সুদর্শন শঙ্খচিল গল্পের লিংক || নূরজাহান আক্তার (আলো)

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ১+২+৩
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

“বিয়ের রাতে বউকে হসপিটালে ভর্তি করলি। তুই কি মানুষ?”
কথাটা বলে শিফাত ওর বন্ধু রনিতকে থাপ্পড় মারল। কথাটা শুনে রনিত মাথা নিচু করে নিল। এতো বিশ্রী ব্যাপার ঘটে যাবে সেও ভাবেনি। এখন ওর নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। আজকে রনিতের বিয়ে হয়েছে। ওর বন্ধুরা ওকে বাসরঘরে ঢুকিয়ে ক্লাবে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। রাত দু’টোর দিকে রনিতের কল পেয়ে ওরা হসপিটালে ছুটে এসেছে।
রনিতের বউয়ের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য তাঁকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। যাকে বলে অপরিপক্ব বয়সে বিয়ের ফল। ঘটনাটা খুবই লজ্জাজনক। রনিতেরও লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। তাঁর মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। এখন দুই পরিবারের সদস্যদের সামনে কিভাবে দাঁড়াবে? আর আত্মীয়-স্বজনরাও শুনলে হয়তো বলবে, “বউ দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। তাই বউয়ের উপর হামলে পড়েছে।”

রনিতের বউয়ের নাম পলক। সে এবার নবম শ্রেনীতে উঠেছে। প্রতিটা মেয়ের মতো পলকও একরাশ স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছিল। সংসারের সুখ-দুঃখে সামিল হয়ে দায়িত্বটা কাঁধে নিতে চেয়েছিল। রনিতকে ভালবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল। এসব আর হলো কই? প্রথম রাতেই তো স্বামী নামক মানুষটা তাঁর মনটা বিষিয়ে দিল। মেয়ের বিদায়ের সময় পলকের বাবা রনিতের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে কেঁদে বলেছিলেন, “আমার কলিজাটাকে তোমাকে দিলাম। আমার পাগলি মেয়েটাকে দেখে রেখো, বাবা।”
রনিত হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়েছিল। বাবার ছায়াতল ছেড়ে স্বামী নামক মানুষটার উপর বিশ্বাস রেখে, সে নব্য স্বপ্নের ডানা মেলেছিল। বাসর রাতে দু’জনে জোছনা বিলাস করতে চেয়েছিল। হাতে হাত রেখে গল্প করতে চেয়েছিল, একে অপরকে বোঝার সময় চেয়েছিল। কিন্তু ঘটে গেল অন্য ঘটনা। স্বামী নামক মানুষটা ওর উপরে হামলে পরল। তাঁকে সাদা বিছানার চাদরে কুমারীত্বের পরীক্ষা দিতে হলো। রনিতও ভুলে গিয়েছিল, পলকের বয়সটা এখন সঙ্গমের জন্য অপরিপক্ব। তাঁর এই ভুলের কারণে এখন লজ্জাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো।
ওদের গল্পটা এমন না হতেও পারতো। রনিত তাঁকে সময় দিতে পারতো। বউ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। সে তো আর অবুঝ নয়। বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে কনট্রোলে রাখতে পারতো। তাহলে হয়তো ওদের গল্পটাও স্বাভাবিক হতো। এই ঘটনায় পুরুষ জাতির প্রতি পলকের মনে ঘৃণার জন্ম নিল। তাঁর মনে একটা ঘৃণিত ধারণা পোষণ হলো, “পুরুষ জাতি নারীর দেহতে তুষ্ট।”
এত রাতে হসপিটালে তেমন ডাক্তার নেই। এদিকে পলকের রক্তক্ষরণ থামছে না। ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চোখের কোণা বেয়ে ঝরছে অশ্রুবিন্দু। লজ্জা আর ভয়ে সে জর্জরিত। একজন নার্স ঘুম থেকে উঠে রেগে বলল, “বুইড়া ব্যাডার হুশ নাই। বউ পাইয়া গতরে ত্যাজ বাইড়া গেছে। ইস! মাইয়াডার কি অবস্থা করছে?”
পলকের অবস্থা বেগতিক দেখে সে দ্রুত ডাক্তার ডাকতে গেল। পলক চুপ করে শুয়ে আছে। ওর ইচ্ছা করছে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে বলতে, “মা! মাগো, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। স্বামী নামক মানুষগুলো খুব খারাপ হয়। তাঁরা মন দিয়ে মন খুঁজে না, তাঁরা দেহের ভাঁজে সুখ খুঁজে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে রনিতের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে। ওর আরো সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তাহলে হয়তো মেয়েটাকে এতোটা কষ্ট পেতে হতো না। সে অনুতপ্ত। পলকের করুণ চাহনি দেখে তাঁর মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অল্প বয়সী মেয়েকে সেও বিয়ে করতে চাচ্ছিল না। কিন্তু বড়রা কথা শুনেনি বরং জোর দিয়ে বলেছে, “নরম মাটিতে মনমতন গড়ন দিলে যেমন সঠিক আকারের পাত্র বানানো যায়। তেমনি ছোট মেয়েকে বিয়ে করলে তাঁকেও মনমতো গড়ে তোলা যায়।”
পলকের সঙ্গে ওর চাচাতো বোন মিতু এসেছিল৷ পলকের শ্বশুরবাড়ির পাশেই মিতুর বান্ধবী তুয়ার বাসা। ওর এখানে একা ভালো লাগছিল না। তাই সে তুয়ার বাসায় চলে গেছে। রনিত মিতুকে মেসেজ করে হসপিটালে আসতে বলল, তবে বাসার কাউকে এই ঘটনা জানাতে নিষেধ করল। মিতু বোনের অবস্থার কথা শুনে কাঁদছে। তুয়া মিতুকে কোনো রকম থামায়। তুয়া এত রাতে মিতুকে কিছুতেই একা ছাড়বে না। তাই দু’জনে একসাথে যাবে বলে ঠিক করল। দু’জনে সর্তকতার সাথে রুম থেকে বের হলো। তুয়া ওর ভাই তুরাগের বাইকের চাবিটা নিলো। দু’জনে বাইকে করে গেলে দ্রুত হসপিটালে পৌঁছাতে পারবে। তুয়া বাইক ড্রাইভ করতে পারে। সে শখের বশে তুরাগের থেকে ড্রাইভ করা শিখেছে।

