মধুবালা সিজন ২ পর্ব ৩

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ৩
ফারজানা আক্তার

বিভিন্ন জাতের কাঁচা ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে তালুকদার বাড়ি। কাঠগোলাপ আর বেলিফুল দিয়ে সাজানো স্টেজ টা মনোমুগ্ধকর হয়েছে যাকে বলে একদম ঝাক্কাস। সিঁড়ির দুই পাশের রেলিং সাজানো হয়েছে গাধা ফুল আর রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে সিঁড়ি গুলো আজ।

দুই তলার রেলিংয়ের উপর দুই হাতে ভর দিয়ে পুরো বাড়ি পর্যবেক্ষণ করছে ছোঁয়া। আজ তালুকদার বাড়ির প্রতিটি কোণা দেখে মুগ্ধ হচ্ছে ছোঁয়া। হঠাৎ কেউ এসে ছোঁয়ার চোখ হাত দিয়ে ঢাকতেই ছোঁয়া কেঁপে উঠলো খানিক কিন্তু পরে বুঝতে পেরে এই হাত কার খুশিতে গদগদ করতে করতে বললো “আরে রুহি বেবি তুই, কবে আসলি তোরা? মামা মামি রাহি এসেছে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চোখ থেকে হাত নামিয়ে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে রুহি বলে “আমরা এসেছি সেই ৩০মিনিট হয়েছে। এতো বড় বাড়িতে কাউকে খুঁজে পাওয়ায় মুশকিল হয়ে যায় ছোঁয়াপু।

আচ্ছা ছোঁয়াপু আমি আর রাহি তো জমজ তাহলে তুমি কিভাবে শিউর হয়ে বলো যে আমিই তোমার চোখে হাত দিয়েছি?”
“কারণ তোর সাথে আমার একটা মনের কানেকশন আছে বুঝেছিস? যা রাহির সাথে নেই। তুই অন্য দেশে থাকলেও দেশে আসলে একদম বাঙ্গালী হয়ে যাস কিন্তু রাহি তো রাহি-ই। রাহি সারাক্ষণ ফোন নিয়ে বিজি থাকে, এতোদিন পর আসলেও সে আমাদের সাথে তোর মো মিশে নাহ।”

“আচ্ছা তো বাকিরা কই? তরি আপু লিলি আপু মিহিকাপু আরজু রিয়াপু?”
“লিলি ওর রুমে আছে তৈরি হচ্ছে। আর মিহিকা রিয়া আরজু তরি আপুর সাথে পার্লারে গিয়েছে।”
“ওহ আচ্ছা, তো তুমি তৈরি হবেনা?”
“এইতো যাচ্ছি আমিও। দেখ আজ বাড়িটা কত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, আমার তো শুধু দেখতেই ইচ্ছে করতেছে, চোখ সরাতে একটুও ইচ্ছে করছেনা রে।”

লিলি একটা বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পরেছে। হাত বর্তি চুড়ি, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, মুখে শুধু একটা হালকা ক্রিম দিয়েছে যাতে সাদা ভাবটা না লেগে যেনো মুখশ্রী টা কিছুটা হলেও লালছে দেখায়, বাসন্তী রঙের সাথে একটা কালো রঙের হিজাব দিয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। চোখে কাজল দিতে গিয়েও দিলোনা কারণ ওর খুব ইচ্ছে কোনো একদিন আলিফ নিজ হাতে ওকে কাজল লাগিয়ে দিবে তাই সে কখনোই চোখে কাজল লাগায় না।

লিলি তৈরি হয়ে দুতলা থেকে নিচতলায় নামতেই সামনে দেখতে পায় আলিফ একটা সিলভার রঙের হাতে কাজ করা পাঞ্জাবী পরিধান করে দাঁড়িয়ে ওর মেজু মামা ফারদিন তালুকদারের সাথে গম্ভীর মুখে কিছু কথা বলছে। লিলি অপলকে তাকিয়ে আছে আলিফের দিকে, শ্যামবর্ণ পুরুষটা ওর চোখে এক মুগ্ধতার পরশ। আলিফকে হেঁসে কথা বলতে তেমন একটা দেখা যায়না, আলিফ সাধারণত কথা বলে খুব কম, চুপচাপ থাকে বেশি সময় আর যদি কথা বলে তাও দুই একটা গম্ভীর মুখ করে।

