সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৪+৫+৬

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৪+৫+৬
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

“নতুন বিয়া কইরা মাইয়া মাইনষের শরীলের সুয়াদ পাইয়া ঘরে ফিরনের কথা কি মুনে থায়ে না?”
রনিত আর পলক আজকে বাসায় ফিরল। বাসার সবাই ওদের উপরে রেগে আছে৷ রনিতের আম্মু পলকের সাথে একটা কথাও বললেন না। উনি রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন। তখন রনিতের দাদী মন্তব্যটি করলেন। রনিত মাথা নিচু করে চলে গেল। ওর দাদী রাশভারী মানুষ। উনি মজা করা মোটেও পছন্দ করেন না। সে দাঁড়িয়ে থাকলে উনি আরো কথা শুনাতেন। এজন্য রনিত ইচ্ছে করেই ওখান থেকে চলে গেল। পলক ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। ওর এখন রুমে যাওয়া উচিত নাকি ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে কথা শুনা উচিত? কোনটা করলে ওকে আর কেউ বকবে না? শ্বশুরবাড়িতে কি এত ভেবে ধাপ ফেলতে হয়? নিজের বাড়ি হলে এতক্ষণে সে পুরো বাড়ি দাপিয়ে বেড়াতো৷ বিয়ে ব্যাপারটা এত কঠিন কেন? এসব কথা পলকের মাথায় ঘুরছে। পলক অনেক সাহস জুগিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াবে, তখনই দাদী বলে উঠলেন, “ছিঃ! ছিঃ! বাসর ঘর থেইকা কেউ ঘুরতে বাইর হয়? বাপ-মায়ে কিছু শিখায় নাই? নাকি গতর দিয়া ব্যাডা মাইনসেরে বশ করাই শিখাইছে।”

পলকের সঙ্গে এর আগে কেউ এমন ভাষায় কথা বলেনি। পলক মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। দাদী এখন বাবা-মা তুলে কথা বলছেন, বাবা-মাকে তুলে কথা বললে সবারই বুকে গিয়ে বিঁধে।
দাদী পান বানিয়ে মুখে পুরে পলকের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলেন। পলক চোখ মুছে রুমের দিকে পা বাড়াল। রনিত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলল, “কিছু মনে করো না। সবাই রেগে আছে তো, এজন্য এভাবে কথা বলল। একটু সময় দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পলক মলিন হাসি দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। রনিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীরে শার্ট জড়িয়ে বাইরে গেল। রনিতের বড় ভাবি দিশা ফোঁড়ন কেটে বলল, “কি গো রনিত! বউয়ের আঁচল থেকে বের হতে ইচ্ছেই করে না নাকি? এত বউ পাগল হলে কবে থেকে?”
রনিত এক টুকরো পরোটা কেবল মুখ দিতে যাচ্ছিল, তখনই ওর ভাবির কথা শুনে খাওয়া থামিয়ে বলল,‌ “আমিও বড় ভাইয়ের মতোই হয়েছি। দুই ভাই একই পথে না চললে লোকে কি বলবে, বলো?”
রনিতের কথার মানে বুঝে দিশা মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেল।
তুয়া তুরাগের রুমে গিয়ে দেখল তুরাগ ঘুমাচ্ছে। আজকে ছুটির দিন, তাই সে বাসাতেই আছে। তুয়া এসে তুরাগকে খোঁচাচ্ছে, কিন্তু তুরাগের উঠার নাম নেই। তুয়া আদুরে সুরে বলছে, “এই ভাইয়া উঠো না! আমাকে ঘুরতে নিয়ে চলো না! শোনো না ভাইয়া, আজকে আমাকে অনেক গুলো চুড়ি কিনে দিবা।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুয়া এসব বলে যাচ্ছে আর তুরাগ শুধু হুম হুম করছে। আজকে পহেলা বৈশাখ। চারদিকে আনন্দমুখর পরিবেশ। তুয়া তুরাগের সাথে বেড়াতে যেতে চাচ্ছে। বেড়াতে যাবে বলে সে লাল সাদা রংয়ের পোশাক শরীরে জড়িয়ে সুন্দর করে সেজেছে। তুরাগের সাথে না পেরে তুয়া একাই বের হলো। মিতু রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। তুরাগের আম্মু এসে তুরাগকে বকতে লাগলেন। তখন তুরাগ উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বাইক নিয়ে তুয়াকে খুঁজতে গেল।
তুরাগ বিরক্ত হয়ে বলল, “এই তুলার অত্যাচারে আমি পাগল হয়ে যাব। ওর বরটার যে কি হাল হবে, একথা ভাবলে ওই বেচারার জন্য আমারই কষ্ট লাগছে।”
ইচ্ছে আজকে লাল টকটকে ফ্রক পরেছে, দুই পাশে পুতুল ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি করেছে, চোখে কাজল দিয়েছে। সে তুয়ার সাথে বেড়াতে যাবে, কিন্তু এসে শুনল তুরাগ-তুয়া কেউ নেই। ইচ্ছে ঠোঁট ফুলিয়ে বাসায় চলে গেল। বাসায় গিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে, “আমি বেলাতে দাবো। আমালে তেউ নিয়ে দাও।”
মেয়ের চিৎকারে ইচ্ছের আম্মুর মন চাচ্ছে ওর পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিতে। উনার জ্বর এসেছে তাই শুয়েছিলেন। ওর বাবাও নেই, অফিসের কাজে ঢাকা গেছেন। ওর আম্মু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আমি যেতে পারব না। তোর যার সাথে ইচ্ছে তুই যা।”
ইচ্ছে ছোট ছোট হাতে চোখ মুছে বলল, “আততা।” কথাটা বলেই ইচ্ছে দৌড়ে এসে হাত দিয়ে প্রত্যয়ের ফ্ল্যাটের দরজা ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে, “দলজা খোলো। তালাতালি দলজা খোলো।”
প্রত্যয়ের আম্মু দরজা খুলে ইচ্ছেকে দেখে মুচকি হাসলেন। ইচ্ছে তাড়াহুড়ো করে বাসায় ঢুকে প্রত্যয়ের আম্মুকে বলল,”আমাল প্রত্তুয় কই?”
প্রত্যয়ের আম্মু বললেন, “রুমে ঘুমাচ্ছে।”

