সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৬+১৭+১৮

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৬+১৭+১৮
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

-“আমি করমুজ খাবই খাব, এনে দাও।”
কথাটা বলে ইচ্ছে হাতপা দাপিয়ে কাঁদতে লাগল। সে কাঁদতে কাঁদতে হাতে থাকা খরগোশটাকে ছিটকে
দূরে আছাড় মারল। খরগোশটা ব্যাথা পেয়ে সোফার নিচে লুকাল। কিছুক্ষণ আগে ইচ্ছে একটা বাচ্চাকে তরমুজ খেতে দেখেছে, এখন বাসায় এসে সেও তরমুজ খাওয়ার জন্য কাঁদছে। ওর আম্মু বলছে পরে এনে দিবে কিন্তু সে কিছুতেই শুনছে না। ওর এখনই তরমুজ চাই- ই চাই।
মেয়ের কান্না দেখে ইচ্ছের আম্মু রেগে ইচ্ছেকে বললেন, “মারলে খেতে না চাইলে চুপ কর, ইচ্ছে।” ইচ্ছে গলা জোর বাড়িয়ে বলল, ” না তুমি এনে দাও, আমি করমুজ খাব।”

এবার সে মেঝেতে শুয়ে উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগল। আর ওর আম্মু রান্নাঘরে চলে গেল। প্রিয়ম বাইরে যাওয়ার জন্য নিচে নামছিল। ইচ্ছেদের দরজা খোলা আর ইচ্ছেকে মেঝেতে শুয়ে কাঁদতে দেখে প্রিয়ম শব্দ করে ডাকল। ইচ্ছে প্রিয়মের গলা শুনে উঠে বসে বলল, “প্রিউুম, আমি মেলা দুঃখু পেয়ে কাঁদছি।” প্রিয়ম হাসি আঁটকে রেখে সামান্য এগিয়ে এসে বলল, “তা কাঁদছ কেন শুনি?”
ইচ্ছের আম্মু রান্নাঘর থেকে এসে প্রিয়মকে ভেতরে আসতে বলল। প্রিয়ম ভেতরে ঢুকে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল। ইচ্ছের আম্মু প্রিয়মকে জানাল সে তরমুজ খাওয়া জন্য কাঁদছে। ইচ্ছে প্রিয়মের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
প্রিয়ম আর প্রত্যয় আগে থেকেই বাচ্চাদের খুব ভালবাসে। কোনো বাচ্চা ওদের কাছে কিছু আবদার করলে, তারা কখনই ফিরায় না। আর ইচ্ছের প্রতি ওদের আলাদা একটা টান কাজ করে। ইচ্ছের মত এমন মিষ্টি দেখতে একটা তোতাপাখিকে ভাল না বেসে থাকাও যাই না।
ইচ্ছের আম্মুর পারমিশন নিয়ে প্রিয়ম ইচ্ছেকে বাইক বসিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটুপরে ইচ্ছে মন মরা হয়ে বলল, “আমার মনে এখন মেলা দুঃখু। আমি এখন কুথাও যাব না, প্রিউুম।” প্রিয়ম হেসে বলল, ” তোমার কষ্ট কমাতেই তো যাচ্ছি, ইচ্ছেমণি।”
ততক্ষণে তরমুজের দোকানের সামনে ওদের বাইক থেমে গেছে। প্রিয়ম ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে দোকানে ঢুকল। তরমুজ দেখে ইচ্ছে দাঁত বের করে হেসে বলল, “ইয়ে করমুজ খাব।”
প্রিয়ম ইচ্ছের পছন্দমত বড় একটা তরমুজ নিয়ে বাসায় ফিরল। ইচ্ছের খুশি যেন আর ধরেনা।
**!!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুয়া ওর জামা কাপড় নিতে ওদের বাসায় এসেছে। তুরাগ চিৎকার করে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, “আহা গো, বাড়িটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কেউ আসলে মন্দ হয় না।” এই নিয়ে চারবার সে একই কথা বলল।
তুয়া ওর ড্রেস নিয়ে তুরাগের সামনে গিয়ে বলল, “ভাইয়া, বিয়ে করবে সরাসরি বলো। এভাবে বাড়ির ফাঁকার হওয়ার অজুহাত দিচ্ছ কেন?”
তুরাগ দাঁত বের করে হেসে বলল, “আরে না সেরকম কিছু না।” তুয়া দুষ্টু হেসে “ওহ আচ্ছা” বলে যাচ্ছে। তুরাগ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে করুণ সুরে বলল, “বোন ওই রকম কিছুই। আব্বু আম্মুকে মনে করিয়ে দে না, প্লিজ।” তুয়া সুযোগে সৎ ব্যবহার করে বলল, “এতে আমার লাভ?”
তুরাগকে বিরক্ত চোখে তাকাতে দেখে তুয়া চলে আসতে যাবে তখন তুরাগ একপ্রকার চেচিয়ে বলল, “শপিং করিয়ে দিব।” তুয়া হেসে, “ডিল ডান” বলে চলে গেল। তুরাগ হেসে মাথা চুলকে রুমে চলে গেল।
**!!

রনিতদের বাসায় ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়ার মূল কারণ রনিত বেতন পেয়ে পলককে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে। পলক দুপুরে গোসল সেরে শাড়িটা পড়েছেও। গোলাপি কালার শাড়িতে পলককে বেশ লাগছে লাগছে। কিন্তু রনিত দিশা আর ওর মায়ের জন্য শাড়ি আনেনি, এটাই এই ঝগড়ার মূখ্য কারণ। উনাদের দু’জনে কথা, “রনিত কেন একটা শাড়ি আনল? বউকে দিল তো আমাদের কেন দিল না?”
এসব বলে উনারা পলককে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। দিশাও ওর শাশুড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে খোঁচা মারছিল। তবে দিশা যে ঘরে বসে লুকিয়ে কত কি খায়, স্বামীকে দিয়ে অসংখ্য শাড়ি এনে আলমারিতে তুলে রাখে, সোনার গয়না বানিয়ে বাবার বাড়ি রেখে আসে, এসব ওর শাশুড়ি জানেও না দেখেও না। তাই ভাবে বড় বউ তুলসীপাতা।
উনাদের ঝগড়ার একপর্যায়ে রনিতের মা পলকের বাবা মা নিয়ে গালাগাল দেওয়া করলেন। এতক্ষণ চুপ থাকলেও পলক আর সহ্য করতে পারল না। বাবা মা একটা মেয়ের সব’চেয়ে দূর্বল পয়েন্ট। সেই বাবাকে মাকে নিয়ে কিছু বললে সহ্য করাও যায় না।
পলক উনার কথা সহ্য করতে পারল না। তাই রেগে হাতের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে বলল, ” আমাকে যা ইচ্ছে বলুন। কিন্তু আমার বাবা মাকে কিছু বলবেন না। তাহলে আজকে আমিও আর চুপ থাকব না।”

