সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২৫+২৬+২৭

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২৫+২৬+২৭
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

-“দুল দুল দুলুনি লাঙ্গা মাতায় চিলুণী।”
ইচ্ছে এই একটা লাইন বার বার বলছে আর ওর পুতুলের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। ফজরের আজানের সময় উঠে সে পুতুল নিয়ে খেলতে বসেছে। ইচ্ছের আম্মু জোর করেও ইচ্ছকে আর ঘুম পাড়াতে পারেননি। ইচ্ছে ওর পুতুলকে সুন্দর করে সাজাচ্ছে, সে তুয়ার ট্রেডির সঙ্গে ওর পুতুলের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবে। পুতুলের বিয়েতে ইচ্ছে সবাইকে দাওয়াত দিবে, শুধু প্রত্যয় আর প্রিয়মকে ছাড়া। ওরা ইচ্ছের মনে মেলা দুঃখু দিয়েছে তাই ইচ্ছে ওদের সঙ্গে আড়ি করেছে।
ইচ্ছের আম্মু ইচ্ছেকে আবার ডেকে বলল,”আম্মু, এদিকে এসো আর একটু ঘুমাও। এখনও সকাল হয় নি তো মা।” ইচ্ছে ওর আম্মুর দিকে না তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিয়ে বলল,”তুমি ধুমাও, আমি কাজ করচি।”
কালকে সারারাত না পলক ঘুমিয়েছে আর না রনিত দু’চোখের পাতা এক করেছে। বমি, অস্বস্তি, মাথা ঘোরা নিয়ে পলক কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। মা হওয়া চারটে খানিক কথা না, পলক এই দুই মাসে যেন হারে হারে টের পাচ্ছে। বমি করে ক্লান্ত হয়ে সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। বেশ কয়েক মিনিট পর পলক রনিতের গাল ছুঁয়ে কান্নারত কন্ঠে বলল, “আমি মারা গেলে তুমি আবার বিয়ে করবা, তাই না?” এই অবস্থায় পলকের মুখে একথা শুনে রনিতের রাগ লাগলেও সেটা চেপে রেখে বলল, “মরবে কেন? আমি কি তোমার যত্ন আর ভালবাসায় কোনো ঘাটতি রেখেছি?”

পলক রনিতকে জড়িয়ে ধরে আবার কিছুক্ষণ পর বলল,”আমাদের মেয়ে হলে কি তুমি রাগ করবা?” রনিত ভ্রু কুঁচকে পলকের বলল,”বেহুদা কথাবার্তা বলা বন্ধ করবা নাকি আমি উঠে চলে যাব? নিশ্চিন্তে একটু ঘুমাবে তা না বকবক করেই যাচ্ছে।”
এই সময় গর্ভবতী মায়েদের মুড সুইয়িং একটু বেশিই হয়। মেজাজ এই ভালো তো এই খারাপ। রনিতের কথা শুনে পলকের মুহূর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেল তখন রেগে বলল,”এই সময় স্বামীরা নাকি পরকিয়া করে, ঘরে পায়না তাই বাইরে যায়। তুই যদি এমন করিস তাহলে তোকে আমি কিমা বানাব।” রনিত হতভম্ব হয়ে পলকের দিকে তাকিয়ে বলল,”পরকিয়া করব কোন দুঃখে? কি পাগলের মতো যা তা বকছ?”
এরকম ভাবে পলক রনিতকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রায় সারারাতই ঝগড়া করেছে। রনিত অতি কষ্টে মুখ বুজে সহ্য করে ছিল। পলক ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। রনিতও পলককে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কালকে পলকদের ফ্ল্যাটে এক প্রতিবেশী এসে এসব উপদেশই দিয়ে গেছেন। উদাহরণ স্বরুপ উনার ফুপাতো ভাইয়ের পরিকিয়ার গল্প তুলে ধরেছিলেন। এমন উপকারী ভাবির কথা শুনলে সংসার বিনা অনলে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। এই ব্যাপারটা রনিত বুঝতে পেরেছে এবং বুদ্ধি খাঁটিয়ে পলককে ওদের এড়িয়ে চলতে বলেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দিশা ওর বরের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে রেগে বাবার বাসায় চলে গেছে। স্বর্ণের দাম এখন একটু কমেছে। এখনই কিছু গয়না বানিয়ে রাখা উচিত পরে দাম চড়া হতে পারে। দিশা ওর বরের কাছে এই প্রস্তাব রাখলে ওর বর দ্বিমত করেছে, আর এতে দিশা রেগে গেছে। রনিতের আব্বু আম্মু ওই রুম থেকে ওদের সব কথা শুনেছে কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে পায়নি। রনিতের আম্মু কেঁদে কেঁদে আজকে রান্নার কথাটা উনার স্বামীকে জানালেন। বুড়ো হলে এই হয় সেই হয় এমন নানান অভিযোগ তুলে ধরলেন। আজকাল দিশা নাকি উনাদের কটু কথা বলে গালমন্দ করে খাবারের খোঁটা দেয়। এসব কথা শুনে রনিতের আব্বু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “তুমি আমার বৃদ্ধা মাকে অত্যাচার করতে তো কম করো নি। উনাকে খাওয়া পড়ার কষ্ট দিতেও তোমার বুক কাপেঁনি।
তাহলে তুমি তোমার পুত্রবধূদের কাছে ভালো ব্যবহার আশা করো কিভাবে, তোমার বিবেকে বাঁধেনা?”

রনিতের আম্মু কথাটা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে কান্না জুড়ে দিলেন। উনার কান্না দেখে রনিতে আব্বু উঠে বাইরে চলে গেলেন। উনার কাছে সংসার জীবনটা বিশ্রী একটা রঙ্গশালা বলে মনে হয়। যেখানে কাহিনীর কোনো শেষ নেই। উনি পুলিশের চাকরি করতেন বিধায় উনার বিধবা মাকে খুব একটা সময় দিতে পারেননি। আর এই সুযোগ রনিতের আম্মু উনার শাশুড়িকে খুব অত্যাচার করতেন। উনাকে খাবার, কাপড় বা ওষুধ কোনোটাই ঠিকমতো দিতেন না। বৃদ্ধার চশমা ভেঙে যাওয়াতে উনি খালি চোখে কিছু দেখতে পেতেন না, তাই দেওয়াল ধরে হাতরে হাতরে চলতেন। তবুও উনাকে চশমা কিনে দেওয়া হয়নি। জ্বরে একা ঘরে শুয়ে একটু পানির জন্য ‘ওহ বউ! ওহ বউ রে, একটু পানি দিয়া যা মা। আমরা গলা শুকিয়ে গেছে রে, মা। একটু দয়া কর মা।” বলে করুন ভাবে ডেকে কেঁদেছেন তবুও উনার পাষাণ মন গলেনি। একদিন রাতে বৃদ্ধা পাকা উঠানে পিছলে পড়ে বুকে প্রচন্ড আঘাত পেয়ে বিছানাগত হয়ে পড়েছিলেন। তার দুই সপ্তাহ পরে অনাদরে উনি নিষ্ঠুর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। প্রকৃতি তার নিজ নিয়মে চলতে পছন্দ করে। মানুষ মানুষকে ছাড় দিলেও প্রকৃতি সঠিক সময়ে তার সঠিক বিচার ঠিকই করে। ওই বৃদ্ধার চোখের পানি দাম আল্লাহ অবশ্যই দিবেন,শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আচ্ছা, আমি কি খুব খারাপ গল্প লিখি? আমার গল্প গুলো সত্যিই কি খুব নিম্নমানের হয়? তোমরা কেউ আমার গল্পের রিভিউ তো দাও ই না আবার কাউকে গল্প পড়তে সাজেস্টও করো না। কেন? তার মানে কি আমার গল্প তোমাদের মন ছোঁয়াতে ব্যর্থ হয়। কথাটা ভেবে সত্যিই আমার খুব কষ্ট লাগছে। এত কষ্ট করে গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করেও তোমাদের মন ছোঁয়াতে ব্যর্থ হচ্ছি।

