সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২২+২৩+২৪

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২২+২৩+২৪
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে তুয়াকে ওর বুকে আবদ্ধ করে নিল। আর তুয়া কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখে আবারও ঘুমিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর প্রত্যয় তুয়াকে ভাল ভাবে শুইয়ে রুমের বাইরে গেল। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করা দরকার। দেশে ফিরেই বউয়ের সঙ্গে ঘরবন্ধী থাকাটা বড্ড বেমানান। আর এতক্ষণে ওর আসার খবরটা চাঁদ সবাইকে জানিয়েও দিয়েছে। প্রত্যয় ড্রয়িংরুমে গিয়ে ওর আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। প্রিয়ম প্রত্যয়ের কথা শুনে সেও এসে প্রত্যয়ের পাশে বসল। টুকটাক কথার মাঝে প্রত্যয়ের আম্মু সবাইকে হালকা নাস্তা দিয়ে বললেন, “পাখি আর আকাশের থেকে খবর পেয়ে তুই ফিরলি নাকি, আব্বু?”
প্রত্যয় উনার কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। প্রত্যয়ের আম্মু হেসে সকালের ঘটনাটা প্রত্যয়কে জানিয়ে হাসলেন। তুয়ার এমন পাগলামির কথা শুনে প্রত্যয় মৃদু হাসল। ছেলের মুখে হাসি দেখে প্রত্যয়ের আম্মু বললেন, “তুয়া কি এখনও ঘুমাচ্ছে?” প্রত্যয় বলল, “হুম।”

সন্ধ্যায় আজানের সময় তুয়া ঘুম থেকে উঠে মন ভার করে বসে রইল। সে সামনে প্রত্যয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে প্রত্যয়কে না পেয়ে স্বপ্ন ভেবে সে কেঁদেই দিল।
হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলে তাকাল। ছলছল চোখে তাকিয়ে দেখল, প্রত্যয় ওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এটা তাহলে স্বপ্ন নয় বরং সত্যি! তুয়া মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ না করে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখ মুছে দিয়ে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল, “যা শাস্তি দিবে বিনাবাক্যে গ্রহন করব, বল কি শাস্তি দিবে?”
তুয়া প্রত্যয়ের বাহুডোর থেকে ছোটার চেষ্টা করলে প্রত্যয় ওকে শক্ত করে ধরে রাখল। তুয়া অভিমানী কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ, আমি তো কারো কেউ না। এখন ঢং করতে হবে না।” প্রত্যয় মুচকি হেসে তুয়ার দুই গালে হাত রেখে বলল, “তোমাকে কারো কেউ হতেও হবে না। তুমি আমার এবং আমার তারপরেও আমার হলেই চলবে।”
কথাটা শুনে তুয়া চুপ হয়ে গেল। প্রত্যয়ের ফোনে কল এসেছে, সে কথা বলতে লাগল। আর তুয়া ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে গেল। তবে তুয়ার মুখের দুষ্টু হাসি প্রত্যয়ের নজর এড়ালো না। তুয়া প্রত্যয়ের আম্মুর কাছে যেতেই উনি বললেন, “এতক্ষণ ঘুমালি, রাতে কি আর ঘুম আসবে?”
চাঁদ হেসে তুয়াকে খোঁচা মেরে আস্তে করে বলল, “রাতে পেনডিং কাজ গুলো সম্পূর্ন করতে হবে, তাই না আপু?”
তুয়া মাথা নিচু করে চাঁদকে একটা চিমটি কাটল। প্রত্যয়ের আম্মু কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে চুপ করে রইলেন। প্রত্যয় মাগরিবের নামাজ পড়ে ড্রয়িংরুমে ওর চাচা-চাচীদের দেখে উনাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল।
সন্ধ্যার পরে প্রিয়ম প্রত্যয়কে বাইরে হাঁটতে যাওয়ার জন্য বলল। দুই ভাই একসঙ্গে বের হবে, তখন চাঁদ দাঁত বের করে হেসে প্রত্যয়কে বলল, “ভাইয়া, আমার বাদাম খেতে মন চাচ্ছে। এখন না খেলে হার্ট এ্যার্টাক করে মারা যেতেও পারি।”
প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে চাঁদকে বলল, “সারাদিন খাওয়া ছাড়া মাথায় আর কিছু আসে না?” প্রত্যয় প্রিয়মকে থামিয়ে চাঁদকে বলল,”আচ্ছা, তোমরা আমাদের সঙ্গে চল।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চাঁদ বাইরে যাওয়ার জন্য দৌড়ে তুয়াকে ডেকে আনল। প্রত্যয় ওর আম্মুকেও ডাকল, কিন্তু উনি যাবেন না বললেন। ওরা চারজনে বেরিয়ে একটা নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটছে। চাঁদ আর তুয়া গল্প করতে করতে প্রত্যয়দের একটু সামনে হাঁটছে। রাতের ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ আলোতে সবাইকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। তুয়া হাসতে হাসতে পেছনে ফিরে প্রিয়মকে বলল, “ভাইয়া, ল্যাম্প পোষ্টের হলুদ আলোতে আপনাদেরকে দেখতে জন্ডিসের পেশেন্টর মতো লাগছে।”
কথাটা বলে চাঁদ তুয়া আবারও একসঙ্গে হেসে উঠল। তুয়ার কথাটা শুনে দুই ভাই মৃদু হাসল। এত জার্নি করে এসে, প্রিয় মানুষ গুলোর হাসি দেখে প্রত্যয়ের সব কষ্ট যেন ফিকে হয়ে গেছে।
প্রিয়ম প্রত্যয়কে কিছু বলার জন্য উশখুশ করছে, কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। প্রত্যয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, “মেয়ে মানে একটু আহ্লাদি, অভিমানিনী, মায়াবী, চঞ্চলাময়ী, তাদের একটু ভালবাসা পেলে তারাও ভালবাসা দিতে কার্পণ্যতা করে না। জীবনের কিছু কিছু ত্যাগ ভাল কিছু বয়ে নিয়ে আসে। প্রিয়ম, জীবনকে আরেকটাবার সুযোগ দাও। একটা মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছ, তাকে ভাল রাখার দায়িত্ব পালনে কোনো কমতি রেখো না।”
প্রিয়ম মুচকি হেসে প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাইয়া, তুমি শুধু আমাকে দূরে সরিও না।”
প্রত্যয় প্রিয়মের পিঠে ভরসার হাত রাখল। প্রিয়ম প্রত্যয়কে ছেড়ে চোখ মুছে মুচকি হাসল। তারপর ওরা চাঁদ আর তুয়ার দিকে এগিয়ে গেল।
পলক সেদিন বিকেলেই বাবার বাড়ি থেকে চলে এসেছে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ি কোনোটাই পলকের আপন রইল না। তবে সে স্বামী নামক মানুষটাকে ভরসা করে বাঁচবে। আজ সকালে পলক ইচ্ছের আম্মুর সঙ্গে হসপিটালে গিয়েছিল। আর কাঙ্খিত রিপোর্ট থেকে জেনেছে, সে মা হতে যাচ্ছে। এ কথা পলক রনিতকে ভয়ে বলতে পারছে না। রনিত অফিস থেকে ফিরে পলকের শুকনো মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?”
পলক জোরপূর্বক হেসে রনিতকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। রনিত ওর হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে সুন্দর ভাবে আবার জিজ্ঞাসা করল, “বলো?”