ইচ্ছে দৌড়ে চলে গেল প্রত্যয়ের রুমে। প্রত্যয় দুই ঘন্টা হলো ঘুমিয়েছে। ইচ্ছা প্রত্যয়ের হাত ধরে টেনে উঠালো। প্রত্যয় ইচ্ছেকে দেখে মুচকি হেসে বলল, “কি হয়েছে রাজকন্যা? তুমি কাঁদছ কেন?”
ইচ্ছে মন খারাপ করে বলল, “তোমাল সাতে বেলাতে দাবো। টুয়া আপু আমাকে নিয়ে দাই নি। ওলা সবাই পঁতা।” কথাটা বলে সে প্রত্যয়ের হাত ধরে টানতে লাগল। এই কয়েকদিনে ইচ্ছের প্রতি প্রত্যয়ের মায়া হয়ে গেছে। ওর আদুরে কথা গুলো তাঁর খুব ভালো লাগে। ইচ্ছের জোরাজুরিতে প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে একটা ব্লু শার্ট আর জিন্স পরে রেডি হলো। ইচ্ছে মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ভালো জামা পলো।”
প্রত্যয় হেসে বলল, “এটাই তো ভালো জামা ইচ্ছেমণি।”
ইচ্ছে মানতে নারাজ। সে কিছুতেই প্রত্যয়ের ড্রেস পছন্দ করছে না। প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে ওর সব ড্রেস দেখাল। ইচ্ছে মাথা নাড়াল, যার মানে একটাও ভালো না। প্রত্যয় বলল, “তাহলে তুমিই বলো আমি কেমন ড্রেস পরব?”
ইচ্ছে ডানে বামে কাত হয়ে বলল, “এপাশে কাতা ওপাশে কাতা। ওই জামা পলো।”
প্রত্যয় বুঝল ইচ্ছে কোন ড্রেসের কথা বলছে। প্রত্যয় হেসে ওর সব পাঞ্জাবী গুলো বের করে ইচ্ছেকে বলল, “তুমি পছন্দ করে দাও আমি কোনটা পরব?”
ইচ্ছে কিছুক্ষণ গবেষণা করে হালকা সবুজ রংয়ের একটা পাঞ্জাবী দেখিয়ে বলল, “এতা পলো।”
প্রত্যয় হেসে ড্রেস বদলে সবুজ পাঞ্জাবী আর সাদা চুরিদার পরে আসলো। ছোট বাচ্চাদের আবদার গুলোকে গুরুত্ব দিতে হয়। প্রত্যয়ের ছোট বোন নেই। এজন্য এসব আবদার করার মানুষও ছিল না। আজকে ইচ্ছে যখন এমন আবদার করল তখন সে ফেলতে পারল না। এক কথায়, সে বাচ্চাদের খুব পছন্দ করে। প্রত্যয় রেডি হয়ে ইচ্ছেকে নিয়ে বের হলো। প্রিয়ম ইচ্ছেকে দেখে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “খুব পঁচা লাগছে।”

ইচ্ছে ঘাড় কাত করে প্রিয়মের দিকে এমন ভাবে তাকাল, যেন সে চোখ দিয়ে ওকে গিলে খাব। ইচ্ছের তাকানো দেখে প্রত্যয় সহ ওর আব্বু-আম্মু হেসে উঠলেন। প্রিয়ম বলল,”ভাইয়া, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।”
ইচ্ছে তখন চিৎকার করে বলল, “না, তুমি প্যালা।”
কথাটা বলে সে প্রত্যয়ের হাত ধরে টানতে লাগল। প্রত্যয় ওদের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রিয়ম আপেলে কামড় বসিয়ে ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু, এই পিচ্চিটাকে দেখে আমার বিয়ে করার স্বাদ মিটে গেছে। আমারও যদি এমন মেয়ে হয়, তাহলে আমার জীবনের অবস্থা দফারফ হয়ে যাবে।”
ছেলের কথা শুনে ওর আম্মু শব্দ করে হাসলেন। প্রত্যয় যাওয়ার আগে ইচ্ছের আম্মুকে বলে গেল। যাতে উনি ইচ্ছেকে না খুঁজেন। প্রত্যয়ের আঙ্গুল ধরে ইচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে, যার ফলে ওর ঝুঁটি দু’টো দুলছে। প্রত্যয় হাসি মুখে ইচ্ছের সাথে কথা বলতে বলতে রিকশায় উঠে বসল। তাঁরা আজকে সারাদিন ঘুরবে।
তুরাগ অনেক কষ্টে তুয়াকে খুঁজে পেয়েছে। মিতু আর তুয়া মিলে তুরাগকে জ্বালিয়ে মারছে। তুরাগ মনে মনে বলল,”এসব মেলাতে মেয়েদের নিয়ে পাগলেরা আসে।” তুয়া আর মিতু মিলে অনেক কেনাকাটা করল, খাওয়ার কথা নাহয় বাদই দিলাম। মেলাতে এসে না খেলে কি হয়? তিনজনে মিলে ফুচকা খাচ্ছিল, তখন তুরাগের এক বন্ধু এসে বলল, “মাম্মা আমরা একটা পাখি খুঁজে পাচ্ছি না। আর তুই দু’টো পাখি নিয়ে ঘুরছিস?”

তুরাগের বন্ধুর কথা শুনে তিনজনে খাওয়া থামিয়ে দিল। তুরাগের সেই বন্ধু দাঁত বের করে হাসছে। মিতু আর তুয়া দু’জনে মাথা নিচু করে নিলো। তুরাগ মুখ কাচুমাচু করে আছে। তুরাগের বন্ধু আবার বলল, “দু’টোই কিন্তু নজর কাড়া, আমাকে একটা ধার দে।”
তুরাগ উঠে ওর বন্ধুর কলার চেপে ধরল। তুয়া আর মিতু দু’জনেই দাঁড়িয়ে গেল। তুরাগ রেগে বলল, “ওরা আমার বোন হয়। মনমানসিকতা ঠিক করে মুখে লাগাম দিয়ে কথা বল। এখানে শুধু কপোত-কপোতীরা আসে না। কোনো ভাই তাঁদের বোনদের নিয়েও আসে। পাঁচ মিনিট আগেও তুই আমার বন্ধু ছিলি বলে ছেড়ে দিলাম। নয়তো তোকে মেরে এখানেই পুঁতে দিতাম।”
কথাটা বলে তুরাগ তুয়া আর মিতুকে নিয়ে চলে গেল। ওর বন্ধু জানতো না এরা তুরাগের বোন। তুরাগ কখনো বাসায় বন্ধুদের আনতো না। এজন্য ওর বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই জানে না তুরাগের বোন আছে। তুরাগের সাথে দু’টো মেয়ে দেখে সে মজা নিতে এসেছিল। সে একবারও ভাবেনি মেয়ে দু’টো ওর বোন হতে পারে। এজন্য যতই কাছের বন্ধু হোক, যখন তখন এসব মজা করা ঠিক না।
রনিত পলকের জন্য মেলা গিয়ে বাসার সবার জন্য খাবার এনেছে। পলককে নিয়ে তো সে মেলাতে যেতে পারব না। বাসায় অনেকে এটা নিয়ে কথা শুনাবে। তাই রনিত পছন্দ করে পলকের জন্য সাদা আর লাল চুড়ি এনেছে। কিন্তু দুঃভাগ্য বশত চুড়ি গুলো দিশার চোখে পড়ে গেল। সে ন্যাকা কান্না করে ওর বরকে বলল, “রনিত মেলা থেকে ওর বউকে চুড়ি এনে দিয়েছে। তুমি কেন দিলে না?”
এসব কথা নিয়ে দু’জনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল। একপর্যায়ে বাসার সবাই জেনে গেল রনিত বউয়ের জন্য চুড়ি এনেছে। রনিতের দাদী রেগে রনিতকে বললেন, “বাইতে তো দুইডা বউ, একজনের লাইগা চুড়ি আনছোস ক্যান? তোর বউ কি মানা করছে দিশার লাইগ্যা চুড়ি আনতে? মাইয়া তো দেহি বহুত সেয়ানা।”