পরেরদিন সকাল দশটার দিকে প্রিয়মের গানের প্রোগ্রাম থাকায় সে দ্রুত বেরিয়ে গেল। প্রত্যয় না খেয়ে খুব সকালে হসপিটালে চলে গেছে। চাঁদ তুয়ার সঙ্গ না পেয়ে সে একা স্কুলের পথে হাঁটা ধরেছে। তুয়া সকালে উঠে তুরাগের জোরাজুরিতে হালকা কিছু খেয়েছে। ওর ফোনটা বন্ধ হয়ে অনাদরে বালিশের নিচে পড়ে আছে। তুয়া দূরে দৃষ্টি মেলে গভীর চিন্তায় এতটাই মগ্ন যে প্রত্যয়ের আম্মুর উপস্থিতি সে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ মাথায় কারো মায়ামাখা স্পর্শ পেয়ে তুয়া পাশে তাকিয়ে মিথিলাকে দেখে মাথা নিচু করে নিল। প্রত্যয়ের আম্মু হেসে বললেন, ”আমার ছেলেটাকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছিস, হুম? শুধু শুধু আমার হিরের টুকরো ছেলেকে কষ্ট দিলে আমি তোকে শূলে চড়াব।”
তুয়া মাথা নিচু করে কাঁদছে ওর বলার কিছু নেই। প্রত্যয়ের আম্মু বললেন,”কালকের ঘটনা চাঁদ আমাকে বলেছে। আমি সব শুনেছি। তোকে শক্ত হতে হবে নাহলে কিভাবে হবে, তুই বল?”
তুয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “প্রত্যয় না খেয়ে হসপিটালে চলে গেছে। তুই বসে বসে কাঁদছিস, তোরা এমন করলে আমরা কিভাবে ভালো থাকব? চল বাসায় চল আর একটা কথা বাড়ালে আমি পিটুনি দিব।”
প্রত্যয়ের আম্মুর জোরাজুরিতে তুয়া প্রত্যয়ের বাসায় গেল। আর তুয়ার আম্মু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। বাসায় গিয়ে প্রত্যয়ের আম্মু রান্নাঘরে কাজ করছেন আর তুয়ার সঙ্গে গল্প করছেন। তুয়ার মনে বিষাদের মেঘ জমেছে, সে অল্প কথায় উত্তর দিচ্ছে। কেনো জানি তুয়ার প্রত্যয়ের উপর খুব রাগ হচ্ছে। প্রত্যয়কে কষ্টে জর্জরিত করে বলতে ইচ্ছা করছে, ধর্ষিতা শব্দ শুনে ওরও এমনই কষ্ট হয়। কি দরকার ছিল কলেজ যাওয়ার? কলেজে না গেলে কেউ ওর ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে আর রক্তাক্ত করতে পারত না। পড়াশোনা করতেই হবে এর কোনো মানে আছে? পড়াশোনা না করলে কি মানুষ বাঁচে না নাকি তারা স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকেনা। কেন প্রত্যয় ওকে কলেজে যেতে বাধ্য করল? সব দোষ প্রত্যয়ের, এসব কথায় ভেবে তুয়া প্রত্যয়ের প্রতি খুব রেগে আছে।

বেস্ট একজন কার্ডিওলজিষ্টের বউ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নাহলে সমাজের মানুষই বা কি বলবে? হয়তো প্রত্যয়ের পাশে ওকে বেমানান এজন্য প্রত্যয় পড়াশোনা করতে বলেছে।
যদিও এসব কথা প্রত্যয় নিজে মুখে তুয়াকে বলেনি। তুয়া প্রত্যয়কে ভুল বুঝে ওর মনগড়া কথাগুলোই ধরে নিয়েছে।
। কিছুদিন আগে প্রত্যয় ওকে বলেছিল,” নিজের একটা পরিচয় গড়তে পড়াশোনাটা আবার শুরু করো। যাতে আমার নামে নয় বরং তোমাকে নামে সবাই তোমাকে চিনে।”
প্রত্যয়ের কথা শুনে তুয়া রাজিও হয়েছিল। কিন্তু এই জার্নি এতোটাও সহজ নয় সেটা তুয়া হারে হারে টের পাচ্ছে। চাঁদ বাসায় ফিরে তুয়াকে দেখে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,”তুয়া আপু চলো আমড়া মাখা খায়।” তুয়া কলিকে খাবার দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আমড়া মাখিয়ে চাঁদকে দিল। মাসের নিদির্ষ্ট সময়ে প্রতিবারে মতো এবারও প্রিয়মের হাত খরচের টাকা ওর একাউন্টে টাকা এসে জমা হয়েছে। তবে আগের তুলনা টাকার এমাউন্ট এবার একটু বেশি। প্রিয়ম টাকার এমাউন্ট দেখে প্রত্যয়কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,”ভাইয়া এত টাকা কেন? আমার এতো টাকা লাগবেনা।”
প্রত্যয় সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,”তুমি তো আর একা নও প্রিয়ম। চাঁদের আবদারগুলো তো পূর্ণ করতে হবে। ভাইয়ের হাত খরচের টাকা দেওয়ার সার্মথ্যটুকু আমার আছে। আর সঠিক ভাবে নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অবধি আমিই দিব। এই বিষয়ে আমি আর একটা কথাও শুনব না।” কথাটা শুনে প্রিয়ম সাহস করে বলল,”আমি প্রোগ্রাম করে বেশ কিছু টাকা পায় তাতেই আমাদের হয়ে যায় তাই বলছি আগে যেটা দিতে ওটাই ঠিক ছিল। আর আমার লাগলে আমি পরে চেয়ে নিব।” প্রত্যয় শান্ত কন্ঠে বলল,”ওকে।”
রাত বারোটায় প্রত্যয় বাসায় ফিরে তুয়াকে রুমে দেখে কিছু বলল না। তুয়া শুয়ে একটা উপন্যাস পড়ছিল, প্রত্যয় দেখেও সে না দেখার ভাণ করে রইল। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে খেয়ে এসে তুয়া হাত ধরে টেনে উঠে বসাল। তুয়া ভ্রু কুঁচকে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে আবার শুয়ে পড়তে গেলে প্রত্যয় ওকে বাঁধা দিয়ে বলল,”হুম বলো এমন ব্যবহারের মানে কি?” তুয়া প্রত্যুত্তর না করে উঠে দাড়াঁলে প্রত্যয় শান্ত কন্ঠে বলল,”এখন এই রুমের বাইরে গেলে প্রবেশের দ্বিতীয় সুযোগ তুমি আর পাবেনা।”
তুয়া থমকে দাঁড়িয়ে প্রত্যয়ের দিকে অবাক চাহনি নিয়ে তাকাল। প্রত্যয় একদম স্বাভাবিক ভাবে কথাটা বলল। প্রত্যয় উঠে দাঁড়িয়ে তুয়া মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