পলক ভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। রনিত পলককে এভাবে কাঁদতে দেখে অবাক বলল, “না বললে বুঝব কিভাবে? আচ্ছা! যাই হোক, কথা দিচ্ছি বকা দিব না।” পলককে হেঁচকি তুলে কেঁদে বলল, “আ আম আমি প্রেগন্যান্ট।”
রনিত ভ্রু কুঁচকে পলকের দিকে তাকাল। কিছুদিন আগেও তো পলক বলল ওর পিরিয়ড হয়েছে। তাহলে ও প্রেগন্যান্ট কিভাবে হয়? রনিত নিজেকে শান্ত করে হেসে বলল, ”সব ব্যাপারে মজা করতে নেই। কিছুদিন আগে না আমাকে বললে তোমার পিরিয়ড হয়েছে?”
পলক রনিতকে রিপোর্ট দেখিয়ে মাথা নিচু করে রইল। রনিত ওকে বার বার বলেছে এখন বাচ্চা নেওয়া যাবে না, এটা ওর জন্য রিস্কি হয়ে যাবে। কিন্তু সেই অঘটনটাই পলক ঘটাল।
পলক মুখ কাচুমাচু করে বলল, “আমিও ডাক্তারকে বললাম কিছুদিন আগে আমার পিরিয়ড হয়েছে। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব? উনি আমাকে বললেন ট্রাইমেস্টারের শুরুর দিকে হালকা রক্তক্ষরণ নাকি গর্ভধারণের আগাম সংকেত। আর আমি ইমপ্ল্যান্টেশন ব্লিডিংকে পিরিয়ড ভেবেছিলাম।”
রনিত মাথা নিচু করে চুল মুঠো করে ধরে বসে রইল। অপরিপক্ক বয়সের মেয়েকে বিয়ের ফল সে হারে হারে টের পাচ্ছে। বাচ্চা আসার খবরটা সুসংবাদ হলেও পলকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর এজন্যই রনিতের মুখের হাসিটা মলিন হয়ে গেল। পলক ছলছল চোখে রনিতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু রনিত কিছু বলল না, উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। পলক চোখের পানি মুছে জানালার পাশে গিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকাল। বিয়ের পর জীবনটা ওর কাছে খুব কঠিন মনে হয়। সবকিছুই ‘না’ শব্দটায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে পলক মনে মনে খুশি। সে চায় ইচ্ছের মতো একটা তোতাপাখি ওর কোল জুড়ে আসুক। সারাদিন পুরো রুম জুড়ে ছোটাছুটি করে আদুরে আবদারের ঝুলি নিয়ে বসুক। পলক ওর পেটে হাত রেখে বলল, “ছোট্ট রনিত নাকি ছোট্ট পলক কে তুই? যেই হোস, বাবার মতো খাটাশ হবি না।”
রনিত হাতে টাওয়াল নিয়ে পলকের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। এতটুকু একটা মেয়ে সে আবার তার বাচ্চা নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করা শুরু করেছে। রনিতের আর কিছু বলার নেই। সব আল্লাহর হাতে। উনার হুকুমেই বাচ্চাটা তার আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। রনিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, বাবা খাটাশ আর মা অনেক ভাল। এজন্য খালি পেটে থেকে বাবুকে এখনও ক্ষুধার্ত রেখেছে।”
রনিতের কথা শুনে পলকের মুখে হাসি ফুটল। সে উঠে রনিতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
**!!

