সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ২০

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ২০
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

আকাশ ভরা কালো মেঘে গুড়গুড় শব্দ। দুপুরের সকল তপ্ততা,রুক্ষতা শুষে তুখোড় বৃষ্টিপাত হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে আজ। কাছেপিঠে আছড়ে পড়ছে বজ্রপাত। অথচ জীমূতনাদের গগনবিদারী একেকটি আওয়াজ, কবির লেখা কবিতার ছন্দের ন্যায় মনে হচ্ছে তীব্রর। বর্ষণের প্রতিটি ফোঁটা যেন সুর তুলেছে গানের। স্পষ্ট বলছে,

“ Tera hoone lagahoon…
Khoone laga hoon..
Jabse mila hoon…”
তীব্রর চাউনী নিশ্চল! অপলক এক জোড়া সাদাটে নয়ন। পুষ্পিতার চোখের পল্লব, ঠোঁটের একেকটি খাঁজ গুণতে থাকার মতোন আকুল মনযোগ সেথায়। পুষ্পিতা মলমের পর ক্ষত স্থানে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। কিছু বলার জন্য চোখ তুলতেই, অপ্রস্তুত হলো গতিতে। তীব্রর নড়চড় নেই৷ ভীষণ স্বাভাবিকত্বের মাঝেও, অস্বাভাবিক-অচপল নেত্র। মূক মুগ্ধতার স্রোতে যার চারপাশ ডুবে।
পুষ্পিতার সাবলীল অভিব্যক্তিতে জড়তা এসে ভেড়ে। বিব্রতবোধে ঘিরে আসে সব। এভাবে কী দেখছেন উনি? মাথা নুইয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ হয়ে গেছে স্যার!”
অপর মানুষটির প্রতিক্রিয়া এলো না। পুষ্পিতা নিভু চোখ ওঠায়। তীব্র তখনও তাকিয়ে।
যেন পুষ্পিতার বিভ্রান্ত হরিণী আঁখিজোড়া নিবেশনের মাপকাঠিতে জর্জরিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। মেয়েটা নীরবে দিশেহারা হলো। অস্বস্তিতে খেই হারাল সহজ সুলভ থাকার।

মেয়েলী মন নেতিবাচক কিছু ভাবতে চাইলেও,শিক্ষার্থীর মন সেসব উড়িয়ে দেয়ার জোর খাটাল খুব! পুষ্পিতা কী করবে বুঝতে পারছে না। উঠে চলে যাবে? না কী অপেক্ষা করবে? সিদ্ধান্তহীনতায় হাসফাস করে বসে রইল কেবল। এমন নয় যে তীব্র গভীর ধ্যানে! এইত, তার বিলাতি মনিদুটো ঘুরছে। খুব নিপুণ ভঙ্গিতে আবর্ত হচ্ছে তার মুখবিবরে। যেই দৃষ্টিতে না চাইতেও গায়ে কাঁ*টা দেয় পুষ্পিতার। লোমকূপে শিরশির লাগে। অপ্রতিভ চিত্তে চিবুক নত করতে গিয়েও থামল। চটক কাটার ন্যায় সচেতন চোখে চাইল ফের।

চশমার চকচকে গ্লাস ভেদ করা, তীব্রর নেত্রমণির দিকে সরাসরি তাক করল দৃষ্টি। সহজ দুপুর,হুট করে ভরতি হলো জটিলতায়। মাথার মধ্যে ঘূর্ণির ন্যায় তে*ড়ে এলো,অপ্রত্যাশিত সেই বিট্টু মাস্তানের কথা। ঠিক এমন চোখ তো,ওই বখাটেটারও। একইরকম সব। শুধু তাকানোর ধরণে তফাত! একজন তাকালে আশেপাশের নরম ত্বক কুঁচকে আসত,আরেকজন…আচ্ছা স্যার হঠাৎ আজ এমন ভাবে কী দেখছেন?

নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে ওদের মাঝামাঝি। তীব্র যে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে,সেটা দেখে মাথা নাড়ল দুপাশে। ছেলেটার এসব কাণ্ডকারখানায় সে বিহ্বল না হয়ে পারছে না। এলাকার সেই বখাটে, কর্কশ বন্ধুটা একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে এমন ক্যাবলা বনে গেল? এভাবে হাঁ করে তো ও মিথিলাকেও কোনোদিন দেখেনি। তৎক্ষনাৎ বুকের বা দিকটা মুচ*ড়ে উঠল নাহিদের। মিথিলার মুখখানি,ছবির মত ধরা দিলো মানস্পটে। ওর বিয়ের আজ কতগুলো দিন! এতদিনে তো কানাডায় চলে যাওয়ার কথা। সেখানে কেমন আছে ও? ভালো আছে? কেমন কাটছে ওর সংসার? আচ্ছা,বিদেশের অমন চাকচিক্যের মাঝে,এই সাদামাটা নাহিদকে কী তার মনে পড়ে? পড়ে না হয়ত। বুক চি*ড়ে সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ছেলেটার। পরপর ধ্যান ভা*ঙল পুষ্পিতার রিনরিনে আওয়াজে। উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বড্ড ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলছে,

“ আমি তাহলে এখন আসি স্যার! আপনি সাবধানে কাজ করবেন।”
এতক্ষণে তীব্রর জড়ের মত দেহের নড়নচড়ন ফেরে। পালটা দাঁড়াল সেও। নাহিদ ধরেই বসল,তীব্র এবার বিদায় জানাবে মেয়েটাকে। অথচ সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ সাবধানে কাজ করে কী হবে? এর আগে কখনও তো রান্না করিনি। দেখলে না,ওইজন্যে একবার কড়াই পু*ড়ল,এবার হাত কা*টল এরপর শুধু গায়ে আ*গুন লাগা বাকী!”

পুষ্পিতার নম্র মনে প্রভাব ফেলল কথাটা। নিমিষে অস্বস্তি ভুলে যায় সে। আঁ*তকে,উদ্বেগে একাকার হয়ে বলে,
“ ছি ছি স্যার এমন কথা বলবেন না! আপনি একটু সতর্ক হয়ে কাজ করলেই দেখবেন এমন কিচ্ছু হবে না।”
তীব্র আবার ফোস করে দম ফেলে বলল,
“ দেখা যাক! এনি ওয়ে,তোমার আন্তরিকতার জন্যে থ্যাংক্স! তুমি বরং বাসায় যাও এখন। আমি আর নাহিদ,পো*ড়া কয়লা যা পারব খেয়ে নেব৷ আসলে ব্যাচেলর লাইফটাই এমন। আমাদের তো আর কেউ নেই,যে কা*টা হাত দেখে মায়া করে রান্না করে দেবে। ব্যাড লাক!”

একটু আগের পুতুল বনে থাকা মানবের সঙ্গে, জাল বুননের মত কাটাকাটা কথা বলা তীব্রর মিল পেলো না পুষ্পিতা। তবে শেষ বাক্যে শুভ্র মুখে আমাবস্যা নামল। মায়াও হলো ভীষণ! ও কি রান্নাটা করে দিয়ে যাবে? স্যার বি*পদে পড়েছেন,তাকে সাহায্য করা তো মানুষ হিসেবে ধর্মেই পড়ে। কিন্তু উনি যদি কিছু মনে করেন!”
তক্ষুণি তীব্র আড়চোখে চেয়ে,সচেতন কণ্ঠে শুধাল,

“ কী ভাবছো? বাই এনি চান্স তুমি আমাকে রান্না করে দেয়ার কথা ভাবছো না নিশ্চয়ই!”
পুষ্পিতা আননে আলো ছড়াল সবেগে। ব্যগ্র চিত্তে বলল,
“ জি। জি স্যার,আমি সেটাই ভাবছিলাম। আপনি যদি অনুমতি দেন,আমি রান্নাটা করে দিয়ে যাব?”
তীব্র বলল,

