হারিয়েছি নাম পরিচয় গল্পের লিঙ্ক || লেখিকাঃ দিশা মনি

হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১
লেখিকাঃ দিশা মনি

নিজের যমজ বোনের যায়গায় বিয়ের আসরে বসে নিঃশব্দে কাদছে মেঘলা। বিয়ের পর নাকি সবাই নতুন পরিচয় পায়, কিন্তু মেঘলার পুরো পরিচয়টাই তো বদলে যাবে বিয়ের পর। আজ নিজের যমজ বোন রোদেলা সেজে তার হয়ে বিয়ে করে নিচ্ছে মেঘলা। বাবা-মায়ের অনুরোধে তাই বিয়ের পর মেঘলাকে রোদেলা হওয়ার অভিনয় করতে হবে।
‘কবুল বল রোদেলা।’

মায়ের কথায় মেঘলা নিজের ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসে। একমুহূর্তের জন্য তো অবাক হয়ে গিয়েছিল। পরে মনে পড়ল এখন তো সেই রোদেলা। নিজের ভাগ্য দেখে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। মেঘলা শুনেছে বিয়ে পড়ানোর সময় কাজি সাহেব পাত্রীর নাম বলেছেন রোদেলা ইসলাম। অথচ সে মেঘলা ইসলাম।
মেঘলা ও রোদেলা যমজ বোন হলেও তাদের স্বভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন। রোদেলা চঞ্চল, স্মার্ট। অপরদিকে মেঘলা শান্তশিষ্ট। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে থাকে সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেঘলা অসহায় চোখে তার বাবার দিকে তাকায়। এই লোকটার জন্যই তো বিয়েটা করতে হচ্ছে তাকে। মেঘলার বাবা শহরের সবথেকে বড় সুদখোর ব্যবসায়ী আমিনুল হকের কাছে টাকা ধার করেছিল। সময়মতো টাকা শোধ করতে পারে নি বিধায় আমিনুল হক লোক পাঠিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল।

এমন সময় আমিনুল হকের বড় ছেলে রিফাত এসে বলে,
‘আমি এই বাড়ির বড় মেয়ে রোদেলাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি এনাদের বাড়িতেই থাকতে দাও।’
ছেলের আবেদনে বিরক্ত হলেও রাজি হয়ে যান আমিনুল হক। শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল।

মেঘলা কয়েকদিন থেকেই খেয়াল করছিল রোদেলার পরিবর্তন। চঞ্চল মেয়েটার হঠাৎ করে কেমন শান্ত হয়ে যায়।
আর আজ বিয়ের মাত্র এক ঘন্টা আগে জানা যায় রোদেলা পালিয়ে গেছে। কথাটা জানামাত্রই মেঘলার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মেঘলার মা মুনিয়া বেগম তাকে অনুরোধ করে বলে,

‘তুই আর রোদেলা তো যমজ। তুই এই বিয়েটা করে নে। কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। তোর বাবার অবস্থাটা দেখ৷ ওনার জন্য হলেও তুই বিয়েটা করে নে মা।’
মেঘলা প্রথমে কিছুতেই রাজি হয়না নিজের মায়ের এরকম কুৎসিত প্রস্তাবে। তখন মুনিয়া বেগম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে,

‘যদি তুই এই বিয়েটা না করিস তাহলে আমি আর তোর আব্বু দুজনেই পানিতে ডু’ব দিয়ে ম’রব।’
মায়ের এরকম হুমকির পর মেঘলা আর কিছু বলতে পারে নি। বাধ্য মেয়ের মতো নিজের জীবন নিয়ে খেলাটা মেনে নিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই অনেক সহজ সরল মেঘলা। রোদেলা যেখানে জেদি, একগুঁয়ে, তার উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায়না। সেখানে মেঘলা শান্ত ও চুপচাপ থাকায় তার উপর যেকোনো বিষয় খুব সহজেই চাপিয়ে দিতে পারে তার বাবা-মা।

মেঘলা এসব কথা ভেবে আর দুঃখ পাবে না ঠিক করে নেয়। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে বলে,
‘কবুল।’
মেঘলা কবুল বলে দিতেই হাফ ছেড়ে বাচে তার বাবা-মা। অথচ মেঘলার ভেতরে অনুশোচনার গ্লানি তাকে শান্তি দিচ্ছিল না। মেঘলা চোখ তুলে তাকায় রিফাতের দিকে। এই লোকটার কাছে আজ সে সবথেকে বড় অপরাধী হয়ে গেল। মিথ্যা বলে তার বউ হয়ে গেল!

নিজেকে এরজন্য হয়তো কখনো ক্ষমা করতে পারবে না মেঘলা। রিফাত মেঘলার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তার চোখের ভাষায় কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছিল। বাট বুঝতে পারছিল না।
মেঘলা আর পারছিল না নিজেকে সামলাতে। তাই সে ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে উঠে আসে। নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে পাগলের মতো কাদতে থাকে। আজ এই বিয়ের মাধ্যমে সে যে আ’ত্ম’হ’ত্যা করল। আজ থেকে মেঘলা নামের পড়াকু শান্ত মেয়েটা যে আর থাকল না। আজ থেকে তাকে স্মার্ট, চঞ্চল রোদেলা হয়ে যেতে হবে।

মেঘলা তার পড়ার টেবিলে এসে ডাক্তারি বইগুলোয় শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে নেয়। মেঘলার চোখে কত স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। মেডিকেলে চান্সও পেয়েছিল। বাট তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন হয়তো আর পূরণ হবে না। কারণ সে যে এখন থেকে রোদেলা। আর রোদেলা তো ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ে।
মেঘলা তার মা-বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলতে থাকে,

