হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১১

হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১১
লেখিকাঃ দিশা মনি

মেঘলা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আছে।
‘না আমি রিফাতকে কিছু বলব না। ও যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে যে আমি বাচতে পারবো না।’
রিফাত মেঘলাকে একমনে কিছু ভাবতে দেখে তার সামনে চুটকি বাজায়।
‘কি এত ভাবছ? ফাবিহা আমার অতিত। ওকে নিয়ে আমি আর কিছু ভাবছি না। এখন আমি শুধু তোমাকে নিয়ে থাকতে চাই। শুধু তোমার কথা ভাবতে চাই। আই লাভ ইউ রোদেলা।’

মেঘলা আচমকা উঠে চলে যায়। রিফাত বুঝতে পারে না মেঘলা এমন করছে কেন। তাই সেও মেঘলার পিছন পিছন যায়। মেঘলা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তার ফুটপাত ধরে হাটতে থাকে। বিভিন্ন রকম চিন্তায় তার মাথা আর কাজ করছে না। জিবনে প্রথম কাউকে ভালোবাসলো এখন তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় খুব গভীরভাবে অনুভব করছে মেঘলা। এই যন্ত্রণা যে কতটা গভীর সেটা মেঘলা অনুধাবন করতে পারছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেঘলা এটাও খুব ভালো করে জানে, সে যতোই চেষ্টা করুক না কেন সত্যটা বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না। একদিন না একদিন রিফাত জানতে পারবেই যে সেই মেঘলা। অন্য কারো কাছ থেকে জানার চেয়ে মেঘলার থেকে জানাই ভালো। তাই মেঘলা ভাবল আজকেই রিফাতকে সবকিছু বলে দিবে৷

মেঘলা এসব ভাবছিল জন্য কোনদিকে কোন খেয়াল ছিল না তার। ফুটপাত থেকে কখন রাস্তায় এসে গেছে সেটা একেবারেই বুঝতে পারে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা একটি গাড়ি দ্রুতবেগে তার দিকে ছুটে আসে। রিফাত দূরে দাড়িয়ে দেখতে পায় একটি গাড়ি মেঘলার দিকেই আসছে। সে চিৎকার করে মেঘলাকে ডাকতে থাকে। মেঘলা রিফাতের গলা শুনে পিছনে ফিরে তাকায়। রিফাত মেঘলাকে সরে আসতে বলে। মেঘলা সরে আসার আগেই গাড়িটি তাকে দ্রুতবেগে এসে জোরে ধা’ক্কা দেয়। মেঘলা দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে।

রিফাত মেঘলা বলে চিৎকার করে উঠে। মেঘলার কাছে এসে তার মাথা নিজের কোলে রেখে বলে,
‘রোদেলা তাকাও আমার দিকে। আমি তোমার কিছু হতে দিবো না। আমার কথা কেন শুনলে না তুমি? তোমায় তো বললাম সরে যেতে আত তুমি,,,,’
মেঘলার নিঃশ্বাস দ্রুত পড়ছিল। অনেক কষ্টে সে বলে,

‘আমি আপনা,,আপনাকে কিছু বলতে চাই,,,’
‘আমি তোমার সব কথা শুনব। তুমি শুধু আমাকে ছেড়ে যেও না,,,আমি এখনই তোমায় হসপিটালে নিয়ে যাব।’
‘আমি ঠকিয়েছি আপনাকে,,আমি ঠক,,,’
মেঘলা আর কিছু বলতে পারে না। তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
রিফাতকে মেঘলার বলা কথাগুলো খুব ভাবাচ্ছিল। সে এসব ভাবনাকে পাত্তা না দিয়ে দ্রুত মেঘলাকে নিজের গাড়িতে তুলে হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়।

রোদেলা মুবিনের জন্য অপেক্ষা করছে। মুবিন রুমে আসতেই তার শার্টের কলার ধরে বলে,
‘সবকিছু তোমার প্ল্যান তাইতো? তুমি সব নষ্টের মূল। তুমি প্ল্যান করে আমাদের দুই বোনকে এরকম সমস্যায় ফেলেছ।’
মুবিন দৃঢ়তার সাথে বলে,