রনিতের মা রেগে বললেন, ‘কালশাপিনী শরীর দিয়ে আমার ছেলেকে বশ করেছিস। ছেলে এখন মাকে ভুলে বউয়ের আঁচলের তলে থাকে। তুই আমার ছেলের কান ভাঙ্গাস আর আমাকে খারাপ করিস। কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না?”
পলক রেগে গর্জে উঠে বলল, “আপনার ছেলে কেন আমার শরীর পেয়ে বশ হল? কেন আপনার আঁচলে তলে থাকল না? ফিরলে ওকেই জিজ্ঞাসা করুন? আজ বিবেকহীন বলেই মা হয়ে একথা অনায়াসে বলতে পারলেন।”
রনিতের আম্মু আরও রাগান্বিত কন্ঠে বললেন, “আমার বিবেক নিয়ে কথা তুলিস? আমার ছেলে বশ করে গলা বাজি করছিস? আমাকে ছেলেকে পর করে তুইও ভাল থাকবি না। তোর উপরে আল্লাহর গজব পড়বে।”
পলক উনার কথা শুনে বলল, বানোয়াট কথা বলবেন না। আপনার ছেলে কি ফিডার খায় নাকি চোখে ছানি পড়া? যে তাকে হাতে ধরে শিখিয়ে বশ করব। আর আপনার বিবেক থাকলে তো বিবেকের কথা তুলব। বিবেকবান হলে এক চোখে তেল আর অন্য চোখে নুন বিলাতেন না। আপনি যত ইচ্ছে অভিশাপ দিতে থাকুন। কথাতেই আছে, শকুণের দোয়াতে গরু মরে না।”
দিশা এবার বলল, “তাই বলে তুমি আম্মাকে শকুণ বলবে?”

পলক দাঁত চেপে বলল, “উনাকে না আপনাকেও বলেছি। কারন আপনিও শকুণ চোখে চুরাচূন্নির মত অন্যের ঘরে উঁকি মারেন।”
এই কথা বলে পলক রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে রইল। দিশা রেগে রুমে চলে গেল আর রনিতের মা বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।
রেগে গেলে মানুষের মুখে কনট্রোল থাকেনা। এখন যেমন রনিতের মায়ের বলা কথাটা বড্ড বেমানান। উনি মা হয়ে ছেলের দিকেই নোংরা ইঙ্গিত করলেন।
উনার কথা দিয়ে বোঝালেন উনার ছেলে বউয়ের শরীরের পাগল।
সংসারের যাবতীয় খরচ সহ এক মাসে সবার মন জয় করা সম্ভব নয়। এই মাসে বউকে কিছু দিল, পরের মাসে না হয় মাকে দিত। কিন্তু রনিতকে উনি সুযোগটাই দিলেন না, তার আগেই আঙ্গুল তুললেন। বাড়ির বউকে যখন শাশুড়ি প্রতিদ্বন্দী ভাবে, তখন এই সমস্যা গুলো সৃষ্টি হয়।
রনিত বাসায় এসে সবটা শুনে শান্তভাবে পলককে বলল, “সব গুছিয়ে নাও আমরা এক্ষনই চলে যাব। রোজকার এসব ঝামেলা থেকে আমি মুক্তি চাই।”
**!!

দুপুরে একটার দিকে প্রত্যয় বাসায় ফিরল। প্রিয়ম আর ইচ্ছে বসে তখন তরমুজ খাচ্ছিল। প্রত্যয়কে দেখে ইচ্ছে দাঁত বের করে হেসে বলল, “প্রত্তুয়, থাবা?”
প্রত্যয় হেসে ইচ্ছের গাল টেনে বলল,” তুমি খাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসি” বলে প্রত্যয় ওর রুমে চলে গেল। প্রিয়মের মাথা নিচু করে বসে রইল। সেদিনের পর প্রত্যয় আর প্রিয়মের কোনো কথা হয় নি। আর প্রিয়মও ইচ্ছে করেই প্রত্যয়ের সামনে যায়নি। সে শুধু ভালবেসেছে কোনো পাপ করেনি। তবুও সে ভাইয়ের চোখে চোখ অপরাধী হয়ে গেছে।
প্রত্যয় রুমে ঢুকে তুয়াকে না পেয়ে ফ্রেশ হতে গেল। তুয়া চাঁদের রুম থেকে এসে কলিকে খাবার দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। কালকে সন্ধ্যায় প্রত্যয় চলে যাবে। একথা ভেবে তুয়ার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।
প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে এসে তুয়াকে শুয়ে থাকতে বলল, “কোনো সমস্যা?” তুয়া প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু প্রত্যত্তুর করল না। প্রত্যয় হাতের টাওয়াল রেখে তুয়ার কপালে হাত দিল। জ্বর নেই দেখে তুয়াকে বলল, “কিছু হয়েছে বলো আমাকে?”
তুয়া অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার অনেক বড় অসুখ হয়েছে, মনে হয় আমি আর বাঁচব না।”
তুয়ার কথা শুনে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “প্রেমরোগে কেউ মরে না। ভালবাসা নামক মেডিসিনটা তিনবেলা ঠিকমত খাও অসুখ সেরে যাবে।”