–“বার বার একই ভুল করবে আর আমি সেটা পুনরায় সংশোধন করব, এটা ভাবলে ভুল ভাববে। রাগ, জেদ, অভিমান শুধু তোমার আছে তা কিন্তু নয়। অকারণে জেদ করা আমার পছন্দ নয়, কিন্তু তুমি তাই করো। কে কি বলল তার দায় ভার আমাকে কেন দিচ্ছ? আমি তো তোমাকে ধর্ষণ করিনি বা করায় নি। তাহলে কেউ কিছু বললে বার বার আমাকে কেন কাঠগড়ায় দাঁড় করাও? তোমাকে ভালবাসি বলে যখন তখন আমাকে এভাবে হার্ট করার রাইট তোমার নেই। তোমার কালকের কাজটাতে তুমি তোমার পরিবারের কাছে আমাকে ছোট করলে, কিন্তু কেন? আমি আদৌ কি তোমাকে হার্ট করেছি বলো?”
তুয়া চুপ করে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। প্রত্যয় আবারও বলল,
–“মেয়েগুলো তোমাকে কথা শুনাল তুমি প্রতিবাদ করলে না কেন? ওরা ভাত খায় তুমি খাও না? আচ্ছা মানলাম কিছু বলতে পারো নি তাহলে আমাকে হার্ট করলে কেন? এখানে আমার কি দোষ ছিল? এখন কিছু বললে তো বললে বলাটা সহজ করাটা এতো সহজ নয়। এই দেখি তাকাও আমার দিকে, আমি যে ডাক্তার হয়েছি। এটা কি এতো সহজ বলে মনে হয়? তোমার কি মনে হয় বই খুলে বসেছি আর সব পড়া অনায়াসে মাথায় ঢুকে গেছে। কষ্ট করেছি, র্নিঘুম থেকে সারারাত পড়ছি, পড়ার চাপে কখনও খেতেও ভুলে গেছি। এক একটা মিনিটের মূল্য বুঝে অযথা আড্ডা না দিয়ে শুধু পড়াতে মন দিয়েছি, নিজের সব শখ আহ্লাদকে দূরে রেখে একটা লক্ষকেই টার্গেট করে পরিবার ছেড়ে দূরে থেকেছি। সেদিন কষ্ট করেছি বলে আজকে এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি। তোমার কি মনে হয় এই জার্নি আমার জন্য খুব সহজ ছিল? এতো অবুজ কেন তুমি তুয়া? এসিডে দগ্ধ হওয়া শত শত মেয়েরা তো বেঁচে আছে, সেখানে তুমি ধর্ষিতা হয়েও
কেন এমন পাগলামি করো? তুমি শিক্ষিত মেয়ে তাই বলছি নিজের চিন্তা চেতনাকে একটু উন্নত করো। তোমাকে এতোবার বুঝিয়েও বার বার একই কাজ করে আমাদের সম্পর্কটাকে নষ্ট করো না।”
তুয়া প্রত্যয়ের ধারালো কথা শুনে হেঁচকি তুলে কেঁদে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে বলল,”আমি বাইরের দেশে গিয়ে পড়াশোনা করব আর নয়তো বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করব। আপনি ঠিক করুন আমাকে কোনটাতে সাপোর্ট করবেন। এর মধ্যে যে কোনো একটা অপশন বাছাই করুন।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[২৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

তুয়ার শর্ত শুনে প্রত্যয় অকপটে বলে দিল,” বাচ্চার চিন্তা বাদ আগে তোমার কেরিয়ার ঠিক করো।”
তুয়া ভেবেছিল প্রত্যয় দ্বিমত জানিয়ে বকবে, বারণ করবে। কিন্তু তুয়াকে অবাক করে দিয়ে প্রত্যয় রাজি হয়ে গেল। প্রত্যয় শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান একটা ছেলে। সে পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝে বলেই তুয়াকে অশিক্ষিত রাখতে চায়না। এই খারাপ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে তুয়াকে অবশ্যই শক্ত হতে হবে, নিজের পা দাঁড়াতে হবে। নিজেকে শক্তপোক্ত অবস্থানে নিতে যেতে হবে, যাতে ওর দিকে কেউ আঙুল তোলা আগে দশ বার ভাবে। প্রত্যয় তুয়ার জেদকে এখন প্রশ্রয় দিচ্ছে না, আর পরবর্তীতে দিবেও না। কিন্তু প্রত্যয়ের কথা শুনে তুয়ার মনে জেদের সৃষ্টি হয়। সে প্রত্যয়ের কথার প্রত্যুত্তরে বলল,
“ভেবে বলছেন?”
“হুম, কোন দেশে যেতে চাও? ”
“জানিনা, তবে যথা শীঘ্রই যেতে চাই।”

কথাটা বলে তুয়া অন্যদিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। প্রত্যয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেও শুয়ে পড়ল। একটুপরে, প্রত্যয় তুয়াকে কিছু বলার জন্য আলতো স্পর্শ করে ডাকল। কিন্তু তুয়া প্রত্যয়ের কথা না শুনে ঝাটকা মেরে ওর হাতটা সরিয়ে দিল। প্রত্যয় মূলত ঠান্ডা মাথায় তুয়াকে বুঝানোর জন্যই ডাকছিল। তুয়ার এমন ব্যবহারে প্রত্যয় কষ্ট পেয়েও শান্ত কন্ঠে বলল,”দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্ম কেউ বুঝেনা। তেমনি তুমিও বুঝছ না তবে সঠিক সময় ঠিকই বুঝবে।” কথাটা বলে প্রত্যয় চোখের উপর হাত রেখে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রিয় মানুষটার যত্নে দেওয়া আঘাতটা সরাসরি বুকে গিয়ে বিঁধে। না চাইলেও কষ্টটা বুকের ভেতরটাতে জ্বলজ্বল করে জ্বলে অদৃশ্য এক ক্ষতের সৃষ্টি করে। আর দূর্ভাগ্যবশত কষ্টের উপলব্ধি দাতা হিসেব নিজেকেই এই কষ্টের অনলে পুড়িয়ে সীমাবদ্ধতা বজায় রাখতে হয়।
তুয়া নিরবে চোখের অশ্রু ঝরিয়ে অভিযোগের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে? কেন প্রত্যয় ওকে বাঁধা দিল না? কেন জোর দিয়ে বলল না, তুয়া তোমার যেতে হবে না? পড়াশোনা করতেই হবে? বাচ্চা নিয়ে মন দিয়ে সংসার করলে কি হবে? মানুষ কি পড়াশোনা ছাড়া সংসার করেনা? প্রত্যয় জানে তাকে ছাড়া থাকতে তুয়ার কষ্ট হয়, তবুও কেন সে মেনে নিচ্ছে? প্রত্যয়কে পরীক্ষা করার জন্য তুয়া কথাটা বলেছে, তাই বলে রাজি হতে হবে? এই তার ভালবাসা? মেয়ে মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। যেমন তুয়া নিজেই প্রত্যয়কে দু’টো অপশন দিয়েছে। এখন নিজেই প্রত্যয়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ছে দিচ্ছে।