লিলির একটুও ভালো লাগেনা আলিফের এমন রুপ। সবার সাথে হাসবে খেলবে হৈচৈ করবে তারপরই তো একটা মানুষ পরিপূর্ণ সুখী হতে পারে, এভাবে চুপচাপ মুখে গম্ভীর্য ধারণ করে রাখলে কী কারো মনে সুখের রং ধরা দেয়? কখনোই নাহ বরং সারাক্ষণ এমন মুখ করে রাখলে মানুষের ভেতরে বিভিন্ন কিছুর চিন্তা আসে আর ভেতরে ভেতরে মানুষটা অসুস্থ হওয়া শুরু করে।

কিছুক্ষণ পর লিলি খেয়াল করলো আলিফ একা দাঁড়িয়ে আছে আর মাথা নিচু করে ফোনে কি জানি করছে। লিলি পা টিপে টিপে আলিফের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে খুব ধীর কন্ঠে বললো “আলিফ স্যার আপনাকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে, একদম আস্ত একটা শ্যামসুন্দর পুরুষ।”

আলিফ ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে কপালে ভাজ পেলে বলে “সৌন্দর্য মাপতে হয় মন দেখে বাহিরের রুপ লাবন্য দেখে নয়। ভালোবাসতে হয় ব্যক্তিত্য দেখে অবস্থান দেখে নয়।”
কথাটা বলেই আলিফ মুচকি হেঁসে চলে যায় সেখান থেকে।
লিলি একরাশ হতাশা নিয়ে চেয়ে রয়েছে আলিফের যাওয়ার পথে।

“তাহলে কী আমার মনের যত্নে লুকানো সুপ্ত ভালোবাসার কথা বুঝেন আলিপ স্যার? কেনো উনি আমাকে অবস্থানের কথা দেখিয়ে গেলেন? আমি তো উনার সরকারি চাকরির জন্য উনাকে ভালোবাসিনি, উনি যখন বেকার ছিলেন তখনও আমি উনাকে ভালোবাসতাম যদিও প্রকাশ করতাম নাহ। উনার মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হওয়াটা কী আমার দোষ? উনার সরকারি চাকরি হওয়া হুট করে কী আমার দোষ? কেনো উনি আমার ফর্সা হওয়া নিয়ে এভাবে বলে গেলেন, আমার গায়ের রং ফর্সা বলে কী আমার মনটা কুৎসিত হবে? আমার মনটাও তো রঙিন হতে পারে, হতে পারে কোনো শ্যামপুরুষকে নিয়ে সাজানো মুগ্ধ করা সুভাসের বাগান। কিভাবে বলতে পারলেন উনি আমার মন অসুন্দর?

কিভাবে বলতে পারলেন আলিফ স্যার আমি উনার অবস্থান দেখে ভালোবাসি উনাকে? তবে কী আমার অনুভূতি গুলো আরো আগে প্রকাশ করা উচিৎ ছিলো আমার?”
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই লিলির চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পরলো। আলিফ ঘুরেও তাকালোনা একবার লিলির দিকে। লিলির মনে হচ্ছে ওর সুন্দর হয়ে জন্ম হওয়াটাই ওর জন্য অ’ভি’শা’প হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আলিফ লিলির অনুভূতি গুলো বুঝেও না বুঝার মতো হয়ে থাকে কারণ আত্মীয়র মধ্যে সম্পর্ক করা ওর মোটেও পছন্দ না তাছাড়া আলিফ কেউ একজনকে নিজের মনের দখলে সেই স্কুল লাইফেই বসিয়ে ফেলেছে। আলিফ চাইলেও তার সেই মায়াবিনীকে ভুলতে পারবেনা। খুব গভীর ভাবে যে ভালোবাসে তার মায়াবিনীকে সে।

একটা কাঁচা হলুদ রংয়ের লেহেঙ্গা পরে মাথায় আকাশী রংয়ের একটা হিজাব পেঁচিয়ে নেয় ছোঁয়া। মুখে হালকা ফেস পাওডার লাগিয়ে ঠোঁটে ডার্ক কালারের লিপস্টিক লাগিয়ে ঠোঁট মেলে একটা হাসি দেয় সে। যে কোনো অনুষ্ঠানে ঠোঁটে ডার্ক কালারের লিপস্টিক লাগানো অভ্যাসে পরিনত হয়েছে ওর। এর আগে শুভ্র ১০টা ডার্ক কালারের লিপস্টিক ময়লার ঝোপে ফেলে দিয়েছিলো তবুও শুভ্রর থেকে লুকিয়ে আরেকটা কিনেছে ছোঁয়া।

চোখের নিচে হালকা কাজল দিয়ে বিছানায় বসে ছোঁয়া একটা বক্স থেকে বালাজোড়া বের করে হাতে পরে নেয়। বালাজোড়ার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বলে “তুই শুধু হাতের বালা নয় তুই আমার প্রাণ তুই আমার বয়ঃসন্ধি কালের প্রথম অনুভূতি, তোর জন্য খু’ন হতেও রাজি, একবার শুধু চিরদিনের জন্য হয়ে যাহ আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর নিজের থেকে আলাদা করবোনা। ছোঁয়ার প্রমিজ এটা।”

