যয়ের আব্বু হাসতে হাসতে বললেন, “আমার পুত্রবধূ যখন যাবে না, তখন কেউ জোর করবে না।”
-“তুলা, মান ইজ্জত শেষ করে দিলি।” (তুরাগ)
সবাই তুয়াকে নিয়ে অনেক মজা করলেন।
তুয়ার আব্বু এসে তুয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, “মন খারাপের কিছু নেই। পাশাপাশি আমাদের বাসা।”
তুয়ার ছলছল চোখে ওর আব্বু-আম্মুর দিকে তাকাল। প্রত্যয় তুয়ার পা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তুয়ার আম্মু বললেন, “এটাই তোমার আসল ঠিকানা। নিজে ভাল থেকো আর সবাইকে ভাল রেখো।”
তুয়ার আব্বু-আম্মু চলে গেলেন। তুরাগ ছলছল চোখে বলল, “ভাল থাক।” তুয়া তুরাগকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। তুরাগ তুয়ার চোখে পানি মুছে দিয়ে চলে গেল। ইচ্ছের আম্মু আর চাঁদ তুয়াকে প্রত্যয়ের রুমে রেখে স্থান ত্যাগ করল।
প্রত্যয় ড্রয়িংরুমে সোফাতে বসে ফোনে কথা বলছে। প্রিয়ম ওর রুমে চলে গেল। প্রিয়মের আম্মু প্রিয়মকে পানি দিতে গিয়ে বললেন, “প্রিয়ম, তোমার চোখ লাল হয়ে আছে কেন? কিছু হয়েছে, আব্বু?”
প্রিয়ম বুকের বা পাশে হাত বুলিয়ে বলল, “না আম্মু, বুকে জ্যাম বেঁধেছে তাই হয়তো চোখ লাল দেখাচ্ছে।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৪]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রিয়ম বুকের বা পাশে হাত বুলিয়ে বলল, “না আম্মু, বুকে জ্যাম বেঁধেছে তাই হয়তো চোখ লাল দেখাচ্ছে।”
প্রিয়মের আম্মু ছেলের বুকে হাত বুলিয়ে বললেন, “কখন ঠান্ডা লাগালে, আদা চা করে দিব?” প্রিয়ম হেসে বলল,”না এমনিতেই সেরে যাবে তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।” ওর আম্মু দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন,” দরজা আটকাবে না আমি এক্ষুণি আসছি।”
প্রত্যয় কল কেটে ওর আম্মুকে রান্নাঘরে দেখে বলল, “আম্মু কি করছ?” ফ্ল্যাস্কে গরম পানি ঢালতে ঢালতে ওর আম্মু বললেন, “প্রিয়মের ঠান্ডা লেগে বুকে ব্যাথা করছে। তাই চা আর গরম পানি করছি।” প্রত্যয় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে প্রিয়মের রুমের দরজা নক করল। প্রিয়ম প্রত্যয়কে দেখে বলল, “ভাইয়া, এসো।”
প্রত্যয় প্রিয়মের কপাল আর বুক চেক করে বলল, ” খুব ব্যাথা করছে, মেডিসিন দিব?” প্রিয়ম হেসে বলল, ” আমি ঠিক আছি, ভাইয়া।” প্রত্যয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ” আচ্ছা! তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো?” প্রিয়ম হেসে বলল,” তেমন কিছু না ভাইয়া আমি ঠিক আছি।”
ওদের আম্মু রুমে প্রবেশ করলেন এবং ফ্ল্যাস্কে গরম পানি আর চা দিয়ে রাখলেন। প্রত্যয় পেইন কিলার এনে দিল, যাতে বুকে বেশি ব্যাথা করলে প্রিয়ম খেতে নিতে পারে। প্রিয়ম হেসে বলল, “ভাইয়া রুমে যাও তুয়া অপেক্ষা করছে।” প্রত্যয় প্রিয়মকে সাবধানে থাকতে বলে চলে গেল। প্রিয়ম ওর আম্মুকেও জোর করে রুমে পাঠিয়ে দিল।

প্রত্যয় ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করল। ওর রুমটা ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। তুয়া প্রত্যয়ের অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। প্রত্যয় দরজা আঁটকে মুচকি হেসে বলল, “অবশেষে ঘুমকাতুরে বউ পেলাম।”