তুয়া হেসে বলল,” এটা কোন ফার্মেসিতে পাওয়া যাবে, শুনি?”
প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে বলল, “কার্ডিওলজিস্ট, ওয়াসিক রায়হান প্রত্যয়ের কাছেই পেয়ে যাবে।”
প্রত্যয়ের আম্মু তুয়া আর প্রত্যয়কে খেতে ডাকছেন। প্রত্যয় তুয়াকে,”খেতে চলো” বলে পা বাড়াতে যাবে তখন তুয়া বলল, “এই যে কার্ডিওলজিস্ট আমার মেডিসিনটা তো দিয়ে যান।”
তুয়ার কথা শুনে প্রত্যয় দাঁড়িয়ে গেল। মুচকি হেসে তুয়ার কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলল, “এই মেডিসিনের সাইড ইফেক্ট মারাত্মক ভয়ংকর, তাই এখন অল্প ডোজের দিলাম।”
প্রত্যয় হাসতে হাসতে উঠে চলে গেল। তুয়া লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। এই বিল্ডিংয়ের সাততলার একটা মেয়ে তুয়ার সঙ্গে দেখা করতে এলো। চাঁদ উনাকে নিয়ে তুয়ার রুমে ঢুকে দেখে, তুয়া মুখ ঢেকে শুয়ে আছে। চাঁদ তুয়াকে ডাকলে তুয়া উঠে বসে বলল, “আরে মুমিনা আপু তুমি, এসো বসো।”
মুমিনা বসে বলল, “তোর কাছে একটা জিনিস চাইতে আসলাম, প্লিজ ফিরাস না বইন।” তুয়া জানতে চাইল,” কি জিনিস?”
মুমিনা তুয়া আর চাঁদের মুখে দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ” তোরা যে প্রোট্রেকশনই ইউজ করিস, ধার দে বইন। তুই তো সদ্য বিবাহিত তোর কাছে অবশ্যই কিছু আছে, প্লিজ দে। ”
তুয়া আর চাঁদ দু’জনেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। মুমিনা দাঁত বের করে হাসল। তুয়া ঢোক গিলে চাঁদের দিকে তাকাল। চাঁদ ওর চোখ দু’টো রসগোল্লার মত বড় বড় তাকিয়ে আছে। মুমিনা যে এই কথা বলবে ওরা ভাবতেও পারেনি। এটা কেউ চাইতে আসতে পারে ওদের জানা ছিল না।
তুয়া ওর ঘরের খবর পরকে না জানিয়ে বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল, “আপু আমরা দ্রুত বাচ্চা নিতে চাই। এজন্য এসব রাখার প্রয়োজন মনে করিনি।”
তুয়ার কথা শুনে চাঁদ বুকের হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে
রইল। পর পর দু’টো অনাকাঙ্ক্ষিত কথা সে মানতে পারছেনা। ওর মনে হচ্ছে সে হার্ট এ্যার্টাক করবে।
তুয়ার কথা শুনে মুমিনা আপু হতাশ হয়ে চলে গেল। প্রত্যয়ের আম্মু মুমিনাকে খেয়ে যেতে বললেন, কিন্তু মুমিনা খেয়ে এসেছি বলে স্থান ত্যাগ করল।

মুমিনা চলে যাওয়ার পর চাঁদ আর তুয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে উচ্চশব্দে হাসতে লাগল। প্রত্যয় তখন ড্রয়িংরুমে বসে ফোনে কথা বলছিল। ওদের হাসি শব্দ ড্রয়িংরুম থেকে শুনতে পাচ্ছে।
প্রিয়ম এসে খেতে বসল। একটু পরে প্রত্যয় এসেও বসল। কিন্তু চাঁদ আর তুয়ার আসার নাম নেই। ওরা দু’জনে পেট ধরে এখনও হাসছে।
চাঁদ হাসতে হাসতে বলল, ” চাল, ডাল, চাইলেও তো সহ্য হয়। তাই বলে প্রোট্রেকশন!”
তুয়াও হেসে বলল, “এটাও দেখার বাকি ছিল। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হল আমাদের।”
সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
তুয়াও হেসে বলল, “এটাও দেখার বাকি ছিল। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হল আমাদের।”
চাঁদ আর তুয়াকে খেতে আসতে না দেখে, প্রত্যয়ের আম্মু ওদের ডেকে বললেন, “এই তোরা আসবি নাকি খুন্তি নিয়ে যাব? দুপুরে খাবার কখন খাবি শুনি?”
উনার কথা শুনে চাঁদও চেঁচিয়ে বলল, “আসছি মিথিলা ডালিং।”
চাঁদের কথা শুনে প্রত্যয়ের আব্বু উচ্চশব্দে হেসে
উঠলেন। প্রত্যয় মিটিমিটি হাসল। প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে মনে মনে চাঁদের গুষ্ঠী উদ্ধার করল। এই মেয়েটার লাগামহীন কথাবার্তা ওর খুব অপছন্দ। চাঁদের কথা শুনে প্রত্যয়ের আম্মু লজ্জা পেয়ে বললেন, “ফাজিল মেয়ে দাঁড়া তোর হচ্ছে।”
দু’জনে হাসতে হাসতে খেতে আসল। তুয়া এসে প্রত্যয়ের পাশে বসল। চাঁদ দাঁত বের করে হেসে, প্রিয়মের পাশে বসতে গেলে প্রিয়মের তাকানো দেখে ভয়ে তুয়ার পাশে গিয়ে বসল। প্রিয়ম একপ্রকার বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে খাওয়াতে মন দিল। চাঁদের অবস্থা দেখে তুয়া মিটিমিটি হাসছে। প্রত্যয়ের পায়ের খোঁচা খেয়ে তুয়া হাসি থামিয়ে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল, প্রত্যয়কে দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু জানেই না, কিছু করা তো দূরে থাক।
প্রত্যয়ের খেতে খেতে আম্মু বললেন, “দুইটা ছেলে পেয়েছি, ছেলেদের বউও পেলাম। এবার দুইটা করে নাতী- নাতনী পেলেই আমার জীবনের সব চাওয়া শেষ।”