প্রত্যয়রা অনেক রাত অবধি ঘুরে তারপর বাসায় ফিরল। রাতে খাবার সময় প্রত্যয় চাঁদ আর প্রিয়মের পুনরায় বিয়ে দেওয়ার কথাটা জানাল। প্রত্যয়ের কথাতে কেউ অমত করেনি। বরং খুশি হয়ে প্রত্যয়ের আব্বু বললেন, “তাহলে আত্মীয়দের ডেকে কালকেই কাজটা সেরে ফেলি।” প্রত্যয় উনার কথায় সম্মতি দিয়ে বলল, “এটাই ভাল হবে, আব্বু।”
এসব বিষয়ে বড়রা আলোচনা করলেন। চাঁদ প্রিয়মের দিকে তাকাল, সে নিজের খাওয়াতে ব্যস্ত। প্রিয়ম ওকে মেনে নিয়েছে ভেবে চাঁদের মুখে হাসি ফুটল। তারপর খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল। প্রত্যয় বেডে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিল। একটু পরে তুয়া রুমে এসে একটা বালিশ নিয়ে পা বাড়াতে যাবে, তখন প্রত্যয় ওর হাত আঁটকে বলল, “কোথায় যাচ্ছ?” তুয়া মুখ গোমড়া করে বলল, “চাঁদের রুমে ঘুমাব।”
কথা শুনে প্রত্যয় উঠে তুয়ার হাতের বালিশটা রেখে আদুরে সুরে গেয়ে উঠল,
“লক্ষী সোনা রাগ করেনা
একটু হাসো প্লিজ।
ভাল্লাগেনা আর আর হবে না
করছি যে প্রমিস।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[২৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয়ের গান শুয়ে তুয়া অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
বাসের সেই বাচ্চাটা এই গানটাই বার বার শুনছিল যার ফলে প্রত্যয়েরও মুখস্থ হয়ে গেছে। আর সেই গানের চার লাইন প্রত্যয় তুয়াকে শোনাল। তুয়াকে হাসতে দেখে প্রত্যয় তুয়াকে ওর পাশে বসিয়ে বুঝিয়ে ওর স্যারের কথাটা জানাল।প্রত্যয়ের পুরো কথা শুনে তুয়ার অভিমান নিমিষেই দূরে হয়ে গেল। তুয়া মুচকি হেসে প্রত্যয়ের হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবিয়ে বলল, “দুরে গেলে সত্যিই কি আমার কথা মনে পড়ে?”
প্রত্যয় তুয়ার কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলল, “ভুললে তো মনে পড়বে।” কথাটা শুনে তুয়া উঠে প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। তুয়ার এমন কাজে প্রত্যয় মুচকি হেসে তুয়াকে ওর বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল। তুয়ার এখন প্রবল আকাঙ্খা প্রত্যয়ের বুকের প্রশান্তিটুকু লুফে নেওয়া। প্রত্যয়ের শরীরের সেই চিরচেনা গন্ধটুকু নিঃশ্বাসের সঙ্গে শুষে নিয়ে মনটাকে শান্ত করা। কিন্তু প্রত্যয় তুয়ার আকাঙ্খায় ইতি টেনে তুয়ার খুব কাছে এসে শান্ত কন্ঠে বলল, “খুব ভালবাসি আমার মিষ্টি বউটাকে।” কথাটা শুনে তুয়া,”আমিও জনাব” বলে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে প্রত্যয়ের বুকে মুখ লুকাল। তুয়ার লজ্জারত কন্ঠ শুনে প্রত্যয় দুষ্টু হেসে তুয়াকে নিয়ে পাড়ি জমাল ভালবাসাময় এক সুখরাজ্যে।

প্রত্যয়ের আম্মু রাতেই উনাদের নিকট আত্মীয়দের নিমন্ত্রণের কাজ সমাপ্ত করলেন। পরেরদিন খুব সকালে প্রত্যয় ওর আব্বুর সঙ্গে বাইরে গিয়েছে, এখনও ফিরেনি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একে একে সব আত্মীয়রা আসা শুরু করেছেন। প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদ তুয়াকে শাড়ি গয়না পরিয়ে সোফায় বসালেন। উপস্থিত আত্মীয়রা নতুন বউ দেখে দোয়া করে যাচ্ছেন। তুয়াদের ঠিক সামনে সম্পর্কে নানী খালারা উনাদের আমলের কাহিনী তুলে ধরেছেন। একে একে আত্মীয়দের সংখ্যা বাড়তে লাগল আর ওরা দু’জন মুখে হাসি ঝুলিয়ে চুপটি করে বসে রইল।
প্রিয়ম সকালে থেকে বাসায় নেই। তবে ফোন করে জানিয়েছে বাসার আশেপাশেই আছে। সম্পর্কে ভাবিরা তুয়াদের নিয়ে ঠাট্টা করে উনারাই হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ের উপরে পড়ছে। একটুপরে, প্রত্যয় আর ওর আব্বুর কিনে আনা জিনিসপত্র বাবুর্চিকে বুঝিয়ে দিলেন। উনাদের কথামতো বাবুর্চি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে রান্নার কাজে লেগে গেলেন। প্রত্যয়কে ড্রয়িংরুমে ঢুকতে দেখে এক ভাবি বললেন, “কি গো বরের ভাই আমাদের দেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছো নাকি?
প্রত্যয় সবাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে মুচকি হেসে বলল,”ভাবি, পালিয়ে বেড়াচ্ছিনা আব্বুর সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলাম।”
প্রত্যয়ের আম্মু এসে তুয়াকে বললেন প্রত্যয়কে খেতে দিতে। তুয়া উঠে প্রত্যয়কে খেতে দিলে প্রত্যয় সবাই খেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করল। তুয়া গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে জানাল প্রিয়ম বাদে সবাই খেয়েছে।
তুয়াকে গাঢ় গোলাপি শাড়ি পরিহিত দেখে প্রত্যয় আস্তে করে বলল, “তোমাকে দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে তবে সাবধানে পড়ে যেও না যেনও।”
কথাটা বলে প্রত্যয় খেয়ে উঠে বাইরে চলে গেল। সাদা কালো টি_শার্টের সঙ্গে কালো জিন্সে প্রত্যয়কে বেশ মানিয়েছে। এই কথাটা তুয়া না মুখ ফুটে বলতে পারল আর না দু’চোখ ভরে দেখতে পারল। এতগুলো মানুষের সামনে ওর দিকে তাকিয়ে থাকাটাও বেমানান দেখাত। প্রত্যয় প্রিয়মকে ফোন করে বাসায় ফিরতে বলে কল কাটতেই, হসপিটাল থেকে কল আসল। জমিলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রত্যয় সামনে দিকে এগিয়ে গেল।
একটুপরে, ভাবিরা চাঁদ আর প্রিয়মের গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে গোসল করাবেন বলে ঠিক করলেন। পুনরায় বিয়ে যখন হচ্ছেই টুকটাক নিয়ম গুলোও পালন করুক। প্রত্যয় কথা বলে ঘুরতেই একজন ভাবি প্রত্যয়কে হলুদ দেওয়ার কথাটা বললেন। উনার কথা শুনে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “ভাবি, প্রিয়ম মনে হয় এসব পছন্দ করবেনা। আর আমিও ঠিক জানিনা হলুদের ছোঁয়াতে আর কি কি লাগে?”
ভাবি দাতঁ বের করে হেসে বলল, “থাক তোমাকে আর এসব জানা লাগবেনা। তুমি শুধু আমাদেরকে দ্রুত চাচিমা হওয়ার ব্যবস্থাটা করিয়ে দিও, তাহলেই হবে।”
কথাটা শুনে ওখানকার অনেকেই হাসিতে ফেটে পড়লেন। প্রত্যয়ের আম্মু সামনে থাকায় প্রত্যয় লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে স্থান ত্যাগ করল। প্রত্যয়ের আম্মু হাসতে হাসতে বললেন, “একথাটা প্রিয়মকে বললে তোমাদেরকে বাঁশ দিত, প্রত্যয় বলে বেঁচে গেলে।”
**!!

