মধুবালা সিজন ২ পর্ব ৪

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ৪
ফারজানা আক্তার

সবাই সিঁড়ির দিকে যেতেই ঠা’স করে রুমের দরজা লাগিয়ে দেয় শুভ্র। দরজা এতো জোরে বন্ধ করেছে যে তীব্র শব্দে কেঁপে উঠে ছোঁয়া। দরজা বন্ধ করে ছোঁয়ার দিকে শুভ্র তাকাতেই ছোঁয়ার দম আঁটকে যাওয়ার উপক্রম। বেচারি ভয়ে কিছু বলতেও পারছেনা। ছোঁয়ার অবস্থা এই মুহুর্তে এমন যে না পারছে পালাতে আর না পারছে দাঁড়িয়ে থাকতে। শুভ্র হাত ধরে টেনে যেখানে দাঁড় করিয়েছে সেখানেই থম মে’রে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া।

শুভ্র রা’গে দাঁত কটমট করতে করতে এগুই ছোঁয়ার দিকে। শুভ্র এক পা সামনে এগুলেই ছোঁয়া দুই পা পিছিয়ে যায় এভাবে পেছাতে পেছাতে বেচারি ধুম করে পরে যায় খাটের উপর। তরির বিছানা টা বেশ নরম হওয়ায় ব্যাথা তেমন পায়নি তবুও ন্যাকা কান্না করে শুভ্রকে বুঝাতে চায় যে সে ব্যাথা পেয়েছে। নাক টেনে টেনে নিজে নিজেই ছোঁয়া বলে যাচ্ছে “আহ্ ম’রে গেলাম রে, কোমর গেলো রে আমার, পা ভে’ঙে গেলো রে। ওমা..আ..আ.. ব্যাথায় আজ আমি পরপারে চলে যাবো রে। এম্বুলেন্স নিয়ে আয় কেউ ওমা..আ..আ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“চুপ একদম চুপ। এমন ভাবে চিল্লাছিস কেনো? আক্কেল জ্ঞান নেই? কেউ শুনলে মনে করবে আমি তোর সাথে…
এতটুকু বলেই শুভ্র খানিক থেমে গেলো তারপর আবার বললো “দেখ আমি ভালো করেই জানি তুই ব্যাথা পাসনি, শুধু শুধু ফা’ল’তু ড্রামা করবিনা। মেজাজ গরম হয়।”

“সবাই অনুষ্ঠান শুরু করে ফেলেছে, আমিও যাবো। স্টেজে উঠে অনেকগুলো ছবি তুলবো। সরো সামনে থেকে।”
কথাটি বলে ছোঁয়া যখনই উঠে দাঁড়াতে যাবে তখন শুভ্র এক হাত দিয়ে ছোঁয়ার লিপস্টিক সব লেপ্টে দিলো। ছোঁয়া এবার একদম কাঁদুম কাঁদুম হয়ে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্র ছোঁয়ার ন্যাকা কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে বললো “এই লিপস্টিক টা আবার কবে কিনছোস? তোকে না বলছি এই লিপস্টিক ব্যবহার করবিনা আর কখনো? ছেলেদের আকর্ষণ পেতে এসব করিস তাইতো? নি’র্ল’জ্জ কোথাকার।

আর এতো সাজুগুজু করার কী বা দরকার তোর? তোর হলুদ হচ্ছে আজ? মানুষ তোকে দেখতে আসছে আজ?”
ছোঁয়ার এবার খুব খারাপ লাগলো। কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র সবসময়ই ওকে এমন শাসনের মাঝে রাখে অথচ সব কাজিন সাঁজে তাদের কিছু বলেনা এটা নিয়ে মনে মনে একটা অভিযোগ পোষে রেখেছে ছোঁয়া। মাথা নিচু করে নাক ফুলাচ্ছে ছোঁয়া, শুভ্রর এখনো রাগ কমেনি। হঠাৎ শুভ্র জুরে ধ’ম’ক দিয়ে বলে “রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যাহ ভালো করে ঠোঁট মুছে নে, আজকের পর আর যদি লিপস্টিক দেখি তোর ঠোঁটে তবে আর হাত ময়লা করবোনা ইয়াম্মি ইয়াম্মি করে খেয়ে নিবো।”