পরেরদিন সূর্য তার সমস্ত আলো ছড়িয়ে নতুন দিনের সূচনা করল। আজকে পবিত্র জুম্মাবার। কালকে রাত থেকে চাঁদের সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। কারন কালকে রাতে প্রিয়ম চাঁদকে পুনরায় থাপ্পড় উপহার দিয়েছে। চাঁদ ঘুমের ঘোরে খাবার ভেবে প্রিয়মের কানে কামড় বসিয়েছে। কামড় খেয়ে প্রিয়ম কানে হাত দিয়ে ধড়পড় করে উঠে চাঁদের গালে থাপ্পড় দেয়। আচানক থাপ্পড় খেয়ে সময় নিয়ে ব্যাপারটা বুঝে চাঁদ দাঁত বের করে হেসে বলল,”একটা কামড়ই তো।” প্রিয়মও একই সুর টেনে বলল,”একটা থাপ্পড়ই তো।” চাঁদ কথা না বাড়িয়ে বাকি রাতটুকু দুরত্ব বজায় রেখে শুয়েছে। প্রিয়মের পুরুষালি শক্ত হাতের থাপ্পড়ের খুব ব্যাথা লাগে। আর এক প্রহরে ডাবল থাপ্পড় খাওয়ার ইচ্ছেও ওর নেই।
সকালে প্রত্যয়রা সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। প্রত্যয়ের আম্মু থমথমে মুখ নিয়ে বললেন, “প্রত্যয় প্রিয়ম তোমাদের নামে অভিযোগ এসেছে। এটা তোমাদের থেকে আমি মোটেও আশা করিনি।” প্রত্যয় প্রিয়ম কথাটা শুনে খাওয়া থামিয়ে ওদের আম্মুর দিকে তাকাল। চাঁদ অতি উৎসাহের সাথে জানতে চাইল, সেই সাহসী মানুষটার নাম। প্রত্যয়ের আম্মু আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় মানুষটাকে দেখিয়ে দিলেন। সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
ইচ্ছে সোফায় বসে পা দুলিয়ে একমনে চানাচুর খাচ্ছে। সে সকালবেলা উপস্থিত হয়ে প্রত্যয় প্রিয়মের নামে অভিযোগ জানিয়েছে এবং ওদের মারার আবদারও করেছে। ইচ্ছেকে দেখে প্রত্যয় প্রিয়ম মুচকি হাসল। প্রিয়ম তো ইচ্ছেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,”আম্মু, এই প্যারা আমাদের বাসায় কেন? আর আমার ভাগের চানাচুর ভুলেও ওকে দিবা না।” ইচ্ছে কটমট করে বলল,”তুমি প্যালা, আমি আলো কানাচুর থাবো।” রাগে ইচ্ছের তুতলানো কথা শুনে চাঁদ খিলখিল করে হেসে উঠল। প্রত্যয়ের আম্মু হেসে ইচ্ছেকে বলল,”ইচ্ছে এই দু’টোকে কি দিয়ে মারব বলো তো?” ইচ্ছে সোফা থেকে নেমে অনেক খুঁজে ঝাঁড়ু এনে বলল,”এতা দিয়ে।” প্রত্যয় প্রিয়ম খাওয়া বন্ধ করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে, অবশেষে ঝাঁড়ুর পিটুনি।

প্রত্যয়ের আম্মু এবার জানতে চাইলেন আগে কাকে মারবে? ইচ্ছে আঙ্গুল দিয়ে প্রত্যয়ের আব্বুকে দেখিয়ে দিল। কারন উনিই সবাই রাজশাহীতে নিয়ে গিয়েছিল। একথা শুনে সবাই হেসে উঠল। প্রত্যয়ের আব্বু হতভম্ব হয়ে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন পাকা বাচ্চা উনি এর আগে আর দু’টো দেখেনি। চাঁদ তুয়া প্রত্যয়ের আব্বুর মুখভঙ্গি দেখে খিলখিল করে হাসছে। প্রত্যয়ের সঙ্গে তুয়ার চোখাচোখি হতেই তুয়া হাসি থামিয়ে খাওয়াতে মনোযোগী হল। প্রিয়ম ব্যাপারটা খেয়াল করে ভ্রু কুঁচকে নিল। ইচ্ছের আম্মুর ডাক শুনে ইচ্ছে দৌড়ে বেরিয়ে আবার ফিরে এসে ওর চানাচুরের বাটি টা নিয়ে গেল। প্রত্যয়ের আব্বু হাসতে হাসতে বললেন,”এমন একটা তোতাপাখি আমাদের বাসা থাকলে কিন্তু মন্দ হয় না।”
একথা শুনে তুয়া ওর খাওয়া থামিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,” আব্বু, সব চাওয়ার কি মূল্য পাওয়া যায়? বরং কখনও কখনও সামান্য কিছু চাওয়ার অপরাধে বড় মূল্য চুকাতে হয় ।”প্রত্যয় কথা শুনে মুচকি হাসলেও প্রত্যুত্তর করল না। প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু একে অপরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন। তারপর খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করলেন। সকাল সাড়ে দশটার দিকে পরিবার পরিকল্পনা সংস্থা থেকে দুটো মহিলা প্রত্যয়দের বাসায় এসেছেন। উনারা সদ্য বিবাহিত মেয়েদের কিছু মূল্যবান উপদেশ দিয়ে থাকেন।
চাঁদ তুয়া এসে উনাদের ঠিক সামনে বসল। একজন মহিলা হেসে আগে চাঁদকে জিজ্ঞাসা করলেন,”তোমরা স্বামী স্ত্রী কোনটা ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করো?” চাঁদ মাথা খাঁটিয়ে বলল,”স্নো, রিভাইভ পাউডার, আর পারফিউম।” চাঁদের উত্তর শুনে তুয়ার হার্ট এ্যার্টাক করার অবস্থা। তাই বলে স্নো, পাউডার আর পারফিউম? চাঁদের উত্তর শুনে মহিলাটি ভাবলেন চাঁদ ছোট মানুষ কিছু বুঝছেনা, তাই বললেন, ”তোমার স্বামী বাসায় থাকলে তাকে জিজ্ঞাসা করে এসো।” চাঁদ একবার ওর গালে হাত বুলিয়ে প্রিয়মকে গিয়ে বলল,”আপনি কোনটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? ওই মহিলাটা জিজ্ঞাসা করতে বললেন।” প্রিয়ম রুম থেকে বের হতে গিয়ে ওনাদের পুরো কথাটা শুনেছে বিধায় অকপটে বলল,”আমাদের সম্পর্কটা এখনও সেই অবধি এগোয়নি। আর পূর্বেও এমন কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় কোনোকিছুর ধারণাই আমার জানা নেই।”