“ না না। তা আবার হয় না কি? স্যার হয়েছি বলে কী ছাত্রীর থেকে এরকম ফেসিলিটি নেব? তোমাকে রান্না করতে হবে না। তুমি যাও।”
“ স্যার কিচ্ছু হবে না। আপনি তো আমাকে বলেননি,আমি নিজেই চাইছি। আর বিপদে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াতেই পারে। কথায় বলে না,মানুষ মানুষের জন্যে?”
পুষ্পিতা মৃদূ হাসল। তীব্র সেই হাসিটা দেখল বড় ঠান্ডা চোখে। ভাবল,
“ কে কার জন্য জানি না৷ তবে তুমি যে শুধু আমার জন্যে এটা জানি!”
কাঁধ উঁচাল পরপর,

“ ঠিক আছে। এত করে যখন বলছো,তখন আর কী বলব! এমনিতেও আমি কারো অনুরোধ ফেলতে পারি না।”
তার কথার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কপালে তুলল নাহিদ। চোর বলছে ধর্মের কাহিনী! এ না কী কারো অনুরোধ ফেলতে পারে না। ওরে মহিষ,বল যে আমি কারো অনুরোধ রাখিনা। শুধু তোমারটা রাখলাম। কারণ তুমি আমার,জান-প্রাণ-কলিজা-ছিদ্র ছাড়া ফুসফুস! অবশ্য যেই সিগারেট টানিস রোজ,তোর ফুসফুস আস্ত আছে এখনও? কিন্তু এত কথা মুখে ফোটেনা ছেলেটার। ঠোঁট টিপে চুপ করে থাকে। শুধু হতবাক বনে দেখে যায়, তীব্রর একেকটা ভুবন দোলানো অভিনয়।

তীব্র ফের সোফায় বসল। হাতলের গায়ে,পেশিবহুল হাত ছড়িয়ে বলল,
“ রান্নাঘরে সব রাখাই আছে। তোমার কী কী লাগবে দেখে নাও। যাও।”
পুষ্পিতা চঞ্চল পায়ে চলে গেল সেদিকে। একপল গলা উঁচু করে সে পথ দেখে নিলো তীব্র। বিজয়ী হেসে, চোখ বুজে মাথা এলিয়ে দিলো পেছনে। প্রথম বার ভীতু মেয়ের হাতের রান্না খাবে! এত কসরতের প্ল্যান তাতে কী! সফলতাই আসল।
নাহিদ বলতে যায়,

“ কী দরকার ছিল ওকে দিয়ে রা…”
শশব্যস্ত নিজের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল তীব্র। চোখ রাঙিয়ে চুপ করতে বোঝাল। চুপ করলও সে। পরপর ঠোঁট উলটে মিনমিন করল,
“ এটা ঠিক হয়নি। কেউ যদি দেখে নেয়,ব্যাচেলর ছেলের বাসায় একটা অবিবাহিত মেয়ে রান্নাবান্না করছে। কী কেলে*ঙ্কারি হবে একবার ভেবেছিস? যদি ফ্ল্যাটের সব লোকজন এসে চড়াও হয় এখানে?”
তীব্র কপাল কোঁচকাল। নিরুৎসাহিত জানাল,

“ তাতে তোর কী? সবাই মিলে এলে,তাদের একজনকে না হয়, কানে কানে বলে দেব কাজী নিয়ে আসতে।”
নাহিদ বোকা বোকা ভাবে মাথা চুলকাল। ও হুকুম করল,
“ ঘরে যা,গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবি। রান্না হলে,ডেকে নেব।”
সে বাধ্যের ন্যায় যেতে নিয়েও দাঁড়াল। পুনরায় বলল,
“ এগুলো ঠিক হচ্ছে না বিট্টু। ভালো লাগছে না আমার।”
তীব্র খটমট করে ওঠে,

“ ব্যাক সাইডে দুটো লা*থি খেলেই ভালো লাগবে। খাবি?”
গাল ফোলাল নাহিদ। বলল,
“ তোর যে এই মিষ্টি লেকচারার রূপের আড়ালে এমন কর্কশ একটা মুখ লুকিয়ে না,এটা যদি ওই মেয়ে জানত! একেবারে চোখ উলটে অক্কা পেত তাহলে।”
তীব্র জ্বলন্ত নেত্রে চাইল। পুরু কণ্ঠে বলল,

“ একদম ভীতু মেয়েকে নিয়ে এসব উল্টোপাল্টা বলবি না।”
পরপর
নাক-মুখ কুঁচকে বলল
“ এই তুই ফোট এখান থেকে। বেশিক্ষণ সামনে থাকলে সত্যিই মে*রে বসব।”
আজকে নাহিদ ভ*য় পেলো না। বরং হাসল দাঁত মেলে। চাপা কণ্ঠে বলল,
“ এহ,যে মেয়ের জন্য মাস্তানি রেখে এখানে ভূয়া লেকচারার সেজে বসে আছিস,সে মেয়ে ঘরে থাকাকালীন আমাকে মা*রবি? হা হা হা।”

স্বশব্দে হাসতে হাসতে চলে গেল নাহিদ।
তীব্র ভ্রু গোছাল। দূর্বলতা ধরা পড়ায়, আলগোছে থতমতও খেল কিছুটা। হঠাৎ সতেচন মস্তিষ্কে ভিন্ন চিন্তা আসে। নাহিদ এখানে এসে বেশ চনমনে হয়েছে৷ আগে তো চুপ করে থাকত,অথচ ইদানীং মুখে কথা ফুটছে টুকটাক। যাক,হলেই ভালো। অন্তত ওই গোল্ড ডিগার মেয়ের শোক কাটাতে পারছে।
রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। তীব্র ত্রস্ত উঠে, রওনা করল সেদিকে।

পেয়াজ কাটছে পুষ্পিতা। ওড়নার এক মাথা সামনে জড়িয়ে,অপর প্রান্ত পিঠ থেকে এনে কোমড়ে গুজেছে। খোপা করা চুলের কিছু অংশ, সন্ধি করেছে কপালের ঘামের সাথে এসে। মুখে কোনো সাজসজ্জা নেই। মসৃন কেশরাশিও অগোছালো। অথচ মোহবিষ্টের ন্যায় চেয়ে রইল তীব্র। মেয়েটাকে দেখতে এত ভালো লাগে কেন? সব ভুলে, জগত ভুলে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কেন?

আহামরি কী আছে? একটু বেশিই সুন্দর, এইত৷ এমন তো নয় এত সুন্দর মেয়ে পৃথিবীতে ও একাই! এর থেকেও হাজার গুণ সুন্দরী মেয়ে আছে চারপাশে। তবে তীব্রর নিরেট বক্ষ কোষে এত আলোড়ন কিসের ওর জন্যে? কিসের এই অযাচিত অমোঘ টান? সে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পুষ্পিতার মনোযোগ দিয়ে রান্না নয়, দেখতে থাকে ওর ঘামে ভেজা আরক্ত সুন্দর মুখখানি। কাল বিলম্বে, মুখের কাছে হাত নিয়ে কাশল। শব্দ পেয়ে চকিতে ঘুরে চাইল পুষ্পিতা।
বুকের কাছের ওড়না টানল আলগোছে।
কণ্ঠে নম্রতা,

“ কিছু লাগবে স্যার?”
তীব্রর ফটাফট জবাব,
“ না। প্রতিদিন তো আর তুমি রান্না করে খাওয়াবে না, তাই শিখে নিতে এলাম। ইউটিউব দেখে না বুঝলেও, হয়তো সরাসরি দেখলে বুঝবো। তবে আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকাতে তোমার অস্বস্তি হলে, চলে যাচ্ছি।”
ভেতর ভেতর সত্যিই অস্বস্তি হচ্ছে পুষ্পিতার। কিন্তু শিক্ষক মানুষ , আবার তারই বাড়ি! সে যেতে নিলেই,মৃদু বেগ নিয়ে বলল ,