‘আমি কিছু করিনি। তুমি আমাকে বুঝেছ। আমি কিছুই করিনি। যা হয়েছে সব রিফাতের জন্য।’
‘একেই তো নিজে অন্যায় করেছ। এখন অন্যের উপর দোষ চাপাচ্ছ। তোমার তো লজ্জা থাকা দরকার।’
মুবিন রোদেলাকে একটা ভিডিও দেখায়। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রিফাত মুবিনকে বলছে,
‘তোকে আর তোর পরিবারকে আমার একদম সহ্য হয়না। তোর মা আমার মায়ের থেকে তার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে, তুই আমার থেকে আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছিস। আমিও এবার রিভেঞ্জ নেবো। তোর থেকে আমি তোর ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নেব। রোদেলাকে কেড়ে নেব তোর থেকে।’

রোদেলা ভিডিওটা দেখে ভীষণ অবাক হয়। মুবিন বলে,
‘দেখলে তো রোদেলা। এটাই রিফাতের আসল রূপ। যখন সে জানতে পারে তোমার আর আমার ব্যাপারে তখন আমাদের আলাদা করার জন্য সে এতকিছু করেছে। আমাদের ব্রেকআপের পেছনে ওর হাত ছিল। ও আমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করেছিল। তোমার পরিবারের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আব্বুকে বলে তোমাকে বিয়ে করার কথা নিয়ে নেয়। সবকিছু ও করেছে আমার থেকে তোমাকে কেড়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা সত্য। তাই দেখো শেষপর্যন্ত ও সফল হয়নি। আমরা আজ এক হয়েছি।’

সবকিছু শুনে রোদেলার কাছে ধীরে ধীরে সবকিছু পরিস্কার হয়। তার শুধু একটা ব্যাপারই খারাপ লাগছিল। তার বোনের জন্য, কারণ মেঘলা এসব কিছুর মাঝে ফেসে গেছে। অন্যের প্রতিশোধ, অন্যের রোষানলের স্বীকার হতে হয়েছে বেচারি মেয়েটাকে। সবাই তাকে শুধু নিজের জন্য ব্যবহার করেছে।
রোদেলা ভাবছিল,

‘যখন আমার বোনটা সবকিছু জানতে পারে তখন ওর কি হবে? এমনিতে অনেক কষ্ট পেয়েছে মেঘ। আপনজনের থেকেই সব কষ্ট পেয়েছে। এখন রিফাতকেও ভালোবেসে ফেলেছে। যদি রিফাতের ব্যাপারে এসব কিছু জানতে পারে তাহলে যে ও একেবারে শেষ হয়ে যাবে।’
এসব কিছু ভেবে রোদেলা মুবিনকে বলে,
‘এসব কথা যেন আমরা ছাড়া আর কেউ না জানে। মেঘলা যেন একেবারেই না জানে। এটা আমার রিকোয়েস্ট।’

রিফাত মেঘলাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছে। ভিতরে মেঘলার চিকিৎসা চলছে। ডাক্তার বলেছে তার অবস্থা বেশি ভালো না। অনেক ব্লিডিং হওয়ায় রক্ত লাগবে। মেঘলার রক্ত এ নেগেটিভ। রক্তটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই রিফাত খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্তের প্রয়োজন।
রিফাত অনেক ব্লাড ব্যাংকে যোগাযোগ করেছে, চেনাজানা অনেককেও বলেছে, ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপেও পোস্ট করেছে। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।

রিফাত কিছু একটা ভেবে মুবিনকে ফোন করে। রোদেলা মুবিনের সাথে ছিল। মুবিন ফোনটা রিসিভ করতেই রিফাত বলে,
‘মেঘলা কি তোর পাশে আছে? ওকে প্লিজ ফোনটা দে। অনেক জরুরি কথা আছে।’
মুবিন রোদেলাকে ফোনটা দেয়। রোদেলা ফোনটা ধরতেই রিফাত কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,
‘মেঘলা তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি সিটি হসপিটালে চলে এসো। রোদেলার,,,,রোদেলার এক্সিডেন্ট হয়েছে। ওর জন্য এ নেগেটিভ ব্লাড প্রয়োজন। তোমরা তো দুই বোন। তোমাদের ব্লাড গ্রুপ নিশ্চয়ই এক।’

রোদেলা মেঘলার এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে ভয় পেয়ে যায়।
‘কি হয়েছে মেঘ,,,রোদেলার? কিভাবে হলো? আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।’
ফোনটা রেখে দিয়েই রোদেলা কান্নাকাটি শুরু করে। মুবিন রোদেলাকে কাদতে দেখে জানতে চায়,
‘তুমি কাদছ কেন? কি হয়েছে?’

‘মুবিন তাড়াতাড়ি সিটি হসপিটালে চলো। মেঘলার এক্সিডেন্ট হয়েছে। ওর ব্লাড প্রয়োজন। আমার বোনটার কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের ওখানে যেতে হবে।’
মুবিন রোদেলাকে নিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে পড়ে।
হসপিটালে পৌছে রোদেলা মেঘলার জন্য ব্লাড দেয়। একজন ডক্টর বলে,
‘আপনি একদম সঠিক সময়ে এসেছেন। আরেকটু দেরি হলে অনেক বড় সমস্যা হয়ে যেত। পেশেন্টের যা ব্লাড লস হয়েছে। লাইফ রিস্ক হতে পারত।’

মুবিন রিফাতের কাছে জানতে চায়,
‘কিভাবে কি হলো? তুমি তো রোদেলার সাথে ছিলা। নিজের স্ত্রীর প্র‍তি খেয়াল রাখতে পারো না। কেমন স্বামী তুমি?’
রিফাত মুবিনের শার্টের কলার ধরে বলে,
‘চুপ,,,একদম চুপ। আমার স্ত্রীর খেয়াল আমি ভালোভাবেই রাখতে পারব। ভুলে যাস না রোদেলা এখন আমার বউ, তোর গার্লফ্রেন্ড নয়। ওকে নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে।’

মুবিন হালকা হাসে। সে রিফাতের অবস্থা দেখেই বুঝতে পেরেছে সে এখন কতটা ভালোবাসে তার স্ত্রীকে। রিফাতের চোখে মেঘলাকে হারানোর ভয় স্পষ্ট দেখেছে সে। মুবিন মনে মনে বলে,
‘তুমি কিছু না জেনেই এত ভালোবেসেছ মেঘলাকে। যখন সত্যটা জানতে পারবে তখন প্লিজ দূরে ঠেলে দিও না ভাইয়া। তুমি আমাকে নিয়ে যাই ভাবো, আমার যতই ক্ষতি চাও না কেন আমি তোমার ভালো চাই। আমি এটাই চাই যে তুমি মেঘলাকে নিয়ে ভালো থাকো। তোমাদের দুজনের ভালোবাসা পূর্ণতা পাক।’

মেঘলার জ্ঞান ফিরে আসে। যদিও এখন তার অবস্থা খুব একটা ভালো না। দূর্ঘটনার কারণে পুরো শরীরে অনেক ক্ষত তৈরি হয়েছে। অনেক ব্যাথা করছে সেগুলো। রিফাত সারারাত নির্ঘুম কা’টানোর জন্য একটু বাইরে গেছে। মেঘলার জ্ঞান ফেরার কথা শুনে তাই রোদেলা মেঘলার কাছে আসে।
মেঘলা জ্ঞান ফিরে রোদেলাকে দেখে। রোদেলা বলে,

‘এত অসাবধানী কিভাবে হলি তুই? যদি বড় কোন বিপদ হতো তাহলে কি হতো ভাবছিস।’
মেঘলা কাপা কাপা গলায় বলে,
‘আমি আর মিথ্যা নাটক করবো না রোদ। আমি চাই রিফাতকে এটা জানাতে যে আমিই আসলে কে। আমি রোদেলা নই মেঘলা।’

হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১০

রিফাত হসপিটালে ফিরে মেঘলার জ্ঞান ফেরর কথা শুনে এসেছিল তার সাথে দেখা করতে। কেবিনের দরজায় দাড়িয়ে থেকে রোদেলা আর মেঘলার কথোপকথন সে শুনে ফেলে। রিফাত জেনে যায় যে সে যাকে রোদেলা ভাবত সে আসলে মেঘলা! তার স্ত্রী রোদেলা নয় মেঘলা।

হারিয়েছি নাম পরিচয় পর্ব ১২