হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৬

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৬
রাউফুন

মাইজিন অফিস থেকে বের হচ্ছিলো। হঠাৎ তার বাবা আব্দুর রৌফ সুলতানের সঙ্গে চোখাচোখি হলো মাইজিনের। মাইজিন তাকে পাশ কা’টিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে চলে যাচ্ছিলো।
‘মাইজিন! ভদ্রতা ভুলে গেছো দেখছি!’

থমকে দাঁড়ালো মাইজিন। কতটা নিদারুণ ভাবে শুধালেন কথাটা। অথচ লোকটা যা করেছে সেজন্যই তার সঙ্গে সম্পর্কের এতোটা অবনতি হয়েছে। মাইজিন সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো। রৌফ সুলতান হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাইজিনের চোখে চোখ রেখে বললেন,
‘তোমার আমাকে এড়িয়ে চলার কারণ টা কি জানতে পারি? কই এতো দিন তো এমন করো নি তবে এই ছয়মাসে কি এমন পরিবর্তন হলো যে তুমি সাধারণ বাক্যলাপ ও করো না।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘হুম?’ ভ্রুকুটি করে বলে মাইজিন।
‘হুম? এতো গুলো কথার বিনিময়ে শুধু হুম?’
‘আমি আমার লাইফে অপছন্দের তালিকায় ফেলা মানুষের সঙ্গে কথা বলি না।’
‘হোয়াট? ডোন্ট ফরগেট আ’ম ইউর ডেড। হাউ ডেয়ার ইউ টক লাইক দিস? স্পীক পোলাইটলি! আন-লেস!’
‘আন-লেস হোয়াট ডেড?’

‘কিছু না। এখন বলো কোথায় থাকছো?’
‘আমি কোথায় থাকি এই কথা জিজ্ঞেস করার জন্য ছয়টা মাস লাগিয়ে দিলেন?’
‘কি বলতে চাইছো? আমি কি তোমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করিনি? তুমি দিনের পর দিন এড়িয়ে গেছো আমায়!’
‘আপনি অন্য পন্থা অবলম্বন করেও আমার খোঁজ নিতে পারতেন! আপনার সেই ক্ষমতা আছে।’
‘আমি নিইনি কারণ আমি চাইনি তোমার ব্যাক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করতে।’

‘আপনি সত্যিই চান নি তবে আমার ব্যাক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ হবে বলে না। আপনি চাননি কজ আপনি নিজের ইগো টাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।’
‘মাইজিন!’

‘ইয়েস ডেড আমি বাধ্য হচ্ছি বলতে। জীবনে কখনোই আমার ভালো-মন্দ খোঁজ রেখেছেন? আমি কতটা কষ্টে ছিলাম, কতটা আনন্দে ছিলাম, যখন আপনাকে আমার প্রয়োজন ছিলো, খুব করে চাইতাম আপনাকে, খোঁজ নিয়েছেন তখন? আপনার অগোচরে কি হতো তার খোঁজ রেখেছেন? শুধু বিজনেস, টাকা পয়সা, বিদেশে ছোটাছুটি করেছেন। নিজের এক মাত্র সন্তানের খোঁজ নেওয়ার মতো সময় কি সত্যিই আপনার ছিলো? আমি আপনার ছেলে, আপনি আমার বাবা, একজন সন্তানের যে বাবার ভালোবাসার প্রয়োজন পরে সেটা কি এতো বছরেও আপনি বুঝতে পারেন নি? যেহেতু আপনার ভালোবাসা থেকে এতো বছর বঞ্চিত ছিলাম তখন এখনো পারবো। বিশ্বাস করুন এখন আমি ভালো আছি আমার স্ত্রীর সঙ্গে!’

‘তুমি বিয়ে করেছো? কি হলো বলো? আমরা কেউ-ই জানি না! কিন্তু কেন? রৌফ সুলতানের ছেলে বিয়ে করেছে অথচ কেউ-ই তা সম্পর্কে অবগত নয়। আমাদের কি জানার অধিকার নেই? অন্তত তোমার মাকে জানাতে পারতে। কেন জানাওনি আমাদের?’ অবাক হয়ে বলেন রৌফ সুলতান
রৌফ সুলতানের কথার উত্তর দেইনা মাইজিন। শুধু যাওয়ার আগে বলে,

‘এমন কাউকে বিশ্বাস করুন যে আপনার রাগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালো মানুষ টাকে চিনতে পারবে। আপনার সততাকে চিনতে পারবে। তাকে বিশ্বাস করবেন না যে আপনার ভালো হৃদয়ের অন্তস্থলে লুকিয়ে থাকা সৎ মনুষ্যত্বকে চিনতেই পারবে না। যে আপনার ভালো মানুষির সুযোগে আপনার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে আপনার থেকে আলাদা করে দিয়েছে তাকে চিন্তেই পারলেন না! একটু চোখ কান খোলা রাখলেই, আশে পাশে দেখলেই বুঝে যাবেন কে আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছে। আসি। আমার স্ত্রী আর আমার জন্য দোয়া করবেন। আসসালামু আলাইকুম।’
মাইজিন চলে গেলো। আর পেছনে ফেলে গেলো রৌফ সুলতানের একরাশ আত্ম গ্লানিবোধ আর অবাক করা মুখ।