প্রত্যয় খেয়াল করল তুয়া বেলী ফুলের গয়না পড়ে আছে। মাথায়, গলায়, বাহুতে, কব্জিতে, কোমরে, পায়েও ফুলের গয়না পড়ে, সে ফুলপরী সেজেছে। তুয়াকে অসাধারণ সুন্দর দেখাচ্ছে। প্রত্যয় তুয়ার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল। তুয়ার ফর্সা শরীরে লাল শাড়ি, ফুলের গয়না, রুম জুড়ে ফুলের সুগন্ধে মোহনীয় এক মুহূর্ত সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তুয়া, সে তো ঘুমে কাতর।
এখন বাজে রাত একটা ছাব্বিশ। তুয়া কাত হয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। প্রত্যয় মুচকি হেসে তুয়ার পাশে বসে বলল, “আমার ফুল এখন আমাকে অপেক্ষা করিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, পঁচা মেয়ে।”
প্রত্যয় ধীরে ধীরে তুয়ার গয়না খুলতে লাগল। এগুলো পড়া থাকলে সে শান্তিতে ঘুমাতে পারবেনা। তুয়া কয়েকবার নড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে গেল। প্রত্যয় সর্তকতার সাথে সব গয়না খুলে তুয়াকে ভাল করে শুইয়ে দিল। সে ফ্রেশ হয়ে এসে তুয়ার পাশে শুয়ে পড়ল। কিছু একটা ভেবে প্রত্যয় উঠে আলতো করে তুয়ার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করল। তারপর মিটিমিটি হাসতে হাসতে তুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “নিষ্ঠুর মেয়ে আমার স্পেশাল রাতটা ঘুমিয়ে নষ্ট করে দিল।”
**!!

প্রিয়ম ওদের মেইন দরজা খুলে ছাদে চলে গেল। এখন চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সুখী মানুষ গুলো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। প্রিয়ম এসে ছাদের মাঝখানে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। ওর চোখর অশ্রু অঝরে ঝরে যাচ্ছে। ওর কোনো কথা, অভিযোগ , আবদার, অধিকারবোধ কিচ্ছু নেই। শুধু আছে একবুক অসহনীয় কষ্ট। কষ্টটাকে সে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। প্রিয়ম ওর মাথার চুল মুঠো করে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। ওর বুকের বা পাশটায় অসহ্য যন্ত্রনা এসে আসর জমিয়েছে।
প্রিয়ম কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোদেরকে রুমবন্দী অবস্থায়
দেখার সাহস আমার নেই। পারছি না, পারছি না আমি। আমার বুকটা যে অসহ্য যন্ত্রনায় জ্বলে যাচ্ছে।”
প্রিয়ম ওর কষ্টটা অশ্রু ঝরিয়ে মুছে ফেলতে চাচ্ছে। কিন্তু কষ্টরা বড্ড নিষ্ঠুর। একবার আসলে সহজে যেতে চায় না। অদৃশ্য অনলে পুড়িয়ে দগ্ধ করে তবেই তারা ক্ষান্ত হয়। প্রিয়ম বুকের বা পাশে একহাত রেখে বলল, “ভালবাসি রে পাগলি। হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে তোকে বড্ড ভালবাসি।”
প্রিয়ম হঠাৎ ওর কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেল। সে চমকে উঠে পিছনে ঘুরে তাকাল। প্রত্যয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রিয়ম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। প্রিয়ম উঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। প্রত্যয় লালবর্ণ চোখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয় বিনাবাক্যে প্রিয়মের গালে স্বজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। প্রিয়ম টু শব্দও করতে পারল না।
প্রত্যয় রেগে প্রিয়মের বুকে ধাক্কা দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল, ” বেইমান, এই তোর বিবেক?”