প্রিয়ম বুঝাল এক চাঁদ বুঝল আরেক। চাঁদ প্রিয়মের কথা শুনে রুম থেকে বলতে বলতে বের হল , “আমার স্বামীর পূর্বের তেমন অভিজ্ঞতা নেই। তাই সে এখন কোনোকিছুতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেনা।” চাঁদের কথা শুনে প্রিয়ম রেগে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আরেকজন মহিলা তুয়াকে একই প্রশ্ন করলেন, তুয়া নতজানু হয়ে জানাল ওরা বাচ্চার প্লানিং করছে। প্রত্যয় রুম থেকে বের হয়ে তুয়ার কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে বেরিয়ে গেল। তুয়া চাঁদের কথা শুনে মহিলা দু’টো কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নিলেন।
আজকে ভোর থেকে পলকের মনে অদ্ভুত একটা ইচ্ছে জেগেছে। ওর নাকি কয়লা চিবুতে ইচ্ছে করছে। রনিত ডাক্তারের কাছে শুনেছে, এই সময় সন্তান সম্ভাবা মায়েদের মনে অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু ভালো লাগা কাজ লাগে। কারো কারো দেওয়াল চাটতে ইচ্ছে করে, কেউ মাটির গন্ধ শুকতে পছন্দ করে, কেউ ফিনাইলের গন্ধ পছন্দ করে, কেউ চাল চিবুতে পছন্দ করে আবার কেউ নতুন জুতোর গন্ধ পছন্দ করে। সাধারণ এসব পছন্দ হরমোনজনিত কারনেই হয়ে থাকে। পলকের আবদার কথা শুনে রনিত গালে হাত দিয়ে বসে আছে। পলক দাঁত কিড়মিড় করে বার বার বলছে, ওকে কয়লা এনে দিতে। রনিত এই নিয়ে খুব চিন্তিত কারন কয়লা পেটে গেলে যদি বাচ্চার ক্ষতি হয়? অার আসল কথা সে এখন কয়লা কোথায় পাবে? কোনো মানুষের কয়লা চিবুতেও ইচ্ছে করে, একথা রনিত পলককে দেখেই জানল।
রনিত পলককে থামানোর জন্য বলল,”কয়লার দোকান খুলুক তারপর এনে দিব। তুমি এখন চুপটি করে বসো আমি জুস করে দিচ্ছি।” পলক দাঁত কিড়মিড় করে বলল,”আমি কয়লাই খাব! আমার দাঁত কিড়মিড় করছে তুমি কয়লায় এনে দাও।”

রনিত পড়েছে মহাবিপদে। সে এসব না পারছে সহ্য করতে আর না পারছে কিছু বলতে। রনিত পলকের মনোযোগ ঘুরাতে ওর ছোট বেলার গল্প বলতে লাগল। দশ বছর বয়স থেকে রনিত নানীর বাসাতেই বেশি থাকত। ওর দাদীর খুব আদরের নাতীও সে ছিল। রনিত ওর দাদীকে বউ বলে ডাকত আর ওর দাদী হেসে বলতেন, “কও সুয়ামী।” রনিত ছলছল চোখে ঠোঁটে হাসি রেখে গল্প বলতে লাগল। একটুপরে, রনিত মন ভার করে ওর দাদীর মারা যাওয়ার ঘটনা জানাল। পলক বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,”তাহলে বাসায় যে থাকেন সে কে? উনি তোমার আপন দাদী নন?”
রনিত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল,”সেও আমার দাদী কিন্তু আমার নিজের দাদী নয়। আমার দাদার ভাইয়ের বউ উনি, সম্পর্কে আমার দাদীই হয়। উনার বিয়ের ছয় মাস পর দাদু মারা যায়, তারপর উনি বাবার বাড়িতেই বেশি থাকতেন। পরে ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে বিবাদ করে এখানে চলে আসেন। বিধবা মেয়ে দেখে মানুষ খুব জ্বালাত, নোংরা প্রস্তাব দিত। এই নিয়ে অনেক ঝামেলাও হতো। পরে আব্বু উনার দায়িত্ব নেন আর আমাদের বাসাতেই থাকতে বলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উনি আমাদের বাড়ির সদস্য হয়ে উঠেন। এখন কেউ বুঝতেই পারেনা উনি আমার নিজের দাদী নন। আমি বা ভাইয়াও উনাকে নিজের দাদীর মতোই ভালবাসি। রনিত গল্পের ছলে পলককে জুস খাইয়ে মাথায় বিলি কাটছিল। গল্প শুনতে শুনতে একপর্যায়ে ঘুমে পলকে চোখ বুজে আসল। পলককে ঘুমাতে দেখে রনিত যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।

প্রত্যয়ের আব্বু তুয়াকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হয়েছিলেন। প্রত্যয় বাসায় ফিরে তুয়াকে না পেয়ে ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল। চাঁদের থেকে শুনেছে তুয়া ওর আব্বুর সঙ্গে ঘুরতে গেছে। চাঁদকে রেখে তুয়াকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ারটা প্রত্যয়ের পছন্দ হলো না। পরে বুঝল প্রিয়ম বাসায় আছে তাই ওর আব্বু চাঁদকে সঙ্গে নেয়নি। প্রিয়মের এই সপ্তাহে বড় বড় দু’টো প্রোগ্রাম আছে। তাই রুমের দরজা আটঁকে সে গান প্রাকটিস করছে। এই দু’টো প্রোগ্রাম ওর স্বপ্ন পূরনের পথে একধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আর দরজা খোলা রাখলে চাঁদ একটু পর পর উঁকি মারছিল, তাই প্রিয়ম রেগে দরজা আঁটকে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর তুয়ারা বাসায় ফিরল, প্রত্যয়ের ড্রয়িংরুমে দেখে তুয়া মুখ ভেংচি দিয়ে রুমে চলে গেল। এটা দেখে প্রত্যয় মৃদু হাসল।
দুপুরে নামাজ পড়ে এসে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে। তখন প্রত্যয়ের আব্বু বললেন,”চাঁদ তুয়া তোমাদের জিনিসপত্র তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। কালকে থেকে অন্য কোথাও থাকতে হবে, তাই না?”
কথাটা শুনে প্রিয়ম তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয়কে স্বাভাবিক দেখে প্রিয়ম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”ওরা কোথায় থাকবে আব্বু?” প্রত্যয়ের আব্বু স্বাভাবিক ভাবে হাতের গ্লাসটা রেখে বললেন,” আমার বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[২৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয়ের আব্বু স্বাভাবিক ভাবে হাতের গ্লাসটা রেখে বললেন,” আমার বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে।” প্রত্যয় ওর আব্বুকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল,”এর কারন?” প্রত্যয়ের আব্বু হেসে বললেন,”দেশের বাইরে গেলেই যে পড়াশোনা হয় তা কিন্তু নয়। তুয়া দেশে থেকেই পড়াশোনা কমপ্লিট করুক।” উনার কথা শুনে প্রত্যয় তুয়ার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। তুয়া মাথা নিচু করে প্লেটে আকিঁবুকিঁ করছে। প্রত্যয়ের আম্মু বললেন,” কিন্তু ওরা একা বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে থাকবে কেন?” প্রত্যয়ের আব্বু বললেন, “আমরা স্ব-পরিবারেই যাবো। আর ওখানকার স্কুল কলেজে ওদের ভর্তি করিয়ে দিব।” প্রত্যয়ের আম্মু সম্মতি দিলেন আর তুয়ার কলেজের ব্যাপারটা উনি তো জানতেন। তাই তুয়ার ভালোর জন্য উনিও সম্মতি জানালেন।
বাবার মুখের উপরে প্রত্যয় প্রিয়ম কোনোদিন কিছু বলেনি, আজও বলল না। কারন ওরা জানে ওদের বাবা বিচক্ষণ এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পূর্ন মানুষ। উনি যে সিদ্ধান্ত নিবে অবশ্যই তাতে সবার ভালো হবে। আজকে সকালে শশুড় বউমা মিলে ঘুরতে গিয়ে অনেক যুক্তি পরামর্শ করে এসেছে। তুয়া এটাও জানিয়েছে, সে বাবার বাড়ি একটু দূরে থাকে চাই। কারন মনমালিন্য করে যাতে তাৎক্ষণিক বাবার বাসায় যেতে না পারে। এত কাছে থাকলে রেগে গেলে এটাই সে পুনরায় করবে। আর মনমালিন্য করে দু’জন দূরে দূরে থাকলে সম্পর্কে ফাটল এবং দুরত্বও বাড়বে। প্রত্যয়ের আব্বুও ভেবে দেখলেন তুয়া কথাটা মন্দ বলেনি। সেই সঙ্গে উনি তুয়ার থেকে ওর বাইরে যাওয়ার কথাটাও শুনলেন। এবং গেলে কি হতে পারে? ভালো মন্দ দু’টো দিকে সুন্দর করে বুঝিয়েছেন। উনার যুক্তি দিয়ে বলা কথা তুয়া অল্পতেই বুঝেছে। তুয়া দেশে থেকে পড়াশোনা করবে আর দেখিও দিবে, উনাকে এই কথা দিয়েছে। তুয়ার কথার ভিত্তি আর আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখতে প্রত্যয়ের আব্বু নতুন ফ্ল্যাটের যাওয়ার কথা বললেন।