প্রত্যয় কেবল ওটি থেকে বের হলো। এক পেশেন্টের গুরুতর অবস্থার জন্য ওকে হসপিটালে আসতে হয়েছিল। বিগত সাড়ে তিন ঘন্টা পর সে ওটি থেকে বের হল। নার্সকে দৌড়ে যেতে দেখে প্রত্যয় জিজ্ঞাসা করল, “কি হয়েছে? এভাবে দৌড়াচ্ছেন কেন?”
নার্স প্রত্যয়কে পলকের কথা জানাল। এর সাথে এটাও বলল এখন একটা ডাক্তারও ফ্রি নেই। যারা আছেন তাঁরা কেবলই ওটি থেকে বের হয়েছেন। উনারা যেতে চাচ্ছেন না। প্রত্যয় আর কথা বাড়াল না। সে কেবিনে গিয়ে দ্রুত ওটির ড্রেস খুলে নার্সের সাথে গেল। সব দায়িত্বে গা ছাড়া ভাব করতে নেই। আর ডাক্তারী পেশাতে তো নয়ই। কারন ডাক্তারের গা ছাড়া ভাব মানে পেশেন্টের প্রাণনাশ। প্রত্যয় দ্রুত ব্ল্যাড বন্ধের ইনজেকশন পুশ করে পলকের শরীরে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলল। নার্স এসে রনিতকে বলল, “আপনারা রক্ত যোগাড় করুন। পেশেন্টের রক্ত লাগবে।”
কথাটা শুনে রনিত আর শিফাত ছুটল ব্ল্যাড ব্যাংকে। যাওয়ার আগে রনিত নার্সকে বলে গেল, উনি যেন পলকের সাথেই থাকে। নার্স মুখ বেঁকিয়ে কেবিনে ডুকল। ওদের রক্ত যোগাড় করে আনতে আনতে পেশেন্ট রক্তশূন্যতায় মারা যেতে পারে। তাই প্রত্যয় নার্সকে বলল,” দ্রুত পেশেন্টের শরীরে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। ওর অবস্থা ভাল নয়।” নার্স জানাল,’ পেশেন্টের বাসার কেউ নেই, আর রক্তের গ্রুপ কিভাবে জানবে?’

প্রত্যয় বলল, “পেশেন্টের ব্ল্যাড টেস্ট করে হসপিটাল থেকে আপাতত ব্ল্যাড কালেক্ট করুন।”
নার্স প্রত্যয়ের কথামতো তাই করল। পলক নিস্তেজ হয়ে বেডে পরে আছে। ইনজেকশন পুশ করার পর ধীরে ধীরে পলকের রক্তক্ষরণ কমতে থাকল। তখন তুয়া আর মিতু হসপিটালে এসে পৌঁছাল। প্রত্যয় নার্সকে খেয়াল রাখতে বলে কেবিন থেকে বের হলো। মিতু কাঁদতে কাঁদতে তখন কেবিনে ডুকল। তুয়া বাইকটা রেখে কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল।
প্রত্যয়কে কেবিন থেকে বের হতে দেখে তুয়া কড়াভাবে বলে উঠল, “এই আপনার লজ্জা করে না? আচ্ছা, লজ্জার কথা বাদ দিলাম। সাধারণ সেন্সটুকুও কি আপনার নেই?”
প্রত্যয় মেয়েটার কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। সে কি এমন করল যে মেয়েটা তাঁর সঙ্গে এভাবে কথা বলছে? এই মেয়েটাই বা কে? প্রত্যয়কে চুপ থাকতে দেখে তুয়া আরো রেগে গেল। সে পারছে‌ না সামনের ছেলেটাকে তুলে আছাড় দিতে। রাগে ওর শরীরটা কিড়মিড় করছে। এমন বেয়াদব ছেলের সাথে পলকের বিয়ে হয়েছে? পলকের বাবা কি আর ছেলে পাননি? একথা ভাবলে তুয়ার রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। প্রত্যয় তুয়ার দিকে তাকিয়ে একদম শান্ত কন্ঠে বলল, “আমি কি করেছি? আমার লজ্জা লাগবে কেন?”
প্রত্যয়ের কথা শুনে তুয়ার রাগটা কনট্রোলের বাইরে চলে গেল। এতো জঘন্য কাজ করে সে আবার ওকেই জিজ্ঞাসা করছে,” সে কি করেছে?” তুয়া রেগে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “বাসরঘরে বউকে রক্তাক্ত করে এখন সাধু সাজা হচ্ছে? আপনি চরম মাপের অসভ্য একজন মানুষ।”