রনিত দাদীর দিকে তাকাল। কিছু একটা হলেই দিশা ব্যাপাটাকে তিল থেকে তাল করে। তারপর সব দোষ গিয়ে চাপে পলকের ঘাড়ে। পলক রান্নাঘরে রান্না করছে আর চোখ মুছছে। সামান্য চুড়ির জন্য এত কিছু হবে জানলে রনিত চুড়িই আনতো না। সে ওর দাদীকে বলল, “নিজের বউকে শখ করে কিছু দিতে পারব না, এই নিয়মের কথা আগে বলো নি কেন? আর আমি অন্যের বউয়ের শখ আহ্লাদ মিটাতে যাবই বা কেন?”
রনিতের কথা শুনে ওর দাদী রেগে গেলেন। রনিত উনাকে কিছু বলতে না দিয়ে পলককে বলল, “আমার শার্ট আইরণ করে দাও এক্ষুনি। এক্ষুনি মানে এক্ষুনিই।”
কথাটা বলে রনিত চলে গেল। দিশা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে রুমে বসে কাঁদছে। রনিতের বড় ভাই রেগে বাইরে চলে গেল। মাত্র আশি টাকার চুড়ির জন্য এত অশান্তি হলো। পলক হাত মুছে রুমে চলে গেল। যদিও রনিতের সব শার্ট আইরণ করাই আছে। দাদীর হাত থেকে বাঁচাতে সে কৌশলে পলককে ডেকে নিলো।
প্রত্যয় আর ইচ্ছে একটা গাছের নিচে বসে হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে। প্রত্যয় ইচ্ছেকে হাত ভর্তি চুড়ি, মাটির পুতুল, খেলনা বাটি কিনে দিয়েছে। ইচ্ছের খুশি যেন আর ধরে না। সে হাত নাড়িয়ে চুড়িতে শব্দ করে খিলখিল করে হাসছে। ইচ্ছে হাসতে হাসতে সামনে তাকিয়ে দেখল তুয়া আর তুরাগ। সে দৌড়ে ওদের কাছে গিয়ে ওদের ডেকে আনল। তুরাগ এসে প্রত্যয়ের সাথে কথা বলল। ইচ্ছে তুয়ার হাত আর ওর হাত প্রত্যয়ের দিকে বাড়িয়ে বলল, “প্রত্তুয় দেকো তো কাল চুলি বেশি সুন্দল? আমাল নাকি টুয়া আপুল?
প্রত্যয় দু’জনের হাতের দিকে তাকাল। ইচ্ছের হাতে লাল-নীল চুড়ি আর তুয়ার হাতে লাল-সাদা চুড়ি। প্রত্যয় একবার তুয়ার দিকে তাকাল হেসে বলল, “ইচ্ছেমণির চুড়ি গুলো খুব সুন্দর। তোমার তুয়া আপুর গুলো পঁচা।”

ইচ্ছে বিশ্বজয় করা হাসি দিল। তুয়া নাক ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকাল। তুয়ার মুখটা দেখে প্রত্যয় মিটিমিটি হাসছে। তুয়া বাজখাঁই গলাতে তুরাগকে বলল, “ভাইয়া, আমাকে কি চুড়ি পছন্দ করে দিলে? আমাকে আবার চুড়ি কিনে দাও এক্ষুণি।”
তুরাগ করুণ চোখে তুয়ার দিকে তাকাল। তুয়া অলরেডি ওর পকেট ফাঁকা করে দিয়েছে। তুরাগ জানাল ওর পায়ে ঝি ঝি লাগছে সে হাঁটতে পারবে না। তুয়া ছলছল চোখে তুরাগের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয় দুই-ভাই বোনের ঝগড়া দেখছে। তুয়া আড়চোখে একবার ইচ্ছের চুড়ির দিকে তাকাচ্ছে, একবার ওর চুড়ির দিকে। তুয়া কান্নামিশ্রিত গলায় তুরাগকে বলল, “ভাইয়া চলো। আমি আরো চুড়ি কিনব।”
তুরাগ বোনের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয় বলল, “ভাইয়া যখন হাঁটতে পারছে না, তুমি চাইলে আমি যেতে পারি।”
তুরাগও প্রত্যয়ের সাথে তুয়াকে পাঠাল। তুরাগ ইচ্ছে আর মিতুকে নিয়ে গাছের নিচে বসল। প্রত্যয় তুয়াকে চুড়ির দোকানে নিয়ে গেল। এত গুলো চুড়ি দেখে তুয়ার চোখ ধাধিয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না কোনটা নিবে। প্রত্যয় এক মুঠো নীল চুড়ি তুয়ার দিকে এগিয়ে দিল। তুয়ার এক পলকে চুড়ি গুলো পছন্দ হয়ে গেল। সে প্রত্যয়ের হাত থেকে চুড়ি গুলো ছিনিয়ে নিলো। প্রত্যয় বলল, “সব ড্রেসের সঙ্গে কাঁচের চুড়ি মানানসই নয়। অন্য চুড়ি নাও।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয়ের কথামতো তুয়া অন্য চুড়িও নিলো। তুয়ার মুখে তখন মিষ্টি হাসি। প্রত্যয় মিতুর জন্যও চুড়ি নিতে বলল। শুধু ইচ্ছে আর তুয়াকে চুড়ি দিলে ওর কাছে ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা লাগছিল। এজন্য সে তিনজনকেই চুড়ি কিনে দিল। ওর বোন অথবা কোনো মনের মানুষ নেই। যার কারণে এমন করে সে কাউকে কখনও চুড়ি কিনে দিতে পারেনি। তাই সুযোগ পেয়ে শখ টা পূরণ করল।
তুয়া প্রত্যয়ের এমন কাজে সত্যিই খুব খুশি হলো। ওরা চুড়ি কিনতে আসার সময় তুরাগ প্রত্যয়কে টাকা দিতে চাইছিল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলেছিল, “ভালবেসে কিছু দিতে চাইলে সেখানে টাকার হিসাব আনতে নেই।”
তুরাগ আর কিছু বলেনি, মাথা নাড়িয়ে শুধু হেসেছে। প্রত্যয় আর তুয়া চুড়ি কিনে আবার সেই গাছের নিচে গেল। প্রত্যয় মিতুকে চুড়িগুলো দিল। মিতু প্রথমে না করলেও পরেরবার আর কিছু বলেনি। কারণ সে প্রত্যয়ের যুক্তির কাছে হেরে গেছে। প্রিয়মও এসে ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সে এখন ইচ্ছেকে পঁচাচ্ছে আর ইচ্ছে রেগে যাচ্ছে। প্রত্যয়কে দেখে ইচ্ছে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “প্রত্তুয় প্রিউুম আবাল আমাতে প্যালা বলছে। তুমি ওলে বকুনি দাও।”
প্রত্যয় রাগি ভাবে প্রিয়মকে বকা দেওয়ার অভিনয় করল। প্রিয়ম ভয় পাওয়ার মতো করে মাথা নিচু করে নিলো। ইচ্ছে তখন দাঁত বের করে হাসল। ওর হাসি দেখে সবাই হেসে দিল। সবাই মিলে আরো কিছুক্ষণ ঘুরল, খেলো, মজা করল। প্রিয়ম তুয়ার পাশাপাশি হেঁটে বিরবির করে বলল, “ওই টুপা, এমন পেত্নী সেজেছ কেন? ছিহ্! একদম পঁচা দেখাচ্ছে।”
তুয়া রাগী চোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রিয়ম দ্রুত পায়ে হেঁটে সামনে চলে গেল। তুয়া বিরবির করে বলল, “খাটাশ একটা।” সেদিনের বাইকের বাজিটা প্রিয়ম ইচ্ছে করেই ধরেনি। বরং ওর ত্যাড়া কথা দিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছিল। প্রিয়ম জানতো তুয়া বাইক ড্রাইভ করতে পারে। আর ওর প্রতি রাগের বশে সে হাই স্প্রিডে বাইক ড্রাইভও করতো। সে প্রিয়মকে হারানোর জন্য উঠে পড়ে লাগত। কারণ রাগের বশে আমাদের মাথায় জেতার চিন্তাটা বেশি ঘুরপাক খায়। এই রাগটাই তুয়ার জন্য মারাত্মক রিস্কি হয়ে যেত। এজন্য সে বুদ্ধি করে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজেকে পিছিয়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। প্রিয়মও ঠিক তাই করেছে।

অনেকটা ঘুরাঘুরি করে ওরা যে যার বাসায় ফিরল। প্রত্যয়ের কোলে ইচ্ছে ঘুমিয়ে গেছে। এজন্য সে ওর রুমেই ইচ্ছেকে শুইয়ে দিল। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে বসতেই ওর আম্মু বললেন, “আব্বু! তোর কোলে ইচ্ছেকে দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিয়ে করে এমন একটা পুতুল আমাদের উপহার দিলেও তো পারিস।”
প্রত্যয় কিছু বলল না, সে চুপ করে কফি খাচ্ছে। প্রিয়ম সোফাতে বসে কমলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “বাসাটা তাহলে পাগলা গারদে পরিণত হবে। সে সবাইকে পাগল করে দিবে।”
ওর আম্মু প্রিয়মের পিঠে থাবড় দিয়ে বললেন, “চুপ কর ফাজিল। তুই না হয়ে আমার একটা মেয়ে হলে কত্ত ভালো হতো।”
প্রিয়ম কমলার তিনটে কোয়া একেবারে মুখে ডুকিয়ে বলল, “কাকে দেখাব মনের দুঃখ গো, আমি বুক চিরিয়া। অন্তরে জ্বলে যে আগুন মায়ের কথা শুনিয়া।”
প্রিয়মের গান শুনে প্রত্যয়ও হেসে দিল। ওর আম্মুও হাসছেন। তখন ওদের আব্বু রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “দুই ছেলের একই দিনে বিয়ে দিব। তারপর নাতি-নাতনি দিয়ে পুরো বাসাটা জান্নাতের বাগানে পরিণত করব। তুমি একদম চিন্তা করো না।”
ওরা সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। সম্পর্কগুলো মধুর, এজন্য সবার সাথে সবাই খুব ফ্রি। ওই দিকে কলি ওর বুলি আওড়াচ্ছে, “দুষ্ট! দুষ্টু! দুষ্টু।”
প্রত্যয় উঠে বেলকনিতে গিয়ে কলিকে সালাম দিল। কলি অস্পষ্ট ভাবে উত্তর দিলো। কলি প্রত্যয়কে বলল,”কেমন আছো? কেমন আছো? কেমন আছো?”
প্রত্যয় হেসে বলল,” আলহামদুলিল্লাহ।”
পাশের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তুয়া আর তুরাগ এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিল। তুয়া অবাক চোখে পাখিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তুরাগ বলল, “প্রত্যয়, পাখিটা কোথা থেকে এনেছ? খুব সুন্দর করে কথা বলে।”
প্রত্যয় কলিকে খাবার দিতে দিতে তুরাগের দিকে তাকিয়ে বলল, “কলিকে খাগড়াছড়ি থেকে এনেছিলাম।”
তুয়া ফট করে বলে উঠল, “ভাইয়া, আমাকেও একটা এনে দাও, প্লিজ।”

তুরাগ মাথা নাড়াল, যার মানে সে এনে দিবে। হঠাৎ চিৎকার চেচাঁমেচিতে ওরা তিনজনে আঁতকে উঠল। তিন তলা থেকে খুব চেচাঁমেচির আওয়াজ হচ্ছে। সবকিছু আছড়ে ফেলার শব্দ ভেসে আসছে৷ দোতলার সবাই তিন তলাতে ছুটে গেল। তিনতলাতে একজন কাপুরুষ তাঁর বউকে মারছে। আর মারের কারণ তাঁর ভাতের প্লেটে সে চুল পেয়েছে। সবাই উনাকে ধরছে তবুও উনি তেড়ে তেড়ে মারতে যাচ্ছে। এর সাথে অকথ্য ভাষাতে গালাগাল তো আছেই। উনার এমন চেচাঁমেচিতে ওখানে আরো অনেকে উপস্থিত হলো।
হঠাৎ করে তুয়া ওখানেই গলগল করে বমি করে দিল। ওর বমি করা দেখে প্রিয়ম, প্রত্যয় আর তুরাগ তিনজনে ওর কাছে ছুটে গেল। প্রত্যয় দ্রুত গিয়ে তুয়ার কপালের দুপাশ চেপে ধরল। তুরাগ তুয়াকে ধরে বলল, “কি রে, কি হলো তোর? হঠাৎ বমি করছিস কেন?”
প্রিয়ম বলল,” ওখানে কিছু দেখে ছিলে?” কথাটা বলে প্রিয়ম রুমের এক কোণে তাকাল। প্রিয়মের তাকানো দেখে প্রত্যয় আর তুরাগও সেদিকে তাকাল। তিনজনে ওইদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল। তুরাগ তুয়াকে ছেড়ে উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরল। সে এখন বোনের সামনে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। প্রিয়ম প্রত্যয়ের সামনে লজ্জা পেয়ে সেও সিঁড়ির কাছে চলে গেল। তুয়া আড়চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে নিজেই উঠে দৌড় দিল। তুয়ার বমি করাতে চেচাঁমেচি থেমে গিয়ে সবাই রুমের ওই কোণে তাকিয়েছে। প্রত্যয় বাবা-মায়ের সামনে লজ্জা পেয়ে সেও হাঁটা ধরল। বড়রা একে অপরের সামনে লজ্জা পেয়ে ছিটকে সরে গেল।

এদিকে প্রিয়ম যেতে যেতে সিঁড়ি উপরে বমি করে দিল। তুয়া প্রিয়মের বমি দেখে আরেক দফা বমি করে দিল। প্রত্যয় কাকে ধরবে বুঝতে পারছে না। তুয়া আর প্রিয়মকে আবার বমি করা দেখে বড়রা ছুটে আসলো। প্রিয়মের আম্মু প্রিয়মকে আর তুয়ার আম্মু তুয়াকে নিয়ে গেল। বড়রাও ছোটদের সামনে কম লজ্জায় পড়ে নি। কারণ রুমের কোণে ব্যবহারিত প্রোটেকশন পড়েছিল। আর এমন নোংরা অবস্থায় ছিটকে পড়ে ছিল, যা যে কেউ দেখলেই বমি করে দিতো। এরা যে এত নোংরা কে জানত? আর প্রিয়ম এমনিতেই নোংরা কিছু সহ্য করতে পারে না। আচানক ভাবে এমন কিছু দেখায় সেও বমি কনট্রোল করতে পারল না। তবে কেউ কেউ ওই ভদ্র লোককে কিছু কথা শুনিয়েই ছাড়ল। আর এটাও জানিয়েছে, এখানে ভদ্র লোকেরা বসবাস করে। এখানে বউ পেটানো চলবে না।
তুয়া রুমে গিয়ে বিরবির করে বলল, “মানুষ এত নোংরা কিভাবে হয়? ছিঃ! এদের ঘরে কি আদৌ রহমতের ফেরেশতা ঢুকে? এদের বাসায় কি আল্লাহর রহমত নাযিল হয়? বস্তির মানুষও তো এত নোংরা হয় না।”
তুয়ার বমি করতে করতে পেট আর গলা ব্যথা হয়ে গেছে। সে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “আমার দেহে প্রাণ থাকা অবধি আর কোনদিনও কারো ঝগড়া দেখতে যাব না। আল্লাহ এবারের মতো মাফ করো তুমি।”
প্রায় চারদিন কেটে গেল তুয়া প্রিয়ম আর প্রত্যয়ের সামনে ভুলেও যায়নি। তুরাগও বোন দেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন বিশ্রী একটা ঘটনা ঘটবে কে জানত। প্রত্যয় একজন ডক্টর। সে এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে।
ইচ্ছের বাবা বাসায় এসেছে। এজন্য ইচ্ছে দুইদিন হলো দোতলাতে তেমন আসে না৷ প্রিয়ম বাইক নিয়ে বের হবে, তখন দেখল ইচ্ছে ওর বাবা কোলে। প্রিয়মকে দেখে ইচ্ছে বলল,”প্রিউুম প্যালা।”

ওর আব্বু মেয়েকে বললেন, “মা বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে নেই। প্রিয়ম তো চাচ্চু হয়।”
ইচ্ছে একবার প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভালুপাশার মানুষকে নাম ধলে ডাকতে হয়৷ তুমি এতা জানো না, পাপা?”
মেয়ের কথা শুনে উনি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এ কথাটা শুনে প্রিয়ম শব্দ করে হেসে উঠল। ইচ্ছেকে ওর আব্বু তুয়াদের বাসায় যেতে বলছেন। কিন্তু ইচ্ছে কিছুতেই যাবে না। ইচ্ছের আম্মুর জ্বরটা বেড়েছে। এজন্য উনাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে হবে। প্রিয়ম একথা শুনে বলল,”ইচ্ছেমণি, আমি এখন ঘুরতে যাচ্ছি। তুমি কি আমার সাথে যাবে? তুমি আমার সাথে আসলে আমরা আজকে অনেক ঘুরব।”
ইচ্ছে ওর আব্বুর দিকে তাকাল। ওর আব্বু ইচ্ছেকে যেতে বলল। ইচ্ছে প্রিয়মের কাছে যাওয়ার জন্য হাত বাড়াল। প্রিয়ম ইচ্ছেকে বাইকের সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি বাইক চালাবে আর আমি বসে থাকব।”
ইচ্ছে আদুরে সুরে বলল, “আমি পালি না তো।”
প্রিয়ম হেসে ইচ্ছের হাত দু’টো ওর হাতের নিচে রাখল। তারপর দু’টো তে ছুটল উড়াল পাখির মতো মুক্ত বাতাসে ঘুরতে। ইচ্ছে খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল,”থানকু প্রিউুম।”
প্রিয়ম হেসে বলল,”ওয়েলকাম ইচ্ছেমণি।”
প্রত্যয় সকালে যাওয়ার সময় বলে দিয়েছে আজকে সে সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকবে। প্রত্যয়ের আম্মু বাসায় একা, এজন্য উনি তুয়াতের বাসায় গেলেন। তুয়ার আম্মু তখন তুয়াকে বকছিলেন। তুয়া ঠোঁট উল্টে চেয়ারে বসে পরোটা আর ভাজির দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। তুয়ার আম্মু লাল শাক কাটতে কাটতে প্রত্যয়ের আম্মুকে বললেন,” ভাবি বসেন! আর বলবেন না, এই মেয়েটা আমার জান জীবন শেষ করে দিল। এর অত্যাচার আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আল্লাহর ত্রিশটা দিন সে খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করে।”
প্রত্যয়ের আম্মু ওনার অভিযোগ শুনে হাসল।
আজকে প্রত্যয়ের কাছে অনেক পেশেন্টের ভীড় জমেছে। সে দম ফেলার সময়টুকুও পাচ্ছে না। তিন দিনের একটা বাচ্চার হার্টের সমস্যার জন্য ওর কাছে এনেছে। এই বাচ্চাটার হার্টে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। বাচ্চাটাকে দেখে প্রত্যয়ের খুব কষ্ট লাগল। এই বাবুটার সার্জারি করলে সে বাঁচবে না। সার্জারির ধকল ওর ছোট্ট প্রাণটা সহ্য করতে পারবে না। একথা প্রত্যয় বাচ্চার বাবা-মাকে আকার ইঙ্গিতে বোঝাল। কিছু কিছু কথা সরাসরি বলতে নেই। বাচ্চার মা কেঁদে কেঁদে বললেন, “স্যার আমার বাবুটা বাঁচবে তো? ওর সার্জারি কি করাই লাগবে?”

“দেখুন, হার্ট সার্জারি ছোট কোনো ব্যাপার নয়। তিনদিনের বাচ্চার জন্য এটা রিস্কি হয়ে যাবে। আল্লাহ ভরসা! আমি চিকিৎসার প্রথম ধাপ শুরু করি। কোনো পরিবর্তন না হলে পরে নাহয় সার্জারির কথা ভাববেন।”
“আচ্ছা।”
বাচ্চাটি কি সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে, সে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আসা মাত্রই কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে গেল। প্রত্যয় আল্লাহর উপর ভরসা করে বাচ্চাটার চিকিৎসা শুরু করল। আপাতত মেডিসিন দিয়ে দেখবে কাজ হচ্ছে কিনা। তারপর পরের ধাপ সে ভেবে চিন্তে নিবে। একের পর এক পেশেন্ট আসতেই আছে। এর মধ্যে প্রত্যয়কে দুইবার উঠতে হয়েছে। কারণ একজন সার্জারির পেশেন্টের হঠাৎ করে বুকে ব্যথা উঠেছিল।
পলক আজকে রান্না করতে গিয়ে তরকারি পুড়িয়ে ফেলেছে। এজন্য বাসায় আবার অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। পলক ইচ্ছে করে নি, একথাটা সে ভয়ে বলতেও পারছে না। রনিত বাসায় নেই, অফিসে গেছে। রনিতের দাদী আর মা মিলে পলককে কথা দিয়ে গিলে খাচ্ছে। পলক মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। সে গোসলে যাওয়ার আগে দিশাকে বলে গিয়েছিল, “ভাবি, চুলার উপরে তরকারি আছে। আপনি একটু দেখলে, আমি গোসলে যেতাম।”
“আচ্ছা যাও।”
দিশা পলককে যেতে বলেছে ঠিকই, কিন্তু সে তরকারি দেখেনি। পলক যখন এসে দেখল ততক্ষণে তরকারি পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। তখন দিশা এসে চিৎকার করে সবাইকে জানাল পলক ইচ্ছে করে এটা করেছে৷ কারণ সে চায় না দুপুরে কেউ ভাত খাক। একথা শুনে দাদী আর শাশুড়ি মিলে ওকে বকতে লাগল।