তুয়ার এখনকার সিদ্ধান্তটাও প্রত্যয় বিনাবাক্যে মেনে নিল।
প্রত্যয়ের আব্বু উনার খাওয়া থামিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,”শুধু তুয়া নয়! তুমিও ভুলেও পড়াশোনা ছাড়ার কথা মাথায় অনবেনা। কারন পড়াশোনা দু’ একদিন নয় বরং সারাজীবনের জন্য সঙ্গী। দিনশেষে বিশ্বস্ত স্বামী যখন বেইমানী করে অথবা মারা যায়, তখন এই পড়াশোনাকে সঙ্গী করে দু’মুঠো ভাত যোগাড় করে যায়। বাস্তবতার কড়াঘাতে পৃষ্ঠ হতে না চাইলে পড়াশোনা করতে হবে। আর আমার ছেলেরা তোমাদের সাপোর্ট করছে। এই সাপোর্ট টাকেই তোমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়তে কাজে লাগাও। আবেগ দিয়ে নয় বিবেক দিয়ে ভেবে মস্তিষ্ককে কাজে লাগাও। আবেগী বয়সে করা এই ভুলটা যেন পরে আফসোসের কারন না হয়, সেভাবেই পরবর্তী পদক্ষেপ নাও। আর একটা কথা মনে রাখবে, আমরা আজ ভালো আছি। কাল না থাকতেও পারি। আজকে তিনবেলা খাবার জুটেছে, কাল একবেলা না জুটতেও পারি। তাই বলছি, বাঁচতে হলে নিজেকে সন্মানিত করে সন্মান নিয়ে বাচাঁর মতো বাঁচো। কেনো কাজই সহজ নয়। বাঁধা বিঘ্ন, আর কষ্টকে অতিক্রম করো দেখবে তুমিও একদিন সফল হবে।”

তুয়া আজকে বুঝল! প্রত্যয় আর প্রিয়ম কেন এতো আত্মবিশ্বাসী? তার কারন ওরা পরিবার নামক শেকড় থেকে এভাবেই সাপোর্ট পায়। তাদের মনোবেল, ইচ্ছেশক্তি, আত্মবিশ্বাসটাকে এভাবেই বাড়িয়ে দেন, তাদের বাবা নামক মানুষটা। বটবৃক্ষের ছায়ার মতো কথার মাধ্যমে মনে সূক্ষ্ম ভাবে প্রশান্তি এনে দেন। আর প্রশান্তিতে পুরো মনটাকে শুদ্ধ করে লক্ষ্য পূরনের উৎসাহটা দ্বিগুন হারে বাড়িয়ে দেয়। শশুড় এমন হয় চাদঁ তুয়ার ধারণা ছিল না। আর শশুড় নামক বাবার সাপোর্ট পেয়ে দু’জনে যেন শক্তি পেল। আর ওরা কথা দিল উনি যা বলবেন তাই হবে।
তারপর খাওয়ার পর্ব শেষ করে যে যার রুমে চলে গেল। তুয়া রুমে গিয়ে প্রত্যয়ের সামনে মাথা নিচু করে বসে বলল,”সরি।” প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে মুচকি হেসে বলল,”তোমাকে দূরে রেখে থাকাটা আমার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যেতো।” তুয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,”আর কষ্ট দিব না, প্রমিস।” প্রত্যয় হেসে তুয়ার কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলল,”হুম, এখন বাচ্চার চিন্তা বাদ দিয়ে পড়াশোনাতে মন দাও।” তুয়া প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখে প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ কর নিল। আর প্রত্যয় তুয়া বাহুডোরে আবদ্ধ করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাল। অবশেষে মান অভিমানের পালা কাটিয়ে ওরা আবার দু’জনে এক হয়ে গেল।

বিকেলে রনিত ইচ্ছেকে ওদের বাসায় এনে পলকের চুলে তেল দিতে বসেছে। পলক চুপ করে বসে আঙ্গুর খাচ্ছে। ইচ্ছে সোফায় বসে নুডুলস খেতে খেতে হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে বলল,”মামা তুমি তেন দিচ্ছ কেনু মামুনীর মাতায়?” রনিত হাসতে হাসতে বলল,”মা, তোমার মামুনি বাচ্চা হয়ে গেছে তাই।” পলক রনিতের পেটে গুঁতো মেরে ইচ্ছেকে বলল,” ইচ্ছে সোনা বলো তো আমাদের বাবুটা কার মতো দেখতে হবে? আমার মতো নাকি তোমার মামার মতো?” ইচ্ছে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, “আমাল মতো ছুন্দল হবে।” রনিত পলককে দু’জনে একসঙ্গে বলে উঠল, “আমিন।” ইচ্ছে উঠে দাঁড়িয়ে নাক ফুলিয়ে বলল,”না আমিনের মতো না। বাবুতা আমাল মতো ছুন্দল হবে।” পলক হাসতে হাসতে বলল,”কেউ ভালো দোয়া করলে আমিন বলতে হয়। যাতে আল্লাহ সেই দোয়াটা পূরণ করে দেয়। আমাদের তো তোমার মতোই বাবু দরকার এজন্য আমিন বললাম।” ইচ্ছে কথাটা শুনে ভুবন ভুলানো হাসি দিল অর্থাৎ কথাটা তার পছন্দ হয়েছে।

