মধুবালা সিজন ২ পর্ব ২

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ২
ফারজানা আক্তার

শুভ্র ভাই আপনার চুলে তেলাপোকার হাগু।”
কথাটা বলেই এক ছুটে গিয়ে মেজু মামার পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো ছোঁয়া। শুভ্র ভ্যাঁবাছ্যাঁকা খেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। মাথায় হাত দিয়ে দেখে চুলে কোনো ময়লা নেই, তীক্ষ্ণ নজরে ছোঁয়ার দিকে তাকায় শুভ্র। সবার প্লেটে খিচুড়ি দিতে দিতে বিরক্তি নিয়ে মুখ বাঁকান রেহেনা বেগম। ছোঁয়া যে সবসময়ই শুভ্রর সাথে লেগে থাকে সেটা উনার মোটেও পছন্দ নাহ। শুভ্র মায়ের বিরক্তির কারণ জেনে আরও বেশি করে মিশে উনার সামনে ছোঁয়ার সাথে। মা নামক মানুষটা শুভ্রর কাছে এখন বিরক্ত ছাড়া আর কিছুইনা।

আজ তরির গায়ে হলুদ। আর একদিন পরই তরির বিদায় হবে তাই পুরো পরিবার আজ একসাথে সকালের খাবার খেতে বসেছে। তরির খুব পছন্দ ভুনাখিচুড়ি তাই আজ সকালের খাবারে ভুনাখিচুড়ি করা হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

খাওয়া শেষে সবাই সবার কাজে লেগে গেলো। পুরো বাড়ি আজ বিভিন্ন জাতের কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। অবশ্য কাঁচা ফুল দিয়ে বাড়ি সাজানোর আইডিয়া ছিলো ছোঁয়ার। তাছাড়া আজকাল প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে মানুষ বিভিন্ন অনুষ্ঠান সাজগোছ সব করে ফলে দেশের কাঁচা ফুল ব্যবসায়িদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে আর ছোঁয়ার কাঁচা ফুলের ঘ্রাণ খুব প্রিয়।

শুভ্র নিজেই কাঁচা ফুলের বাগান করা শুরু করেছে। শুভ্ররও ইচ্ছে কাঁচা ফুলের ব্যবসা করে অনেক উন্নতি করার তাই তো সে পড়ালেখা শেষ করে বাপ চাচার সাথে নিজেদের ব্যবসায় না জড়িয়ে দুটো জমি কিনে সেখানে ফুলের চাষ করা শুরু করেছে সপ্তাহ খানিক আগে। শুভ্রর বাগানে আপাততঃ তিন জাতীয় ফুলের চারা লাগানো হয়েছে। জমিটা তালুকদার বাড়ি থেকে বেশ দূরে হওয়ায় ছোঁয়া একা যেতে পারছেনা শুভ্রও নিয়ে যাচ্ছেনা ওকে আর এটা নিয়েই শুভ্রকে কয়েকদিন বেশ জ্বা’লি’য়ে’ছে ছোঁয়া।

ডেকোরেশনের লোকেরা বাড়ি সাজানোর কাজ করছে আর শুভ্র তাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় কিভাবে সাজালে বেশি সৌন্দর্য লাগবে সেটা।
সোফায় বসে বসে পা দোলাচ্ছে ছোঁয়া আর বাদাম খাচ্ছে। শুভ্রর চোখ গেলো হঠাৎ ছোঁয়ার দিকে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে আর একটা একটা করে মুখে দিচ্ছে। শুভ্র ধীর পায়ে গিয়ে ছোঁয়ার পাশে বসতেই ছোঁয়া ধরপরিয়ে উঠে, পাশে কে বসেছে সেটা দেখার আগেই ছোঁয়া বলে উঠে “উঁহু আমার বাদাম আমি কাউকেই দিবোনা, দিবোনা দিবোনা দিবোনা। মেজু মামি দিয়েছে আমায়, তুইও যাহ মেজু মামি তোকেও দিবে।”

আরজু মনে করে কথাগুলো বলেই ঘাড় ফিরিয়ে দেখে শুভ্র বসে আছে ওর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। বুকটা হঠাৎ ধুক করে উঠে ছোঁয়ার। ছোঁয়া আমতা আমতা করে আবার বলে “আ.. আসলে শুভ্র ভাই আমি ভেবেছিলাম আ…”
“ইডিয়ট, যাহ নিজের রুমে যা। দেখিসনা এখানে এতোগুলা লোক কাজ করে? কোন আক্কেলে এখানে বসে বসে পা দোলাচ্ছিস?”