সন্ধ্যার পরে প্রিয়ম বান্দরবানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। ওর বান্দরবানে যাওয়ার কথা সবাই জানত। বছরে দুইবার সে ভবঘুরেদের মতো ঘুরে বেড়ায়। ওর সঙ্গী হিসেবে কাউকে লাগে না। সে একা একাই ইচ্ছেমতো ঘুরতে ভালবাসে। সে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বুদ হতে ভালবাসে। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে আবার নতুন করে বাঁচার ইচ্ছেটুকু সে মনে পোষণ করে। এত সুন্দর পৃথিবী! এত মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য না দেখে ব্যস্ততার যাতাকলে সে পিষ্ট হতে চায় না। এজন্য বছরে দুইবার সে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ায়। রাতের জার্নি সব সময় প্রিয়মের কাছে বেস্ট মনে হয়। প্রিয়মের বাস ছেড়ে দিয়েছে। সে নিজের সিটে হেলান দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে নিল। হঠাৎ দু’চোখের পাতা খুলে বলল, “ফিরে এসে উত্তরটা নিব।” কথাটা বলে প্রিয়ম আবার চোখ বন্ধ করে নিলো। ওর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠছে।
পরের দিন সন্ধ্যা বেলা তুয়া কোচিং থেকে ফিরছিল। হঠাৎ কয়েকজন ছেলে ওর পথ আগলে দাঁড়াল। ছেলে গুলোর মুখে বিশ্রি হাসি। সন্ধ্যার আজান হয়ে গেছে, চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। ছেলে গুলো এসে ওকে ঘিরে ধরেছে। তুয়া ভীতু চোখে আশে পাশে তাকাল, কিন্তু রাস্তাটা ফাঁকা। কোচিং থেকে বের হয়ে ফিরতে ওর দেরী হয়ে যাচ্ছিল। তাঁর মধ্যে একটাও রিকশা খুঁজে পাচ্ছল না। তাই শটকার্ট রাস্তা ধরে হাঁটছিল। ছেলে গুলো তুয়াকে একা দেখে ওকে এতক্ষণ ফলো করছিল। তুয়া ব্যাপারটা বুঝতেও পারেনি। ছেলে গুলো ওর দিকে এগিয়ে আসলো। তুয়ার ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। একটা ছেলে হেসে বলল, “পিছিয়ে আর কতদূর যাবে মামনি? তুমি পিছাতেই থাকো আমরা না হয় তোমার দিকে এগোতে থাকি?”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

তুয়া কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ঢুকল। প্রত্যয়ের আম্মু সহ কয়েকজন ভাবিরা মিলে তুয়াদের দরজার সামনে গল্প করছিলেন। তুয়াকে দেখে সবার কথা বন্ধ হয়ে গেল। তুয়া কাঁদতে কাঁদতে ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরল। তুয়া উচ্চশব্দে কেঁদে কেঁদে বলল, “আম্মু! আম্মু গো! আমার সাথে কেন এমন হলো? তোমার মেয়ে নোংরা হয়ে গেছে, আম্মু।”
তুয়ার আম্মু মেয়ের কথা শুনে থরথর করে কাঁপছেন। ওখানকার উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। তুয়ার ছেঁড়া জামা, কাটা ঠোঁট, এলোমেলো চুল, গলা-হাতে আঁচড়ের দাগ থেকে স্পষ্ট যে ওর সাথে কি ঘটেছে। তুয়ার আম্মু মেয়ের অবস্থা দেখে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তুরাগ কেবল অফিস থেকে বাসায় ফিরল। তুয়ার আম্মু মেয়ের অবস্থা দেখে সেন্সলেস হয়ে গেলেন। সবাই উনাকে ধরে রুমে নিয়ে গেল। তুরাগ বাসায় ঢুকে এত মানুষ দেখে আতংকে উঠল। সে ধীর পায়ে ওর আম্মুর রুমে গেল। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার আম্মুর মুখে পানি ছিটাচ্ছেন, তবুও উনার সেন্স ফিরছে না। তুয়া কাঁদতে কাঁদতে ওর আম্মুর হাতে পায়ে মালিশ করছে। তুরাগ দ্রুত এসে ওর আম্মুকে ডাকতে লাগল। উনার কোনো সাড়াশব্দ নেই। পানি ছিটানো, হাতে-পায়ে মালিশ করার বেশ কিছুক্ষণ পর উনার সেন্স ফিরল। উনি তুয়ার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তুরাগ এবার তুয়ার দিকে খেয়াল করল। তুয়ার অবস্থা দেখে ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বোনকে দেখে ওর কলিজা কেঁপে উঠল। তুয়া কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমে চলে গেল।

এতটুকু সময়ের মধ্যে তুয়ার ধর্ষিত হওয়ার খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। খারাপ খবর নাকি বাতাসের আগে ছড়ায়। এখানে ব্যাপারটা তাই ঘটল। এটা নিয়ে পুরো বিল্ডিং জুড়ে কানাঘুষা চলছে। বিল্ডিংয়ের অনেকে এসে ওদের শান্তণার বাণী দিয়ে যাচ্ছে। কেউ বা আকার ইঙ্গিতে কটু কথা শুনাচ্ছে। কেউ বা তুয়ার বিয়ে নিয়ে আপসোস করছে। তুয়া ওর রুমে বসে উচ্চ শব্দে কাঁদছে। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার আম্মুকে বলছেন, “ভাবি কাঁদবেন না। আপনি ধৈর্য ধরুন। মেয়েটাকে তো আপনাকেই সামলাতে হবে।”
“আমার কপাল পুড়েছে, ভাবি। আমিই জানি আমার কি হচ্ছে। আজকে সবাই আমাকে সান্ত্বনার বাণী শুনাচ্ছে। কাল সবাই আমার মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলবে। তাকে উঠতে বসতে কথা শুনতে হবে। আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করব? আমার মেয়েটার শরীরে যে ধর্ষিতার কালিমা লেগে গেছে। আমার কলিজার টুকরো মেয়েটার এবার কি হবে? আল্লাহ! আল্লাহ গো! আমি কি অপরাধ করেছিলাম? আমাকে কেন এমন বিপদে ফেললে? গো আল্লাহ?”