প্রত্যয় তুয়ার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে নিলো। বিয়ে, বউ, বাসরঘর কোথায় থেকে আসলো? প্রত্যয় বুঝতে পারল, মেয়েটা ওকে কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। হয়তো ওকে পলকের হাজবেন্ড ভেবেছে। মেয়েটা রেগে দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ওর সাথে কথা বলছে, রাগে ওর নাকটা ফুলে উঠছে। ভ্রু দু’টো কুঁচকে আছে। তুয়া পারছে না প্রত্যয়কে গিলে খেতে। প্রত্যয় তুয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমি ডক্টর ওয়াসিক রায়হান প্রত্যয়।”
তুয়া রেগে বলল, “তো আমি কি নাচব?”
একটা বাচ্চা মেয়ে কিনা ওকে বকছে! ওর এই দিনও দেখতে হলো। প্রত্যয় আবারও বলল,”আমি পেশেন্টের হাজবেন্ড নই। আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”
তুয়া প্রত্যয়ের কথা শুনে জিহ্বাতে কামড় দিল। সে চিনতে ভুল করে ফেলেছে। মিতু ওকে বলেছে পলকের বর খুব সুদর্শন। এজন্য সে প্রত্যয়কে রনিত ভেবেছিল। তাছাড়া প্রত্যয় ডক্টরের ড্রেসআপে ছিল না। যার জন্য সে বুঝতে পারেনি। তুয়া লজ্জিত কন্ঠে বলল, “দুঃখিত। আমাকে মাফ করবেন। টেনশনে মাথা ঠিক ছিল না।”

“ইট’স ওকে।” বলে প্রত্যয় মুচকি হেসে চলে গেল।
একটুপরে, রনিত আর শিফাত রক্ত নিয়ে হসপিটালে আসল। তুয়া রাগে রনিতের মুখের দিকে‌ তাকালও না। লোকটার উপর ওর খুব রাগ হচ্ছে। মিতু কেবিনের বাইরের চেয়ারে বসে আছে। পলকের শরীরে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। রনিত শুকনো মুখে পলকের কেবিনে ডুকল। পলক চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। রনিত আলতো করে পলকের হাতটা ওর মুঠোয় পুরে বলল, “দুঃখিত! আমাকে মাফ করো।” পলক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রনিতের চোখেও পানি। রনিত সত্যিই খুব অনুতপ্ত। স্বামীর চোখে পানি দেখে পলকের মনটা গলে গেল। অল্প বয়সী আবেগী মনে অভিমান রাগ ধরে রাখতে পারল না। রনিত পলকের কপালে আদর দিয়ে বলল, “ঘুমাও। আমি এখানেই আছি।” পলক রনিতের কথামত চোখ বন্ধ করে নিলো।
ওরা চারজন সারারাত হসপিটালে ছিল। সকাল বেলা রণিত আর পলককে ওদের বাসার কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। রনিতের বাসায় এটা নিয়ে কানাঘুসা চলছে। রনিতের আব্বু রনিতকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কোথায়?”
রনিত বলল, “বাবা! আমরা কক্সবাজারে এসেছি। এক সপ্তাহ পরে বাসায় ফিরব। শিফাত হুট করে কক্সবাজারে আসার টিকিট উপহার দিল, এজন্য তোমাদের জানাতে পারিনি।”
বাসা ভর্তি মেহমান উপস্থিত। আর ছেলের এমন কাজে ওর বাবা রেগে গেলেন। উনি রনিতকে গালাগাল করে ফোন রাখলেন। রনিত ফোন রেখে মাথা নিচু করে বসে রইল। রনিতকে এই বুদ্ধিটা তুয়া দিয়েছে। যাতে ওরা কারো কাছে হাসির পাত্র না হয়। ভুল যখন হয়েই গেছে, তখন সেটা শুধরে নিতে হবে।
তুয়া প্রথমে রনিতের উপরে রেগে থাকলেও, পলকের প্রতি ওর যত্নশীলতা দেখে তুয়ার মনটা নরম হয়েছে। এজন্যই সে নিজে থেকে রনিতকে এই বুদ্ধিটা দিয়েছে। সকালে তুয়া আর মিতু বাসায় ফিরল। এত সকালে তুয়াকে বাইক নিয়ে ফিরতে দেখে ওর আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “এতো সকালে তোরা কোথায় গিয়েছিলি?” তুয়া হেসে বলল,
“আম্মু, মিতুকে নিয়ে সকালের বাতাস খেতে গিয়েছিলাম।”
“বাতাস খেয়ে পেট ভরেছে নাকি খাবার খাবি?”
“দ্রুত খেতে দাও, আমার খুব খুধা লেগেছে।”

কথাটা বলে তুয়া মিতুকে নিয়ে খেতে বসল। তুরাগও এসে ওর পাশের চেয়ারে বসল। এরমধ্যেই তুয়া তুরাগের ঝগড়া লেগে গেল। তুরাগ তুয়ার ভাগের ডিম ভাজা খেয়ে নিচ্ছে। মিতু বসে ওদের মারামারি দেখছে। তুরাগ তুয়ার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। তুয়া উঠে এক মগ পানি নিয়ে তুরাগকে দৌড়ানি দিল। তুরাগ ফ্ল্যাটের দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ বসে পড়ল। ততক্ষণে তুয়া পানি ছুঁড়ে দিয়েছে। তখন প্রত্যয় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল। ব্যস! একমগ পানি গিয়ে পড়ল প্রত্যয়ের বুকে। এমন ঘটনায় তুয়া আর তুরাগ দু’জনেই হতভম্ব। প্রত্যয় নিজেও হতবাক হয়ে গেছে। তুয়া ভয়ে ভয়ে একবার প্রত্যয়ের দিকে তাকাল তারপর তুরাগের দিকে তাকিয়ে ,দৌড়ে বাসায় ঢুকে গেল। তুরাগ প্রত্যয়কে বলল, “সরি! আমরা বুঝতে পারিনি তুমি উপরে উঠছিলে। প্লিজ কিছু মনে করো না”
প্রত্যয় তুরাগের ছোট হবে। এজন্য তুরাগ ওকে তুমি করেই বলল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “ব্যাপার না। আমি কিছু মনে করিনি।” তুরাগ প্রত্যয়ের সাথে কথা বলে জানতে পারল। প্রত্যয় ওদের ফ্ল্যাটের সামনের ফ্ল্যাটে উঠেছে। প্রত্যয়ের ফ্ল্যাটের দরজা আর তুয়াদের দরজা একেবারে সামনাসামনি। তুরাগ প্রত্যয়কে ওর পরিচয় জানাতে বলল, “আমি তুরাগ ইমতিয়াজ।”
“আমি ওয়াসিক রায়হান প্রত্যয়।”
“জব নাকি পড়াশোনা?
“আমি কার্ডিওলজিস্ট।”
“হার্টের ডাক্তার! বাহ! তা এসো আমাদের বাসায়।”
” অন্য একদিন যাব।”
“আচ্ছা।”
দু’জনে টুকটাক কথা বলে যে যার বাসায় চলে গেল। এটা প্রত্যয়দের নিজস্ব ফ্ল্যাট। ওরা কেউ এখানে থাকত না। ওর বাবা-মা রাজশাহীতে থাকেন। প্রত্যয় নিজের হসপিটালে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে নিযুক্ত আছে। ওর ডাক্তারী পেশার জন্য এই ফ্ল্যাটে তিনদিন হলো উঠেছে। সে এখানে একা থাকে। সারাদিন হসপিটালে থাকে বিধায় ওকে তেমন কেউ চিনে না। তুয়াকে দেখে প্রত্যয় বাসায় ঢুকে মনে মনে বলল, “এই মেয়েটা এখানে কেন?”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

