সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২৮+২৯+৩০

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২৮+২৯+৩০
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

পৃথার কথাটা শুনে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল,”বাচ্চা বউয়ের বাচ্চামি আবদার নিয়ে আমি কিন্তু বেশ ভাল আছি।” পৃথা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল, “দোয়া করি অনেক ভাল থাক।” প্রত্যয় হেসে বলল,” তোদের জন্যও রইল অনেক ভালবাসা এবং শুভ কামনা।”
একটুদূরে, তুয়া প্রত্যয়ের বন্ধুর বউদের সঙ্গে কথা বলছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাঙালি নয়। ওরা প্যারিস থেকে এসেছে। আর মুখস্থ পড়ার মতো ইংলিশে কথা বলছে। ওরা যখন তুয়ার সঙ্গে দ্রুত ইংলিশে কথা বলছিল। তুয়া তখন ওদের কথা বুঝতে পারছিল না। ইন্টার পড়া মেয়ের ইংলিশ স্পিকিং নিয়ে চর্চা না থাকলে, যা হয় আর কি। যেখানে মাস্টার্স কমপ্লিট করা ছাত্র-ছাত্রীরও চর্চা না করে, ইংলিশে কথা বলতে গেলে আঁটকে যায়। যেখানে তুয়া তো শিক্ষাগত যোগ্যর দিক থেকে বাচ্চা। হ্যাঁ, তুয়াও টুকটাক ইংলিশ বোঝে। কিন্তু মুখস্থ পড়ার মতো ইংলিশ বোঝার জ্ঞান টা, সে এখনও অর্জন করতে পারেনি। আর গল্পের হিরোইন হলে যে সব পারতে হবে তা কিন্তু নয়। মানুষ এক লাফে গাছে উঠতে পারেনা। চর্চা, জ্ঞান, কৌশল, বুদ্ধি, আর পদক্ষেপ ঠিক করে তারপর গাছে উঠতে শিখে।
তুয়াকে উত্তর দিতে না দেখে উনারা মুখ বাঁকালো। উনারা ভাবছে, তুয়া অহংকার করে কথা বলছেনা। একটুপরে, প্রত্যয় তুয়াকে ডাকল। তুয়া প্রত্যয় কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তখন একজন বাঙালি ভাবি বিদ্রুপ করে বললেন, ” রুপ থাকলে হয় না গুনও থাকতে হয়। বড় ডক্টরকে বিয়ে করলেই সন্মানিত হওয়া যায় না, সন্মান পেতেও যোগ্যতা থাকা লাগে।”

উনার কথার প্রত্যুত্তর না করে তুয়া প্রত্যয়ের কাছে চলে গেল। প্রত্যয় দু’জনের সঙ্গে তুয়ার পরিচয় করিয়ে দিল। উনারাও বাঙালী নন। যার ফলে অর্নগল ইংলিশে কথা বলছেন। তুয়ার এখন নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে। প্রত্যয় বুঝতে পেরে উনার কথাটা বাংলাতে বলল। তখন তুয়া উনার কথার উত্তর দিল। প্রত্যয় কথার ছলে উনাকে ইংলিশে জানিয়ে দিল, তার বাচ্চা বউ ইংলিশে একটু কাঁচা। উনি যেন কিছু মনে না করে। অপর ব্যাক্তি হেসে ইংলিশে বলল, “এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, এখানে মনে করার মতো কিছু নেই। আজ পারছেনা কাল নিশ্চয়ই পারবে।”
প্রত্যয় হেসে সুন্দর ভাবে ব্যাপারটা সামলে নিল। যাতে তুয়া কষ্ট না পায় আর নিজেকে ছোট না ভাবে। কিন্তু তুয়া যে একটু আগে অপমানিত হয়েছে। এটা প্রত্যয়ের অজানায় থেকে গেল। প্রত্যয়ের বন্ধু এক একজন উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদে কর্মরত। তারা বিয়েও করেছে যোগ্যতা মোতাবেক। কিন্তু প্রত্যয় এখানে যোগ্যতা দাপট দেখায় নি। বরং তুয়াকে ভালবেসে গ্রহন করেছে। এখানে তুয়াকে নিয়ে প্রত্যয়ের একটুও ইতস্ততবোধ হচ্ছে না। এদের সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে ওর রাগও হচ্ছে না। কারন এটাই তুয়ার শিখার সময়। সঠিক সময় সেও একদিন ঠিক পারবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারপর ওরা আনন্দের সমাপ্ত ঘটিয়ে বিদায় নিয়ে বাসায় পথে রওনা দিল। গাড়ি বসে তুয়া প্রত্যয়কে বুঝতেও দিল না, ওর বুকে কেউ কথার তীর মেরেছে। আর সেখানটাই বেশ গভীরভাবে জখম হয়েছে। প্রত্যয় গাড়ি থামিয়ে তুয়াকে বেলী ফুলের মালা আর এক গুচ্ছ লাল গোলাপ কিনে দিল। তুয়া ফুল গুলো নিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,”ধন্যবাদ স্বামী।” প্রত্যয়ও হেসে প্রত্যুত্তরে বলল, “স্বাগতম বউ।”
দু’জনে বাসার গেটে ঢুকে গাড়ি থেকে নামল। তখন পলক আর রনিতের সঙ্গে ওদের দেখা হল। তুয়া জানত না, এখানে পলক থাকে। কারন ওদের সঙ্গে ওর দেখাও হয়নি। প্রত্যয় তুয়া ওদের সঙ্গে কথা বলল। তুয়া পলকের হাতে কয়লা দেখে জিজ্ঞাসা করল,’ আপু, কয়লা কি করবে?’ রনিত হেসে পলকের ব্যাপারটা ওদের জানাল। প্রত্যয় সবটা শুনে পলককে বলল,”পলক এই বাচ্চাটাকে কি তুমি চাও না?” পলক অবাক এবং একটু রাগান্বিত হয়ে বলল,”চাইব না কেন? খুব করে চাই।” পলককের কথা শুনে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল,”এই সময় অনেক কিছু ইচ্ছে জাগে। কিন্তু সব ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে নেই। এই যে কয়লা চিবুচ্ছে, এটার রস পেটে গেলে বাচ্চাও খাবে। আর এসব খেলে পেটে সমস্যা দেখা দিবে। তখন দিন দিন বাচ্চার বেঁচে থাকাটা রিস্কি হয়ে যাবে। এবার তুমি ভাবো, তুমি তোমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিবে নাকি বাচ্চার কথা ভাববে।”