চাঁদ একটা আলু মুখে পুরে বলল, “আম্মু, তোমার চাওয়া দ্রুতই পূরণ হবে। একটু আগে তুয়া আপু বলল।”
কথাটা শুনে তুয়া কাশতে শুরু করল। তুয়ার ঢপ এখন তুয়াকেই গিলতে হচ্ছে, তাও প্রত্যয়ের সামনে। তুয়াকে কাশতে দেখে প্রত্যয় তুয়ার দিকে পানি এগিয়ে দিল। তুয়া পানি খেয়ে মাথা নিচু করে নিল। প্রত্যয় তুয়ার পা আলতো করে আঁকড়ে ধরল। যার মানে,” আমি প্রস্তুত।”
প্রত্যয়ের আব্বু সবাইকে রাজশাহীতে বেড়াতে যাওয়ার কথা বললেন। প্রত্যয় বলল সে কালকে প্যারিস যাচ্ছে তাই যেতে পারবে না। প্রিয়ম বলল সে যাবে না। দুই ছেলের কথা শুনে প্রত্যয়ের আম্মু রেগে বললেন, “বউদেরও শখ আহ্লাদ বলে তো কিছু আছে। শশুড়বাড়ি ওরা দেখব না?”
প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু চাঁদ আর তুয়াকে রাজশাহীর বাড়ি দেখাতে চাচ্ছে। দুই ছেলেরই বিয়ে হলো সাদামাটা ভাবে। কোনো অনুষ্ঠান করতে পারেননি,
ওখানে নিকটতম আত্মীয় স্বজনরা আছে। তাদের সঙ্গে পুত্রবধূদের পরিচয় করাতে হবে। কতদিনই বা বিয়ের কথা গোপন রাখবে? বিয়েটা যেমন ভাবেই হোক, হয়েছে তো।
চাঁদ , তুয়া , কেউ এই বিষয়ে কথা বলল না। যেহেতু বড়রা কথা বলছেন হুট করে কথা না বলাই ভালো। প্রত্যয়ের আব্বু প্রত্যয় প্রিয়মকে তুয়া আর চাঁদকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। এখানে দুই ভাই কেউ দ্বিমত পোষণ করল না। তবে প্রত্যয় স্বাভাবিক ভাবে বলল, “বাবা, গেলে সবাইকে নিয়েই যাও।”
প্রিয়মের বুঝতে বাকি রইল না প্রত্যয়ের ইঙ্গিত। প্রত্যয় চাই সে যাক তাই প্রিয়ম জানাল সে যাবে। প্রিয়ম বাসায় একা থাকলে ওকে একাকীত্ব এসে ঘিরে ধরবে। ঠিকমত খাওয়া দাওয়াও করবেনা।
এজন্য প্রত্যয় ইঙ্গিত করে সবাইকে যেতে বলল।
বুদ্ধিমান ব্যাক্তিরা হাজারটা নয় বরং একটা কথাটাতেই কাজ সারে। প্রত্যয় যেমন এক কথাতেই প্রিয়মকে বুঝিয়ে দিল। প্রত্যয়ের আম্মু প্রত্যয়কে জিজ্ঞাসা করল সে কবে ফিরবে? প্রত্যয় জানাল এক সপ্তাহ লাগতে পারে। কথাটা শুনে তুয়া চমকে উঠে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তুয়ার দিকে তাকাল না। কেউ কথা না বাড়িয়ে খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল।
প্রত্যয়ের আব্বু রুমে গিয়ে উনার সহধর্মিণীকে বললেন,”আজকে আমি খুব খুশি। এইরকম একটা জান্নাত গড়তে চেয়েছিলাম। যেখানে শশুড়, ভাসুর, দেবর, পুত্রবধূ, সবার সঙ্গে সবার সম্পর্কটা সহজ হবে। একে অন্যের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে পারবে। আর তুয়া আর চাঁদকে একসঙ্গে দেখে মনে হয় দুই বোন। ওরা খুব তারাতারি একে অন্যের সঙ্গে মিশে গেছে। এই কয়েকদিনে ওরা দু’জন বাসাতে নতুন ভাবে প্রান এনেছে। ওরা জা নয় বরং বোন হয়েই থাকুক।”
প্রত্যয়ের আম্মুও হেসে বললেন, “তাই যেন হয়।”
**!!

রনিতের বড় ভাই রিয়াল বাসায় এসে দেখে রনিত পলককে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওর মা ড্রয়িংরুমে বসে বিলাপ করে কাঁদছে। মায়ের কান্না দেখে রিয়াল রনিতকে ডেকে বললেন, “কাপুরুষের মত বাড়ি ছাড়ছিস কেন? মা কাঁদছে দেখছিস না?”
রনিত ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ” কাপুরুষ বলেই তোর মত এতদিন চুপ ছিলাম। মাকে কাঁদতে দেখে আঙ্গুল তুললি, আর মায়ের মুখের লাগামহীন কথাবার্তা শুনে কি বলবি?”
রিয়াল রনিতের কথা শুনে গলা নামিয়ে বলল, ” তাই বলে সামান্য শাড়ির জন্য মাকে কাদাবি?”
রনিত চুপ না থেকে বলল, ” হ্যাঁ! সামান্য শাড়ির জন্যই এত অশান্তি। তুই তো এখন অবধি পলককে কুটোটিও দিস না। তাহলে আমি কেন ভাবিকে শাড়ি দিব, উত্তর দে? বিশেষ দিনে নাহয় শাড়ি উপহার দিলাম। তাই বলে বউকে যখন যা দিব ভাবিকেও দিতে হবে? তুই না দিলে আমার বেলায় উল্টো নিয়ম কেন? কি ভাবিস, নতুন জবে আমাকে লাখ লাখ টাকা স্যালারি দেয়?”
রিয়াল রেগে দিশার দিকে তাকাল। দিশা মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ রনিত কারো বারণ না শুনে পলককে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রনিতের মা কেঁদেও ছেলেকে আঁটকাতে পারলেন না।
রনিতের বাবা চুপ করে দেখলেন। কারন উনিও রোজকার ঝামেলা অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। পলক ছোট্ট একটা মেয়ে সবাই যেন ভুলেই গেছে। সারাটাদিন তাকে অনবরত কথা শুনাতে থাকে, সেও তো মানুষ। আর রনিত এতদিন ওর মাকে কড়া কথা শুনাতে পারেনা বলে চুপ ছিল। বউটাও তো এখানে থাকে তার ভরসাতেই। সেও তো ভাল থাকার জন্যই এখানে এসেছে। তাকেই বা কিভাবে অবিশ্বাস, অবহেলা, করে মাকে সাপোর্ট করবে?
রনিত পলককে নিয়ে ইচ্ছেদের বাসায় এলো। ইচ্ছের আম্মু রনিতের চাচাত বোন। কালকে এই বিল্ডিংয়ের আটতলায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ফ্ল্যাটে উঠবে। রনিত আজকেই উঠতে চেয়েছিল কিন্তু ইচ্ছের আম্মু বাঁধা দিল। একটা রুম দেখিয়ে রনিতদের রুমে পাঠিয়ে দিল। ইচ্ছের আব্বু ঢাকায় থাকে ইচ্ছের আম্মু বাসায় একাই থাকে। উনি রনিতকে এখানে থাকার কথা বললে রনিত রাজি হয় না। তাই ইচ্ছের আম্মু খোঁজ নিয়ে আটতলা ফাঁকা থাকায় ওদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিল।
**!!