কথাটা বলেই দরজা খুলে বেড়িয়ে যায় শুভ্র, দরজার বাহিরে গিয়ে নরম সুরে বলে দ্রুত যেনো নিচে আসে ঠোঁট পরিষ্কার করে আর হাতে একটা টিস্যুর পেকেট দিয়ে যায় ছোঁয়ার।
শুভ্র চলে গেলে ছোঁয়া আবার ধপাস করে বসে পরে খাটে। শুভ্রর কথাগুলো আজ খুব বেশিই হার্ট করেছে ছোঁয়াকে। ছোঁয়া ভাবতে পারছেনা আর কিছু, যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে সে। বারবার ছোঁয়ার কর্ণধারে বাজতে লাগলো

“আজকের পর আর যদি লিপস্টিক দেখি তোর ঠোঁটে তবে আর হাত ময়লা করবোনা ইয়াম্মি ইয়াম্মি করে খেয়ে নিবো।”
কথাটি। ছোঁয়া বিড়বিড় করে বলে উঠলো “তাহলে কী শুভ্র ভাইও আমাকে অনুভব করে? কিন্তু ও তো সহ্যই করতে পারেনা আমায়। আমার হাতে বালাজোড়া দেখলে তো খুব বেশিই রেগে যায় ও। কেনো এতো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার হঠাৎ করে?”

হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে একটু আগেই। এখন তরির হাতে মেহেদী লাগানো হচ্ছে। রাত এখন ১২টা ১৫। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে আজ লিলি আর ছোঁয়া খুব চুপচাপ। দুজনের মনেই চলছে দুই রকম তু’ফা’ন। কেউ একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল আর কেউ প্রিয় মানুষের যত্নে অবাক, বিরক্ত।

ছোঁয়া তখন ঠোঁট পরিষ্কার করে নিচে নামতেই সব কাজিন ওকে জিজ্ঞেস করছিলো বারবার ঠোঁটের লিপস্টিক মুছার কারণ কিন্তু ছোঁয়া একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। শুভ্রর এহেন কাজে আজ ছোঁয়া ভীষণ বিরক্ত। তারপর হাত এতো শক্ত করে ধরেছিলো যে এখনো ব্যাথা হচ্ছে কিছুটা। শুভ্র হঠাৎ এতোটা রেগে যাবে ছোঁয়ার ভাবনার বাহিরে ছিলো।

ছোঁয়া স্টেজে উঠতেই ওর হাতে বালাজোড়া দেখে রেহেনা বেগম রে’গে গেলেন কিন্তু সবার সামনে কিছু বলতেও পারছেননা। অনেক মেহমান আসছে। রাত ১২টার পর এক এক করে সবাই চলে গিয়েছে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর।
সবাই চলে যাওয়ার পর ছোঁয়া আর লিলি বসেছে তরির হাতে মেহেদী লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। তখনই রেহেনা বেগম এসে ছোঁয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে রোকেয়া বানুর সামনে দাঁড় করিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলেন “দেখেন মা আপনার প্রিয় নাতনি আবারও খান্দানী বালাজোড়া চু’রি করেছে। এবার ওকে একটা শাস্তি দিয়েই দিন তারপর ভয় করবে একটু হলেও।”

ছোঁয়া ভয়ে ঢুক গিলে। গলা শুকিয়ে খাট হয়ে গিয়েছে ছোঁয়ার। কাঁপা কাঁপা হাতে ছোঁয়া ওড়না দিয়ে বালাজোড়া ঢাকার ব্যার্থ চেষ্টা করছে। ছোঁয়ার মা বাবাও এতক্ষণে এগিয়ে এসেছে এইদিকে। ছোঁয়ার মেজু মামি রুবিনা খানম ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো “ভাবী ছেড়ে দেন ছোট মানুষ। এতোকিছু বুঝলে কী ও আর বারবার সবার বকা শোনার পরেও বালাজোড়া চু’রি করতো? বাচ্চা মানুষ বাদ দেন।”