রনিত বাসায় একজন বুয়া রেখেছে। উনিই রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কাজ করে দিয়ে যাবেন। রনিত পলককে নিয়ে ডাক্তারে কাছে গিয়েছিল এবং ডাক্তারের কথা অনুযায়ী চলবে বলে ঠিক করে। অপরিপক্ব বয়সে গর্ভধারণ খুব ঝুঁকিপূর্ন, তাই সে এখন থেকেই পলকের যত্নের কোনো ত্রুটি রাখছেনা।
সকাল বেলায় সারাদিনের পর্যাপ্ত পানি, ফল, খাবার, সবটা গুছিয়ে দিয়ে তারপর সে অফিসে যায়। আর শর্ত দেয় বাসায় ফিরে যেন এগুলো আর না দেখে, যদি একটা কিছুও পড়ে থাকে তাহলে পলকের খবর আছে। পলক রনিতের এসব কাজে রাগ দেখালেও মনে মনে খুব খুশি হয়। ইচ্ছের আম্মু আর ইচ্ছে এসে পলকের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটায়। আজকে ইচ্ছের আম্মু ইচ্ছেকে পলকের কাছে রেখে একটা কাজে বাইরে গিয়েছে। পলক ইচ্ছেকে ওর পাশে বসিয়ে মুচকি হেসে বলল,” ইচ্ছে বলো তো আমার কি বাবু হবে?”
ইচ্ছে চানাচুর খাওয়া থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তোমার তো এত্ত বলো(বড়) পেত নেই? তাহলে বাবু হবে কেনু?”
পলক ইচ্ছের গাল দু’টো চটকে দিয়ে বলল, “আমার পেটে তোমার মতো কিউট একটা বাবু আছে। সে এখন অনেক ছোট আস্তে আস্তে বড় হবে, এখন বুঝলেন পাকা বুড়ি?”
ইচ্ছে কি বুঝল কে জানে? সে চানাচুর তুলে পলকের পেটে ঠেকিয়ে বলল, “নাও বাবু কানাচুর খাও আল তালাতালি বলো (বড়) হও।”
ইচ্ছের কথা শুনে পলক হেসে ইচ্ছকে কাতুকুতু দিতে লাগল।
আর পলকের কাতুকুতুতে ইচ্ছে খিলখিল করে হাসতে লাগল।
**!!

প্রিয়ম বাসায় ফিরে ওর গায়ে হলুদ দিতে নিষেধ করে দিল। এসব আদিখ্যেতা তার মোটেও পছন্দ নয়। ভাবিরা জোর করেও প্রিয়মকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলেন না। প্রত্যয়ের আম্মু এসব দেখে প্রত্যয়কে ডাকতে পাঠালেন কারন প্রত্যয়ের কাছেই প্রিয়ম কাবু।
একজন ভাবি গিয়ে প্রত্যয়কে ডেকে আনলেন। ভাবিদের জোরাজুরিতে প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে একই জেদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবিরা প্রিয়মকে ছাড়ছেও না আবার যেতেও দিচ্ছেনা। তাই প্রত্যয় নিজে এসে প্রিয়মের গালে হলুদ ছোঁয়াল। প্রিয়ম প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইয়া প্লিজ।”
প্রত্যয় প্রিয়মের গালে হলুদ ছুঁইয়ে মুচকি হেসে বলল, “সামান্য একটু।”
প্রিয়ম প্রত্যয় ছাড়া আর কারো থেকে হলুদ নিল না। তাই প্রত্যয় সবাইকে সুন্দরভাবে নিষেধ করল প্রিয়মকে আর জোরাজুরি না করতে। হঠাৎ ভিড়ের মাঝে থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, “বিয়ের পরও ভাইয়ে ভাইয়ে এত মিল মহব্বত থাকলেই হয়।”
কথাটা শুনে প্রত্যয় প্রিয়মসহ উপস্থিত সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। পরিবেশটাও এক নিমিষেই গুমোট ধরে গেল। কিন্তু কে এই কথাটা বললেন তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। চাঁদ তুয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে প্রত্যয় প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রত্যয় প্রিয়ম দু’জনেই কথাটা যেন বুকে গিয়ে বিঁধেছে, ওরা দু’ভাই ই থম মেরে দাঁড়িয়ে গেছে।
প্রত্যয়ের আম্মু পরিবেশটাকে শান্ত করতে হেসে বললেন, “জানিনা কথাটা কে বললেন? তবে সবার উদ্দেশ্যেই আমি কিছু কথা বলছি। প্রিয়ম যখন আমার পেটে তখন প্রত্যয় একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “আম্মু আমার ভাই হবে নাকি বোন?” আমি তখন প্রত্যয়কে বলেছিলাম, “তোমার ছোট্ট একটা ভাই হবে।” কথাটা শুনে প্রত্যয় খুশি হয়ে কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে বলেছিল,” আম্মু, ভাই বড় হয়ে কি আমাকে কষ্ট দিবে?”