–“ভাইয়া আজকে কি রান্না করেছো?”
কথাটা বলে প্রিয়ম চেয়ার টেনে বসে পড়লো। একে একে সব খাবারের ঢাকনা তুলে দেখল। খাবারের আইটেম দেখে প্রিয়মের মুখে হাসি ফুটল। ওর পছন্দের সর্ষে ইলিশ রান্না হয়েছে। প্রিয়ম প্লেট নিয়ে ঝটপট খেতে বসে গেল। ইলিশ মাছ ওর খুব পছন্দ। আর সর্ষে ইলিশ হলে তো কোনো কথায় নেই। সে মাছের বড় বড় দু’টো পিচ প্লেটে নিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছে। প্রিয়ম আজকে ওর বড় ভাইয়ার বাসায় এসেছে। সে ওর বাবা মায়েরর সঙ্গে রাজশাহীতে থাকতো। তবে এখন থেকে সে এখানে থাকবে। প্রিয়ম একজন গায়ক। ওর শখ বিখ্যাত একজন গায়ক হওয়া। সে নিজের লক্ষ্য পূরণের চেষ্টায় আছে। প্রিয়ম মুখের খাবারটুকু গিলে ওর ভাইকে ডেকে বলল, “ভাইয়া তুমি খাবেনা?”
প্রিয়মের বড় ভাই প্রত্যয় ফোনে কথা বলতে বলতে এসে প্রিয়মের পাশে বসল। প্রিয়ম পানি খেয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় কথা বলা অবস্থায় প্রিয়মের প্লেটে ভাত আর মাছ তুলে দিল। প্রিয়ম প্রত্যয়কে নিষেধ করছে, না দিতে। প্রত্যয় প্রিয়মের কথা শুনল না বরং সে খেতে ইশারা করল। আজকে প্রত্যয়ের দুইটা অপারেশন করতে হবে। সকালে ছয়টাতে একটা আর আরেকটা রাত দশটাতে। এসব নিয়ে সে ফোনে কথা বলছিল। আর বাকি সময়টুকু অন্য সব পেশেন্ট দেখবে। প্রত্যয় কথা বলে কল কেটে প্রিয়মকে বলল,
-“ফ্রিজ থেকে দই বের করে রেখেছি। ঠান্ডা টা কমলে তারপর খাবে।”
প্রিয়ম খেয়ে উঠে নিজের এঁটো প্লেট আর ধুয়ে হাত নিল।
নিজের এঁটো প্লেট ধোয়ার অভ্যাসটা সে প্রত্যয়ের থেকে শিখেছে। প্রিয়ম আবার গিয়ে ভাইয়ের পাশে বসল। প্রত্যয় প্রিয়মকে বলল,

-“বাসায় থাকবে নাকি এখন বের হবে?”
-“এখন আর বের হবো না। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে এখন ঘুমাব।”
-“আচ্ছা! বিকেলে দু’জন লোক আসবে উনারা আসলে দরজা খুলে দিও।”
-“কিসের লোক?”
-“রান্না আর রুম পরিষ্কার করার জন্য। আমি তো সময় পাব না।”
–“ওনাদের আসতে হবেনা। আমি আছি সব ম্যানেজ করে নিব।”
প্রত্যয় প্রিয়মকে নিষেধ করল। কিন্তু প্রিয়ম কোনো কথা শুনল না। তাই প্রত্যয় লোক দু’টোকে আসতে নিষেধ করে দিল। প্রিয়ম দই নিয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে গেল। প্রত্যয় খেয়ে রেডি হয়ে প্রিয়মকে বলে হসপিটালে চলে গেল। প্রিয়ম বাসায় এখন একা আছে। সে সোফাতে শুয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখল, তারপর উঠে গিটার নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। প্রত্যয়ের বেলকণিতে একটা ময়না পাখি খাঁচাতে ঝুলানো আছে। প্রত্যয় ময়নাপাখির নাম দিয়েছে কলি। প্রত্যয় কলিকে ছোট ছোট কয়েকটা শব্দ শিখিয়েছে। যেমন; আল্লাহ, বিসমিল্লাহ্, আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছো, দাঁড়াও, কই যাচ্ছো, সুন্দর, দুষ্টু। কলি এই শব্দ গুলো বলতে শিখে গেছে। কিন্তু সালামটা ঠিক মত দিতে পারো না, বড়গুলো শব্দ এজন্য। তবে প্রত্যয় যখন সুন্দর করে স্পষ্টভাবে কলির সামনে ,”আসসালামু আলাইকুম।” বলে তখন প্রত্যয়ের দেখে কলিও স্পষ্টভাবে বলার চেষ্টা করে।
কলি প্রিয়মকে দেখে সবগুলো বুলি পরপর আড়তাতে লাগলো। প্রিয়ম কলির দিকে তাকিয়ে বলল,”পাগল করে দিবি নাকি?” কলি এই কথা শুনে সেও বার বার বলতে থাকলো, “পাগল করে দিবি নাকি।” প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে কলির দিকে তাকিয়ে গিটারের সুর তুলল। তখন কলি চুপ হয়ে গেল।