প্রত্যয়ের আম্মু আর কিছু বললেন না। তুয়ার আম্মু উচ্চশব্দে কাঁদছেন। উনি মা হয়ে মেয়ের এত করুণ অবস্থা কিভাবে সহ্য করবেন? উনার কলিজার টুকরো মেয়েটার লোকচক্ষুর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে? সমাজের লোকদের কটু কথার হাত থেকে মা হয়ে উনি কিভাবে মেয়েকে রক্ষা করবেন? আমাদের সমাজে ধর্ষকের থেকে ধর্ষিতার শাস্তি হয় বেশি। তুয়াও এখন ধর্ষিতা। তার শরীরেরও লেগেছে ধর্ষিতার ট্যাগ। সমাজের মানুষ আদৌও স্বাভাবিক ভাবে ওকে বাঁচতে দিবে তো?
তুরাগ আর ওর বাবা সোফাতে বসে চোখের পানি ফেলছেন। বোনের এত করুণ অবস্থা তুরাগও মানতে পারছে না। বোনের চোখের পানি সে সহ্য করতে পারে না। বোনকে শক্ত করতে হবে, ওকে সাপোর্ট দিতে হবে, ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। আর পাঁচজনের মতো সে বোনকে তিলে তিলে মরতে দিবেনা। সবার মতো সে বোনের দিক থেকে মুখ ফিরাবে না। সে তুয়ার সাপোর্টার হবে। ভাই হয়ে বোনের জন্য সব লড়াই করতে সে সর্বদা প্রস্তুত। এসব ভেবে তুরাগ উঠে তুয়ার রুমে গেল।
তুয়া বন্ধ রুমে ততক্ষণে ওর হাতের রগ কেটে ফেলেছে। তুয়া বিরবির করে বলল,” সরি! আমি খুব সরি।” কথাটা বলে তুয়ার নিভু নিভু চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ওর রক্তে বেডশীট ভিজে গেছে। সে যে ধর্ষিতা নামক অভিশাপ অভিশপ্ত হয়ে গেছে। তুয়া ধর্ষিতার ট্যাগ নিয়ে বাঁচতে চায় না। কারো কটু কথা শোনার শক্তি তার নেই। বাবা-ভাইয়ের মাথা নিচু করাটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। সে সমাজের চোখে খারাপ হয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় অনেকে ওকে দেখে হেসেছে। কেউ বা অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে। তুয়ার নিজের প্রতি ঘৃণা লাগছে, প্রচন্ড ঘৃণা। আর এই ঘৃণা নিয়ে সে বাঁচতে চায় না, কিছুতেই না। এজন্য সে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দু’বারও ভাবল না।

তুরাগ বোনের অবস্থা দেখে দৌড়ে বোনের কাছে গেল। সে তুয়াকে পাগলের মতো ডাকতে লাগল। তুরাগের চিৎকারে সবাই তুয়ার রুমে দৌড়ে এলো। তুয়ার হাত থেকে অনবরত রক্ত পড়েই যাচ্ছে। তুরাগ ওর রুমাল দিয়ে তুয়ার হাতটা বেঁধে নিল। তুয়ার অবস্থা দেখে সবার চোখে পানি। তুয়ার আম্মুর আহাজারি কান্নাতে বাসাটা থমকে গেছে।
তুরাগ দেরী না করে দ্রুত তুয়াকে নিয়ে হসপিটালে ছুটল। প্রত্যয়ের আম্মু তুরাগকে প্রত্যয়ের হসপিটালে যেতে বললেন। উনি বার বার প্রত্যয়কে ফোন করছেন। কিন্তু প্রত্যয়ের ফোন সুইচ অফ বলছে। প্রত্যয়ের আম্মু জামিলকে ফোন দিলেন। জামিল হলো প্রত্যয়ের সহকারী। জামিল ফোন ধরে জানাল, প্রত্যয় অন্য হসপিটালে সার্জারি করতে গেছে। তাকে তিন থেকে চার ঘন্টার আগে পাওয়া যাবে না। প্রত্যয়ের আম্মু প্রত্যয়কে না পেয়ে নিজেই হসপিটালে আসলেন। উনাকে এখানকার সবাই চিনে। কারণ উনি এই হসপিটালের মালকিন। প্রত্যয়ের আম্মু দ্রুত তুয়ার বেস্ট চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বললেন। কয়েকজন ডাক্তার তুয়াকে নিয়ে দ্রুত ওটিতে ঢুকে গেল। তুয়ার আব্বু-আম্মু আর তুরাগ ওটির সামনে বসে চোখের পানি ফেলতে থাকল।
প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার আম্মুকে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছেন না। উনিও চুপ করে বসে চোখের পানি ফেলছেন। তুয়ার প্রতি উনার মায়া জন্মে গেছে। তুয়ার আম্মু কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আল্লাহ! আমার কলিজাটাকে ফিরিয়ে দাও। আমার বুকটা খালি করে দিও না। আমি আমার মেয়েকে ছাড়া বাঁচব না। আল্লাহ! আল্লাহ গো! দয়া করো গো আল্লাহ!”

রনিত অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আসলো। পলক হাসি মুখে রনিতের জন্য লেবুর শরবত করে আনল। রনিত হেসে হাফ শরবত নিজে খেয়ে বাকিটা পলককে খেতে ইশারা করল। এটা রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এজন্য পলক বিনাবাক্যতে খেয়ে নিলো। রনিত আজকে ফিরতে একটু দেরী হয়েছে। কারণ ওর বন্ধু শিফাত কাতারে চলে গেল। তাকে বিদায় দিয়ে ফিরতেই দেরীটা হয়েছে। রনিত পলকের মুখে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পলক কেঁদেছে সে বুঝতে পারছে। তবে সে মুখে কিছু বলল না। পলকের সঙ্গে রনিতের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পলকের মনে রনিতের প্রতি আর ভুল ধারণা নেই। বরং সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, ‘স্বামী নামক মানুষটাই একজন স্ত্রীর শক্তি।’
প্রত্যয় সার্জারি শেষ করে সোজা বাসায় চলে গেছে। ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে তার খেয়াল নেই। প্রত্যয় বাসায় ফিরে ওর আম্মুকে না পেয়ে ভাবল হয়তো তুয়াদের বাসায়। কারণ এখানে আসার পর ওর আম্মু তুয়াদের বাসায় বেশি সময় কাটায়। দু’জনে মাঝে মাঝে শপিং করতেও বেরিয়ে পড়ে। এজন্য প্রত্যয় আর কিছু ভাবল না। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে বাসায় প্রবেশ করল। নিজের রুমে গিয়ে প্রত্যয় একেবারে শাওয়ার নিল। টানা কয়েক ঘন্টা সার্জারি করার পর ক্ষুধা লাগে। আর সার্জারির পর পর সে ভাত খেতে পারে না। এজন্য সাধারণত সে ফল খায়। প্রত্যয় ওর মনমতো কিছু ফল ধুয়ে কাটতে বসল। এক টুকরো আপেলে কামড় বসিয়ে প্রত্যয়ের ফোনটা অন করল। তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল। সে দ্রুত মুখের আপেলটুকু গিলে ফোনটা রিসিভ করল। জামিল বলল, “স্যার, ম্যম হসপিটালে এসেছেন। তুয়া নামের একটা মেয়ে রেপ হয়েছে, তাকে নিয়ে ম্যম হসপিটালে এসেছেন। আপনি কি আর হসপিটালে আসবেন না?”