“ না, সমস্যা নেই। আপনি দাঁড়ান, আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।”
কালচে ঠোঁটের ভাঁজে চতুরের ন্যায় হাসিটা সন্তর্পণে চেপে রাখল তীব্র। এগিয়ে এসে
সানসেট ঘেঁষে দাঁড়ালো। পুষ্পিতা ব্যস্ত হলো রান্নায়। কিন্তু পাশেই, অল্প কয়েক দিনের অচেনা পুরুষ দাঁড়িয়ে। নারী মনে একটু তো বিব্রত লাগছেই।
তীব্রর চোখ তখন মেয়েটার চটপটে হাত দুটোর ওপর। পেলব, ফরসা হস্তের পৃষ্ঠে ছোট ছোট ঠাড় লোম। পরিষ্কার সমুদ্রের পাশে বোনা ,ঝাউবনের মত সুন্দর! তীব্র বুক ভরে শ্বাস টানল। কাজে বহাল পুষ্পিতার দিক সরাসরি চেয়ে ভাবল,

“ খুব তাড়াতাড়ি আমাকে সারা জীবনের মতো রান্না করে খাওয়ানোর দ্বায়ভারটাও তোমার হাতে তুলে দেব ভীতু মেয়ে! জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ!”
পুষ্পিতা স্টিলের মত শক্ত শরীরে কাজ করছে। মেয়েটার অপ্রতিভ ভাবমূর্তি ধরে ফেলল তীব্র। ওকে স্বাভাবিক করতে কথার বাহানা ধরল । জিজ্ঞেস করল গাম্ভীর্য সমেত,

“ তুমি বেশ ভালো রান্না জানো মনে হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি কাজ করছ!’’
ও বলল,
“ হ্যাঁ, আসলে ছোট থেকে মণির সাথে টুকটাক কাজ করতাম তো। তাই আর কী!”
পুষ্পিতার ব্যপারে তীব্রর সবই জানা। তাও ইচ্ছেকৃত শুধাল,
“ মণি কে?তোমার মা?”
খুন্তি নাড়া ব্যস্ত হাতটা সহসা থমকে যায় মেয়েটার। পাশ ফিরে চাইল। পরপর মৃদূ হেসে বলল,
“ হ্যাঁ,মা-ই তো।”

তীব্রর চশমার পাড়ের চোখদুটি ছোট হলো। ভীতু মেয়েটা মিথ্যে বলছে কেন? না কি সে বাইরের লোক বলে ব্যক্তিগত কথা বলতে চাইছে না?
একটু চুপ থেকে বলল,
“ কোথায় থাকে তোমার মা-বাবা?”
পুষ্পিতার উজ্জ্বল সুশ্রী আনন মলিন হলো প্রশ্নটায়। শুভ্র চিবুকের পেশী লালচে দেখাল ভীষণ। উঁচু নাকের ডগা যেন জোয়ারে ফেঁপে ওঠা উত্তাল প্রবাহিণী!

ভীতু মেয়ের কি কষ্ট হচ্ছে? ও কিএকটু মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেবে?
তীব্র হাতটা বাড়িয়েও পিছিয়ে আনলো আবার।
পুষ্পিতা একটা ছোট্ট ঢোক গিলল। সাথে গিলে নিলো সমস্ত পীড়া। বাবার কথা মনে পড়লেই তার কান্নার স্রোত উগলে আসে গলায়। অথচ কাউকে দেখাতে পারেনা, বোঝাতে পারেনা, বলতেও পারেনা।
কেমন এক ভয়াবহ জ্বালায় ফেলেছেন বিধাতা!