কিছুটা গ’র্জে রোকেয়া বানু বললেন “নাহ এবার আর ক্ষমা করা যাবেনা। ছোঁয়ার নানুভাই বেঁচে থাকলেও উনি বারবার এভাবে দোষ করলে ক্ষমা করতেননা কখনো। আমি একটা শাস্তি ভেবে রেখেছি ছোঁয়ার জন্য। এমন শাস্তি দেবো সবাইকে অবাক করে দিবো। আমি আমার ছেলেদের সাথে কথা বলে খুব শীগ্রই ছোঁয়ার শাস্তির ব্যবস্থা করবো। বারবার এভাবে ক্ষমা করা যায়না বাচ্চা মানুষ বলে বলে।”

এবার সবাই ভয় পেয়ে গেলো। ছোঁয়া তো ভয়ে কান্নায় করে দিলো। টুপটাপ করে ছোঁয়ার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতেছে। শুভ্র স্টেজের এক কোণায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সব পর্যবেক্ষণ করছে। ছোঁয়ার কান্না দেখে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে শুভ্রর কিন্তু তবুও সে নিজের জায়গা থেকে নড়ছেনা।

আলিফ তেড়ে এসেই ছোঁয়ার গালে একটা থা’প্প’ড় দিতে যাবে তখনই শুভ্র ছুটে এসে ছোঁয়ার সামনে দাঁড়িয়ে যায় আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে থা’প্প’ড় টা শুভ্রর গালে পরে। ছোঁয়া ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে রেখেছে এখনো। আলিফ রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো “শুভ্র সর সামনে থেকে। অন্যের আঘাত নিজের শরীরে বয়ে বেড়ানো নিতান্তই বোকামি। আজ তো ছোঁয়াকে আমি শেষ-ই করে ফেলবো। এই বাড়িতে ওকে আর রাখা যাবেনা, এখনই বাসায় নিয়ে যাবো ওকে আমি।”

ছোঁয়া পিটপিট করে চোখ খুলে শুভ্রর পিটের পাঞ্জাবী খামছে ধরে। শুভ্র মাথা হালকা ঘুরিয়ে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বলে “কান্না বন্ধ করো। যাও তরিকে মেহেদী লাগিয়ে দাও, তরি অপেক্ষা করছে।”

শুভ্রর এমন শান্ত কন্ঠ আর ‘তুমি’ করে বলা টা ছোঁয়ার মনে ঝড় তুলে দিলো। ছোঁয়ার হৃদপিণ্ডের স্পন্দনের গতি বহু গুন বেড়ে গিয়েছে। এতো শক্ত করে শুভ্রর পাঞ্জাবী খাঁমচে ধরেছে যে শুভ্রর পিটে নকের আঁচড় কে’টে যাচ্ছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে ভীষন। বুকের ভেতর হঠাৎ করে ভ’য়ং’ক’র অনুভূতি শুরু হয়ে গিয়েছে। শুভ্র ছোঁয়ার হাত ধরে আবারো শান্ত কন্ঠে বললো “কিছু বলেছি আমি, যাও ঠান্ডা মাথায় সুন্দর করে রাঙিয়ে দাও তরির দুই হাত।”

ছোঁয়া ধীর পায়ে গিয়ে তরির পাশে বসে মেহেদী লাগাতে শুরু করে। সবাই অবাকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। শুভ্রর হঠাৎ ছোঁয়াকে এভাবে তুমি বলে সম্মোধন করা কেউ হজম করতে পারছেনা কারণ ওদের দুজনকে সবসময়ই সবাই ঝগড়া করতেই দেখেছে, কখনোই সুন্দর করে একটা কথা বলতেও দুজনকে কেউ দেখেনি।