কথাটা শুনে প্রত্যয়ের যেন নিঃশ্বাস আঁটকে গেল। সে জামিলকে আসছি বলেই পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে দ্রুত দরজা লক করে বেরিয়ে পড়ল। প্রত্যয়ের খেয়াল নেই সে নরমাল টি-শার্ট আর টাওজার পরিহিত। প্রত্যয় দ্রুত ড্রাইভ করে হসপিটালে ঢুকল। প্রত্যয় ওর আম্মুকে ফোন দিয়ে বলল, “আম্মু! তুয়া এখন কোথায়?”
ওর আম্মু বললেন, “দোতলার দুইশো পাঁচ নং ওটিতে।”
প্রত্যয় কল কেটে দ্রুত পায়ে সেখানে গেল। ওটির বাইরে সবাইকে বসে থাকতে দেখে সে কথা বাড়াল না। প্রত্যয় ওটির দরজা মৃদু ভাবে নক করল। একজন নার্স বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে প্রত্যয় দেখে সরে দাঁড়াল। প্রত্যয় দ্রুত ওটিতে ঢুকে গেল।
প্রিয়ম এসবের কিছু জানে না। সে নিজের জগতে ডুবে আছে। কেউ ওকে কিছু জানায়ও নি। ইচ্ছের আম্মুরা এতক্ষণ বাসায় ছিল না। উনারা ইচ্ছের দাদুর বাসায় থেকে ফিরে এসব শুনে কষ্ট পেল। প্রত্যয় ওটিতে ঢুকে তুয়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ডক্টরদের সাথে কথা বলল। তুয়ার হাতের রগটা গভীরভাবে কাটেনি। এখন সে বিপদমুক্ত। তুরাগ বুদ্ধি করে তুয়ার হাতটা না বাঁধলে অন্য কিছু ঘটতে পারতো।

সত্যি কথা হলো হাত কাটলে মানুষ কখনো মরে না। বোকারা ভাবে হাতের রগ কাটলে মানুষ মারা যায়। এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ হাতের রগই না একটা মানুষের পুরো হাত কেটে ফেললেও সে বাঁচে। আর রগ কেটে মানুষ মারা যায় রক্তশূন্যতা হয়ে। হাতের রগ কাটার ফলে শরীর থেকে রক্ত নির্গত হতে থাকে। যার ফলে সেই ব্যাক্তির শরীর রক্তশূন্য হতে থাকে, ফলে সে মানুষ মারা যায়। প্রত্যয় তুয়ার বিপদমুক্ত হওয়ার কথাটা নার্সকে বলল বাইরে জানতে। প্রত্যয় নিজে আরেকবার তুয়ার হাত চেক করে নিলো। এরপর তুয়াকে আইসিইউ’তে রাখার পারমিশন দিল। কয়েকজন মিলে স্টেচারে করে তুয়াকে ওটি থেকে আইসিইউ রুমে রাখতে গেল। তখন সবাই এক পলক তুয়াকে দেখে নিলো।
প্রত্যয় এসে সবার মুখের দিকে তাকাল। উপস্থিত সবার মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। প্রত্যয় বলল, “আংকেল-আন্টি, তুয়া এখন বিপদমুক্ত। আপনারা এবার শান্ত হন। আর বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট করুন।”
কথাটা শুনে তুয়ার আম্মু কান্নামাখা কন্ঠে বললেন, “আমার কলিজাটাকে ছেড়ে কিভাবে যাব? আমার সোনার টুকরো কত কষ্ট পেয়েছে! আমি কিছুতেই যাব না।”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১+২+৩

তুয়ার আব্বু চুপ করে আছেন। মেয়ের এমন অবস্থায় উনি যেন জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছেন। তুরাগ দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। প্রত্যয় একপ্রকার জোর করে ওর আম্মুর সঙ্গে তুয়ার আম্মু আর আব্বুকে বাসায় পাঠাল। প্রত্যয় উনাদের শান্ত ভাবে বুঝাল সে হসপিটালেই আছে। তুয়ার কোনো সমস্যা সে হতে দিবে না। প্রত্যয়ের অনেক বুঝানোর পর উনারা মানল। তুরাগ আর প্রত্যয় হসপিটালে থেকে গেল। প্রত্যয় তুরাগকে ওর কেবিনে নিয়ে গিয়ে রেস্ট নিতে বলল। প্রত্যয় তুরাগকে কেবিনে রেখে বেরিয়ে গেল। তুরাগ প্রত্যয়ের কেবিনের বেডের উপর শুয়ে পড়ল। তখন ওর চোখের কোণা বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গাড়িয়ে পড়ল।
প্রত্যয় তুয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তুয়ার এই অবস্থা প্রত্যয় মানতেই পারছে না। ওর বুকের ভেতরে চিনেচিনে ব্যথা অনুভব করছে৷ ওর চোখ দু’টো বড্ড জ্বালা করছে। মনে হয় চোখ দু’টো থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে। সে কেন কষ্ট পাচ্ছে? ওর তো কষ্ট পাওয়া কথা না। প্রত্যয় তুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। প্রাণবন্ত মেয়েটার মুখ থেকে হাসিটা হারিয়ে গেছে। চোখ দু’টো ফুলে আছে, মুখের কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। প্রত্যয় চুপ করে বসে আছে। একটুপর তুয়া পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল। তুয়া প্রত্যয়কে ওর সামনে দেখে কেঁদে কেঁদে বলল, “আমি ধর্ষিতা! আমি অপবিত্র! আমি নোংরা হয়ে গেছি। আমি বাঁচতে চাই না। আমি খারাপ।”
কথাটা বলে সে চিৎকার করে উঠে হাতের ক্যানোলা খুলে ফেলল। আচানক এমন করাই হাতের ক্যানোলা খুলে হাত থেকে রক্ত পড়তে থাকল। তুয়ার চিৎকার শুনে দুইজন নার্স দৌড়ে আসলো। প্রত্যয় ইশারায় ওনাদের যেতে বলল। উনারা দরজা আটকে বাইরে চলে গেল।

তুয়ার কোনো দিকে খেয়াল নেই। সে দ্রুত নামতে গিয়ে কাটা হাতে বারি খেয়ে কঁকিয়ে উঠল। তুয়ার মাথায় নিজেকে শেষ করার জেদ চেপেছে। সে ধর্ষিতা নামক কালিমা থেকে মুক্ত হতে চায়। তুয়ার বেগতিক অবস্থা দেখে প্রত্যয় দ্রুত উঠে তুয়াকে জাপটে ধরল। তুয়া প্রত্যয়কে ওর থেকে সরাতে চাচ্ছে। কিন্তু সে জোর খাটিয়েও প্রত্যয়কে এক চুলও নড়াতে পারল না। তুয়া এখনো ছোটাছুটি করেই যাচ্ছে। ওর ছোটাছুটিতে কাটা হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
তুয়া নিজেকে প্রত্যয়ের থেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলো। সে রেগে প্রত্যয়কে কিল ঘুষিও দিল, তবুও প্রত্যয় ওকে ছাড়ল না। অবশেষে তুয়া ক্লান্ত হয়ে প্রত্যয়ের বুকের টি-শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে লাগল। ওর চোখের এক এক ফোঁটা অশ্রু প্রত্যয়ের টি শার্টে পড়ছে। তুয়ার আতনার্দ গুলো প্রত্যয়ের বুকে গিয়ে বিঁধছে। তবুও প্রত্যয় তুয়াকে ছাড়ল না। বরং সে আরো শক্ত করে ওর বাহুডোরে তুয়াকে যত্ন করে আবদ্ধ করে নিল। আর মনে মনে বলল,
“আমি আছি তো।”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৭+৮+৯