প্রিয়ম নিরুত্তর রইল। প্রত্যয় ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ, সে সহজে রাগে না। কিন্তু যখন রেগে যায় তখন মারাত্মক কিছু করতেও দ্বিধা করে না। প্রত্যয়ের রাগ সম্পর্কে প্রিয়মের একটু হলেও ধারণা আছে। এই মুহূর্তে প্রত্যয়ের চোখ আর কন্ঠে বলে দিচ্ছে, সে মারাত্মক রেগে আছে। আর এখন প্রত্যয়ের মুখের উপর প্রিয়মের টু শব্দ করার সাহসটুকুও নেই। এজন্য প্রিয়ম চুপ করেই থাকল।
প্রত্যয় অাগুন ঝরা কন্ঠে বলল, “আজকে থেকে তোর ভাইয়া তোর কাছে মৃত।”
কথাটা বলে প্রত্যয় সামনে পা বাড়াল। প্রিয়ম গিয়ে প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরল। প্রত্যয় জোরপূর্বক প্রিয়মের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু প্রিয়ম প্রত্যয়কে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“ভাইয়া! ভাইয়া! আমার ভুল হয়ে গেছে, ভাইয়া। আর এমনটা হবে না। মাফ করো, কথা দিচ্ছি ভুলেও আর একথা বলব না।”
প্রত্যয় প্রত্যুত্তর না প্রিয়মকে সরিয়ে দিল। প্রিয়ম প্রত্যয়ের পায়ের কাছে বসে অশ্রু ঝরিয়ে বলল, “আমাকে তুমি দূরে ঠেলে দিও না, ভাইয়া। আমি মরে যাব, সত্যিই মরে যাব। প্লিজ ভাইয়া এবারের মত আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ।”
প্রত্যয় পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। একটা কথাও বলল না। প্রিয়ম প্রত্যয়ের পা ধরে শব্দ করে কেঁদে বলল, “একথা ভুলেও আর উচ্চারণ করব না। কেউ জানাবেনা আমি জানতে দিব না। ভাইয়া প্লিজ আমার সঙ্গে কথা বল,ভাইয়া।”
প্রত্যয় প্রিয়মের থেকে পা ছাড়িয়ে চলে গেল। প্রিয়ম ওখানে বসে অশ্রু ঝরাতে লাগল। প্রত্যয় নামতে নামতে ওর চোখ মুছে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল।
প্রত্যয় প্রিয়মের থেকে পা ছাড়িয়ে চলে গেল। প্রিয়ম ওখানে বসে অশ্রু ঝরাতে লাগল। প্রত্যয় নামতে নামতে ওর চোখ মুছে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল।

তখন বাইরের দরজা খোলার শব্দে প্রত্যয় রুম থেকে বের হয়েছিল। প্রত্যয় এতো রাতে প্রিয়মকে বাইরে যেতে দেখে অবাক হয়। কিছু একটা ভেবে সেও ছাদে যায় এবং দুঃভাগ্যবশত প্রিয়মের সব কথা শুনে ফেলে। প্রত্যয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পূর্ন একটা ছেলে, প্রিয়মের বলা রুমবন্দী শব্দটা শুনে ওর কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সে বুঝে গেছে ভাইয়ের কষ্টের কারণ একমাত্র সে।
প্রিয়ম সারারাত ছাদেই কাটিয়ে দিল। ভোরের আলো ফুটছে, পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করছে। এখন ছাদে কেউ আসতে পারে। তাই প্রিয়ম উঠে সোজা ওর রুমে চলে গেল।
তুয়া ঘুম ভেঙে প্রত্যয়কে না পেয়ে মন খারাপ করে রইল। বিয়ের প্রথম সকালটা ওর কাছে নিরামিষের মত লাগল। তুয়া মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, “পেশেন্ট নিয়েই থাকুন। ঘরে যে বউ আছে মনে করতেও হবেনা। বরং হসপিটালকে নিয়েই সংসার শুরু করুন, পঁচামার্কা ছেলে।”
**!!
পলক রনিতের বুকে মাথা রেখে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। এর্লামের শব্দে রনিত পলককে ডেকে বলল, “পলক! সকাল হয়ে গেছে, উঠবে না?”