আর আজ কিনা সেই শুভ্র ছোঁয়ার আঘাত নিজের গালে নিয়ে নিলো, সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। শুভ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আলিফের কাঁধে হাত দিয়ে বলে “মধুবালা কোত্থাও যাবেনা। ও এখানে ছিলো ছোটবেলা থেকে আর এখানেই থাকবে।”

এটা বলে শুভ্র আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারও বললো সবাইকে উদ্দেশ্য করে “এই বিষয়টা নিয়ে আর কোনো কথা হোক এই ঘরে তা আমি চাইনা। সবাই মিলে তরির বিয়ের অনুষ্ঠান কেমনে আরো আনন্দদায়ক সুন্দর করবে তা নিয়ে ভাবো।”

কেউ কিছু বললোনা কারণ শুভ্রর রা’গ সম্পর্কে সবারই ধারণা আছে। শুভ্র তালুকদার বাড়ির একমাত্র বংশধর যার কারণে ওর কথার মান সবাই রাখার চেষ্টা করে, আর ছোটবেলায় একবার শুভ্র বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে নিয়েছিলো রাগের বসে তাই সবাই ওর রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে ওর সকল কথা সকল আবদার মেনে নেয়।
কিছু একটা বুঝে আলিফও চুপ হয়ে গেলো, শুভ্রর হঠাৎ ছোঁয়ার সাথে তুমি করে বলাটা আলিফের মনে সন্দেহের ঝ’ড় তুলে দিয়েছে। শুভ্রছোঁয়ার ব্যাপারটা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে আলিফ।

তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে রেহেনা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো “আপনার মতো মানুষ এই পৃথিবীতে আমি আর একটাও দেখিনি। আপনি খুব স্বার্থপর একজন মহিলা। নিজের স্বার্থ ছাড়া দুই চোখে আর কিছুই দেখতে পাননা। এতো সুন্দর একটা মুহুর্ত নষ্ট করার কী খুব প্রয়োজন ছিলো? সবার মুখের হাসি মুহুর্তেই ছি’নি’য়ে ফেলার ক্ষমতা আপনার মাঝে বিদ্যমান।

সাবধান করতেছি আপনাকে, মধুবালা থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখবেন।”
কথাগুলো বলে আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো শুভ্র। রেহেনা বেগমের গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো এক ফোঁটা নোনাজল। ছোটবেলায় শুভ্রকে অবহেলা করলেও এখন একটা ছেলের অভাব খুব করে অনুভব করেন রেহেনা বেগম। শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করে রেহেনা বেগমের ‘”ক্ষমা করে দে এই অযোগ্য মা কে বাবা।” কিন্তু লজ্জায় সংকোচে বলা হয়ে উঠেনি এক লাইনের শব্দ উচ্চারণ কখনো। উনি যে খুব দেরি করে ফেলেছেন।

লিলি তরির হাতে মেহেদী লাগাতে লাগাতে আঁড়চোখে তাকায় আলিফের দিকে। নাক ফুলিয়ে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে আলিফ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রচন্ড রে’গে আছে সে।
ছোঁয়া তরিকে মেহেদী দিতে দিতে নিজের হাতের বালা জোড়ার দিকেও নজর দিলো একবার। বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে ছোঁয়ার। এই বালার জন্যই আজ সবার আনন্দ মাটি হলো।

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ৩

তবুও বালাজোড়া হাত থেকে খুলতে একটুও ইচ্ছে করছে না ছোঁয়ার।
দূরে দাঁড়িয়ে রাহি নিজের হাতের মোবাইল টা কচলাচ্ছে। রাহির ইচ্ছে করছে ছোঁয়াকে চিবিয়ে খেতে। শুভ্রর এভাবে হুট করে ছোঁয়াকে তুমি বলা মোটেও ভালো লাগেনি রাহির। রাহি রে’গে অস্থির হয়ে দৌড়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়।

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ৫