টানা চল্লিশ মিনিটের লম্বা গোসল সেড়ে, বেরিয়েছে নূহা। তোয়ালে চুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে পুষ্পিতার নাম ধরে ডাকল। কোনোরূপ উত্তরের সাথে মেয়েটাও এলো না। ভ্রু গুছিয়ে কামরা ছেড়ে বসার ঘরে এলো নূহা। বারান্দা,রান্নাঘর সবখানে দেখল। কোত্থাও পুষ্পিতা নেই। এইবার চিন্তায় ললাটের সূক্ষ ভাঁজ গাঢ় হলো তার। সদর দরজাটাও ঠাঁ করে খোলা। পুষ্পিতাতো ওকে না বলে বাইরে যাওয়ার মেয়ে নয়! তাহলে গেল কোথায়?
মেয়েটার বুক কাঁপে ভয়ে। অন্তঃস্থলে ছুটে আসে অশনী সংকেত।

পুষ্পিতাকে আবার কেউ তুলে নিয়ে যায়নি তো? সেই বিট্টু মাস্তানটাই নিয়ে গেল না কি?
নূহা ঝড়ের গতিতে দরজার কাছে এলো। বাইরে তাকাতেই দেখল,
শুধু ওদের নয়, পাশের ফ্ল্যাটের দোরও একইরকম খোলা। ও চোখ সরু করল। খটকা জাগল মনে। পা বাড়াল সেদিকে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব সমেত মাথা ঢুকিয়ে,ভেতরে উঁকি দিলো। কাউকে দেখা না গেলেও, ঘর হতে ভেসে আসা পুষ্পিতার কণ্ঠ স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। ওমনি টানটান হয়ে দাঁড়াল নূহা।

দুজন ব্যাচেলর ছেলের ঘরে কী করছে গাধীটা?
নূহা ওদিকে যেতে নিয়েও থামল। ডাকতে চেয়েও ডাকল না। মাথায় ঢুকল এখানে বিপদের কিছু নেই। পুষ্পিতার তখনকার কথায় যতটুকু বুঝেছে,স্যার লোকটা ভালো,ভদ্র মানুষ। আতঙ্কের কোনও ব্যাপার-স্যাপার থাকলে, নিশ্চয়ই দরজা খোলা থাকত না! কিয়ৎক্ষণ বিজ্ঞের ন্যায় হিসেব-নিকেশ কষে ফিরে গেল ঘরে।

সকাল সকাল পুরুষালি কর্কশ কণ্ঠের চিৎকারে ঘুম ছুটে গেল মিথিলার। ধড়ফড়িয়ে তাকাল। চোখমুখ কঠিন করে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। ও তাকাতেই রেগেমেগে বলল,
“ এটা কি ঘুমোনোর সময় মিথিলা? আমার অফিস আছে,জানো না?”
মিথিলা ধাতস্থ হলো বিলম্বহীন। ফিরে গেল উদ্বেগশূন্যতায়। নিষ্প্রভ বলল,
“ তো যাও। আমি কি তোমাকে ধরে রেখেছি?”
“ যাও মানে? আমার ব্রেকফাস্ট কোথায়? আমি কি অফিসে না খেয়ে যাব না কি?”

মিথিলা আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ এখন কি আমাকে ব্রেকফাস্টও বানিয়ে দিতে হবে?”
পলাশ কাঁধ উঁচাল,
“ অবশ্যই। ঘরের সব কাজ তোমাকে করতে হবে যখন,এটা বাদ থাকবে কেন? তাড়াতাড়ি করো,অলমোস্ট আটটা বেজে গেছে। আ’ম লেইট!”
মিথিলা বিস্মিত চোখে তাকাল,

“ আটটা? এই আটটার সময় আমাকে ঘুম থেকে তুলে তুমি নাস্তা বানাতে বলছো? আমি বিয়ের আগে কখনও এগারটার আগে ঘুম থেকে উঠিনি পলাশ। সেখা…”
পলাশ তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে,চুল ব্যাকব্রাশ করছিল। ফিরে চাইল কথাটায়। তুচ্ছ হেসে বলল,
“ সেসব জেনে আমি কী করব? তখন তুমি তোমার বাবার টাকায় খেতে,সে কাজ করায়নি। এখন আমার টাকায় খেতে হলে আমার সেবা করতে হবে। আর রোজ রোজ এই এক ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগছে না কিন্তু। বেশি কথা না বাড়িয়ে যাও তো!”