পলক আহ্লাদি কন্ঠে, “উঠছি” বলে আবার চোখ বন্ধ করে নিল। রনিত পলকের নাক টেনে বলল, ” উঠুন, আম্মুর বকা খেয়ে পরে গাল ফুলিয়ে রাখলে, মাইর দিব।”
পলক চোখ বন্ধ করে ধীর কন্ঠে বলল,” পিরিয়ড হয়েছে। পেটে খুব ব্যাথা করছে আর একটু শুয়ে থাকি, প্লিজ।”
রনিত আর ডাকল না। সে নিজে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। পলক না উঠলে তো বাড়ির লোক ছেড়ে কথা বলবেনা। তাই সে নিজে গিয়ে ওর আম্মুকে বলল, “আম্মু পলক অসুস্থ। আজকে সকালের নাস্তা ভাবিকে বানাতে বল।”
রনিকের আম্মু ভ্রু কুঁচকে বললেন, “সকাল বেলা বউয়ের ওকালতি করতে এসেছিস?”
রনিতও ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা কেমন কথা? পলক মানুষ না নাকি অসুস্থ হতে পারে না? ওর পক্ষে কিছু বললেই ওকালতি করা হয়?”
রনিতের আম্মু রাগে গজগজ করে চলে গেলেন। রনিত ওর রুমে চলে গেল। দিশা এখন কিছুতেই রান্নাঘরে যাবেনা। অনিচ্ছা সত্ত্বে এখন উনাকেই রান্নাঘরে যেতে হবে।
**!!

সকাল আটটার দিকে প্রত্যয় বাসায় ফিরল। তুয়া চাঁদ আর প্রত্যয়ের আম্মু রান্নাঘরে ছিল। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে বলল, “তুয়া এখন রুমে যাও।” তুয়া বোকার মত প্রশ্ন করল, “কেন?” চাঁদ দাঁত বের করে হেসে বলল, “ভাইয়ার সঙ্গে প্রেম করতে।” প্রত্যয়ের আম্মু হেসে চাঁদের পিঠে থাবড় মেরে বলল, “ফাজিল মেয়ে কাজ কর।”
তুয়া মাথা নিচু করে রুমে চলে গেল। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে এসে দাঁড়াতেই তুয়ার মুখোমুখি হল। তুয়া চোখ নামিয়ে বলল, “এখনই কি চলে যাবেন নাকি থেমে যাবেন?” প্রত্যয় বেলকণিতে গিয়ে কলিকে খাবার দিয়ে বলল, “থেমে যাব।” কলি একমনে ওর বুলি আওড়াচ্ছে। সে অনবরত বলেই যাচ্ছে, “তুয়া! বউ! বউ! ভালবাসি! ভালবাসি! দুষ্টু।”
তুয়ার বেলকনিতে এসে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, “ঢং, সারারাতে খবর নিল না। এখন আসছে ভালবাসা দেখাতে, পঁচা পাখি।”
তুয়া প্রত্যয়কে ইঙ্গিত করে কথাটা বলে চলে যাবে। তখন প্রত্যয় বলল, “কালকে সন্ধ্যায় আমি প্যারিসে যাচ্ছি।”
তুয়ার পা থেকে গেল। সে অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যয়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,”কতদিনের জন্য?” প্রত্যয় বলল,” গিয়ে জানাব।”
প্রত্যয়কে তুয়ার কেন জানি স্বাভাবিক লাগছেনা। প্রত্যয়ের চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে। কিন্তু কথা বলছে যথেষ্ট স্বাভাবিক হয়ে। হঠাৎ প্যারিসে যাচ্ছে কেন? তুয়া কিছুই বুঝতে পারল না। তাই র্নিবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রত্যয়ও আর তুয়ার দিকে তাকাল না।
কালকে রাতটা ওদের জন্য স্পেশাল একটা রাত ছিল। কিন্তু প্রত্যয় সারারাত বাসাতেই ছিল না। অথচ কালকে রাতে ওর হসপিটালে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। একথাটা তুয়া সকালে প্রত্যয়ের আম্মু থেকে জেনেছে। আবার প্রত্যয় এখন বলছে প্যারিসে চলে যাবে।
প্রত্যয়ের এমন ব্যবহারে তুয়ার মাথায় একটা প্রশ্ন এসে ভর করল। তুয়া মনে মনে বলল, ” ধর্ষিতা বলেই কি প্রত্যয় আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? নাকি বিয়ে করে ওর এখন আফসোস হচ্ছে?”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

তুয়া মনে মনে বলল, “ধর্ষিতা বলেই কি প্রত্যয় আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? নাকি বিয়ে করে এখন ওর আফসোস হচ্ছে?”