পলক দুইদিন হসপিটালে থেকে পলক এখন সুস্থ আছে। রনিত পলককে কক্সবাজারে বেড়াতে নিয়ে গেল। দু’জনে কিছুদিন আলাদাভাবে সময় কাটাবে ভেবে। বিশেষ করে রনিত পলককে বোঝাতে চাই, সে খারাপ স্বামী নয়। পলকের মনে ওর প্রতি ভুল ধারণা গুলো সে দূর করতে চাই। রনিত যে খারাপ ছেলে তা কিন্তু নয়। সেও বুদ্ধিমান একজন ছেলে। একটা ভুলে জন্য তাকে দোষারোপ করা উচিত হবে না। আর দোষারোপ যদি করতেই হয়। তাহলে প্রথমে সমাজ, ওদের বাবা মা, কাজি , এই কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে দোষটা রনিতের কাছে আসছে। রনিত তো একা দোষী নয়। ওর আগে পিছে আরো দোষী আছে।
আমাদের সৃষ্টিকর্তা প্রতিটা মানুষকে শারীরিক চাহিদা দিয়ে তৈরী করেছেন। সৃষ্টির শুরু থেকে এই ধারা চলে আসছে। যদি শারীরিক চাহিদা বলে কিছু না থাকতো, তাহলে বংশ বিস্তার হতো না। পৃথিবীটাও অনেক আগে রসাতলে চলে যেতো। শারীরিক চাহিদা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত দেওয়া। এটাকে অমান্য করা, হাসহাসি করা, বাজে মন্তব্য করা উচিত না। সৃষ্টিকর্তা মানুষের শারীরিক চাহিদা পূরনের বৈধতাও দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে রনিত ও তো মানুষ । ওর তো কিছু চাহিদা আছে। সে তো ওর বিয়ের করা বউয়ের কাছে গেছে। হ্যাঁ, সে একটু সময় নিয়ে আরও সচেতন হতে পারত। তবে যাই হোক সে এখন অনুতপ্ত।
তুয়া আর মিতু দু’জনে ছাদে বসে আছে। তুয়ার আম্মু একটু দূরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করছে। তুয়া বাদাম খাচ্ছে আর খোসা গুলো মিতুকে ছুঁড়ে মারছে। মিতু রেগে তুয়ার দিকে মটমট করে তাকাচ্ছে। তখন তুয়া খিলখিল করে হেসে আরো বেশি করে খোসা ছুঁড়ে দিচ্ছে।

প্রিয়ম এখানে নতুন এসেছে সে এখানকার কিছু চিনেনা। আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য সে রেডি হয়ে বের হল। কয়েক ধাপ এগোতেই ওর মাথার উপর পানি জাতীয় কিছু একটা পড়ল। প্রিয়ম ওর শার্টের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকাল। ওর শার্টে কেউ কাদা মাটি ছুঁড়ে মেরেছে। প্রিয়ম উপরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। তাই বিরক্ত হয়ে আবার রুমে ফিরে এলো। মিতু আর তুয়া ছাদে বসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তুয়া ইচ্ছে করেই কাঁদা ফেলেছে কারন মিতু বলেছে,
— “ওই সাদা শার্ট পরা ছেলেটার গায়ে কাঁদা মারতে পারলে, আমার সব বাদাম তোকে দিব।”
এজন্য তুয়া প্রিয়মের গায়ে কাঁদা ছুঁড়ে মারল। মিতু ভেবেছিল তুয়া করবেনা। কিন্তু সে কাজটা সম্পূর্ণ করে ওর বাদামগুলো নিয়ে নিল। প্রিয়ম আজ আর বের হলো না। সে শার্ট বদলে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিল। কারন ওর ধুলাবালিতে এর্লাজি বেড়ে যায়। প্রত্যয় ওর পেশেন্ট দেখে কেবল বাসায় ফিরল। ওরা দোতলায় থাকে এজন্য লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে, সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। প্রত্যয় কলিংবেল চাপ দিয়ে পেছনে ঘুরতে যাবে। তখন একটা বাচ্চা মেয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল,”কানাচুর থাবো।”
প্রত্যয় বাচ্চাটা দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। প্রত্যয়কে হাসতে দেখে সেও হাসলো। প্রত্যয় হাঁটু গেড়ে বসে বললো,
–“রাজকন্যা তোমার নাম কি?”
–“আমি নাজতন্যা ইত্তে ।”
–“ওহ আচ্ছা! তোমার নাম ইচ্ছে, খুব সুন্দর নাম। তুমি কি খাবে বললে?”
–“কানাচুর থাবো।”
প্রিয়ম এসে দরজা খুলে দেখে প্রত্যয় কারো সঙ্গে কথা বলছে। প্রিয়ম এগিয়ে এসে দেখে দুই পাশে ঝুঁটি করা একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যয় হেসে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বাসায় ঢুকলো। রান্নাঘরে গিয়ে পুরো চানাচুরের প্যাকেট মেয়েটিকে দিয়ে সোফায় বসিয়ে দিল। প্রিয়ম ইচ্ছেকে কোলে নিতে গেল। কিন্তু ওর কোলে এলো না। প্রিয়ম বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বিরবির করে বলল,
-“মেয়ে মানেই প্যারা।”