প্রত্যয় ওর কথার কৌশলে পলকের মন ঘুরিয়ে দিল। সে ডক্টর হয়ে তো বেহুদা কথা বলবে না। এটা ভেবে পলক ওর হাতের কয়লা দূরে ছুঁড়ে মারল। পলকের এমন কাজে রনিতের মুখে হাসি ফুটল। প্রত্যয় তুয়াকে ইশারা করল, পলককে নিয়ে একটু দূরে যেতে। তুয়া প্রত্যয়ের ইশারা বুঝল। আর কথার ছলে পলককে নিয়ে ইচ্ছদের বাসায় ডুকল। ওদের যেতে দেখে প্রত্যয় রনিতকে বলল,”পলকের এই রোগের নাম পাইকা ডিজঅর্ডার। যদিও এটা একটা মানসিক রোগ।”
একথা শুনে রনিত অবাক হয়ে তাকাল। কারন অখাদ্য কিছু জিনিস খাওয়া কোনো রোগ হতে পারে, এটা ওর জানা ছিল না। রনিত এবার ব্যাপারটা সিরিয়াস ভাবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,”স্যার আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন, প্লিজ। আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিনা।”
প্রত্যয় রনিতের কথার প্রত্যুত্তরে বলল,” জ্বি অবশ্যই! পলকের এই অদ্ভুত ইচ্ছে দু’টো কারনে হতে পারে। প্রথমটা হলো প্রেগনেন্সী আর দ্বিতীয়টা পাইকা ডিজঅর্ডার। পাইকা রোগের লক্ষণ, ছাই/কয়লা, সুঁতা, ইট, কলমের কালি, মাটির তৈরী চায়ের ভাঁড়, এক কথায় অখাদ্য গুলো খেয়ে ফেলা। তাছাড়া শরীরে আয়রণ, আর জিংক এর অভাব থাকলে, অদ্ভুত খাবার খেতে ইচ্ছে করে। যেটা এই মুহূর্তে ওর বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। প্রেগনেন্সীতে হরমোন চেঞ্জের কারনে এই সমস্যা দেখা দেয় আবার সমাধানও হয়ে যায়। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলুন। ওর মানসিক চাপটা কি নিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন। যদি সম্ভব হয় তো সেটার সমাধান করুন। তারপরেও যদি ঠিক না হয় তাহলে এর রোগের চিকিৎসা নিতে হবে। কারন এটা হাস্যকর রোগ হলেও, রোগ সারানোর পথ এতটাও সহজ নয়।” রনিতের মুখে চিন্তার ছাপ দেখে প্রত্যয় আবারও বলল,”সমস্যা থাকলে সমাধানও হবে। আপনি ইজি থাকুন আর পলকের কার্যকলাপে নজর রাখুন।”

রনিত প্রত্যয়কে ধন্যবাদ জানাল। প্রত্যয় নিজে থেকে ব্যাপারটা না জানালে, সে ব্যাপারটা তুচ্ছ ভেবে অবহেলা করত। প্রত্যয় রনিতের থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে আবার এসে বলল,”বাচ্চা ছেলে/মেয়ে হওয়ার নিয়েও সন্তান সম্ভাবা মায়েরা চিন্তিত থাকে। আর এই চিন্তাটা অনেক সময় মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। অনেকের আবার শশুড়বাড়ির চাপ, বাচ্চা নিয়ে হাজবেন্ডের খুশি/অখুশির ভাবনা, মেয়ে বাচ্চা নিয়ে মানুষের কটু কথার ভয়, এসব নিয়েও মানসিক রোগ সৃষ্টি করে। আপনি ওর প্রতি খেয়াল রাখুন। তাহলে হয়তো সবটা বুঝতে পারবেন, আসি।”
প্রত্যয় তুয়াকে ডেকে ওদের বাসায় চলে গেল। প্রত্যয় ওর কথা দিয়েই রনিত সমস্যা দেখিয়ে দিল। আর রনিতও সেটা দ্রুত ক্যাচ করতে পারল। কারো পরিবার নিয়ে হুট করা কথা বলাটা বেমানান। তাই প্রত্যয় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পরিবারের কথাটা রনিতকে বোঝাল। যদিও পরিবার নিয়ে কথাটা প্রত্যয় আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে বলেছে। যাতে রনিতের এই ব্যাপরটাও ভেবে দেখে। আর সমস্যাটা খুঁজে বের করতে পারে।
প্রত্যয়ের প্রত্যেকটা কথা রনিত গভীর ভাবে চিন্তা করল। প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকে পলকের একই কথা, “কি বাবু হবে? কার মতো হবে, তুমি খুশি তো? মেয়ে হলে ভালবাসবা তো? আমার মনে হয় মেয়ে হবে?” অহরহ বার সে পলকের এই কথার সম্মুখীন হয়েছে। আর রনিতের মা, দাদী, মেয়ে বাচ্চা পছন্দ করেনা, একথাও পলক জানে। হয়তো এসব চিন্তায় পলকের মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। রনিত সমস্যা এবং সমাধান দু’টোই পেয়ে না দাঁড়িয়ে পলককে নিয়ে বাসায় চলে গেল।