তুয়া নিজের করা প্রশ্নে নিজেই আঁতকে উঠল। প্রত্যয়কে তুয়া ওর বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে পেয়েছে। বিশ্রী অতীতকে পিছে ফেলে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু প্রত্যয় এখন মুখ ফিরিয়ে নিলে তুয়া চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
তুয়া ওর মনের অবান্তর চিন্তা বাদ দিয়ে ধীর পায়ে প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে বলল, “আপনার কি কিছু হয়েছে? আমাকে বলা যায় না?”
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “আমি ঠিক আছি। আচ্ছা, তুমি গিয়ে আম্মুকে বল, আমি নাস্তা করব না। এখন আমি দুই ঘন্টা ঘুমাব।”
প্রত্যয় রুমে গিয়ে চোখের উপরে হাত রেখে শুয়ে পড়ল। তুয়া মন খারাপ করে প্রত্যয়ের আম্মুকে জানাল প্রত্যয় এখন নাস্তা করবে না। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার মন খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হল, মন ভার কেন?”
তুয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল, “আম্মু, ওই বাসাতে যাব?”

প্রত্যয়ের আম্মু হেসে বললেন, “যাও, তবে প্রত্যয় বাসায় আছে, তাড়াতাড়ি চলে এসো।” তুয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।
প্রত্যয়ের আম্মু প্রিয়মকে নাস্তা করতে ডাকলেন। প্রিয়মও বলল, সে খাবে না। চাঁদ আর প্রত্যয়ের আম্মু-আব্বু নাস্তা করে নিলেন। তুয়া ওর রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে কাঁদতে লাগল। তুয়ার আম্মু মেয়ের এমন করার কারণ বুঝলেন না। তুরাগ ইশারায় উনাকে চুপ থাকতে বলল। তুয়ার আম্মু চিন্তিত হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
চাঁদ অনেকক্ষণ ধরে প্রিয়মের রুমের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কিন্তু কিছুতেই প্রিয়ম দরজা খুলছে না। প্রত্যয়ের আম্মু হাসতে হাসতে বললেন, “চাঁদ, প্রিয়মের থাপ্পড় খেতে না চাইলে চলে আয়।”
চাঁদ মুখ ভেংচি দিয়ে প্রত্যয়ের আম্মুর পাশে বসে বলল, “থাপ্পড় তো তোমার ছেলের হাতের মোয়া। আমি না চাইলেও সে জোর করে দিয়ে দেয়।”
প্রত্যয়ের আম্মু শব্দ করে হাসতে লাগলেন। চাঁদ আসার পর উনি কথা বলার মানুষ পেয়েছেন। এই কয়েকদিনে চাঁদের প্রতি উনার মায়া বসে গেছে। উনাদের সম্পর্কটাও আগের তুলনায় ভাল হয়েছে।
-“আর কি মানুষের পিরিয়ড হয় না, নাকি তুমিই পৃথিবীতে প্রথম মেয়ে যার পিরিয়ড হলো?”
রনিতের আম্মু রাগে গজগজ করতে করতে কথাটা বললেন। পলক লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল। রনিতের দাদী মুখে পান দিয়ে বললেন, “ছিঃ! ছিঃ! ব্যাডা মাইষ্যের কানেও এসব কওন লাগে? লাজ লজ্জা কিচ্ছু নাই।”
পলক সবার কথা চুপ করে শুধু শুনল। দাদী শাশুড়ির কথার প্রতি উত্তরে পলকের বলতে ইচ্ছে করল, “স্বামীকেই তো বলেছি, পুরো পাড়ায় তো আর ঢোল পিটিয়ে জানাই নি। তাহলে এত খ্যাচ খ্যাচ করছেন কেন?”
পলক চাইলেও বলতে পারল না তাই ওর ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখল। রনিতের আম্মু বললেন, “যাও গিয়ে রান্নাঘরটা পরিষ্কার করো।” পলক রান্নাঘরে যেতে যেতে শুনল, দিশা সোফায় বসে আপেল খেতে খেতে বিরক্তের কন্ঠে বলল, “যত্তসব আহ্লাদ।”

পলক রান্নাঘরে গিয়ে সকালের এটো থালাবাসন ধুয়ে নিল। রনিত অফিসে যাওয়ার পর পরই সে উঠে পড়েছে৷ তবুও এত কথা শুনতে হল। বাবার বাসায় থাকলে পিরিয়ডের প্রথম দিন সারাদিন শুয়ে থাকত। ওর আম্মু গরম পানি করে দিত, খাইয়ে দিত। বাহানা দেখিয়ে বাড়ির কোনো কাজ করত না। কিন্তু এখন ওকেই সব কাজ করতে হচ্ছে। প্রায় সব মেয়েরাই বাবার বাড়িতে আহ্লাদে চললেও, শশুড়বাড়ি এসে নিজেকে শক্ত করে তোলে। কারণ প্রথমদিন এসেই সে বুঝে যায়, এটা শশুড়বাড়ি।
রনিত আজকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসল। পলক তখন শুয়ে ছিল। পেটের ব্যাথায় সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কোনো রকমে কাজ সেরে এসে শুয়ে পড়েছে।
রনিত পলককে বলল, “গোসল করে নাও।” পলক কিছু বলল না। এই সময় মেজাজটা খুব খিটখিটে থাকে। তাই রনিত কথা বাড়াল না। সে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল।
প্রত্যয় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। টানা দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে ওর মাথাটা এখন যথেষ্ট ঠান্ডা আছে। প্রত্যয় আশেপাশে তাকিয়ে তুয়াকে দেখতে পেল না। কলি বেলকনিতে চেচাঁমেচি শুরু করেছে। প্রত্যয় কলিকে খাবার দিয়ে এসে রেডি হচ্ছে। একটুপরে তুয়া কেঁদে চোখ ফুলিয়ে প্রত্যয়ের রুমে ঢুকল। প্রত্যয় শার্টের কলার ঠিক করে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কাঁদছ কেন?”
তুয়া মুখ ঘুরিয়ে কান্নারত গলায় বলল, “কোনো কাজ পাচ্ছি না তাই বসে কাঁদছি।”
তুয়ার অভিমানী কথা শুনে প্রত্যয় হেসে তুয়ার পাশে বসে বলল, “দেখি, আমার দিকে তাকাও।”
তুয়া মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “সরি!”
তুয়া হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-“না, সরিতে কাজ হবে না।”
-“তাহলে কিসে কাজ হবে?” (মুচকি হেসে)
-“প্যারিসে যাবেন না, যাবেন না মানে যাবেনই না।”
প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখের পানি মুছে দিল। তুয়া প্রত্যয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “আমি কি কোনো ভুল করেছি? আমাকে বলুন, আমি আমার ভুলটা শুধরে নিব। তবুও আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েন না।”
প্রত্যয় শান্ত কন্ঠে তুয়ার হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল,
– “কালকে সারারাত জেগে ছিলাম, একটুও ঘুমাতে পারিনি। প্রচন্ড মাথা ব্যথা আর মনটাও ভাল ছিল না। তাই তোমাকে হার্ট করে ফেলেছি। এজন্য আমি আবারও সরি। আর আমি প্যারিসে যাচ্ছি ইমারজেন্সি পেশেন্টের অপারেশন করতে। ওখানে থেকে ডাক্তারী পড়া শেষ করে ফিরেছি। ওখানে আমাকে সবাই জানে এবং চিনে। আমারই একজন টিচার আমাকে ডেকেছে, কি করে না যায় বল?