পরেরদিন রনিতের ছুটি শেষ। তাই পলককে ইচ্ছেদের বাসায় রেখে, সে অফিসে গেছে। পলক সারাটাদিন ইচ্ছের সঙ্গে বকবক করে সময় কাটায়। রনিত প্রতি ঘন্টায় ফোন করে পলকের খোঁজ নেয়। সে বেচারাও শান্তিতে থাকতে পারেনা। সব সময় পলককের চিন্তায় ওর মাথায় ঘুরঘুর করে। দুপুরের দিকে ইচ্ছে পুরো রুমে হেঁটে ওর বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। ওর বাবাও আদুরে সুরে মেয়ের কথার তালে তাল মিলাচ্ছে। চাকরিসূত্রে উনি ঢাকা থেকে পোস্টিং হয়ে সিলেটে আছেন। কিন্তু উনার মনটা পড়ে থাকে তার এই তোতাপাখি মেয়েটার কাছে। ইচ্ছে ওর বাবাকে জানাল, রনিত পলকের মাথায় তেল দিয়ে দেয়, প্রিয়ম ওকে প্যারা বলে, ওর পুতুলের বিয়ে দিবে , পানি ফেলে দেওয়াতে ওর আম্মু বকা দিয়েছে, ওর খরগোশটা সারাদিন খায়, বড় স্যান্ডেল পরে হাঁটতে গিয়ে সে হাঁটুতে ব্যাথা পেয়েছে। মেয়ে হাঁটু ব্যাথা পেয়েছে শুনে উনি বললেন,”আম্মা পায়ে বেশি ব্যাথা পেয়েছ?” ইচ্ছে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,”ফুঁ দিয়ে দাও বাবা।” ইচ্ছের ওর হাঁটুর কাছে ফোনটা রাখল আর ওর বাবা ফুঁ দিয়ে দিল। বাবা দেওয়া ফুঁ তে ওর সব ব্যাথা চলে যাবে। কারন বাবার দেওয়া ফুঁ তে জাদু আছে।
প্রত্যয় হসপিটাল কাজ সেরে দ্রুত বাসায় ফিরে এসেছে। ওর বন্ধু সাদের বিয়ে উপলক্ষে ওদের স্ব- পরিবারে সেখানে যাওয়ার কথা। কিন্তু সবাই ব্যস্ততায় থাকায় অগত্যা প্রত্যয় তুয়াকেই যেতে হচ্ছে। তুয়া বেশ কয়েকটা ড্রেস বের করে প্রত্যয়কে দেখিয়ে বলল,
“কোনটা পড়ব?”
“যেটাতে তুমি স্বস্তিবোধ করবে। আর ব্ল্যাক ড্রেসে গরম লাগে বেশি তাই ব্ল্যাক বাদ থাক।”
-“আচ্ছা।”

তুয়ার কলাপাতা রংয়ের শাড়ি সঙ্গে মিল রেখে প্রত্যয় সেইম কালার পান্জাবী পড়ল। পান্জাবীটার বুকে, বাহুতে, সবুজ সুতার ডিজাইন করা। তুয়া ভেবেছিল প্রত্যয় ব্লেজার পড়বে কিন্তু প্রত্যয় পান্জাবী পড়ল। প্রত্যয়ের পছন্দমতো তুয়া হালকা সাজে মানানসই হালকা গয়না পরে রেডি হলো। তারপর দু’জনে আম্মুকে বলে বেরিয়ে হলো। তুয়া গাড়িতে বসে কিছু বলার আগে, প্রত্যয় ড্রাইভিং সিটে বসে তুয়ার সিটবেল্ট লাগিয়ে বলল,”তুমি শাড়ি আর আমি ব্লেজার পরলে, দেশী বিদেশী মিলে ব্যাপারটা খামছাড়া লাগত। আর যাচ্ছি তো বাঙালির বিয়েতে। তাই তুমি শাড়িতে আর পান্জাবীতে এটাই পারফেক্ট।” তুয়া মুচকি হেসে বাইরে দৃষ্টি রেখে বিরবির করে বলল,”দেখতে কিন্তু মন্দ লাগছেনা।”
সাদ, পৃথা আর প্রত্যয় তিনজনে প্যারিস থেকে ডাক্তারী ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছে। ওরা তিনজনে খুব ভালো বন্ধু আর সাদের সঙ্গে পৃথার বিয়ে হচ্ছে। যদিও সাদ আর পৃথা সম্পর্কে চাচাতো ভাই বোন। সাদ একজন সাইকোলজিস্ট,পৃথা
গাইনোকোলজিস্ট আর প্রত্যয় কার্ডিওলজিস্ট। এই তিনজনই মানুষের সেবা প্রদানের কাজে নিয়োজিত। এসব নিয়ে গল্প করতে করতে প্রত্যয় সাদের বাসায় পৌঁছাল। সাদের বাসার দারোয়ান প্রত্যয়কে দেখে খুশি বললেন,”ওয়াসিক বাবা তুমি! তা কেমন আছো, বাবা? তোমার বাবা মা আর ছোট ভাইটা ভালো আছে তো?” প্রত্যয় গাড়ি থেকে বের হয়ে উনাকে সালাম দিয়ে মুচকি হেসে বলল,”আলহামদুলিল্লাহ! সবাই ভালো আছে আংকেল, আপনি কেমন আছেন?” উনি ছলছল চোখে তাকিয়ে ধরা গলায় উত্তরটা দিতে পারলেন না, তাই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালেন। প্রত্যয় উনার অবস্থা বুঝতে পেরে সোজা গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন। একজন ডক্টর, দামী পোশাক, দামী সুগন্ধী মাখা ছেলেটা এমন করবে, দারোয়ানের পোশাকে পরিহিত মানুষটা এতটাও আশা করেননি। উনি শক্ত করে প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে কম্পিত কণ্ঠে বললে,”ভালো আছি বাবা, খুব ভালো আছি।”

উনি না ছাড়া অবধি প্রত্যয় নিজেকে ছাড়ল না৷ একটুপরে, উনি প্রত্যয়কে ছেড়ে তুয়ার দিকে তাকালেন। প্রত্যয় তুয়ার সঙ্গে উনার পরিচয় করিয়ে দিল, তুয়া উনাকে সালাম দিল। উনি সালামের উত্তর নিয়ে বললেন, “ম্যাম আপনি ভালো আছেন?” তুয়া মুচকি হেসে বলল,”ওয়াসিক আপনার বাবা হলে আমি ম্যাম হলাম কিভাবে? বাবা সঙ্গে মা ডাকটাই মানায়, তাই না?” উনি খুশি হয়ে মাথা নাড়িয়ে তুয়ার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। তারপর প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে সামনের এগোলো আর দারোয়ান আংকেল ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,”আল্লাহ, ওদের ভালো রেখ আর সুখ সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে দিও।”
দারোয়ান আংকেলের ছেলে বেঁচে আছে আল্লাহর রহমত আর প্রত্যয়ের সঠিক চিকিৎসার ফলে। এজন্য উনার যতবার প্রত্যয়ের সঙে দেখা হয়, উনি ততবার আবেগপ্রবণ হয়ে যায়।
প্রত্যয় তুয়াকে বাসায় নিয়ে প্রবেশ করে দ্রুত ওর পাশে থেকে তুয়াকে সরিয়ে দিল। আর একদল ছেলে মৌমাছির দলের মতো প্রত্যয়ের উপরে হামলে পড়ল। কমপক্ষে বিশ পঁচিশটা ছেলে তো হবেই। তুয়া হতভম্ব হয়ে দুই হাত দিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তুয়া ভাবছে এত জনের নিচে প্রত্যয় নিশ্চয়ই চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।
উপস্থিত সবার চোখ তখন ওদের দিকে। হঠাৎ প্রত্যয় তুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,”তোরা উঠবি নাকি মেঝেতেই শুয়ে থাকবি?” প্রত্যয়ের কথা শুনে ছেলে গুলো হুড়মুড় করে উঠে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। তখন তুয়াকে সরিয়ে প্রত্যয় নিজেও সরে গেছে। আর ওর জায়গায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাদকে এগিয়ে দিয়েছে। আর সবাই নিচে চাপা পরেছে বেচারা সাদ। সবাই উঠে পরলেও সাদ তখনও টানটান হয়ে মেঝেতে শুয়ে ছিল। এত জনের ভরে ওর বেহাল দশা। সাদ নড়ে চড়ে বলে উঠল,”ইয়াম্মা, আমার আর বাসর করা হবে না। আমি হাড়-গুর সব চুরচুর করে দিয়েছে।”