সন্ধ্যার পর চাঁদ প্রিয়মের কাছে পড়তে বসেছে। এই নিয়ে প্রিয়ম একই অংক চাঁদকে পাঁচবার বুঝাল। কিন্তু চাঁদ তাও বুঝতে পারছেনা। প্রিয়মের কটমট করে তাকানো দেখে চাঁদ না বুঝেও বলল বুঝেছে। প্রিয়ম চাঁদকে একটা অংক করতে দিল। চাঁদ তখন ধরা খেয়ে কলমের নিব কামড়াতে লাগল। চাঁদের কাহিনী বুঝতে পেরে প্রিয়ম স্টিলের স্কেলটা হাতে নিল। চাঁদ তখন দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”তুয়া আপুরা এসেছে নাকি দেখে আসছি।” প্রিয়ম স্কেলটা দিয়ে ইশারা করে ওকে বসতে বলল। চাঁদ মিনমিন করে বলল,”তোমার কাছে অংক বুঝছিনা, আমি ভাইয়ার কাছে বুঝব।” প্রিয়ম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,”ভাইয়া, নিজের ব্রেণকে পরীক্ষা করতে কানে ইয়ারফোন গুঁজে ফুল পাওয়ারে গান দিয়ে, ত্রিকোনোমিতি আর পিথাগোরাসের অংকের সমাধান করে। তাহলে ভাবো, সে কেমন ছাত্র। তাই বলছি! তোমার মতো গবেট গিয়ে ভাইয়ার সময় নষ্ট করো না।”
কথাটা শুনে চাঁদ মুখ ভেংচি দিয়ে খাতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, নিজে নিজে অংক করতে লাগল। আর প্রিয়ম নিজের বই নিয়ে পড়াতে মন দিল। প্রিয়মের কিছুদিন পর পরীক্ষা। তাই সে শুয়ে শুয়ে পড়ছিল। ওর দেখে চাঁদ শখ করে পড়তে বসে ফেঁসে গেছে। প্রিয়ম পড়তে পড়তে চাঁদের খাতার দিকে তাকাচ্ছে, একটা জায়গায় এসে চাঁদ আঁটকে গেছে। সেখানে সূত্র প্রয়োগ করলে সমাধান বের হয়ে যাবে। প্রিয়ম চাঁদের খাতা টেনে সমাধান করে দিল। আর বেশ কয়েকটা সূত্র লিখে চাঁদকে মুখস্থ করতে দিল। চাঁদ মন দিয়ে পড়ে প্রিয়মকে ধরতে দিল। প্রিয়ম এলোমেলো করে ধরাতে চাঁদের সবটা গুলিয়ে গেল। তখন তুয়া ড্রয়িংরুমে বসে চাঁদকে ডেকে উঠল। তুয়ার ডাক শুনে চাঁদ দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। প্রিয়ম চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,”বুদ্ধি আছে কিন্তু কাজে লাগায় না, ফাজিল একটা।”

একটুপরে, চাঁদ হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে এসে প্রিয়মকে বলল,”এই লোক, এই! আপনার পুরো নাম কি?” প্রিয়ম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”এক থাপ্পড়ে ভদ্রতা শিখায় দিব।” থাপ্পড়ের কথা শুনে চাঁদ ঢোক গিলে জোরপূর্বক হেসে বলল,”আপনার পুরো নামটা বলবেন? একটু দরকার ছিল।” প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,”তাশফিক সাফায়েত প্রিয়ম।” চাঁদ ওর হাতের সুন্দর একটা বেসলেট দেখিয়ে বলল,”প্রত্যয় ভাইয়া প্যারিস থেকে এনেছে। আমার টাতে ‘S’ আর তুয়া আপুটাতে ‘W’ লিখা। দারুন দেখতে, তাই না?” প্রিয়ম ‘হুম’ বলে ওর পড়াতে মন দিল। আর চাঁদ মুখ ভেংচি দিয়ে স্থান ত্যাগ করল।
প্যারিস থেকে আসার সময় প্রত্যয় চাঁদ তুয়া জন্য একই রকম দু’টো বেসলেট এনেছে। শুধু অক্ষর আলাদা। আরো অনেক কিছু এনেছে। কিন্তু দেওয়ার কথা প্রত্যয়ের মনে ছিল না। প্রিয়ম জানে প্রত্যয় ওর জন্যও ইউনিক কিছু এনেছে। কারন প্রত্যয় যতবার প্যারিসে যায়, ততবার ওর জন্য ইউনিক মডেলের ড্রেস অবশ্যই আনে। প্রিয়মের গিটারটাও প্যারিস থেকে আনা। রাতে খাওয়ার সময় প্রত্যয়ের আব্বু জানালেন, কালকে সবাই বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে চলে যাবে। এখান থেকে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিবে। আসবাবপত্র দিয়ে ওই ফ্ল্যাট সাজানোই আছে।
প্রত্যয় তখন বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে চাদঁ তুয়াকে বেসলেট দিয়েছিল। তার পর পরই জরুরী কল আসায় হসপিটালে চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে, তুয়া কল দিল কিন্তু প্রত্যয় রিসিভ করল না। প্রত্যয়ের অপেক্ষা করতে করতে তুয়া বেলকণিতে ঘুমিয়ে গেল। আর ওখানেই সারারাত কেটে গেল। কিন্তু প্রত্যয় বাসায় ফিরল না। পরেরদিন সকাল আটটায় জামিল প্রিয়মকে ফোন করে বলল,”ছোট ভাই দ্রুত হসপিটালে চলে এসো। একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[২৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

গতরাতে ইচ্ছের আব্বু বাসায় এসেছেন। মূলত ইচ্ছেদের
সিলেটে নিয়ে যাওয়া জন্য উনার এই আগমন। যদিও ওদের যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হুট করে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে। রনিতের সাহায্য নিয়ে উনাদের গোছগাছও প্রায় শেষ। ইচ্ছের ওর আব্বুকে পেয়ে রুম থেকে আর বের হয়নি। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে, ইচ্ছে ওর আব্বুকে খুঁচিয়ে উঠাল। তার বায়না সে এখন ঘুরতে বের হবে। মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে ইচ্ছের আব্বু ইচ্ছেকে নিয়ে বের হল। ইচ্ছে ওর বাবার আঙ্গুল ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। সাথে তোতাপাখি মতো কথার ফুলঝুঁড়ি তো আছেই। ইচ্ছের আব্বু মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলেন। দুই বছর আগে, ইচ্ছের আব্বু আম্মু পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। দুই পরিবারের কেউ আজও তাদের মেনে নেয়নি। আর না কারো সঙ্গে উনাদের যোগাযোগ হয়েছে। এখন মেয়েটাই উনাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। মেয়েকে নিয়ে উনারা বেশ সুখে আছেন। ইচ্ছে হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে একটা ডোবার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আঙ্গুল দিয়ে একটা ব্যাঙ দেখিয়ে বলল,”বাবা, ব্যাংগেল মা বাবা আল বুন্দু আচে?”