তুয়া রেগে আর প্রত্যয়ের রুমে না গিয়ে ওদের বাসায় গেল। তুরাগকে সামনে বসিয়ে এখন জেরা করা হচ্ছে। তার কোনো পছন্দ আছে নাকি? তুরাগ জানাই তার পছন্দ আছে। তুয়ার আম্মু মেয়ের বাসায় ঠিকানা জানতে চাই। তুরাগ মাথা চুলকে বলে, “মেয়ের নাম ইলা, সে ডাক্তারী পড়ছে।” তুয়ার আব্বু সব শুনে নাম্বার নিয়ে ইলার আব্বুর সঙ্গে কথা বললেন। ইলার বাবা মা তুরাগের কথা জানত। তুরাগকেই উনারা বলেছিলেন বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে।
তুরাগের আব্বু এই সপ্তাহে এনগেজমেন্ট করতে চাইল। কিন্তু ইলার বাবা বললেন ইলার তিনটে পরীক্ষা বাকি আছে। দুই সপ্তাহ পরে ওদের এনগেজমেন্টটা করলে ভাল হয়। তুরাগের বাবা উনার কথায় সম্মতি দিলেন। এবং দুই সপ্তাহ পরে তুরাগ আর ইলার এনগেজমেন্টট ঠিক করলেন।
তুয়ার অপেক্ষা করতে করতে প্রত্যয় ঘুমিয়ে গিয়েছিল। জামিলের ফোন পেয়ে সে উঠে ফ্রেশ হয়ে হসপিটালে গেল। তুয়ার সঙ্গে প্রত্যয়ের আর দেখা হলো না। সন্ধ্যার পর প্রিয়ম রাজশাহী যাওয়ার জন্য এয়ার টিকিট কেটে আনল। কালকে প্রত্যয় চলে যাবে প্যারিস আর ওরা যাবে রাজশাহী। চাঁদ আর তুয়া ওদের জামা কাপড় গুছিয়ে নিল।
রাত দেড়টার দিকে প্রত্যয় বাসায় ফিরল। তুয়া তখন অন্ধকার বেলকনিতে বসে কাঁদছিল। কলি মাঝে মাঝে দুই একটা বুলি ছড়াচ্ছে। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে এসে তুয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,” উহুম! উহুম! আমার মিষ্টি বধূটা শুনছেন?”
তুয়া কোনো প্রত্যুত্তর না করে নিজেকে ছাড়িয়ে রুমে চলে গেল। প্রত্যয় রুমে গিয়ে তুয়াকে ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল, “কাঁদছ কেন? আর এত রাত অবধি জেগে কেন, হুম?”

তুয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “এজন্য কি বিপদে পড়ে গেলেন?” প্রত্যয় শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “কালকে চলে যাব ভেবে না কেঁদে একটু ভালবাসলেও তো পার?”
প্রত্যয় দুষ্টু হেসে বলল সে গেলে আর ফিরবেনা। কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগও রাখবে না। ওখানেই একেবারে থেকে যাবে। এসব শুনে তুয়া প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছেন। প্লিজ, প্রত্যয় এমনটা কিছু করো না। আমি সত্যি মারা যাব।”
তুয়া প্রত্যয়ের টি- শার্ট খামছে ধরে অস্পষ্টভাবে কিছু বলছে৷ কিন্তু কান্নার ফলে কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। প্রত্যয় প্রত্যুত্তর না করে তুয়াকে জড়িয়ে ধরেই লাইট নিভিয়ে দিল।
তুয়াকে কিছু বলতে না দিয়ে দু’জনে পাড়ি দিল ভালবাসাময় এক অন্য ভুবনে। শুধু মন নয়। যতদিন দু’টো শরীর মিলে মিশে একাকার হচ্ছে, তুয়ার মনে এই প্রশ্নটাগুলোই রয়ে যেত। তুয়া ভাবত প্রত্যয় ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে বা ধর্ষিতা বলে দূরে সরিয়ে রাখছে। আর প্রত্যয় তুয়াকে সময় দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সময় দিতে গিয়ে ওদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হত। আর এটা প্রত্যয় কখনই চাইত না। তাই সীমাহীন ভালবাসায় দিয়ে তুয়াকে মুড়িয়ে দিল।
পরেরদিন সকালে খাবার টেবিলে সবাই খাচ্ছে।
চাঁদ অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করে ওর দুই গালে হাত রেখে বিষ্মিত সুরে বলল, “আপু তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে কেন? কি মেখেছে তুমি?”
চাঁদের কথা শুনে সবার দৃষ্টি তুয়ার দিকে। প্রত্যয়ের আব্বু দু’জনের দিকে তাকিয়ে উনার সহধর্মিণী দিকে তাকালেন। উনাদের দু’জনের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। কিছু কিছু জিনিস কারো চোখ চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না। আর বাবা মায়ের চোখ তো নয়ই। তুয়া প্রত্যয়ের ফেসে অদ্ভুত সুখময় সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। এজন্যই চাঁদ বিষ্মিত সুরে কথাটা বলল।
প্রত্যয়ের আম্মুর চোখে তুয়ার চোখ পড়ে গেল। তুয়া লজ্জা পেয়ে উঠে রুমে চলে গেল৷ আর চাঁদের কথার প্রতিউত্তরে মনে মনে বলল, “অনেক আদর মেখেছি।”