‘তোমরা নিজেদের মেয়ের খু’নি। আমি তোমাদের কখনো ক্ষমা করবো না। আজ তোমাদের জন্য আমায় এভাবে এতগুলো মানুষকে ঠকাতে হলো, নিজের পরিচয়, নিজের অস্তিত্ব সব বদলে ফেলতে হলো। তোমরা একদিন পস্তাবে দেখে নিও।’
মেঘলার বাবা মঞ্জুরুল ইসলাম দরজার বাইরে দাড়িয়ে সব কথা শুনছিল। নিজেকে আজ খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার। নিজের মেয়ের জীবন নিয়ে এভাবে খেলা করতে তো চান নি তিনি। বাট আজ বাধ্য হয়ে এমনটা করতে হলো।

নিজের রুম থেকে বের হয়ে আসে মেঘলা। বাইরে আসতেই মঞ্জুরুল ইসলামের মুখোমুখি হয়। আব্বু নামক মানুষটাকে তো কত ভালোবাসত মেঘলা। আজ আর সেই ভালোবাসা বেচে নেই। নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য লোকটার প্রতি ঘৃণা হচ্ছে।
মঞ্জুরুল ইসলাম কিছু বলতে চাইছিল মেঘলাকে। মেঘলা কিছু না শুনেই তাকে পাশ কা’টিয়ে চলে আসে। মঞ্জুরুল ইসলামের বুক হাহাকারে ভরে যায়।

বসার ঘরে চলে আসে মেঘলা। রিফাতের পুরো পরিবার সমেত এখানে উপস্থিত আছে। রিফাতের বাবা আমিনুল হক এই বিয়েটা নিয়ে ততোটাও খুশি নয়। সেটা তার মুখ চোখ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কত আশা ছিল তার মঞ্জুরুল ইসলামের সব সম্পত্তি দখল করে নেবেন। বাট নিজের ছেলের জেদের কারণে সম্পত্তির বদল এই বাড়ির মেয়েকে নিজের ছেলের বউ করতে নিয়ে যেতে হচ্ছে।

আমিনুল হক খুশি না হলেও তার স্ত্রী রোজিয়া খুব খুশি হয়েছে এই বিয়েটায়। রোদেলাকে প্রথম দেখাতেই তার পছন্দ হয়ে যায়। তার উপর রিফাত রোদেলাকে পছন্দ করে। তাই নিজের ছেলের খুশিতে খুশি তিনিও।
মেঘলা বসার ঘরে আসার কিছুক্ষণ পরেই মঞ্জুরুল ইসলামও চলে আসেন। আমিনুল হকের আর এখানে থাকতে ভালো লাগছিল না।
‘বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন আমরা বউ নিয়ে চলে যাব। আপনারা বিদায়ের ব্যবস্থা করুন।’

মেঘলার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছে তার বাবা-মা। বাট মেঘলা তার ব্যবহারে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কারো সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয়। রিফাতের পাশে ঘাপটি মে’রে বসে আসে সে।
রিফাত সেই কখন থেকে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে। বাট মেঘলা তার দিকে তাকাচ্ছে না। এই নিয়ে মন খারাপ রিফাতের। রোজিয়া ব্যাপারটা খেয়াল করেন। রিফাতের কাছে এসে তার কানে কানে বলে,

‘একটু আগে বিয়ে হলো আর এর মধ্যেই কিভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস। মানুষ দেখলে কি ভাববে বলতো?’
‘আমি এসব কেয়ার করি না আম্মু। আমি তো জাস্ট এটা ভেবে পাচ্ছি না যে রোদেলা এরকম শান্ত বিহেভিয়ার করছে কেন। আমি যতদূর দেখেছি ও তো বেশ চঞ্চল আর ছটফটে।’
‘আজকে মেয়েটার বিয়ে। সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। আজ তো ওর একটু মন খারাপ হবেই। তোরা ছেলেরা কখনো মেয়েদের কষ্ট বুঝতে পারবি না।’

‘চিন্তা করিওনা আম্মু। আমি আদর ভালোবাসা দিয়ে রোদেলার সব কষ্ট দূর করে দেব।’
‘ছি ছি! তুই কেমন ছেলে রে? নিজের মাকে এরকম কথা বলছিস।’
‘তুমি তো বলো যে, আমি যেন তোমাকে ফ্রেন্ড ভেবে সব কথা শেয়ার করি।’
‘তোর সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে।’

রোজিয়া আমিনুল হকের পাশে চলে আসে। রিফাতের মন থেকে খটকা তখনো দূর হচ্ছিল না। রোদেলাকে অনেকদিন থেকেই চেনে রিফাত। মেয়েটাকে যতবার দেখেছে ততবারই খেয়াল করেছে মেয়েটা কতটা চঞ্চল আর বাচাল। কথা না বলে থাকতেই পারে না। আর সেই মেয়ে আজ এত চুপ। ব্যাপারটা কোনভাবেই হজম হচ্ছেনা রিফাতের।

রিফাতের মনে আচমকা একটা কথা আসে। সে ভাবে রোদেলার একটা যমজ বোন আছে না মেঘলা। রিফাত শুনেছিল মেঘলা রোদেলার ঠিক বিপরীত চরিত্রের। সে শান্ত এবং গম্ভীর। রিফাতের মনে সন্দেহ দানা বাধে। মেঘলার দিকে তাকিয়ে মনযোগ দিয়ে কিছু ভাবতে থাকে। হঠাৎ করে ডেকে ওঠে,
‘মেঘলা!’

হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ২