হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১২

হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১২
লেখিকাঃ দিশা মনি

রিফাত জেনে যায় যে সে যাকে রোদেলা ভাবত সে আসলে মেঘলা! তার স্ত্রী রোদেলা নয় মেঘলা।
সত্যটা জেনে রিফাত বিন্দুমাত্র খুশি হয়না। রিফাতের মনে হতে থাকে তাকে ঠকানো হয়েছে। তার সাথে ছলনা করা হয়েছে। রাগে ক্রোধে রিফাত আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাড়িয়ে বেরিয়ে আসে। মুবিন রিফাতকে এভাবে যেতে দেখে ভাবে,
‘ভাইয়ার আবার কি হলো? এভাবে কোথায় যাচ্ছে।’

মুবিন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রিফাত লিফটে উঠে যায়। লিফটে করে একেবারে নিচে নেমে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়। গাড়িতে উঠে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে জোরে ড্রাইভ করতে থাকে।
কিছুদূর গিয়ে অল্পের জন্য বড় একটি দূর্ঘটনার হাত থেকে বেচে যায়। আরেকটু হলেই একটা বাসের সাথে ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল রিফাত। আশেপাশের অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায় রিফাতের সামনে। এমন উদভ্রান্তের মতো ড্রাইভ করার জন্য লোকজন তাকে অনেক কথাই শোনায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রিফাতের কানে সেসব কোন কথাই ঢোকে না। তার মাথায় শুধু এই কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল যে তাকে ঠকানো হয়েছে। যেই মেয়েটাকে সে সবথেকে বেশি বিশ্বাস করেছিল, সবথেকে বেশি ভালোবেসেছিল সেই তাকে ঠকিয়েছে। মিথ্যা পরিচয়ে থেকেছে এতদিন। এতবড় একটা সত্য লুকিয়েছে রিফাতের থেকে।

নিজের নামপরিচয় লুকিয়েছে। রিফাত যাকে রোদেলা ভেবে এত ভালোবাসল, যত্ন করল সে আসলে মেঘলা। এই সত্যটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না রিফাত। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়। পাশে একটি দোকানে গাড়ি থামিয়ে এক প্যাকেট সি’গারেট কিনে নেয়। নিজের সব কষ্ট কমানোর জন্য বেছে নেয় নেশাকে। একের পর এক সি’গারেট খাচ্ছিল রিফাত। ধোয়ার সাথে উড়িয়ে দিচ্ছিল বিশ্বাস ঘাতকতার গ্লানি।

মেঘলা হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিল। তার এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে তার মা-বাবা,রোজিয়া, মেহের, মুন্নি সবাই দেখা করতে এসেছে। সবার মাঝে থেকেও মেঘলা শান্তি পাচ্ছিল না। তার চোখ শুধু একজনকেই খুজছিল। জ্ঞান ফেরার পর থেকে মানুষটাকে একবারের জন্যেও দেখেনি মেঘলা।

অথচ রোদেলার কাছে শুনেছিল তার এক্সিডেন্টের কারণে সবথেকে বিচলিত ছিল সেই মানুষটা। সারারাত এখানে ওখানে ছোটাছুটি করেছে। মেঘলার সুস্থতার জন্য দোয়া করেছে। আর এখন যখন মেঘলা সুস্থ হয়ে গেছে তখন রিফাত একবার দেখা করতেও এলোনা। ব্যাপারটা বেশ ভাবাচ্ছে মেঘলাকে।
মেঘলাকে বিচলিত দেখে রোদেলা তার পাশে এসে বসে। মেঘলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘তোর শরীর এখন ভালো নেই। এখন এত টেনশন করিস না তো। এটা তোর স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। ডক্টর বলেছে তোকে রেস্ট নিতে। এখন আর না ভেবে শুয়ে পড়।’
‘রিফাত কোথায় রোদ? আমার জ্ঞান ফেরার খবর কি ও পায়নি? যদি পেয়ে থাকে তাহলে একটিবার আমার সাথে দেখা করতে এলো না কেন?’

এই ব্যাপারটা রোদেলাকেও বেশ ভাবাচ্ছিল। যেই রিফাত কাল অব্দি মেঘলার সুস্থতার জন্য কত কি করল এখন যখন মেঘলা সুস্থ হলো তখন একবার দেখা করতেও এলো না। তবুও মেঘলাকে বোঝানোর জন্য বলে,
‘হয়তো কোন জরুরি কাজ পড়ে গেছে তাই আসতে পারে নি। তুই তো জানিস মেঘ তোর স্বামীর কত কাজ।’
‘সেই কাজটা কি আমার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ?’

বেশ অভিমানী সুরে প্রশ্নটি করল মেঘলা। রোদেলা কি উত্তর দেবে কিছু বুঝতে পারছিল না। অনেক ভেবে বলল,
‘তুই তো এতটা অবুঝ না মেঘ। ছোট থেকে তুই কতো বুঝদার আর ধৈর্যশীল। এখন হঠাৎ এরকম করে অধৈর্য কেন হয়ে গেছিস?’

‘প্রসঙ্গ যখন ভালোবাসার তখন ধৈর্য্য আসে না রোদ। আমি জানি তুই আমার থেকে ৫ সেকেন্ডের বড়। কিন্তু তাই বলে এই না তুই আমার থেকে সবকিছু ভালো বুঝিস। আমি সবটা বুঝি জন্য এভাবে বলছি। রিফাত যে কাল অব্দি নাকি অস্থির ছিল, আমার জন্য চিন্তিত ছিল, আজ সকাল থেকে আমার সাথে একবার দেখা করতে এলো না। আচ্ছা দেখা করার কথা বাদ দিলাম। ফোন করে একটা খবরও নিল না। এসব এত সহজ মনে হয় তোর কাছে?’