প্রিয়ম ওর মুখ খাবারটুকু গিলতেও পারছেনা আবার ফেলতেও পারছেনা। এটা তো হওয়ারই কথা ছিল। তবুও বুকে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে।
প্রত্যয় উঠে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। বাবা মায়ের সামনে সেও একটু লজ্জা পেয়েছে। তবে তুয়ার মত বুঝতে দেয় নি তাই।
প্রিয়ম মাথা নিচু করে রইল। কেউ মুখে কিছু না বলেও, যার যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। যুগ আপডেট মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এদিকে তুয়া আর প্রত্যয়কে চলে যেতে দেখে চাঁদ অবাক হয়ে বলল, “লে ব্যাপারটা কি হলো? এরা পালিয়ে গেল কেন?”
প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে বলল, “আম্মু এই জংলীটাকে আমার চোখের সামনে থেকে যেতে বলো। নাহলে আমি ওরে তুলে আছাড় দিব।”
চাঁদ আরো একদফা বিষ্ময় নিয়ে বলল, “লেও ঠ্যালা আমি আবার কি করলাম?”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

আজকে সকাল থেকে চাঁদ তুয়াকে দেখলেই দাঁত বের করে হেসে, “আপু ভাল আছো?” বলে খিলখিল করে হেসে উঠছে।
তুয়া তখন পারছেনা লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। তুয়াকে লজ্জা পেতে দেখে চাঁদ ইচ্ছে করে একই কাজ বার বার করছে। প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদকে ধমক দিতে গিয়ে উনিও হেসে ফেলেছেন। উনাদের হাসি দেখে তুয়া লজ্জায় আর রুম থেকেই বের হয়নি। দুপুরের খাবার সে রুমে বসে খেয়েছে৷ পেশেন্টের ভিড় বেশি থাকায় প্রত্যয় দুপুরে বাসায় আসতে পারল না। তবে তুয়াকে মেসেজ করে বলে দিল, “খেয়ে চুপটি করে ঘুমাও। আমার ফিরতে দেরী হবে।”
তুয়া প্রত্যয়ের মেসেজটা দেখে মুচকি হেসে শুয়ে পড়ল। কলি বেলকনিতে থেকে অনবরত বুলি আওড়াচ্ছে। একটুপরে,
প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার রুমের দরজা নক করে বলল, “তুয়া আসব?”
তুয়া দ্রুত উঠে বসে বলল, “হ্যাঁ আম্মু এসো।” প্রত্যয়ের আম্মু রুমে প্রবেশ করে তুয়ার পাশে বসলেন। তুয়াকে চুপ থাকতে দেখে প্রত্যয়ের আম্মু হেসে বললেন, “প্রত্যয় ফোন করেছিল? কখন ফিরবে কিছু বলেছে?” তুয়া জানাল প্রত্যয়ের ফিরতে দেরী হবে।
প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে বলল, “বোকা মেয়ে এত লজ্জার কিছু নেই।”

তুয়া প্রত্যুত্তর না করে চুপ থাকল। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে ঘুমাতে বলে চলে গেলেন। উনার যাওয়ার পর পরই চাঁদকে ঢুকতে দেখে তুয়া ঘুমের ভাণ ধরে রইল। তুয়াকে ঘুমাতে চাঁদ একপ্রকার হতাশ হল। কয়েকবার তুয়ার মুখের উপর হাত নাড়িয়ে চাঁদ স্থান ত্যাগ করল। চাঁদ যাওয়ার পর তুয়া মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে নিল। এখন তুয়া ঘুমের ভাণ না ধরলে চাঁদ বকবক করে ওর মাথা পাগল করে দিত।
প্রত্যয় সব কাজ সেরে বিকালে বাসায় ফিরল। রুমে ঢুকে তুয়াকে ঘুমাতে দেখে সে নিঃশব্দে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আর এই সুযোগে তুয়া উঠে ওদের বাসায় চলে গেল। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে এসে তুয়াকে রুমে না দেখে বলল, “হায়রে লজ্জা রে। সকালে লজ্জা পেয়ে নিজে তো ফাঁসলোই সঙ্গে আমাকেও ফাঁসালো।”
কথাটা বলে প্রত্যয় মিটিমিটি হাসতে হাসতে বেলকনিতে পা বাড়াল। কলি প্রত্যয়কে দেখে ডানা ঝাঁপটে অনবরত বলছে, “তুয়া! বউ! ভালবাসি! ভালবাসি! দুষ্টু!” প্রত্যয় হেসে কলিকে খাবার দিতে দিতে সালাম দিল। কলি অস্পষ্ট ভাবে উত্তর নিয়ে ডানা ঝাঁপটাতে লাগল। প্রত্যয় সুন্দর করে সালাম এবং সালামের উত্তম নিল প্রত্যয়ের দেখে কলিও প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল।
কলির বুলিগুলো প্রত্যয় ইচ্ছে করেই কলিকে শিখিছে। যখন কলি প্রত্যয়ের সামনে তুয়াকে অনবরত বউ! ভালবাসি! একথা বলে তুয়া তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। আর এটা দেখে প্রত্যয় মিটিমিটি হাসে।
**!!

প্রিয়ম ওর রুমে উল্টো ঘুরে কিছু একটা করছিল। চাঁদ গুটি গুটি রুমে ঢুকে দুষ্টু হেসে হুট করে প্রিয়মকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়ম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে চাঁদের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। চাঁদ থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে কাঁদছে। প্রিয়ম চাঁদকে ধাক্কা মেরে বলল, “বেহায়া মেয়ে তোর লজ্জা নেই?”
চাঁদ মাথা নিচু করে নিল প্রিয়ম স্বজোরে থাপ্পড়টা মেরেছে। প্রিয়ম চাঁদকে কিছু বলতে না দিয়ে রুম থেকে বের করে স্বজোরে দরজা আঁটকে দিল।
চাঁদ পেছনে ঘুরে প্রত্যয়কে দেখে থেমে গেল। সে দ্রুত গাল থেকে হাত সরিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, “ভাইয়া কিছু বলবেন? আপুকে ডেকে দিব?”
প্রত্যয় চাঁদের কান্নাভেজা কন্ঠস্বর শুনে শান্ত কন্ঠে, “অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট। শুধু একটু ধৈর্য্য ধরো।” কথাটা বলে প্রত্যয় মুচকি হেসে রুমে চলে গেল।
চাঁদ চোখ মুছে প্রিয়মের রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি জিনিস জন্মাইলেন গো শাশুড়ি আম্মা। একটু কিছু করলে দাম দুম করে ফেটে পড়ে।”
চাঁদ তুয়াকে ডেকে জানাল প্রত্যয় ডাকছে। তুয়া রুমে ঢুকে দেখে প্রত্যয় ওর ট্রলি গুছাচ্ছে। প্রত্যয় তুয়াকে দেখে বলল, “আপনি কি খুব বেশি ব্যস্ত?” তুয়া ড্রেসিং টেবিলে সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচঁড়ানো থামিয়ে বলল, “কই না তো।”
প্রত্যয় তুয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তা আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? আমার অপরাধ কি শুনি?” তুয়া হাতের চিরুনীটা রেখে ঘুরে বলল, “তেমন কিছু না জনাব। এখন চলুন, ইচ্ছের আম্মু আপনাকে ডাকছে।”
প্রত্যয়কে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে তুয়া বলল, “ইচ্ছের জ্বর এসেছে। ওকে ইনজেকশন পুশ করতে হবে।” ইচ্ছের জ্বরের কথা শুনে প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে নিচে গেল। চাঁদ প্রত্যয়ের আম্মুর সঙ্গে তখন ওখানেই ছিল। প্রত্যয় ইচ্ছের জ্বর মেপে ইনজেকশন রেডি করল। ইচ্ছে এখন ঘুমাচ্ছে, এই সুযোগে ইনজেকশন দিতে হবে। না হলে লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে।
তুয়া চাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ধীর কন্ঠে বলল, “চাঁদ তোমার গালে কি হয়েছে?” চাঁদও আস্তে করে বলল, “তোমার দেবর চুম্মিয়ে গাল লাল করে দিয়েছে।”

তুয়া কিছু বলার আগে প্রিয়ম পেছন থেকে রেগে বলল, “তুই কি মানুষ হবি না? জংলী সারাজীবন জংলীই থাকবি?” প্রিয়ম ইশারায় ওর আম্মুকে বলে বাইক নিয়ে চলে গেল। চাঁদের মুখের অবস্থা দেখে তুয়া মুখে ওড়না গুঁজে হাসতে লাগল। তুয়াকে হাসি দেখে প্রত্যয় ইনজেকশন দিতে গিয়ে থেমে গেল। তুয়া হাসি আঁটকাতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে এল।
প্রত্যয় ইচ্ছেকে ইনজেকশন পুশ করে দ্রুত সিরিঞ্জ সরিয়ে ফেলল। ইচ্ছে একটু ব্যাথা পেয়ে চোখ বন্ধ খুলে চোখ বড় বড় করে তাকাল। প্রত্যয় হেসে বলল, ” ইচ্ছেমণি তোমার জ্বরের আমাকে জানাও নি কেন? আমি এজন্য তোমাকে দেখতে আসলাম।”
প্রত্যয় কৌশলে ইচ্ছেকে কোলে তুলে ইনজেকশন পুশ করা স্থানে হালকা করে ডলতে লাগল। ইচ্ছে প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমি সূচ দিব না।”
প্রত্যয় হেসে বলল, “কার এত সাহস তোমাকে সূচ দিবে? যে সূচ দিবে তাকে আমি পুলিশের কাছে রেখে আসব।” প্রত্যয়ের কথা শুনে রুমের সবাই হাসল। প্রত্যয় খুব সহজে ইচ্ছেকে সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিল। এখানে অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণে ইচ্ছে তাকে কামড় আর খামচি দিয়ে আধমরা করে দিত। মূলত এজন্যই ইচ্ছের আম্মু বুদ্ধি করে প্রত্যয়কে ডেকেছে।
ইচ্ছে প্রত্যয়ের কাঁধ থেকে মাথা তুলে বলল, “প্রত্তুয় কানাচুর আনো নি।” প্রত্যয় ইচ্ছেকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে যেতে বলল, “উহুম, এখানে আনলে রুমের সবাই কেড়ে খেতে নিত। এখন তুমি আমার বাসায় চল ওখানে গিয়ে চানাচুর খাবে।” ইচ্ছে রুমের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “সব্বাই লুভি।”

ইচ্ছের কথা শুনে সবাই উচ্চশব্দে হাসতে লাগল। আর প্রত্যয় ইচ্ছেকে নিয়ে বাসায় চলে এল। তুয়া ড্রয়িংরুমের মেঝেতে বসে এখনও হাসছে। আর চাঁদ গাল ঝুলিয়ে সোফায় বসে আছে। এখন তুয়া চাঁদকে দেখে বার বার বলছে, “আর আদর লাগবে চাঁদ ডালিং?” কথাটা বলে তুয়া আবার হাসতে লাগল। প্রত্যয় ইচ্ছে কে সোফায় বসিয়ে চানাচুর এনে দিল।
ইচ্ছে চানাচুর নিয়ে প্রত্যয়ের বুকে সাথে লেপ্টে বসে রইল। তুয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “ইচ্ছে তুই এত লোভী কোনো? তুই সত্যিই খুব পঁচা মেয়ে।” ইচ্ছে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল, “তেনু?” তুয়া রাগের অভিনয় করে বলল, “আমার বরের বুকে মাথা রাখছিস কেন? সর, সর বলছি।”
তুয়ার কথা শুনে ইচ্ছে প্রত্যয়ের দিকে ছলছল চোখে তাকাল। প্রত্যয় হেসে ইচ্ছের চোখ মুছে দিয়ে বলল, “আরে ও তো একটা পাগলি। ওর কথা একদম শুনবে না।” ইচ্ছে তুয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে তুয়া রেগে তাকিয়ে আছে। প্রিয়মকে বাসায় ঢুকতে দেখে ইচ্ছে ওর দিকে বাড়িয়ে বলল, “প্রিউুম কোলে যাব।” প্রিয়ম হাতের ব্যাগটা রেখে হেসে ইচ্ছেকে কোলে নিল। ইচ্ছা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,”তুয়া আপু বকছে। তুমি বকা দাও।”
প্রিয়ম বাহানা করে তুয়াকে বকা দিল। প্রিয়মের বকা দেখে তুয়া আর চাঁদ হো হো করে হেসে দিল। ওদের হাসতে দেখে ইচ্ছে করুন চোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল। তুয়া উঠে ইচ্ছেকে বলল, “যা আমার শশুড়বাড়ি একদম আসবি না। এবার আসলে মেলা বকা দিব।” ইচ্ছেও এবার রেগে বলল, “একদম বকা দিবা না, না হলে আমিও শুশুর বালি চলে যাব।”