আট বছরের প্রত্যয়ের মুখে একথা শুনে ওর বাবা বুঝিয়ে বলেছিলেন, “ভাইকে যদি ভালো মানুষ বানাতে পারো তাহলে সে কখনও তোমাকে কষ্ট দিবেনা।”
সেদিন প্রত্যয় প্রত্যুত্তরে বলেছিল, “আব্বু, ভাইকে আমি ভালো মানুষ বানাব আর অনেক ভালোও বাসব। তবুও ভাই আমাকে কষ্ট দিলে ভাববো আমি পঁচা ভাই।”
সেদিনের প্রত্যয়ের বলা কথাটা আজও আমার কানে বাজে। সেই ছোট প্রত্যয় কথাটা শুধু মুখেই বলেনি বরং তার ভাইকে মানুষের মতো মানুষ করে দেখিয়েছে। আমি জানিনা ভবিষ্যতে কি হবে বা কি ঘটবে? তবে এতটুকু জোর দিয়ে বলব আমার ছেলেরা সহজে কেউ কারো সঙ্গ ছাড়বেনা। হ্যাঁ, ছেলেদের বিয়ে দিয়েছি তাদের সন্তান হবে একদিন সংসারও হয়তো আলাদা হবে। সংসার আলাদা হওয়াকে আমি সঙ্গছাড়া বলে না, বলে সম্পর্কের বিচ্ছেদটা হওয়াটাকে।
আর প্রতিটা মেয়ের চাওয়া ঝামেলাহীন সংসারে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে। আমি নিজেও এটা চেয়েছি, এখন চাঁদ তুয়া এটা চাইলে আমি ওদের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারব না। আর বিয়ের পর ওদের দুই ভাইয়ের মিল থাকুক বা না থাকুক। ওরা সবাই যেন সবাই দুধে ভাতে থাকে, এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।”
প্রত্যয়ের আম্মু কথাটা বলতে বলতে কেঁদে দিলেন আর উনার সঙ্গে অনেকের চোখের অশ্রু ঝরে গেল। তুয়া আর চাঁদ প্রত্যয়ের আম্মুকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। তুয়া প্রত্যয়ের আম্মুর হাতটা ধরে কান্নারত কন্ঠে বলল, “আম্মু কেঁদো না পরেরটা নাহয় পরেই দেখা যাবে। পরের বাড়ির মেয়েরা শুধু সংসার আলাদা করতে জানে তা কিন্তু নয়।”
চাঁদ প্রত্যয় প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, ” শক্ত বাঁধনে বাঁধা সম্পর্কগুলো ভাঙ্গা এতোটা সহজ না।”

প্রত্যয়ের আব্বু পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করতে সবাইকে তাড়া দিতে লাগলেন। চাঁদ প্রিয়মকে রেডি করিয়ে যথাসময়ে ওদের বিয়ে সম্পূর্ণ করা হল। একটা কনের যাবতীয় জিনিসপত্র চাঁদকে দেওয়া হয়েছে, তবুও সে একটা লাল শাড়ি পড়ে সাজহীন ভাবে বসে আছে। প্রত্যয়ের আম্মু দুই ছেলের বউকে দু’টো ট্রলি দিয়েছে, সেখানে গয়না থেকে শুরু করে তাদের যাবতীয় সব জিনিস রয়েছে। তাড়াহুড়োর বিয়েতে পুত্রবধুদের কিছু দিতে পারেনি বলে এতোদিন মনে মনে খুব আফসোস করতেন। আজকে উনার সেই আফসোসের ইতি টানলেন।
হাসি ঠাট্টা খাওয়া দাওয়ার মাঝে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। সন্ধ্যার পর একে একে আত্মীয় স্বজনরা বিদায় নিলেন। আজকে থেকে চাঁদের ঠাঁই হবে প্রিয়মের রুমে। তবে প্রিয়মের বুকে আদৌ ওর ঠাঁই হবে কি না এটা চাঁদের অজানা। মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে, চাঁদও আবার নব্য স্বপ্নে বুনে ওর জীবনের নতুন অধ্যয়ে পা রাখল।
আত্নীয়রা চলে যাওয়াতে বাড়িটা এখন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ড্রয়িংরুমে চাঁদ তুয়া বসে ওদের মতো হাসাহাসি করছে। আজকে তুয়া চাঁদকে প্রিয়মকে নিয়ে খোঁচা মেরে খিলখিল করে হাসছে। আর চাঁদ চুপ করে তুয়া দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু উনাদের রুমে আর প্রত্যয় আর প্রিয়ম গেছে ছাদে। রাত এগারোটার দিকে
রাতের খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে, তুয়া চাঁদকে প্রিয়মের রুমের দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,” ভালবাসা মাখতে প্রস্তুত হও।”
কথাটা বলে তুয়া হাসতে হাসতে ওদের রুমে চলে গেল। আর চাঁদ কান্নারত কন্ঠে মুচকি হেসে মনে মনে বলল, “সে যে তোমাকে বড্ড ভালবাসে গো আপু। তার ভালবাসা মাখার সৌভাগ্যটুকুও যে আমার ভাগ্যেতে নেই।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[২৪]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