রোদেলা জানে মেঘলার প্রত্যেকটা কথাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এখন যে করেই হোক তাকে মেঘলাকে শান্ত করতে হবে। ডক্টর মেঘলাকে স্ট্রেস নিতে মানা করেছে। তাই রোদেলা বলে,
‘বললাম তো রিফাত হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সময় সুযোগ পেলে ঠিকই খোজ নেবে। এখন তুই রেস্ট নে।’
মেঘলা নরম গলায় বলে,

‘আমি আজই রিফাতকে সব বলে দেব দেখিস। আর অপেক্ষা করব না। রিফাত আমার জিবনে ঠিক কতোটা মূল্যবান সেটা আমি বুঝে গেছি। তাই আমি ওকে আর ঠকাতে পারব না। তাছাড়া আমাদের বিয়েটাও তো জায়েজ না। আমি চাই রিফাতকে সব সত্য বলে ওকে বিয়ে করে নিতে। এই মিথ্যা সম্পর্ক আর টেনে নিয়ে যাবো না আমি।’

রোজিয়া বসার ঘরে বসে দুশ্চিন্তা করে চলছিল। ঘড়ির কা’টায় তখন রাত ১২ টা। সকাল থেকে রিফাতের কোন খোজ নেই। কল করলে ফোনও তুলছে না। সবমিলিয়ে ভীষণ চিন্তার মধ্যে ছিলেন রোজিয়া। সমানে পায়চারি করে চলেছেন আর নিজের ছেলের কথা ভাবছেন। এমন সময় কলিং বেজে ওঠায় তার মনে আশার সঞ্চার হয়। তড়িঘড়ি করে দরজাটা খুলে দেন রোজিয়া।

দরজা খুলেই রিফাতকে দেখতে পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সব দুশ্চিন্তা তার মন থেকে দূর হয়ে যায়।
রিফাতকে ভালোভাবে খেয়াল করতেই রোজিয়ার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। ভীষণ অগোছালো লাগছিল রিফাতকে। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাটা দিন কিভাবে কা’টিয়েছে। রোজিয়া অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
‘কি হয়েছে তোর রিফাত? এমন দেখাচ্ছে কেন? রোদেলার ব্যাপারটা নিয়ে কি তুই চিন্তিত? আর চিন্তা করিস না। রোদেলা একদম ঠিক আছে।’

রোজিয়ার কথাটা শুনে রিফাত পাগলের মতো হাসতে থাকে। রোজিয়ার ভ্রু কুচকে আসে।
‘এভাবে পাগলের মতো হাসছিস কেন রিফাত?’
রিফাত হাসি থামিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,
‘কে রোদেলা? রোদেলা নামের কেউ তো আমার জিবনে নেই৷’
‘তুই এসব কি বলছিস? রোদেলা তোর স্ত্রী।’
‘মিথ্যা মিথ্যা সব মিথ্যা রোদেলা বলে কেউ আমার জিবনে নাই, কখনো ছিলনা। আমাকে ঠকানো হয়েছে। ঠকে গেছি আমি।’

রিফাত রোজিয়াকে সকালের ঘটনাগুলো বলে। সব শুনে রোজিয়া হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।
‘আমার ছেলেকে ঠকিয়েছে ঐ মেয়ে। আমি ওকে ছাড়বোনা। আমার আসল রূপ ও দেখেনি। এবার দেখিয়ে দেব। তুই যা রিফাত নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। এসব কিছু আমি সামলে নেব।’

দূর থেকে দাড়িয়ে মা-ছেলের সব কথোপকথন শুনে নেয় মেহের। তার মনে অজানা ভয় কাজ করতে থাকে। রোজিয়ার ভয়ানক রূপ দেখেছে মেহের। তাই জানে মেঘলার সাথে ঠিক কি হতে পারে। মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগে মেহেরের। পরক্ষণেই মনে পড়ে তার ছেলেও তো জড়িয়ে গেছে এসবে। যদি রিফাতের স্ত্রী মেঘলা হয় তারমানে মুবিন যাকে বিয়ে করেছে সে রোদেলা!
মেহের বলে ওঠে,

‘এবার কি করব আমি? না, যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।’
মেহের নিজের রুমে চলে যায়। বিছানায় শুয়ে অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা করতে থাকে।

মেঘলা আজ এক সপ্তাহ হলো হাসপাতালে আছে। এই কয়েকদিনে তার মা-বাবা আর রোদেলা ছাড়া কেউই তার খোজ নেয়নি। এই নিয়ে মেঘলা অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে।
আজ মেঘলাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হবে। মেঘলা রোদেলাকে বলে,
‘রিফাত আজও কি আমাকে নিতে আসবে না?’

‘আমি কি করে জানব বল? আমিও তো অনেকদিন থেকে ঐ বাড়িতে যাইনা। মুবিনও খুলনা চলে গেছে। এই মুহুর্তে তাই ঐ বাড়ির কোন খবর আমি জানি না।’
মেঘলা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১১

‘নিশ্চয়ই কোন বড় সমস্যা হয়েছে। আমার আর দেরি করলে চলবে না। আজই আমি ঐ বাড়িতে ফিরে যাব।’
মেঘলা রোদেলার উঠে দাড়ায়। এরপর তাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
কলিং বেল বাজাতেই মেহের এসে দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলামাত্রই মেঘলা রিফাত রিফাত বলে চিৎকার করতে থাকে।
মেঘলার ডাকে রিফাত চলে আসে। মেঘলা ও রিফাত মুখোমুখি হয়।

হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১৩