বেচারা বরের বেহাল দশা দেখেও উপস্থিত সবাই অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ল। প্রত্যয় সব বন্ধু একে একে ওদের সঙ্গে কথা বলল। প্রত্যয় যে এদের খুব কাছের, ওদের ব্যবহার দেখে তুয়া বুঝতে পারছে। এরা সবাই প্রত্যয়কে ওয়াসিক নামে ডাকছে আর অবাক করা ব্যাপার সবাই পান্জাবী পরিহিত। সবাই তাদের পেশা এবং সাহেবী চাল বাদ দিয়ে সাধারণ পোশাকে এসেছে। যাতে বন্ধুর বিয়ে প্রাণ খুলে মজা করতে পারে। প্রত্যয়ের তখনকার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে, তুয়া এখনও শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এদিকে সব বন্ধুরা মিলে হৈচৈ করে আড্ডা দিতে লাগল। পৃথাও তুয়ার সঙ্গে অল্পতে মিশে গেল। সবাই কথা বলছে আর তুয়া চুপ করে শুনছে। এত কাপলদের ভিড়ে প্রত্যয় তুয়ার জুটিটা যেন সবার নজর কাড়ছে।
বিয়ে পড়ানো সম্পূর্ণ করে খাওয়া দাওয়াত পর্বও সমাপ্ত করা হলো। বর বউ, এবং বন্ধুরা মিলে একদফা ফটোশুটও চলল। হঠাৎ প্রত্যয়ের বন্ধুরা এসে প্রত্যয়ের দুই হাত বেঁধে বলল,”ভাই তোরে সহজে বাগে আনতে পারিনা, আজকে তোরে ছাড়ছিনা। কি ভাবি এতে আপনার আপত্তি আছে?”
প্রত্যয় নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,”ভাই ছাড় তাহলে মনমতো ট্রিট পাবি। আরেকজন বলে উঠল, “মিষ্টি কথায় কাজ হবেনা ব্রো। ভাবি আপনি আমাদের দল তো?”
কথাটা শুনে তুয়া বোকার উপর মাথা নাড়াল। আর সবাই হামলে পড়ল প্রত্যয়ের উপর। হাত বাঁধা থাকায় প্রত্যয় কিছু করতে পারল না, চুপ করে বন্ধুদের অত্যাচার সহ্য করল।

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২২+২৩+২৪

পার্টি স্প্রে, বার্থডে কেক, বিভিন্ন রংয়ের জরি দিয়ে প্রত্যয়কে ভূত বানানো হলো। প্রত্যয় মাথা নাড়ালেই ওরা স্প্রে করছে। তুয়া এক কোণে দাঁড়িয়ে সব বন্ধুদের উল্লাস দেখছে। অনেকদিন পর প্রত্যয়কে পেয়ে সব বন্ধুরা খুব খুশি। শুধু প্রত্যয় নয় ওদের সবার একই দশা, এখানে বর বউও ছাড় পায়নি। তুয়া বাদ ছিল কিন্তু পৃথা সেই কাজটাও সম্পূর্ণ করল। তুয়া প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে টিস্যু দিয়ে প্রত্যয়ের চোখ মুছে দিল। প্রত্যয় তাকাতে পারছিল না হয়তো ওর চোখ জ্বলছিল। এটা দেখে সবাই, “ওহো! কত্ত প্রেম ” বলে চিৎকার করে উঠল।
প্রত্যয় তুয়াকে ওর হাতটা খুলে দিতে বলল। প্রত্যয় টিস্যু দিয়ে পুরো মুখ মুছে সাদকে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধল। বর বলে কথা ওকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। সাদের অবস্থা করুন দেখে সবাই হেসে মেঝেতেগড়াগড়ি খাচ্ছে। সাদকে সবাই ইচ্ছে মতো ভূত বানাল। আর পাশাপাশি সাদ পৃথার বাড়ি তাই বিদায়েরও তাড়া নেই। ওদের এসব আনন্দে উপস্থিত সবাই দূরে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। সবার আড়ালে প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে ফ্রেশ হতে গেল। হৈচৈ এর ভিড়ে কেউ ওদের খেয়াল করল না। প্রত্যয় ওয়াশরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ওর চুলে শ্যাম্পু করে নিল। ক্লোথ স্টানে টাওয়াল থাকার সত্ত্বেও ওর রুমাল ভিজিয়ে মুখ আর ড্রেস মুছল। কারন কারো ব্যবহারিত টাওয়াল বা ড্রেস ব্যবহার করা ওর পছন্দ নয়।

তারপর প্রত্যয় তুয়াকেও ফ্রেশ হতে সাহায্য করল। ওই রুমটাতে হেয়ার ড্রায়ার দেখে প্রত্যয় সেই রুমের মালিকের পারমিশন নিল। তারপর ড্রায়ার দিয়ে আগে তুয়ার শাড়ি তারপর ওর চুল আর পান্জাবী শুকিয়ে নিল। তুয়া ওর হ্যান্ড ব্যাগ থেকে চিরুণী বের করে ওর আর প্রত্যয়ের চুল ঠিক করে নিল। তারপর দু’জনের বাইরে বের হলো। ওদের দেখে সাদ চিৎকার করে বলল,”আবার ফিটফাট হয়ে মিঃ পারফেক্ট হয়ে গেলি।” কথাটা শুনে প্রত্যয় বাঁকা হেসে বলল,”কারন ওয়াসিক রায়হান পারফেক্ট কাজেই অভ্যস্ত।”
একটু দূরে তুয়ার সঙ্গে সাদের আম্মু কথা বলছেন। মেহমান আর আত্মীয়ও ভিড়ে তখন ভালো ভাবে কথা বলতে পারেন নি। তুয়ার সঙ্গে প্রত্যয়ের আরো বন্ধুদের বউও আছে। প্রত্যয় এক সাইডে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলে কল কাটতে, পৃথা এসে ওর পাশে দাঁড়াল। পৃথাকে দেখে প্রত্যয় মুচকি হেসে ফোনটা ওর পকেটে রেখে বলল,”কিছু বলবি? আর তোর মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেন?”
পৃথা ছলছল চোখে তাকিয়ে প্রত্যুত্তরে বলল,”বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করে, আসলেই কি সুখে আছিস? সে আদৌ কি তোর চাওয়া পাওয়ার দাম দেয়?”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২৮+২৯+৩০