ছোঁয়ার কথা পুরো হওয়ার আগেই শুভ্র ধ’ম’কে’র গলায় বলে কথাগুলো। ছোঁয়া কিছুটা ভয় পেয়ে চুপসে যায়। শুভ্র আবারও বলে “কী? কানে যাচ্ছে না কথা? বসে আছিস কোন সাহসে এখনো?”
“যাচ্ছি তো, এমন রংঢং করতাছো কেনো তুমি?”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকায় ছোঁয়ার দিকে আর রংঢং শব্দের মানে বুঝার চেষ্টা করে। ছোঁয়া শুভ্রর মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলে “তোমার মতো ডামিস স্টুডেন্ট কখনোও কোনো কথার মানে বুঝবেনা হুহ। আসছে আমায় বকতে, সত্যি সত্যিই তেলাপোকা হাগু করবে তোমার মাথায় একদিন দেখে নিয়ো।”

কথাটা বলেই এক ছুটে নিজের রুমে চলে যায় ছোঁয়া। কাজের লোক গুলো ছোঁয়ার যাওয়ার দিকে তাকাতেই শুভ্র এক ধ’ম’ক লাগায় সবাইকে। “এদিক ওদিক কী হ্যাঁ? কাজ করুন মন দিয়ে সবাই।”
শুভ্রর ধ’ম’কে সবাই আবার কাজে লেগে গিয়েছে। শুভ্রও পুনরায় ওর কাজে মন দিলো।

মিহিকা রিয়া আরজু আর তরির মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে লিলি ওদের চোখে গোল গোল করে কা’টা শসা দিয়ে বলে সবাইকে চুপ হয়ে বসে থাকতে ২০মিনিট।

তরি একবার বলেছিলো লিলিকেও ফেসপ্যাক লাগানোর জন্য কিন্তু লিলি লাগালো নাহ। অবশিষ্ট যেগুলো আছে ছোঁয়ার জন্য রেখে দিলো। ছোঁয়া আবার রূপচর্চা করতে ভীষণ পছন্দ করে। লিলি আর শুভ্র দুই ভাইবোন একটু বেশিই ফর্সা ধাঁচের। তাই লিলি মুখে কিছু ব্যবহার করেনা। লিলির এমন ফর্সা ত্বক মোটেও পছন্দ নয়। শ্যামবর্ণ মানুষ লিলির খুব বেশিই প্রিয় তাইতো সে তার শ্যামপুরুষের জন্য এতোটা ব্যাকুল।

আলিফ ছোঁয়ার বড় ভাই। আলিফের জন্যই লিলির মনটা কেমন জানি আনচান করছে। একটু আগে ছোঁয়ার মা বাবাও চলে এসেছে অথচ আলিফের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই এখনো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে গেইটের দিকে। শুধু দুজন ওয়াচম্যান ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছেনা।

মনে মনে আলিফকে নিয়ে শত কল্পনা সাজালেও আলিফের সামনে দাঁড়িয়ে এখনো মনের গহিণে লুকানো অপ্রকাশিত “ভালোবাসি” শব্দ টা উচ্চারণ করার সাহস সে পায়নি। আলিফ একটু রাগি টাইপের ছেলে। আলিফ আর শুভ্র একই বয়সের। আলিফ আগে প্রায়ই এই বাসায় আসলেও ইদানীং খুব কম আসে। একটা সরকারি স্কুলে টিচার পদে নিয়োগ হয়েছে সে তাই এখন সময় পায়না তেমন। কিন্তু লিলির তৃষ্ণার্ত প্রাণটা যে সহ্য করতে পারেনা এতো দূরত্ব।

লিলি আর ছোঁয়া অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা দিবে এবার, তরির পড়ালেখা কমপ্লিট। রিয়া আর মিহিকা এসএসসি পরিক্ষার্থী আর মাহিন সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পা দিয়েছে।
হঠাৎ করে লিলির সামনে কিছু ময়লা উড়ে আসতেই চোখ বন্ধ করে বিরক্তিকর একটা শব্দ বের করে মুখ দিয়ে সে। ছোঁয়া হাসতে হাসতে বলে “আরে আরে কুল ডিয়ার জান্তুস, এগুলো বাদামের খোসা তোর জন্য এনেছি নে খা।”
“তুই আর তোর রাগি বদমেজাজি ভাই মিলে খা গা যাহ।”

এটা বলেই লিলি সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই ছোঁয়া চিল্লিয়ে বলে উঠে “আরে ভাইয়া তুমি এসে গিয়েছো?”
কথাটি লিলির কর্ণধারে পৌঁছাতেই সে দ্রুত গতিতে ফিরে তাকায় নিচে। লিলি চোখ বুলিয়ে সব জায়গা দেখে নিলো কিন্তু কোথাও আলিফ নেই। তারপর ছোঁয়াকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে “কই আলিফ স্যার?”
“ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে, হয়তো ড্রয়িংরুমে আছে।”

ছোঁয়া কথাটা বলতেই লিলি ছুটে গেলো সিঁড়ির দিকে। লিলি যেতেই ছোঁয়া কুটকুট করে হেঁসে উঠে। লিলি যে আলিফকে পছন্দ করে এটা ছোঁয়া বুঝে যদিও লিলি কখনো তেমনভাবে শেয়ার করেনি বিষয়টা ছোঁয়ার সামনে। সবাই আলিফকে ভাইয়া ডাকলেও লিলি ছোট থেকে আলিফকে স্যার বলে ডাকে কারণ ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত ছোঁয়া আর লিলিকে আলিফ প্রাইভেট পড়াতো পরে একটু ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় নিজের পড়ালেখা নিয়ে আর পড়াতে পারেনি ওদের। আলিফ ছোট থেকেই খুব ভালো স্টুডেন্ট।