তুমি তো জানো আমার পেশাটাই হচ্ছে সেবাপ্রদান করা। এখন অবধি কোনো পেশেন্টকে ইগনোর করে সরিয়ে দেই নি, আজও পারব না। আচ্ছা, পাঁচদিনের জন্য আমাকে যেতে দাও। আমি কথা দিচ্ছি কাজ সেরে দ্রুত ফিরে আসব।”
তুয়া এবার কান্না থামাল। এখন প্রত্যয়ের যাওয়া আটকানো মানে অমানবিক একটা কাজ করা। কারণ সে একজন দায়িত্ববান ডাক্তার, একথা ভুললে চলবে না। তুয়ার মনটা প্রত্যয়ের জাদু মিশ্রিত কথা শুনে ভাল হয়ে গেল।
আজকে সকালের প্রত্যয়কে ওর বড্ড অচেনা লাগছিল। কিন্তু এই প্রত্যয় তার চেনা প্রত্যয়, শুধু তার প্রত্যয়। আর এই চেনা প্রত্যয়কেই সে পাগলের মতো ভালবাসে। কারণ এই ছেলেটাই এখন ওর বেঁচে থাকার অবলম্বন।
প্রত্যয় তুয়ার দুই গালে হাত রেখে আদুরে সুরে বলল, “এত সহজে আমার থেকে মুক্তি পাবে না, মনে রেখ এটা।”
তুয়া প্রত্যয়ের চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি কখনও এই মুক্তি চাইবও না।”
প্রত্যয় মুচকি হেসে তুয়াকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল। তুয়া প্রত্যয়ের কানে কানে স্লো ভয়েজে বলল,
-“সাংঘাতিক ভালবাসি।”
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “ধন্যবাদ।”
**!!

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১০+১১+১২

বিল্ডিংয়ের অনেকে জানে প্রত্যয় আর তুয়ার বিয়ের কথা। এই নিয়ে বেশ কানাঘুষাও চলছে। সকালে দুই জন মহিলা বাসায় এসে প্রত্যয়ের আম্মুকে বলেছেন, “ভাবি, সব বাদ দিয়ে ধর্ষিতার সঙ্গে সোনার টুকরো ছেলের বিয়ে দিলেন?”
আরেকজন মহিলা বললেন, “ছেলেটা লোক সমাজে মুখ দেখাবে কি করে? একবারও ভাবলেন না?” প্রত্যয়ের আম্মু উনাদের চা দিয়ে হেসে বললেন, “আমি ছেলের শরীরে মানুষের রক্ত আছে। তাই সে ধর্ষিতা মেয়েকে সজ্ঞানে বিয়ে করেছে।”
মহিলারা আর কিছু বলার মুখ পেল না। তুয়াকে রুম থেকে বের হতে দেখে প্রত্যয়ের আম্মু বলল, “তুয়া, কলিকে খাবার দিয়ে এসো, না হলে চেচাঁমেচি করে কান শেষ করে দিবে।”

তুয়া ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল। প্রত্যয়ের আম্মু কৌশলে তুয়াকে ওখান থেকে সরিয়ে বলল, “আমরা ভাল আছি। আপনারা বিষ না ঢালতে আসলেই খুশি হব।” মহিলা দুইজন অপমানিত হয়ে চা না খেয়ে চলে গেলেন।
মহিলাদের বিদায় দিয়ে প্রিয়মকে ওর আম্মু ডেকেও উঠাতে পারলেন না। প্রত্যয় নাস্তা করে হসপিটালে চলে গেল। তারপর প্রিয়ম রুম থেকে বের হলো। ভাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস ওর নেই। চাঁদ আর তুয়া বেলকনিতে বসে গল্প করছে আর পেয়ারা খাচ্ছে। চাঁদ গল্প করতে করতে ওদের বিয়ের কথা তুয়াকে জানাল। সব শুনে তুয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
-“কেউই চায় না তার নুড পিক ভাইরাল হোক। প্রিয়ম ভাইয়ার সঙ্গে যা হয়েছে সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে।”
চাঁদ মাথা নিচু করে নিল। এসবের পেছনে তারও হাত ছিল না। চাঁদকে কাঁদতে দেখে তুয়া বলল, ” ধৈর্য্য ধরো, নিশ্চয়ই তোমার ভালবাসার জয় হবে।”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৬+১৭+১৮