দরজা খুলে শুভ্রর রুমের দরজার দিকে উঁকি দিলো ছোঁয়া। শুভ্রর দরজা বন্ধ দেখে মনে মনে বেশ খুশি হয়ে পা বাড়াতেই কেউ খপ করে বালা সহ ছোঁয়ার হাত ধরে ফেলে। চোখ বন্ধ করে একটা শুকনো ঢুক গিলে ছোঁয়া।
“এতো বড় সাহস তোর? তুই আবারও আমার হবু বউয়ের বালাজোড়া চু’রি করেছিস। তোর নামে আমি মামলা দিবো।”
চোখ খুলে শুভ্রর দিকে তাকাতেই ছোঁয়া হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। হলুদ কালারের পাঞ্জাবী পরেছে শুভ্র যার বুকের বাম পাশে খুব চমৎকার কাজ করা। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে শুভ্রকে নিদারুন লাগছে ছোঁয়ার দৃষ্টিতে। ছোঁয়া অপলকে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। শুভ্র মুচকি হাসে।

“কিরে স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেনো? দে আমার হবু বউয়ের বালাজোড়া দে।”
“দিবোনা, এগুলো এখন আমার হাতে মানে আমার। জীবনেও দিবোনা আমি।”
“চো’রে’র মায়ের বড় গলা।”
“কী তুমি আমাকে চো’র বললে?”
“তো কি বলবো? কিভাবে চু’রি করেছিস তুই হ্যাঁ?

আমি বুঝিনা দাদুমনি কোথায় থাকে তুই চু’রি করার সময়।”
“হি হি হি নানুমনি তো তখন ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমাই।”
শুভ্র ছোঁয়ার হাত থেকে বালাজোড়া খুলতে নিতেই ছোঁয়া এক চিল্লানি দেয়। ছোঁয়ার চিৎকারে শুভ্র হঠাৎ ভয় পেয়ে ছোঁয়ার হাত ছেড়ে দেয় আর তখনই সুযোগ বুঝে সে পালিয়ে যায়। এবার সত্যিই খুব রাগ হচ্ছে শুভ্রর।

ছোঁয়া তরির রুমে আসতেই দেখে রুহি রাহি মিহিকা আরজু লিলি সবাই বসে আছে। তরিকে একটু পরই স্টেজে নিয়ে যাওয়া হবে। রাত প্রায়ই নয়টা ছুঁই ছুঁই। ছোঁয়া এসে রাহির সাথে আলাপ করলো। রাহি তেমন একটা পাত্তা দিলোনা ছোঁয়া বুঝেও হেঁসে উড়িয়ে দিলো তা। রুহি ছোঁয়ার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দুই গালে হাত দিয়ে বললো “ওয়াও সো প্রিটি। তোমাকে আজ অন্নেক সুন্দর লাগছে ছোঁয়াপু মাশাআল্লাহ। ”

ছোঁয়া মৃদু হাসলো। তখনই শুভ্র ওখানে প্রবেশ করলো গটগট পায়ে। শুভ্রর সাথে আলিফ আর মাহিনও এসেছে। তরিকে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছে ওরা।
শুভ্রকে দেখে ছোঁয়ার কলিজা যেনো শুকিয়ে খাট। আস্তে করে ছোঁয়া লিলির পেঁছনে গিয়ে শুভ্রর থেকে আড়াল হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে। শুভ্র বিষয়টা লক্ষ করে ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসির রেখা টানে।

অন্যদিকে লিলির ছোঁয়া শুভ্রর এই লুকোচুরির দিকে কোনো নজর নেই। লিলি আনমনা হয়ে আলিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আলিফ সেটা দেখেও এড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু লিলিকে এড়িয়ে চলতে কেনো জানি বুকের ভেতর চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব হয় আলিফের যা সে বুঝে উঠতে পারেনা।

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ২

সবাই তরিকে নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়েছে। ছোঁয়া রুমের বাহিরে পা রাখতে যাবে ঠিক তখনই শুভ্র ছোঁয়ার হাত ধরে আবার রুমের ভেতরে চলে যায়। সবাই সামনের দিকে নজর দিয়ে হাঁটছে তাই শুভ্র ছোঁয়াকে কেউ খেয়াল করেনি। ছোঁয়া হঠাৎ ভয় পেয়ে যায় শুভ্রর এমন কান্ডে।

মধুবালা সিজন ২ পর্ব ৪