তুয়া কিছু একটা ভেবে আবার চাঁদের কাছে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই প্রিয়মের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তুয়া মুচকি হেসে বলল,”ভাইয়া, আমাদের জীবনটা বহমান নদীর মতো চলমান একটা ঢেউ। আর ঢেউয়ের মতো সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, আবেগ আর অনুভূতি নিয়ে ভেসে চলে আমাদের জীবন। খারাপ পরিস্থিতি যে খারাপ ফল বয়ে আনে তা কিন্তু নয়। সব ভুলে চাঁদকে নিয়ে অনেক ভাল থাকুন আর আপনাদের জন্য অনেক দোয়া এবং ভালবাসা রইল।”
কথাটা বলে তুয়া প্রিয়মের থেকে বিদায় নিয়ে আবার রুমে ঢুকে গেল। আর প্রিয়ম তুয়ার যাওয়ার পাণে তাকিয়ে নিজের ভাগ্য দেখে মৃদু হাসল। চাঁদ প্রিয়মের রুমের বেলকণিতে দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়ম রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বেলকণিতে গিয়ে দাঁড়াতেই চাঁদ বলল, “প্রিয় মানুষটাকে অন্যের রুমে ঢুকতে দেখলে তোমার কষ্ট হয় না, প্রিয়ম?”
প্রিয়ম চাঁদের কথায় অবাক না হয়ে চাঁদকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল। ওর বুকের ক্ষতটাকে এখন নতুন করে খোঁচাতে চাচ্ছেনা সে। এমনিতেই বিনা অনলে যথেষ্ট জ্বলে যাচ্ছে প্রিয়মের বুকের বাঁ পাশটা।
প্রিয়মের উত্তর না পেয়ে চাঁদ আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,”জানো প্রিয়ম আমিও ওই চাঁদটার মতো বড্ড একা। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে কখনও বাবার ছিঁটেফোঁটা আদরও কপালে জুটেনি, ছোট খালার কাছে লাথি ঝাড়া খেয়ে মানুষ হয়েছি। আমার পরে আমার বোন হওয়াতে মায়ের উপরে বাবার অত্যাচার দ্বিগুন বেড়ে গেল। একপর্যায়ে মা বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করল। বাবা আবার বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করল। আর আমি ছিলাম খালার কাছে উটকো ঝামেলা তাই তারা সুযোগ বুঝে তোমার গলাতে আমাকে ঝুলিয়ে দিল। এখন তোমার জীবনে এসে তোমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছি, তাই না? আচ্ছা আমাকে কি একটু ভালোবাসা যায়না প্রিয়ম?”

প্রিয়ম চাঁদের কথা শুনে বলল, ”চেষ্টা করছি বলেই
পুনরায় তোমাকে বিয়ে করে নতুন ভাবে পথচলা শুরু করলাম। আমাদের সম্পর্কটাকে আর একটু সময় দাও। আর তুয়া সম্পর্কে কি জেনেছ বা জানো জানতে চাচ্ছি না। তবে একটা কথা সরাসরি জানিয়ে দিচ্ছি, এসব কথা আমার সামনে কেনো কারো সামনেই ভুলেও আর কখনও তুলবেনা।
এখন যাও ফ্রেশ হয় ঘুমিয়ে পড়ো অনেক রাত হয়েছে।”
প্রিয়মের কথা শুনে চাঁদ আর কথা বাড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রিয়মও চাঁদের পাশে গিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কিছু কিছু কষ্ট এতটা তীব্র হয় যে কাউকে না বোঝানো যায় আর না দেখানো যায়। শুধু নিজের দীর্ঘশ্বাসের ভিড়ে বুকের গহীনে থাকা কষ্টটাকে আড়ালে রাখতে হয়। চাঁদ অনেকটা সাহস জুগিয়ে প্রিয়মের বুকের বুকে ওর মাথা রাখল। প্রিয়ম চমকে উঠে চাঁদকে সরাতে গিয়েও সরালো না। চাঁদের তখন ওর ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে আবেশে চোখ দুটি বন্ধ করে বিরবির করে বলল, “শুধু তোমাকে ভালবাসার সুযোগটুকু দাও।”
**!!
তুয়া রুমে ঢুকতেই অতি যত্নে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে গেল। আচানক এমন হওয়াতে তুয়া চমকে উঠলেও তাৎক্ষণিক বুঝল এটা তারই প্রিয় মানুষটা। তাই মুচকি হেসে দুই হাত দিয়ে প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “কি জনাব এখনও ঘুমান নি কেন?” প্রত্যয় প্রত্যুত্তরে মুচকি হেসে বলল, ” বউ ছাড়া ঘুমালে বড় বড় পাপ হবে এজন্য।”