ইচ্ছের আব্বু হেসে বললেন, “হুম আছে! ওর বাবা মা আর বন্ধু বাসায় ঘুমাচ্ছে।” ইচ্ছে বড়দের মতো মাথা নাড়িয়ে আবার হাঁটতে লাগল। একটুপরে, আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,”বাবা, আমলা পাকির মতো আকাশে উলব।” ইচ্ছের বাবা মেয়ের কথার উত্তর খুঁজতে লাগলেন। তখন একটা কুকুর ছানা ঘেউ ঘেউ করে উঠল। ইচ্ছে,”বাবা পালাও” বলে বাসার দিকে দৌড়াতে লাগল। ইচ্ছের আব্বুর মেয়েকে কোলে তুলে দৌড়ে বাসায় ঢুকে গেল। কুকুর ছানাটা ওদের পিছু নিয়ে দৌড়ে এসে গেট বন্ধ দেখে ঘুরে চলে গেল।
সকাল আটটায় বাস। তাই সাড়ে সাতটায় ইচ্ছেরা রেডি হয়ে নিল। উনারা তুরাগ এবং প্রত্যয়দের থেকে বিদায় নিতে গেল। সবার সঙ্গে দেখা হলেও প্রত্যয়ের সঙ্গে ইচ্ছের দেখা হল না। প্রিয়ম ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে আদর করে উপহার দিল। এই তোতাপাখিটা চলে যাবে, তাই সবার মন খারাপ। তুয়া ছলছল চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বলল,”আবার বেড়াতে আসবি তো ?” ইচ্ছে ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। তারপর ইচ্ছে সবার দিকে তাকিয়ে বলল,”প্রত্তুয় কুথায়? আমার সাতে কথা বলবে না?” প্রত্যয়ের আব্বু ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে এক হাজারের টাকার নোট দিয়ে বললেন,”ইচ্ছেবুড়ি, প্রত্যয় তো বাসায় নেই। হসপিটালে জুরুরী কাজে আটঁকে গেছে।” ইচ্ছে টাকাটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,”আচ্ছা।” তারপর ওরা রনিত পলকসহ সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এই তোতাপাখিটার সাথে ওদের দেখা হবে কি না? কারো জানা নেই। প্রিয়ম বেলকনিতে এসে ইচ্ছেদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। দুষ্টুটা এসে আর বলবেনা,”কানাচুর দাও, তুমি খালাপ প্যালা প্রিউুম।”

তুয়ারা সবাই একসঙ্গে সকালের নাস্তা করতে বসেছে। আজকে ওরাও বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে চলে যাবে। প্রত্যয়ের সময় নেই। তাই ওরা সবাই গোছগাছ করে নিয়েছে। পরে এসে বাকি জিনিসগুলো নিয়ে যাবে। আটটার দিকে প্রিয়মের ফোনে কল আসল, তখন সে খাচ্ছিল। প্রিয়ম রুমে গিয়ে কল রিসিভ করলে জামিল বলল,”ছোট ভাই দ্রুত হসপিটালে চলে এসো, একটা সমস্যা হয়ে গেছে।” প্রিয়ম আংকিত কন্ঠে বলল,”ভা ভাইয়া ঠিক আছে?” জামিল কথা না বাড়িয়ে প্রিয়মকে আসতে বলে কল কাটল। প্রিয়ম হাত ধুয়ে বাইকের চাবি নিয়ে বের হচ্ছিল। তখন ওর আব্বু বললেন, “এখন কোথায় যাচ্ছ? একটুপর, আমাদের তো বের হতে হবে তো।” প্রিয়ম যেতে যেতে,”আব্বু তুমি সবাইকে নিয়ে যাও, আমি পরে আসছি।” বলে দৌড়ে নেমে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল।
রনিত পলককে সাবধানে থাকতে বলে অফিসে চলে গেল। পলককে একা বাসায় রাখা ঠিক হবেনা, এজন্য বাচ্চার কথা সবাইকে জানিয়েছে। আর পলকের মাকে এখানে থাকার কথা বলেছে। কালকে বিকালে রনিত পাঁকা টমেটো এনেছে। কারন পলক বিটলবণ দিয়ে টমেটো খেতে বেশ পছন্দ করে। পলক পুরো রুম হেঁটে হেঁটে টমেটো খাচ্ছিল। তখন রনিত ওর ফোনে কল দিল। হঠাৎ পলকের হাত ফসকে টমেটো টা পরে গেল। পলক বিরক্ত হয়ে টমেটো না তুলে আগে রনিতের কল রিসিভ করল। পাঁচ মিনিট কথা বলে, পলক ফোনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে টমেটোর উপরের পা ফেলল। টাইলস্ করা মেঝেতে পা পিছলে পরার সময় ধরার কিছু পেল না। ফলস্বরূপ মেঝেতে আঁছড়ে পরে, ‘ওহ মা’ বলে চিৎকার করে উঠল।