ইচ্ছে কথাটা শুনে খাওয়া থামিয়ে প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রত্যয় ফ্রেশ হতে গেছে। প্রিয়ম বসে একমনে টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছে। ইচ্ছে উঠে সোফার উপর দাঁড়িয়ে প্রিয়মের চুল শক্ত করে টেনে ধরে চিৎকার করে বললো,
–“তুমি প্যালা। তুমি মেলা খালাপ প্যালা।”
প্রিয়ম ওর চুল ছাড়ানো চেষ্টা করছে কিন্তু ইচ্ছে আরো শক্ত করে ধরছে। প্রিয়ম প্রত্যয়কে জোরে জোরে ডেকে উঠলো। প্রত্যয় ওদের চিৎকার শুনে দ্রুত পায়ে এসে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল। প্রিয়ম মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
–“ভাইয়া এই বিচ্ছুটাকে কোথায় পেলে? উফ! আমার চুলের জান শেষ।”
ইচ্ছে প্রত্যয়ের কোল থেকে নেমে আবার প্রিয়মের কাছে যাচ্ছিল। তখন তুরাগ এসে দরজা নক করে। প্রত্যয় ইচ্ছে কে কোলে নিয়ে দরজা খুলে দেয়। তুরাগ ইচ্ছে দেখে প্রাণ ফিরে পায়। প্রত্যয় তুরাগের সাথে কুশল বিনিময় করে তুরাগের সাথে প্রিয়মের পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রিয়ম সালাম দিয়ে তুরাগের সাথে কথা বলে।
তুরাগকে দেখে ইচ্ছে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল, “দান আমাতে প্যালা বলেছে।” তুরাগ রেগে যাওয়ার ভান করে বলল, “কার এত সাহস আমার জান পাখিকে প্যারা বলেছে। তাকে এক্ষুনি আমি চিনি খাইয়ে মেরে ফেলব।” তুরাগের কথা শুনে প্রত্যয় প্রিয়ম দু’জনে হেসে দিল।

ইচ্ছে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে প্রিয়মকে দেখিয়ে দিল। প্রিয়ম হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতটুকু বাচ্চা এত পাকা? তুরাগ প্রিয়মকে বকে ইচ্ছেকে কোলে নিল। প্রত্যয় হেসে ইচ্ছে কে বলল,”আবার এসো কেমন।” ইচ্ছা মিষ্টি হেসে বলল,”কানাচুর দিবে?” প্রত্যয় চানাচুরের প্যাকেট ইচ্ছেকে দিয়ে বলল,”হুম দিবো তো।” ইচ্ছা প্যাকেটা হাতে নিয়ে বলল,”আচ্ছা তাহলে আছব।” তুরাগ হেসে ইচ্ছেকে নিয়ে চলে গেল। ইচ্ছেরা নিচ তলায় ভাড়া থাকে, সে তুরাগদের বাসায় বেশি থাকে। তার পছন্দের খাবার চানাচুর। যে ওকে চানাচুর দেয় সে তার কাছে চলে যায়। ওর চানাচুর এতটাই পছন্দ যে ওকে চানাচুর খোর ডাকলেও ভুল হবে না।
সন্ধ্যার পরে প্রত্যয় আর প্রিয়ম দুই ভাই হাঁটতে বের হল৷ প্রত্যয়ের আজকে পেশেন্ট কম ছিল। এজন্য বাসায় চলে এসেছিল। ওরা দু’ভাই হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর অবধি গেল। তখন প্রত্যয়ের হসপিটাল থেকে কল আসল। ওকে এখন যেতে হবে তাই প্রিয়মকে বলল,” প্রিয়ম আমি হসপিটালে যাচ্ছি, তুমি সাবধানে ফিরে যেও।” প্রিয়ম বলল, “তুমি সাবধানে যেও।” প্রত্যয় “আচ্ছা” বলে চলে গেল।
প্রিয়ম একা একা কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে বাসায় ফিরল। আর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে তুয়ার সঙ্গে ধাক্কা খেল। তুয়া তখন ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। ফলস্বরুপ তুয়ার হাতে থাকা ডিম দু’টো প্রিয়মের বুকে লেগে ফেটে গেল।
প্রিয়ম তুয়াকে দাঁড়াতে বলে দ্রুত রুমে ঢুকে দু’টো ডিম এনে তুয়ার মাথায় ফাটিয়ে বলল,
–“এবার ঠিক আছে। বাহ্! আপনাকে দারুণ লাগছে।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রিয়ম তুয়ার মাথায় ডিম ফাটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তুয়া দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে আছে। প্রিয়ম বলল, “এটাকে বলে টিট ফর ট্যাট।”
তুয়ার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে রাম ধোলাই দিতে। কত্ত বড় খাটাশ, বদলাও নিয়ে নিলো। দু’জনের শরীর থেকে ডিমের আঁশটে গন্ধ আসছে। তুয়া চলে আসতে যাবে তখন প্রিয়ম হেসে বলল, “আমার নাম প্রিয়ম আর তোমার নাম কি গো রাগিণী?”
তুয়ার আম্মু তুয়াকে ডাকছেন। তুয়া বলল,”আসছি আম্মু।”
প্রিয়ম হাসতে হাসতে বলল, “তোমার নাম টুপা? বাহ্! একদম ইউনিক নাম। ”
তুয়া একবার রাগী চোখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে আমি পরে দেখে নিব।”
প্রিয়ম বাঁকা হেসে ওদের ফ্ল্যাটের দরজা দেখিয়ে বলল, “আমাকে যখন দেখতে ইচ্ছে করবে আমার বাসায় চলে এসো, টুপারাণী।”
“আপনি মারাত্মক অসভ্য একটা ছেলে।”
“ধন্যবাদ।”
তুয়া রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। প্রিয়ম হাসতে হাসতে বাসায় ঢুকে গেল। প্রিয়মকে আজ মোট তিনবার শাওয়ার নিতে হলো। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! প্রিয়ম শাওয়ার নিয়ে রান্না করতে গেল। প্রত্যয় আর প্রিয়ম দু’জনেই রান্না করতে পারে। বাসায় মাঝে মাঝে ওরা নিজেরা রান্না করে ওদের আব্বু-আম্মুকে খাওয়ায়। প্রিয়ম ওর আম্মুকে ভিডিও কল করল। ওর আম্মু মিথিলা রায়হান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছোট রাজকুমার কি রান্না করছেন? আমার বড় রাজকুমার কই?”
প্রিয়ম ফোনটা একসাইডে রাখে, চুলার পাওয়ার কমিয়ে প্যানে থাকা গরম তেলে পেঁয়াজ ছেড়ে নাড়তে নাড়তে বলল, “ভাইয়া হসপিটালে। আমি মাংস আর খিঁচুড়ি রান্না করছি। বাবা এখনো বাসায় ফিরেনি, আম্মু?”