প্রত্যয়ের কথা শুনে তুয়া শব্দ করে হেসে প্রত্যয়ের পায়ের পাতার উপর উঠে দাঁড়াল। প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে ধীর পায়ে পুরো রুম জুড়ে হাঁটতে লাগল। তুয়া ভয়ে পেয়ে প্রত্যয়ের টি-শার্ট ধরে ভীত কন্ঠে বলল, “এই পড়ে যাব তো।” প্রত্যয় তুয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “পড়তে দিলে তো।” তুয়া প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে ধরে ভ্রু নাচিয়ে বলল, “কি ব্যাপার আসল কাহিনী কি, হুম হুম?” প্রত্যয় ফিচলে হেসে বলল,” কাহিনী ছাড়া বউয়ের কাছে আসা নিষেধ নাকি?”
তুয়া প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না শুধু হাসল। দু’জনের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় চন্দ্রবিলাশ করে ঘুমাতে গেল। পরেরদিন ওরা সবাই মিলে রাজশাহীর অনেক জায়গা ঘুরে ফিরে দেখল। হসপিটাল থেকে প্রত্যয়ের জুরুরী কল আসায়, ওরা ঢাকাতে ফিরে রোজকার মতো আবারও ব্যস্ত জীবনে ব্যস্ত হয়ে গেল। প্রিয়ম চাঁদকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল আর প্রত্যয়ের যুক্তির কাছে হার মেরে তুয়া কলেজে যেতে রাজি হল।
তুরাগের এনগেজমেন্টের ডেট ক্যান্সেল করা হয়েছে। কারন ইলার বাবা হঠাৎ সাইলেন্ট হার্ট এ্যার্টাক করেছেন। ইচ্ছে প্রত্যয়ের দেখে বেশ কয়েকবার উপরে এসেছে কিন্তু সঙ্গে কথা বলেনি। কেউ ডাকলেও কারো কাছে যায়নি কিছু জিজ্ঞাসা করলে কোনো উত্তর দেয়নি। একটা পুতুল হাতে নিয়ে একা একা ঘুরে আবার চলে গেছে। ওর ছোট্ট মনে ওদের প্রতি বেশ অভিমান জমেছে।
তুয়া আজকে ওর কলেজে এসেছে। কিন্তু মিতুকে ছাড়া ওর খুব একা লাগছে। স্কুল বা কলেজে বেস্টুর অনুপস্থিতে নিজেকে কেমন এতিম এতিম লাগে। কোনোকিছুতেই যেন মন বসে না। তুয়া মিতুর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। আজকে কলেজে এসে শুনল মিতু নাকি টিসি নিয়ে অন্য কলেজে চলে গেছে। কথাটা শুনে তুয়ার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে পড়ল, কোন অপরাধে মিতু এমন করল তুয়াও জানেনা। নাকি তুয়া ধর্ষিতা বলে মিতু ঘৃণা করে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেনা? বেস্ট ফ্রেন্ড তো বোনের আরেকটা রুপ হয় তাহলে মিতু কিভাবে পারল এমনটা করতে? এসব প্রশ্ন তুয়ার মাথাতে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর ক্লাস শুরু হতে এখনও বিশ মিনিট দেরী আছে। তাই সে ঘাসের উপর বসে মন খারাপ করে এসবই ভাবছে।

কয়েকটা মেয়ে এসে তুয়ার থেকে একদূরে বসে নিজেরা গল্প করতে লাগল। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ বলে উঠল, ” ধর্ষণ আর সঙ্গমের তফাৎ কি তোরা বলতে পারবি ?” ওদের মধ্যে একজন খিলখিল করে হেসে বলল,”যারা করেছে তাদের জিজ্ঞাসা কর।”
প্রথমজন আশেপাশে কিছু খুঁজার মতো করে তুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “হেই তুয়া তুমি তো ধর্ষিতা তাই না? বলো! বলো! প্লিজ বলো না ধর্ষণ আর সঙ্গমের মধ্যে তফাৎ কি? তোমার তো এসবে দারুন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে।”
মেয়ে গুলোর কথা শুনে কয়েকজন তুয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। দুইটা ছেলে খোঁচা মেরে কিছু বলে হাসতে হাসতে স্থান ত্যাগ করল। তুয়া লজ্জা আর অপমান দুই হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে দিল। এতদিন প্রত্যয়ের সংস্পর্শে থেকে ভুলেই গিয়েছিল সে ধর্ষিতা নামক জঘন্য কালিমায় লিপ্ত মানবী। আজকে আবারও ওর মনে পড়ে গেল সেই কুৎসিত সময়টার কথা। সে ভুলেও গেলেও ওর আশেপাশে মানুষ যত্ন করে মনে করিয়ে দিল, “সে ধর্ষিতা।”
মেয়েগুলো তুয়াকে কাঁদতে দেখে আবারও বলল, “এই তুয়া তোমার ফিলিংস আমাদের সঙ্গে শেয়ার করো, তখন মজা তো পেয়েই গেছো। এখন আবার ঢং করে কাঁদছ কেন? আমাদের কে সবটা খুলে বলো না ইয়ার।”
একটুপরে, পিয়ন এসে ওই মেয়ে গুলোকে প্রফেসরের রুমে ডেকে নিয়ে গেল। ওরা তুয়ার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে প্রফেসরের রুমের ঢুকে তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। প্রফেসর ওদের দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলল, “ধর্ষণ আর সঙ্গমের তফাৎ টিসি নিয়ে কলেজের বাইরে গিয়ে জেনে এসো, বেয়াদব মেয়ে। এসব করতেই তোমারা কলেজে আসো? তোমাদের শিক্ষা দীক্ষা বলে কি আদৌ কিছু আছে?”
টিসির কথা শুনে মেয়েগুলো কাঁদো কাঁদো হয়ে মাফ চাইল কিন্তু প্রফেসর মানতে চাচ্ছিল না। উনি এসব নোংরা কথাবার্তা মোটেও পছন্দ করেন না। মেয়ে গুলো কেঁদে বার বার নিজেদের ভুল স্বীকার করে মাফ চাইল। চাঁদের অনুরোধে প্রফেসর রাজি হয়ে ওদের ওয়ানিং দিয়ে চলে যেতে বলল।
চাঁদ আর তুয়ার স্কুল কলেজ পাশাপাশি হওয়াতে ওদের দু’জনের যাতায়াতের সুবিধা হয়েছে। চাঁদ ওর স্কুল ফাঁকি দিয়ে তুয়ার কলেজটা ঘুরে দেখতে এসেছিল। আর এসেই দেখে কয়েকটা মেয়ে তুয়াকে নোংরা কথা শুনাচ্ছে, তখন সে ঝটপট ফোনে ভিডিও করে সরাসরি প্রফেসরকে গিয়ে প্রমানসহ দেখায় আর এতেই কাজ হয়ে যায়। চাঁদ প্রফেসরের রুমে থেকে বের হয়ে তুয়াকে আর কোথাও খুঁজে পেল না, তাই তাকে একাই বাসায় ফিরতে হল।
**!!