পলক প্রচন্ড ব্যথায় পেট চেপে ধরে ছটফট করতে লাগল। ফোনটা দূরে ছিঁটকে পরাতে হাত বাড়িয়ে ফোনের নাগাল সে পেল না। পেটে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে পলকের ব্লেডিং শুরু হল। প্রায় দুই ঘন্টা পর, রনিত পলকের আর খোঁজ পাচ্ছে না। সে অনবরত ফোন দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু ফোন সুইচ অফ দেখাচ্ছে। ইচ্ছেরাও নেই, যে পলকের কাছে পাঠিয়ে খবর নিবে। রনিত ব্যাপারটা অফিসে জানিয়ে বাসার পথে রওনা দিল।
প্রিয়ম হসপিটালে পৌঁছে বাইক রেখে দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করল। তারপর জামিলের কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,”জামিল ভাই আমার ভাইয়া কোথায়? ভাইয়া ঠিক আছে?” জামিল প্রিয়মকে হাঁপাতে দেখে প্রত্যয়ের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর বলল,” হসপিটালে একটা সমস্যা হয়েছে। কালকে রাতে একটা ছেলেকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল। ছেলেটা হার্টের পেশেন্ট ছিল। ডক্টর আহমদ ওটিতে ছিল আর ডক্টর সাফাত ছিল ছুটিতে। তাই জরুরী ভাবে প্রত্যয় স্যারকে ডাকা হয়েছিল। প্রত্যয় স্যার এসে ছেলেটার চিকিৎসা শুরু করে। ছেলেটা শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়াতে ওর অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছিল। ওটিতে নেওয়ার আগে, নিয়ম অনুযায়ী নার্সরা ওর শরীরের থাকা তাবিজ/মাদুলী খুলে ফেলেছিল। গ্রামের মানুষ জ্বিন ভূতের কারবার ভেবেছিল। তাই এতোদিন ছেলেটার চিকিৎসা না করে কবিরাজ দেখিয়েছে। কবিরাজ টাকা খেয়ে একাধিক মাদুলী দিয়েছে। ছেলেটার শরীরে বাহু, গলা, আর কোমরে মোট আটটা মাদুলী ছিল। মাদুলী খুলে বাড়ির লোকের হাতে দেওয়া হয়েছে। ছেলেটার হার্ট ব্লক হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে এসে চিকিৎসার কাজে লাগেনি। ফলে সারারাত মৃত্যু সঙ্গে লড়াই করে, আজ সকালে মারা গেল। প্রত্যয় স্যার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে উনারও কিছু করার ছিল না। কিন্তু এখন ছেলেটার বাড়ির লোক ঝামেলা শুরু করেছে। তারা বলছে, মাদুলী খুলে ফেলাতে ছেলেটা মারা গেল। এখন সব দোষ প্রত্যয় স্যারের, স্যার নাকি সঠিক চিকিৎসা করেনি।” প্রিয়ম সবটা শুনে বলল, “ভাইয়া কোথায়?” জামিল বলল,”ওটিতে আছে, তিন ঘন্টার আগে বের হবেনা। ওই ছেলের বাড়ির লোকও ওটির বাইরে আছে।” প্রিয়ম জামিলকে নিয়ে ওটির কাছে গেল।

রনিত দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। পলক সেন্সলেস হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। রনিত দ্রুত পলককে কোলে তুলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। রনিত পলককে প্রত্যয়ের হসপিটালে হসপিটালের ভর্তি করল। কিন্তু
প্রত্যয়ের খোঁজ করে রনিত পেল না। হঠাৎ প্রিয়মকে দেখে রনিত ওকে সবটা জানাল। প্রিয়ম রিসিপশনে বলে দিল বেস্ট চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। প্রিয়মের হুকুম পেয়ে নার্স আর ডক্টর মিলে দ্রুত পলকের চিকিৎসা শুরু করল। কিন্তু পলকের মিসক্যারেজ এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জটিলতা দেখা দিল। পলকের শরীরে রক্ত কম। তার উপরে অপরিপক্ব বয়স, গর্ভধারণ, আবার মিসক্যারেজ। সব মিলিয়ে পলক মৃত্যু সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে।
তারপর প্রিয়ম ওটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওই ছেলের মা কাঁদছে আর প্রত্যয়কে অভিশাপ দিয়ে বলছে,”ওই ডাক্তারের মায়ের বুক খালি হোক। ওই ডাক্তার আমার বুক খালি করল রে। ওই ডাক্তার যেন জ্বলে পুরে মরুক রে।” প্রিয়ম উনার কাছে গিয়ে বলল,”এক মা হয়ে আরেক মাকে এই অভিশাপ দিচ্ছেন? এই বিবেক আপনার?” হঠাৎ একটা ছেলে প্রিয়মের কলার ধরে বিশ্রী গালি দিয়ে বলল,”**** পোলা হিরো সাজতে এসেছিস? যা ভাগ এখান থেকে।”

প্রিয়ম ছেলেটার নাক বরাবর স্বজোরে ঘুষি বসিয়ে দিল। জামিল কোনোরকম পরিবেশ সামলে প্রিয়মকে নিয়ে বাইরে গেল। ওইদিকে রনিত পাগল হয়ে গেছে। সে রক্ত যোগাড় করতে পারছেনা। প্রিয়ম শুনে ওর বন্ধুদের ডাকল। রনিত বাড়ির লোকরাও শুনে চলে আসল। এদিকে পলকের শরীর রক্ত শূন্য হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। ওর শরীরে রক্ত নিচ্ছে না। রনিত লোকলজ্জা ভুলে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। একটু পরে ডক্টর এসে জানাল,”পেশেন্ট রেসপন্স করছেনা, সরি।”
রনিত কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। অনাকাঙ্ক্ষিত কথাটা শুনে যেন ওর মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল। রনিত এই খবরটা নিতে পারল না, সেন্স হারিয়ে ফেলল। আর অপরিপক্ব বয়সে বিয়ে, বাচ্চা, অসাবধানতা পলককের প্রাণটা গেল। বাস্তবতার কড়াঘাত বড়ই নিষ্ঠুর। তবুও আমরা মানতে বাধ্য। কারন জীবন কারো গড়া নিয়মে জীবনে চলে না। জীবন চলে বাস্তবতার কড়াঘাতে পৃষ্ঠ হতে হতে।
(এমনটা না করলেও পারতাম, জানি তাও করতে হলো। এখন কেউ যদি বলেন আর গল্পটা আর পড়বেন না। তাহলে বলব, এটা আপনাদের ব্যাপার। গল্পের মূল থিম আনার জন্য এমনটা করতে বাধ্য হয়েছি।)

দুই ঘন্টা পর প্রত্যয় ওটি থেকে বের হল। ওই ছেলেটা প্রত্যয়কে দেখে বলল,”তুই আমার বোনকে বিধবা করেছিস। তোর নামে আমি কেস করব।”প্রত্যয় নার্সকে ডেকে একটা কাগজ নিয়ে ওদের দেখিয়ে বলল,”এই পেপারে আপনারা সাইন করেছিলেন। এই সাইন মানে, পেশেন্টের কিছু হলে ডক্টর বা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ কেউ দায়ী নয়। তাহলে এখন ঝামেলা করছেন কেন?” তখন একজন মহিলা তেড়ে এসে বললেন,”দু’অক্ষর শিখে জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। আমরা কিছু বুঝিনা, আমরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি?” প্রিয়ম রেগে দূরে দাঁড়িয়ে বলল,”ঘাসে মুখ দেন অথবা গোবরে, এটা আমাদের দেখার বিষয় না। ফাউল কাহিনী না করে বিদায় হন।”
মৃত ছেলেটার মা কাঁদতে কাঁদতে বলল,”বাবা রে, তুমি ক্যান মাদুলীডা খুইল্লা ফেলাইলা রে। কবিরাজ কইছিল ওডা না খুলতে রে।” প্রত্যয় উনার সামনে বসে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন,”আন্টি, চিকিৎসা সময় এসব এলাও করা হয় না। হার্টের চিকিৎসাতে বৈদ্যুতিক যত্নপাতি ব্যবহার করা হয়। এসব থাকলে অনেক সময় দূর্ঘটনা ঘটে। তাই নিয়ম অনুযায়ী খুলতে হয়, আর মৃত্যু তো স্বয়ং আল্লাহর হাতে।”
প্রত্যয়ের কথাটাতে পরিবেশ শান্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই মার খাওয়া ছেলেটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,” মিষ্টি কথায় মন ভোলানো হচ্ছে? তুই আমার বোনকে বিধবা করেছিস। এখন তোকে আমার বোনের সব দায়িত্ব নিতে হবে।” ছেলেটার কথাটা বলতে দেরী, কিন্তু প্রিয়মের লাথি দিতে দেরী করেনি। সে পর পর তিনটে ঘুষি আর একটা লাথি দিয়ে বলল, “ভেবেছিস, তোর থার্ড ক্লাস কথা মেনে নিব। বোনের দায়িত্ব নেওয়ার ভয়ে এখন ডক্টরের ফাঁসাচ্ছিস। মনে করেছিস কিছু বুঝিনা।”

প্রিয়ম কথাটা ভুল বলেনি। এটাই ছিল তাদের ঝামেলা সৃষ্টির মূল কারণ। আর এখানকার কেউ এদের উষ্কেছে। এবং বুঝিয়েছে, বোনকে প্রত্যয়ের ঘাড়ে গছালে রাজা আর রাজত্ব দু’টোই তাদের। বোকা লোকগুলো উষ্কানিমূলক কথা শুনে তাই করছিল। কিন্তু মধ্যেখানে ধরা খেয়ে গেল।প্রত্যয় প্রিয়মকে থামিয়ে ওর চেম্বারে নিয়ে গেল।
আর প্রিয়ম যাওয়ার আগে ছেলেটাকে বলে গেল,”চেচাঁমেচি বাইরে গিয়ে কর, বাস্টার্ড। নয়তো তোদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩০]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয় প্রিয়মের থেকে পলকের কথা শুনে দ্রুত পায়ে কেবিনের দিকে গেল। রনিত তখনও থম মেরে বসে ছিল।
প্রত্যয় কেবিনে ঢুকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টরের দিকে তাকাল। ডক্টরের চোখের ভাষা বুঝে প্রত্যয় চুপ হয়ে গেল। রনিত ছলছল আকুতি ভরা চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কারন ওর শেষ ভরসাটুকু প্রত্যয়ের একটা প্রত্যুত্তর। প্রত্যয় নিজ চেক করে ‘না’ বোধক মাথা নাড়াল। যার অর্থ আর নেই। রনিতের শেষ আশাটুকু একনিমিষেই নিভে গেল। সে মেঝেতে বসে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।
তুয়া চাঁদ পলকের খবরটা শুনে হসপিটালে ছুটে এসেছে। কালকে রাতে পলকের সঙ্গে ওদের কথা হয়েছে। আর আজকে পলক আর নেই। তুয়া যেন এটা মানতেই পারছেনা।
একটুপরে, হসপিটাল থেকে পলককে রনিতের বাসায় আনা হলো। পলক লাল শাড়ি পরে এই বাসায় প্রবেশ করেছিল। আর আজ সাদা কাফনে চিরতরে গৃহত্যাগ করবে। এটাই যেন বাস্তবতার নিষ্ঠুর এক নিয়ম। প্রত্যয় হসপিটালের কাজ সেরে সবাই নিয়ে রনিতদের বাসায় আসল। পলকের মা বাবা উঠানে বসে শব্দ করে কাঁদছেন। এতদিন যারা পলককে কটু কথা শুনাত। আজ তারাও ওর চিরবিদায়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে।

পলককে গোসল করিয়ে কাফন পড়ানো হয়েছে। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওর অন্ধকার কবরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। পলককের নামটা বাতিল করে লাশ নামে নামকরণ হচ্ছে। শরীর থেকে প্রাণ যেতেই লাশ নামে সবাই ডাকা শুরু করেছে। লাশ দাফন হবে কখন? লাশকে গোসল করানো হয়েছে? লাশ কয়টার সময় মারা গেছে? আশে পাশের মানুষজন ফিসফিস করে এসব আলোচনা করছে। রনিত ধীর পায়ে হেঁটে পলকের কাছে গিয়ে বসল। একদৃষ্টিতে পলককের দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,” তুমি যাও, আমিও খুব শীঘ্রই আসব। হাশরের ময়দানে আমাদের আবার দেখা হবে।”
রনিতের কথাটা শুনে উপস্থিত সবার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। রনিতের কথাটা বুঝিয়ে দিল, পলকের প্রতি তার ভালবাসা। কথাটা বলে রনিত মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। ইশার নামাজের পূর্বে পলকের দাফন কার্য সম্পূর্ণ করা হলো। কবরস্থান থেকে সবাই ধীরে ধীরে স্থান ত্যাগ করল। শুধু রনিত পলকের কবরের থেকে একদূরে বসে রইল। ওদের আড়াই মাসের মৃত বাচ্চাটা দেখে রনিতের বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিল। বাবুটা ধীরে ধীরে বড় হতো। ওকে আদুরে সুরে বাবা বলে ডাকত, নানান আবদার করত। কিন্তু সবটাই অপরিপূর্ণ স্বপ্ন হিসেবে রয়ে গেল। শুধু পলক নয় ওদের বাচ্চাটাও ওকে ফাঁকি দিল। রনিত মাথা নিচু করে বিরবির করে বলল,”আল্লাহ! আল্লাহ গো, আমি পাপী বলেই কি আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে? আমার দুই টা প্রিয় মানুষের সঙ্গে আমাকে কেন নিলেনা?”

রনিতের থেকে বেশ কিছুটা দূরে প্রত্যয় আর তুয়া দাঁড়িয়ে আছে। তুয়া প্রত্যয়ের বাহুতে মাথা রেখে নিরবে কাঁদছে। আজকে রনিত পলকের জায়গায় ওরা দু’জন থাকতে পারত। তুয়ার জেদ মানলে হয়তো তুয়ার পরিণতিও এমন হতে পারত। মূলত একারনেই প্রত্যয় তুয়ার আবেগকে সাপোর্ট করেনি। তুয়ার কথাতে কষ্ট পেলেও ভুল পদক্ষেপ নিতে দেয়নি। অপরিপক্ব বয়সে বিয়ে আর গর্ভধারণ দু’টো এক নয়। বিয়েটা সামলে নিলেও অপরিপক্ব বয়সে গর্ভধারণ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তার সঠিক উদাহরণ পলক।
তুয়া মারা গেলে প্রত্যয় কি করত? তুয়াকে ছাড়া প্রত্যয় থাকতে পারত? প্রত্যয়কে ছাড়া সে বা কিভাবে থাকত? এসব ভাবনা তুয়াকে কষ্টে জর্জরিত করে দিচ্ছে। তুয়া আবারও ভাবছে, ‘ অপরিপক্ব বয়সে অহরহ মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে, বাচ্চা হচ্ছে। তারা তো দিব্যি সুস্থভাবে বেঁচে আছে। পলকের সঙ্গেও এমনটা না হলেও পারত। কিন্তু তা তো হলো না।’ এখানে আবার প্রমান হলো সবার ভাগ্য এক নয়। নিরাপদ পথের যাত্রাকালে সবাই বিনাবিঘ্নে চলে যায়। কিন্তু সহজ সরল মানুষটা সেখানে মুখ থুবকে পরে। আর নয়তো কোনো একটা বিপদের সম্মুখীন হয়। এজন্য কারো ভাগ্যের সঙ্গে কারো ভাগ্যের মিল খুঁজতে নেই। কারন কারো জীবনের পরিসীমা এক নয়। আর এটা তিতা হলেও আরেকটা বাস্তবিক সত্য।

প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখ মুছে শান্ত কন্ঠে বলল,” প্রিয় মানুষটাকে দাফন করার কষ্ট সেই বোঝে, সে করে। উহুম, কেঁদো না দোয়া করো। আল্লাহ যেন রনিতকে ধৈর্য্য ধারণের তৌফিক দান করে।” তুয়া হেঁচকি তুলে কেঁদে বলল,”ভাইয়ার কষ্টটা চোখে দেখা যাচ্ছে না। এমনটা তো না হলেও পারতো?” প্রত্যয় প্রত্যুত্তরে বলল,”এটা হচ্ছে বাস্তবতা নিষ্ঠুর কড়াঘাত। আর এটা আমর সবাই মানতে বাধ্য।”
একটুপরে, প্রত্যয় তুয়া রনিতকে বুঝিয়ে বাসায় নিয়ে গেল। বাসায় ফেরার সময় রনিত বার বার পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। ওর মনে হচ্ছিল পলক ওকে ডাকছে। কিন্তু পলকের ডাক শুনতে পেলো না। প্রত্যয় রনিতের বাসায় নিয়ে গিয়ে যতটুকু সম্ভব বুঝাল। রাত এগারোটার দিকে রনিতের খেয়াল রাখতে বলে, প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে বাসার পথে রওনা দিল। দাফনের কাজ শেষ করে প্রিয়মরা চলে গেছে। শুধু প্রত্যয় আর তুয়া ছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রনিতের বাসাটাও আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে গেল।

গাড়িতে, তুয়া প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে বসে আছে। প্রত্যয় এক হাতে তুয়াকে আঁকড়ে ধরে অন্যহাতে ড্রাইভ করছে। তুয়াকে নিশ্চুপ দেখে প্রত্যয় তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,”বাস্তবতা নিয়েই আমাদের জীবন। জন্ম নিলে মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে নিতে হবে। জানো, একটা সময় আমি আমার পেশেন্টের মৃত্যু মানতে পারতাম না। খারাপ লাগত খুব কষ্টও হতো। মনে হতো জাদু করে সবাইকে বাঁচিয়ে দিতে। কিন্তু জন্ম, আর মৃত্যুর জাদুকাঠি তো সৃষ্টিকর্তার হাতে। তাই কষ্ট হলেও মেনে নিতে হতো। ইন্টার্নির সময় প্রথমবার হার্টের অপারেশন করা দেখে, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছিলাম। অথচ, আজকে এই হাত দিয়ে অসংখ্য পেশেন্টের হার্ট অপারেশন করি। এখন হসপিটালে রোজ মৃত্যুর রথ আর আপনজন হারানো আত্মনার্দ শুনি। এখন পেশেন্টের মৃত্যুর আগ মূহুর্তের ছটফটানি দেখেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আজকে সকালেও আমার একটা পেশেন্ট মারা গেল। মারা যাওয়ার সময় আমার হাতের মুঠোয় ওর হাত ছিল। ছেলেটা মারা যাচ্ছে দেখে আয়াতুল কুরসি পড়ে ওকে ফুঁ দিলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। আম্মু একদিন বলেছিল, তুমি ডক্টর হওয়ার আগে একজন মানুষ। যখন কেউ তোমার সামনে মারা যাবে, তখন আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিবা। তাহলে তার মৃত্যুটা সহজ হবে।’ আম্মুর কথাটা শুনে আমি ঠিক তাই করি। আমার এই কাজ দেখে অনেকজন হেসেছে, তবুও কিন্তু আমি আমার কাজ থামায়নি। জানো তুয়া আমার মনে হয়, আজ আমি কারো শেষ সময়ে পাশে থাকলে, আমার মৃত্যুর সময় আমিও কাউকে আমার পাশে পাবো। আর আমরা ডক্টররা কল্পনায় ডুবে নয়। বরং মৃত্যুর মতো কঠিন সত্য দেখে আমাদের দিন কাটে। তবে এর মধ্যেও আরেকটা সত্যি লুকিয়ে আছে, জানো সেটা কি?”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ২৫+২৬+২৭

তুয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে ‘না’ বোধক মাথা নাড়াল। প্রত্যয় মুচকি হেসে একহাত দিয়ে তুয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,”ডক্টরদের মন অনেক শক্ত হয়। তারপরেও প্রিয় মানুষটার ক্ষেত্রে তারাও খুব দূর্বল। কথাটা শুনে তুয়া নিজেকে আর আঁটকাতে পারল না। প্রত্যয়ের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। প্রত্যয় কিছু বলল না শুধু দেখে গেল। সে বুঝল, পলকের মৃত্যু আর রনিতের ভালবাসা দেখে তুয়ার মনে দাগ কেটেছে।
এদিকে, ইচ্ছের আম্মু এ খবর শুনে কান্নাকাটি করছে। ওরা সিলেট পৌঁছোনোর পরে তুয়া থেকে খবরটা শুনল। কিন্তু এতরাতে আর আসতে পারল না।
প্রায় তেরো দিনপর, রনিত ওর অফিসে গেল। কিছুদিন আগে রনিতকে বাইরের দেশে যাওয়ার অফার করা হয়েছিল। কিন্তু পলকের জন্য সে না করেছিল। এই গুমোট পরিবেশ থেকে বের হতে, রনিত বাইরের দেশের যাওয়ার কথাটা জানাল। যদিও অফিস কতৃপক্ষ রনিতের জায়গায় অন্য কারো নাম দিয়েছিল। কিন্তু রনিতের ব্যাপারটা বিশেষ বিবেচনায় ভেবে ওকে সুযোগ দেওয়া হলো। সে যদি এভাবে নিজেকে সামলে নিতে পারে। তাহলে ক্ষতি কি? রনিত অফিস থেকে বের হয়ে, পলকের কবর জিয়ারত করে ওখানে বসে রইল। সে বাড়ির কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলেনা। নিজের মতো চলে, কখন যায়? কখন আসে? কেউ বুঝতেও পারেনা। চারদিন পর রনিত চাকরিসূত্রে জার্মানিতে চলে গেল। আর যাওয়ার আগে ওর বাবাকে ওদের ফ্ল্যাটের জিনিস গুলো এনে, ফ্ল্যাট টা ছেড়ে দিতে বলল। সে চাইলে কাজটা নিজে করতে পারত। কিন্তু পলকছাড়া ওর ফ্ল্যাটে ঢোকার সাহস ওর হয়ে উঠল না।

ব্যস্ত জীবনে যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। চাঁদ আর তুয়া নিজেদের পড়াশোনায় মনে দিয়েছে। এখন ওরা সবাই বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে থাকে। প্রিয়ম দু’টো প্রোগ্রামে সফল হয়েছে। এখন সে আগের তুলনায় গানের অনেক অফারও পাচ্ছে। চাঁদ আর প্রিয়মের সম্পর্কটা আগের তুলনায় একটু পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু প্রিয়মের থাপ্পড়ের কোনো পরিবর্তন আসেনি। চাঁদ উল্টা পাল্টা কিছু করলে বা বললে থাপ্পড় খায়। দুইদিন আগে, ইচ্ছের সাথে প্রত্যয়ের অনেক কথা হয়েছে। সিলেটে গিয়ে ইচ্ছে থাকতে চাচ্ছিল না খুব কান্নাকাটি করছিল। কিন্তু তিনদিনের বেলায় খেলার সাথী পেয়ে মানিয়ে নিয়েছে। তুয়ার আব্বু আম্মু প্রত্যয়দের বাসায় থেকে দুইবার বেড়াতে গিয়ে ছিলেন। উনারা এখন তুরাগের বিয়ের চিন্তা করছেন। তুরাগ আজকাল কেমন হয়ে গেছে। কিছু বললে রেগে যায় অযথা চেঁচামেচি করে। বিয়ের কথা তুললে এড়িয়ে যায়।
তার ঠিক দুইদিন পর, বিকেলের দিকে তুরাগ বাসায় ফিরল। ওর আব্বু আম্মু তখন চা খাচ্ছিলেন। তুরাগ ফোনে কথা বলে রেগে সোফার কুশনটা ছুঁড়ে মেরে বলল,”আম্মু আব্বু দুই দিনের মধ্যে আমি বিয়ে করব, তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করো।” তুরাগের বাবা বললেন,”তাহলে ইলার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।” তুরাগ রাগটা কনট্রোল করে বলল,”ইলা নয়, তোমরা অন্য মেয়ে দেখো। আর দুই দিনের মধ্যে বিয়ে দাও নাহলে আমি বাড়ি ছাড়া হবো। আর ভুলেও ওই মেয়ের নাম মুখে আনবে না।”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৩১+৩২+৩৩