কিছুক্ষণ পর লিলি এসে দেখে ছোঁয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে এখনো বাদাম খাচ্ছে। লিলি এসে ছোঁয়ার মাথায় একটা থা’ব’র মে’রে বলে “পেট ফুলে ম’র’বি এতো বেশি খে’লে। আলিফ স্যার তো আসেনি মিথ্যা বললি কেনো? শুধু শুধু শুভ্র ভাইয়ার বকা খেয়ে আসলাম।”

“হিহি আমিও একটু আগে শুভ্র ভাইয়ের বকা খেয়ে এসেছি তাই তোকেও একটু করে তার ভাগিদার করলাম। আচ্ছা চল আমাকে ফেসপ্যাক লাগিয়ে দিবি।”

“তোর ভাই কী টাকা দিয়ে চাকর রেখেছে আমায় যে তোর সেবা করবো আমি? হুহ, পারবোনা আমি।”
“ওলে লে লে আমি হবো গিয়ে তোর একমাত্র ভাবি, আমার সেবা করবি না তো কার সেবা করবি হুম?”
“হা হা, তোর কী মনে হয়? শুভ্র ভাইয়া তোর মতো চঞ্চল পড়ালেখায় ডামিস একটা মেয়েকে বিয়ে করবে?”
কিছুটা মজার ছলেই কথাটা বলে লিলি।

“আবি তো বাস সুরুয়াত হে বস, আগে আগে দেখো হতা হে কিয়া।”
এটা বলেই ছোঁয়া গিয়ে ফেসপ্যাকের বাটিটা এনে লিলির হাতে ধরিয়ে দিলো।
লিলি ছোঁয়াকেও ফেসপ্যাক লাগিয়ে দিয়ে ওর দুই চোখে শসা রেখে চুপ করে বসে থাকতে বললো কিন্তু এটা যে ছোঁয়ার পক্ষে সম্ভব নাহ, দুইমিনিট কথা বলতে না পারলে যেনো দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় ওর আর ও কিনা ২০মিনিট চুপ থাকবে এটা সে মানতে পারলোনা। লিলি সামনে থেকে সরতেই চোখের শসা দুটো নিয়ে খরখর করে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো সে তারপর রুম থেকে বেড়িয়ে পরলো।

এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সে পুরো বাড়িটা। প্রায়ই অনেকটা সাজানো শেষ।
ছোঁয়া ঘুরতে ঘুরতে হুট করে ধা’ক্কা খেলো গিয়ে শুভ্রর বাহুর সাথে। শুভ্রর হাতে ছিলো গাঁধা ফুল আর লাল গোলাপের পাপড়ি। ধা’ক্কা লেগে সব ছোঁয়ার গায়ের উপর পরে গেলো। ছোঁয়ার মুখের ফেসপ্যাক শুকাইনি যার কারণে পাপড়ি গুলো সব ছোঁয়ার মুখে লেগে গিয়েছে। শুভ্র ছোঁয়ার মুখের দিকে তাকাতেই একটা হালকা চিৎকার দিয়ে ছিঁটকে পরে। তারপর ছোঁয়ার গায়ের সে হলুদ রংয়ের জামা টা দেখে চিনে ওকে।

“ইডিয়ট মুখে এসব কী লাগিয়ে ঢ্যাংঢ্যাং করছিস? দেখিসনা বাড়িতে কাজ চলছে?”
“হুহ্ আমি তো ফেসপ্যাক লাগিয়ে আমার রুমে যাচ্ছিলাম তরি আপুর রুম থেকে। তুমি হঠাৎ আমার সাথে ধা’ক্কা খেতে আসলে কেনো?”
“চ’ট’ক’না চিনিস? বে’য়া’দ’ব তুই দিয়েছিস ধা’ক্কা আমি নয়। চোখ তো হাতে নিয়ে হাঁটিস দেখবি কেমনে সামনে মানুষ আছে নাকি অন্যকিছু।”

“দেখো একদম ভালো হবেনা কিন্তু। শুধু শুধু বকা দেও কেনো?”
“ধূর তোর সাথে কথা বলার চেয়ে রাস্তার পাগলের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া অনেক ভালো। যাহ তো আগে মুখ টা পরিষ্কার করে আয়, বিড়ালের হাগু কতগুলো মুখে লাগিয়ে নাম দিয়েছিস ফেসপ্যাক।”
“কি কী বললে তুমি? বিড়ালের হাগু লাগিয়েছি মুখে আমি? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।”

এটা বলেই ছোঁয়া ওর মুখটা শুভ্রর বুকে ঘষে দিলো। শুভ্রর সাদা শার্ট টা মুহুর্তেই হলদে হয়ে গেলো। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা শুভ্র।
শুভ্র চোখ গরম করে ছোঁয়ার দিকে তাকাতেই ছোঁয়া ছুটে গিয়ে ওর রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। শুভ্র সেদিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ১

এই হাসির আড়ালে যে কতশত মায়া লুকানো সেটা বুঝানো বড় দায়।

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ৩