ইচ্ছের কথা শুনে চাঁদ তুয়া সহ প্রিয়মও হেসে দিল। ইচ্ছে আর সহ্য করতে না পেরে প্রিয়মের চুল টেনে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল। প্রত্যয় উঠে প্রিয়মের চুল ছাড়িয়ে ইচ্ছেকে কোলে নিল। প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদ তুয়াকে দেখে বললেন, “কি রে এত হাসছিস কেন?”
প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “সারাটা দিন কানের কাছে খ্যা খ্যা করতেই থাকে। আম্মু ইট দিয়ে এদের দাঁত ভেঙ্গে দাও যাতে লজ্জায় হাসতে না পারে।” প্রিয়মের কথা শুনে চাঁদ তুয়াসহ প্রত্যয়ের আম্মুও হাসতে লাগলেন। প্রিয়ম সোফাতে বসে বলল, “এই দু’টোকে রাজশাহীতে রেখে আসবে। এদের আর আনার দরকার নেই।” প্রত্যয়ের আম্মু হেসে প্রত্যয়কে বলল, “কি আব্বু সত্যি ওদের রেখে আসব?” প্রত্যয় তুয়া মুচকি হেসে বলল, “হুম রেখে এসো, আরেকটা বিয়ে করতে পারব।” প্রত্যয়ের আম্মু হাসতে হাসতে বললেন, “ছেড়ে থাকতে পারবি তো আব্বু?”
প্রত্যয় কিছু বলতে পারল না পেরে ইচ্ছেকে নিয়ে রুমে চলে গেল। তুয়ার ততক্ষণে হাসি থেমে লজ্জা এসে লাল হয়ে গেছে। প্রত্যয়ের আম্মু হেসে রুমে চলে গেলেন। তুয়াও উঠে প্রত্যয়ের রুমে ঢুকল। প্রিয়ম সোফাতে শুয়ে টিভির চ্যালেন বদলাতে লাগল। চাঁদ দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে প্রিয়মকে করুণ সুরে বলল, “আমাকে একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? ভালবাসার অধিকারটুকু না হয় দাও।” প্রিয়মের প্রত্যুত্তর না পেয়ে চাঁদ মন খারাপ করে উঠে দাঁড়াল।
**!!
রনিত পলককে নিয়ে বাজার থেকে কেবল ফিরল। রনিতের আম্মু বার বার ফোন দিয়ে কান্না কাটি করছেন। রনিত উনাকে বলে দিয়েছে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাবে। একথা শুনে উনি নতুন করে পলকের নামে অভিযোগ তুলে ধরেছেন। বার বার বোঝাচ্ছেন পলক মেয়ে ভাল না। এসব শুনে রনিত রেগে কল কেটে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। সংসার যদি সুখের হয় সেটা জান্নাতে পরিণত হয়। আর যদি সংসারে অশান্তি লেগে থাকে সেটা জাহান্নামে পরিণত হতে সময় লাগে না। একথা সে যেন হারে হারে টের পাচ্ছে।
পলক ওদের ফ্ল্যাটটা মনমত গুছিয়ে নিয়েছে। এখানে ওরা দু’জন মিলে ভালবাসায় মুড়ানো ছোট্ট একটা সংসার পাতবে। রনিত ইচ্ছের ঔষুধ আর কিছু ফল ইচ্ছেদের বাসায় দিয়ে বাসায় আসল। পলককে রান্না ঘরে দেখে রনিত সোফায় বসে বলল, “যা করবে সাবধানে। হাতে কাটে না যেন।” কথাটা শুনে পলক মুচকি হাসল।
**!!

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৩+১৪+১৫

ইচ্ছের আম্মু এসে ইচ্ছেকে বাসায় নিয়ে গেল। হালকা নাস্তা সেরে প্রত্যয়ের বাসার সবাই রেডি হচ্ছে। তুয়াকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে হিজাবে পিন আঁটকে ঘুরতেই প্রত্যয় তুয়াকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল, “আমার বউটাকে তোমার কাছে আমানত রাখলাম। আমি ফিরে এসে আমার বউকে নিখুঁতভাবে বুঝে নিব।”
প্রত্যয় কথাটা বলে তুয়ার কপালে আদর দিল। তুয়া ছলছল চোখে অন্য দিকে তাকাল। সে অনেকক্ষণ থেকে চোখের পানি আঁটকে রেখেছিল। কিন্তু প্রত্যয়ের কথা শুনে হার মেনে অশ্রুটুকু গড়িয়ে গেল। প্রত্যয় তুয়ার দুই গালে হাত রেখে বলল, “সাবধানে থাকবা আর যা লাগবে আম্মু আর প্রিয়মকে বলবে।”
তুয়ার চোখের পানি মুছিয়ে প্রত্যয় মৃদু হেসে পা বাড়াতে যাবে, তখন তুয়া প্রত্যয়ের শার্ট টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, “জনাব আপনার অপেক্ষা থাকব। আপনি দ্রুত আমার কাছে ফিরে আসবেন।”

প্রত্যয় সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। কলিকে তুয়াদের বাসায় রেখে উনাদের থেকে বিদায় নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ল। ওদের যেতে দেখে ইচ্ছে বায়না ধরবে তাই কেউ আর ইচ্ছের সঙ্গে দেখা করল না। এয়ারপোর্টে পৌঁছে প্রত্যয় প্রিয়মের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “সাবধানে যেও আর সবার খেয়াল রেখো।” প্রিয়ম প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমিও সাবধানে যেও ভাইয়া। চিন্তা করো না আমি আছি।”
প্রত্যয় ওর আব্বু আম্মু চাঁদ আর তুয়াকে সাবধানে থাকতে বলল। তুয়াতের ফ্লাইট আগে তাই তুয়ারা আগে যাবে। তুয়া সামনে এগোতে এগোতে কতবার যে পেছন ফিরে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়েছে তার হিসাব নেই। প্রত্যয় মুচকি হেসে ওদের যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে। তুয়াদের যাওয়ার বিশ মিনিটে পরে প্রত্যয়ও ওর পথে যাত্রা পথে রওনা দিল।

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৯+২০+২১