কয়েকদিন ধরে পলক সামান্য কিছু খেলেও সবটা বমি করে উগলে দিচ্ছে। তাই সে বমির ভয়ে কিছু খেতে না চাইলেও রনিত ওকে ছাড় দিচ্ছেনা।
রনিত অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে পলকের কপালে আদর দিতে ওর কাছে গিয়েছিল। কিন্তু রনিতের পারফিউমের গন্ধ পলক সহ্য করতে না পেরে পলক রনিতের গায়ে বমি করে দিল। এখন খাবার সহ সবকিছুতেই ওর গন্ধ লাগে। রনিতের এত সুন্দর পারফিউমে গন্ধটাও ওর কাছে এখন বিশ্রী লাগছে। গায়ে বমি করাতে রনিত বকবে ভেবে পলক ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রনিতের দিকে তাকাল। রনিত পানি এনে পলককে কুলি করিয়ে মুখ মুছিয়ে বলল, “খালি পেটে থাকা যাবেনা এখন কিছু একটা খেতে হবে।”
খাওয়ার কথা শুনে পলক শব্দ করে কেঁদে দিয়ে বলল,”খেলেই বমি হচ্ছে আর আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। আমাকে কষ্ট পেতে দেখতে তোমার ভাল লাগছে, তাই না?” রনিত কিছু না বলে অন্য রুমে গিয়ে অফিসে ফোন করে দু’টো দিন ছুটি নিল। তারপর ফ্রেশ হয়ে পলকের জন্য ফল কেটে নিয়ে এসে বলল, “ভালো মায়েরা বাবুকে ক্ষুধার্ত রাখেনা। তাই বমি পেলেও আপনাকে খেতে হবে।”
কথাটা শুনে পলক মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকাল। রনিত হেসে পলকের পাশে শুয়ে নিজেও ফল খাচ্ছে আর পলককেও কথা তালে খাইয়ে দিচ্ছে। পলক খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল, “বাবুর কথাটা কি বাড়িতে জানিয়েছ?” রনিত অকপটে বলল,”না সময় হলে জানাব।”
রনিতের আম্মুর কোমরে ব্যাথাটা খুব বেড়েছে তাই শুয়ে ছিলেন। দিশা রান্নাঘরে রাগের চোটে থালা-বাসন গুলো শব্দ করে রাখছে। তার রাগের কারন তাকে আজকে রান্না করতে বলা হয়েছে। কালকে সে ফুড ফেসিয়াল, পেডিকিউর আর মিনিকিউর করে এসেছে আর আজকে রান্না করলে সব টাকা জলে যাবে।
দিশা রাগের চোটে বলেই ফেলল, ” আমি পারব না রান্না করতে, আমার এতো ঠেকা পড়েনি। একজন তো চলে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে আর আপদগুলো আমার ঘাড়ে এসে জুটেছে। যার গিলার প্রয়োজন হবে সে রান্না করে গিলুক। আমি দাসী বাদীর মতো আর খাটতে পারব না।”
কথাটা বলে দিশা ওর রুমে গিয়ে শব্দে করে দরজা আঁটকে দিল। রনিতের আম্মু এসব শুনে নিজেই রান্না করতে আসলেন। চোখের পানি ফেলে চুলার উপরে ভাত বসিয়ে আলুর খোসা ছড়াতে ছড়াতে বললেন,”এখন শাশুড়ি হয়েছি। ছেলের বউয়ের লাথি ঝাটা তো সহ্য করতেই হবে, কি আর করার।”
**!!

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১৯+২০+২১

তুয়া কলেজ থেকে ফিরে প্রত্যয়দের ফ্ল্যাটে আর যায়নি। ওর রুমে গিয়ে বালিশে মুখে গুঁজে ইচ্ছেমতো কেঁদেছে। তুয়ার আম্মু আব্বু এতো ডেকেও দরজা খুলাতে পারেনি। তুরাগ বোনকে আদুরে আদুরে কথা বলেও দরজা খুলাতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রত্যয়ের সঙ্গে মনমালিন্য হয়েছে ভেবে তুয়ার আব্বু আম্মু প্রত্যয়কে ফোন করে জানানোর সাহস করলেন না। প্রতিটা সংসারে স্বামী স্ত্রী মনমালিন্য হয়েই থাকে কিছুক্ষণ পর ওরাই এক হয়ে যাবে। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে ডাকতে এসেছিলেন, তুয়া ঘুমাচ্ছে বলে তুরাগ ব্যাপারটা কোনো মতো
সামলে নিয়েছে।
তুয়া সারাদিন না খেয়ে শুয়ে শুয়ে শুধু কেঁদেছে। এমনকি প্রত্যয়ের কলটা অবধি রিসিভ করেনি। প্রত্যয়ের পেশেন্টের সংখ্যা আজকে অনেক বেশি ছিল, তারপর একটা অপারেশনও করেছে। জুরুরী বিভাগের হার্টের পেশেন্টের দেখে আসতে না আসতেই নতুন হার্টের পেশেন্ট এসে ভর্তি হয়েছে। উনার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে চিকিৎসা শুরু আগেই উনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এসব নিয়ে সারাটা দিন প্রত্যয়ের খুব ব্যস্ত সময় কেটেছে। তুয়া কল না ধরায় দুপুরে সে ঠিকমতো খেতেও পারেনি।
এই কয়েকদিনে তার অনুপস্থিতে হসপিটালের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব তথ্য জেনে রাত সাড়ে বারোটায় প্রত্যয় বাসায় ফিরল। সারাদিনের ছোটাছুটিতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে ঢুকে তুয়াকে কোথাও খুঁজে পেল না। বেশ কয়েকবার কল দিল কিন্তু রিসিভ হলো না। এতো রাতে তুয়াদের ফ্ল্যাটে কলিংবেল বাজানোটাও ওর কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে।
হঠাৎ তুয়ার এমন ব্যবহারে প্রত্যয়ের মনটা বিষাদে ছুঁয়ে গেল। ওর কোন ভুলে তুয়া অভিমান করেছে প্রত্যয় বুঝতে পারছেনা। প্রত্যয় ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল, “এটা আমার কোন অপরাধে শাস্তি দিচ্ছ? দোষটা দেখালে মনটাকে তো অন্তত বুঝ দিতে পারতাম।”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২৫+২৬+২৭