“না! ফোন দিয়ে বলল ফিরতে নাকি রাত হবে।”
“ওহ।”
“তোদের ওখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো, আব্বু?”
“না, আম্মু।”
মা-ছেলে কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটল। ওদের আব্বু-আম্মু সামনের সপ্তাহে এখানে চলে আসবেন। মিথিলা ছেলেদের ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে নারাজ। উনাদের সব কিছু গুছিয়ে নিতে এক সপ্তাহের মতো লেগে যাবে। তারপর সবাই এখানে এসে সেটেল হবেন। প্রিয়ম গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে রান্না করতে থাকল। প্রত্যয় কখন ফিরবে তাঁর কোনো ঠিক নেই। আজকেও তাঁকে ওটিতে ঢুকতে হয়েছে। ওর খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। সারাদিন সে হসপিটালে থাকে। আবার কখনো কখনো রাতেও বাসাতে ফিরে না। একজন দায়িত্বশীল ডাক্তারের রেস্ট বলে কিছু থাকে না। আর প্রত্যয় নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মতো ছেলে নয়। তাঁর যত কষ্টই হোক। প্রত্যয় সর্বদা চেষ্টা করে নিজের দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করতে।
প্রিয়ম রান্না করে খেয়ে বাকিটা হটপটে তুলে রাখল। ভিডিও কলের মাধ্যমে ওর রাজশাহীর বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিল। সবাইকে সে খুব মিস করছে। সোফাতে টান টান হয়ে শুয়ে সে বেশ কিছুক্ষণ টিভি দেখল। কলি বেলকণিতে বুলি আওড়াতে আছে, সে এখন প্রত্যয়কে ডাকছে। প্রিয়ম কলির ডাকাডাকি শুনে বিরবির করে বলল, “এই ফাজিল পাখিটা আমার কান বয়রা করেই ছাড়বে।”
প্রিয়ম কলিকে বেলকণি থেকে এনে খেতে দিল। কলি এখন ঠুকরে ঠুকরে কাঁচা মরিচ খাচ্ছে। ওর পছন্দের খাবার ঝাল। কলি এখন খাচ্ছে আর একটা বুলি আওড়াচ্ছে, “শুভ রাত্রি! শুভ রাত্রি!”

তুয়া বাসায় গিয়ে প্রিয়মকে ইচ্ছেমতো গালি দিল। সে এই রকম বেয়াদব ছেলে একটাও দেখে নি। আর ওকে ‘টুপা’ বলে ডাকল। ওর এত সুন্দর নামটার ইজ্জত শেষ করে দিল। তুয়াও এর শেষ দেখেই ছাড়বে। তখন ইচ্ছের আম্মু তুয়ার আম্মুকে ফোন করে দু’টো ডিম দিতে বলেছিল। ইচ্ছে নাকি তখন নুডুলস খাওয়ার বায়না ধরেছিল। ওদের ফ্রিজে ডিম ছিল না। তুয়া তখন ইচ্ছেদের বাসায় ডিম দু’টো দিতেই যাচ্ছিল। কিন্তু প্রিয়মের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ধাক্কা গেলে গেল। আর ওই বিশ্রী ঘটনাটা ঘটল। তুয়া রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “ব্যাটা বজ্জাত! দাঁড়া, দেখ আমি তোর কি ব্যবস্থা করছি।”
পরেরদিন সকালে তুয়া আর মিতু কলেজ যাওয়ার জন্য বের হলো। প্রত্যয় সারারাত হসপিটালে থেকে তখন বাসায় ফিরছিল। মিতু প্রত্যয়কে দেখে অবাক হয়ে বলল, “স্যার! আপনি এখানে?”
প্রত্যয় হেসে জানাল সে এই বিল্ডিংয়েই থাকে। মিতু একবার তুয়ার দিকে তাকাল। প্রত্যয় মিতুকে পলকের কথা জিজ্ঞাসা করল। খুব ব্যস্ত থাকায় প্রত্যয় পলকের আর খোঁজ নিতে পারেনি। মিতু জানাল পলক এখন সুস্থ আছে। প্রত্যয় মুচকি হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তুয়া বলল, “একজন প্রত্যয় আর আরেকজন প্রিয়ম। এরা মনে হয় দুই ভাই হবে, বুঝলি? এই ডাক্তারটা ভালোই তবে উনার ভাইটা আস্ত বেয়াদব।”
মিতু আর কথা বাড়াল না। দু’জনে গল্প করতে করতে কলেজে চলে গেল। তুয়া আর মিতু দু’জনেই ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
প্রত্যয় চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। প্রিয়ম এখনো ঘুমাচ্ছে, এজন্য প্রত্যয় আর ওকে ডাকল না। হার্টের অপারেশন করা এক পেশেন্টের অবস্থা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য সে সারারাত প্রায় জেগেই ছিল। ঘুমটা না হওয়ার কারণে ওর শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। প্রত্যয় শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হলো। এরপর রান্না করে খেয়ে নিলো। সারারাত জেগে ছিল বলে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