মিথিলার চোখ ভিজে উঠল। কিয়ৎক্ষণ আহতের ন্যায় চেয়ে থেকে চলে গেল রান্নাঘরে। পলাশ শোবার ঘরে থেকেই,শুনতে পাচ্ছে একেকটি বাসন-কোসনের তন্ড নৃত্যের উৎকট আওয়াজ ! ওমনি গলা উঁচু করে বলল,
“ একটা জিনিসও যদি ভাঙে মিথিলা,কপালে দূর্ভোগ আছে মনে রেখ!”
ঘোষণা মাত্র থেমে গেল সব। একটা টু শব্দও এলো না। পলাশ মিটিমিটি হাসল। বিড়বিড় করল,
“ এসব পাপাকি পারিদের টাইট দেয়ার কৌশল আমি খুব ভালো করে জানি!”
মিথিলার নাস্তা বানাতে এক ঘন্টার ওপরে লেগেছে। পলাশ কোনোরকম নাকে-মুখে খেলো। যাওয়ার সময়, শু র‍্যাক থেকে জুতো বের করে ঠেলে দিলো ওর দিকে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

“ মুছে দাও তো!”
মিথিলা হতবিহ্বল, হতচেতন! নিজের দিক আঙুল তাক করে বলল,
“ আমি জুতো মুছব? আমি?”
পলাশ কিছু বলল না। কেবল সজোরর দন্তপাটি পিষে ধরল নিজের। স্বামীর মটমটে চিবুক দেখেই ঘাবড়ে গেল বেচারি। মিনসে কণ্ঠে বলল,
“ দিচ্ছি!”

জুতো শুধু মোছা অবধি রইল না,রীতিমতো পায়ে পরিয়েও দিতে হয়েছে। মিথিলার রাগে-দুঃখে -অপমানে কান্না দলা পাঁকাচ্ছে গলায়। এখন অবধি ওকে এখানকার সিম কিনে দেয়নি পলাশ। তারওপর, বাংলাদেশের সিমটাও বন্ধ। ওর ফোন থেকেও কথা বলতে দিচ্ছে না। বাবার কাছে কোনোমতেই এসব নালিশ ঠোকার উপায় নেই মেয়েটার।
নিজের ওপর সে নিজেই ফুঁসছে এখন। কানাডায় টুরিস্ট ভিসায় এসে,সিটিজেনশিপ পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল সারা পথে। অথচ এখন মনে হচ্ছে দেশে যেতে পারলে বাঁচে।

একবার সেখানে গেলে,বাবার বাসায় গিয়ে থাকবে। ওখানে তো আর কোনো কাজ করতে হয় না। এতদিনে নিশ্চয়ই পুষ্পিতাকে খুঁজে পাওয়া গেছে! ওটাকে দিয়েই ইচ্ছেমতো খাটানো যায়।
পলাশ লিফটের বাটন টিপতে টিপতে বলল,
“ লাঞ্চে খেতে আসব না। রাতেও ফিরতে দেরি হবে।”
মিথিলা “ কেন” জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করল না। ভাবল,যা মন চায় করুক,তাতে ওর কী! সে তো আরামসে বাইরে থেকে কিছু একটা অর্ডার করে খেয়ে নেবে ।

তারপর দরজা লাগিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হঠাৎ চোখ পড়ল নীচে। পলাশ ইতোমধ্যে নেমে গেছে। জেনিকে গাড়ি সমেত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই তুরন্ত মেজাজ চটে গেল মিথিলার। পলাশ কি এখন এই সাদা চূন্নীর সাথে যাবে না কী?

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ১৯

তার চমক বাড়াতে পলাশ হাসিমুখে গিয়েই জড়িয়ে ধরল জেনিকে। তারপর দুজন মিলে গা জড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসল। ছুটে যাওয়া বাহন আর ধোঁয়ার দিক কেবল হাঁ করে চেয়ে রইল মিথিলা। মাথার মধ্যে তেঁতে উঠল,ভীষণ গুরুতর প্রশ্ন,
“ পলাশ আর জেনি সত্যিই কি বন্ধু?”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ২১