প্রিয়মের আজ সকাল দশটার সময় একটা প্রোগ্রাম আছে। কালকে রাতে ঘুমানোর আগে সে এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিল। তাই সকাল পৌণে নয়টার দিকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। প্রত্যয়কে একটা মেসেজ করে সে গিটার নিয়ে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে প্রিয়মের ইচ্ছের সাথে দেখা হলো। ইচ্ছে প্রিয়মকে দেখে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেল। প্রিয়ম মনে মনে বলল, “এই বিল্ডিংয়ের সব মেয়ে গুলোই এমন বারুদ নাকি!”
একসপ্তাহ পরে প্রিয়মের আব্বু-আম্মু প্রত্যয়ের ফ্ল্যাটে চলে আসলেন। মিথিলা রায়হান এসেই আগে দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বাসাটা এবার যেন প্রাণ পেল। মা ছাড়া বাসাটাও যেন এতিম হয়ে গিয়েছিল। উনারা আসার সময় অনেক আসবাবপত্রও এনেছেন। সেই আসবাবপত্র দিয়ে ফ্ল্যাটটাকে আরো পরিপাটি করে সাজালেন। প্রিয়ম ওর বাইক পেয়ে গেছে। ওকে আর পায় কে, সে ছুটল পুরো শহর ঘুরতে। সে এখানে থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করবে। সে সুবাদে ওর ব্যাচের কয়েকজন বন্ধুও জুটে গেছে। প্রত্যয় অর্ধেক বেলা বাসায় আছে। সে ওর আম্মুর কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ওর আম্মু ছেলের চুল টেনে দিতে দিতে বললেন, “আব্বু, প্যারিস থেকে ডাক্তারী পড়া সম্পূর্ণ করে তবেই ফিরলে। তুমি তো এখন যথেষ্ট স্বাবলম্বী। এবার তোমার জন্য মেয়ে দেখি?”
“আম্মু, এত তাড়া কিসের?”
“একটা লাল টুকটুকে বউ আনতে হবে তো। বউ ছাড়া যে বাসা পরিপূর্ণ হয় না।”
“আম্মু, আমি বিয়ে নিয়ে এখন ভাবছি না। আমাকে আর একটু সময় দাও।”
“লক্ষী একটা বউ আনব তোর জন্য। যে আমার রাজকুমারকে চোখে হারাবে, বুঝলি?”
“সে পরে দেখা যাবে।”
প্রত্যয় কথাটা কোনো রকম কাটিয়ে দিল। ওর কেন জানি লজ্জা লাগে নিজের বিয়ের কথা বলতে। তাছাড়া সে এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছেও না। সে আরেকটু সময় নিয়ে নিজের জায়গাটা আরো পাকাপোক্ত করতে চায়। বিয়ে মানে কারো সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়া। তাঁকে সর্বোচ্চ ভালো রাখার চেষ্টা করা। তাঁকে সবদিক থেকে আগলে রাখা। তাই প্রত্যয় চাচ্ছে নিজেকে আগে গুছিয়ে নিতে।
প্রত্যয় দেশে ফিরে নিজস্ব একটা হসপিটাল তৈরী করেছে। এই হসপিটালের ইঞ্জিনিয়ার ওর বাবা ইশতিয়াক রায়হান। ছেলের স্বপ্ন পূরণের জন্য উনি সবটা নিজে হাতে করেছেন। প্রত্যয় নিজের হসপিটাল ছাড়াও কয়েকটা হসপিটালে কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে সেবা প্রদান করে। সে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেশ ভালো পরিচিতি লাভ করেছে। বিশেষ করে ওর চিকিৎসা, মার্জিত ব্যবহার আর বিনয়ী কথা বার্তার মাধ্যমে। প্রিয়ম একটু চঞ্চল টাইপের হলেও প্রত্যয় একদম শান্ত স্বভাবের। সে ওর কথার মাধুর্যতা দিয়ে মানুষের মন কাড়তে সক্ষম হয়।

তুয়ার আম্মু ইচ্ছেদের বাসায় যাচ্ছিলেন। প্রত্যয়ের আম্মুকে দেখে উনিই আগে কথা বললেন। কথা বলতে বলতে দু’জনে নিচে গেলেন। তুয়ার আম্মু প্রত্যয়ের আম্মুকে অনেকের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলেন। একই বিল্ডিংয়ে যখন থাকবেন তখন সম্পর্কটাও ভালো হওয়া প্রয়োজন।
কলেজ থেকে ফেরার পথে তুয়ার সামনে প্রিয়ম বাইক থামাল। হঠাৎ এমন করাতে তুয়া ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। রিকশা না পাওয়াতে কড়া রোদের মধ্যে সে হাঁটছিল। রোদের প্রখর তাপে ওর মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। তাঁর মধ্যে প্রিয়মের এই কাজে ওর রাগে যেন উচ্চ মাত্রায় বেড়ে গেল। প্রিয়ম ঠোঁটে কোণে বাঁকা হাসি রেখে ফুটিয়ে বলল, “কি গো টুপা! এ কি অবস্থা তোমার?”
“আমার সামনে এসে এভাবে বাইক থামালেন কেন?”
“ভয় পেলে বুঝি? আহারে বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়েছে। আমার জানামতে এভাবেই বাইক থামাতে হয়।”
“আমাকে শিখাতে এসেছেন?”
“তুমি শিখলে আমার শিখাতে সমস্যা নেই।”
তুয়া প্রিয়মের দিকে তাকাল। প্রিয়ম তুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তুয়া মুখের ঘামটা মুছে বলল, “চলুন বাইক নিয়েই একটা বাজি হয়ে যাক।”

সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব ৪+৫+৬