তুলিকা রান্না করছে। ব্রেকফাস্ট তৈরির সময় মাইজিন এসে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। ঘাড়ে নাক ঘষে আবার চলে গেলো। একটু পর আবার এসে গালে চু’মু দিলো। মাইজিনের এসব কাণ্ডে যারপরনাই অবাক তুলিকা। আবারও এসে ডান গালে চু’মু দিলো তুলিকার। তারপর আবার এসে মাথায় চু’মু দিলো। পরবতর্তীতে এসে হাতে চু’মু দিলো। ষষ্ঠ বার যখন এসে ওষ্ঠে চু’মু দিতে যাবে তখনই তুলিকা একটা হাড়ি তার মুখের সামনে ধরেছে। মাইজিন সেই হাড়িতে চুমু দিয়েছে। ঠিক সেই মুহুর্তে মিষ্টি ওখানে এসে উপস্থিত! এদিকে তুলিকা হেসে লুটোপুটি খাওয়ার অবস্থা। পে’ট চেপে হেসেই যাচ্ছে। মিষ্টি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মাইজিনের দিকে।

‘একি ভাইয়া আপনি এভাবে হাড়িতে মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
মাইজিন চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ‘‘আআআহ!” করে চিৎকার দিয়ে ছিটকে সরে যায়। কি ভেবেছিলো কি হলো!
‘মিষ্টি তুমি কখন এলে?’
‘আপনি যখন হাড়িতে চুমু দিয়েছেন তখনই!’
‘তুমি কিছুই দেখো নি ঠিক আছে? যাও রেডি হও!’
মিষ্টি মাথা চুলকে চলে গেলো।

‘এই এটা কি হলো? মাইজিন তুলিকার কাছে এসে দাঁড়ালো।
‘কদিন থেকেই দেখছি এরকম করছেন! আমাকে এতো জ্বালাচ্ছেন কেন শুনি?’
‘কি হয়েছে তাতে? আমি আমার বউকে একটু চু’মুও দিতে পারবো না?’
‘এতো দিন ভাবতাম কি জানেন?’
‘কি ভাবতে?’

‘আপনি একটা নিরীহ, নিরামীষ আন-রোমান্টিক পার্সন! কিন্তু না এখন বুঝতে পারছি। আল্লাহ এভাবে জ্বালান যদি আমি কিভাবে কাজ করব!’
‘হ্যাঁ বউয়ের কাছে সব ছেলেই রোমান্টিক। এখন মানুষকে কি দেখাতে যাবো আমি রোমান্টিক? তখন আমাকে কাছেই ঘেঁষতে দেও নাই তাই জানো না আমি কতটা রোমান্টিক!’
মাইজিন জড়িয়ে ধরে তুলিকাকে। তুলিকা কনুই দিয়ে গুতা দিলো তার পে’টে।

‘আউচ! এটা করতে পারলে তুমি?’
‘খুব পারলাম।’
‘কাঁদতে হবে আড়ালে রোমান্টিক বর হারালে।’
‘অদ্ভুত!’

মাইজিন আর নাফিস টংয়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। নাফিস কখন থেকে নার্ভাস। কাপের পর কাপ খালি হচ্ছে চায়ের, কিন্তু এখনো অব্দি কিছুই বলতে পারেনি নাফিস। মাইজিনের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। সে মুখ বিকৃত করে বলল,
❝তুই কি বলবি, এক্সাক্টলি কি বলতে চাইছিস?❞
❝মিষ্টি আমাকে মে’রে’ছে।❞ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল নাফিস।
❝কিহ? আবার?❞
‘হ্যাঁ!’

‘তুই আবার সেটা গর্ব করে বলছিস? মা’র খেয়ে কেউ লজ্জা পায়?’
‘গর্ব করবো না তো কি করবো। ওইভাবেই তো ওঁ আমাকে স্প’র্শ করে একটু তাই লজ্জা পাচ্ছি!’
‘আসলেই? মানে সিরিয়াসলি? মা’র খেয়ে কেউ লজ্জা পায়? তা আবার কি বলেছিলি যে উড়ং ধোঁলাই দিলো?’
‘বলেছিলাম চলো বিয়ে করি!’

‘হেই কি জন্য বলছিস তুই এসব? মাথায় একটা বা’রি দিয়ে চেং দোলা করে তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিবো। মিষ্টির হাতে মা’র খেয়েছিস এবার আমার হাতে খাবি। তুই ওর পেছনে ছুটতেছিস হ্যাঁহ? ওঁ আমার বোন। ওঁকে ছাড় এবার!’
‘তুই বুঝতে পারছিস না কেন আমি ওঁকে ছাড়া থাকতে পারবো না। হোক সে বাচ্চা, হোক সে রাগীনি, সে আমার বাচ্চা মরিচ!’
‘মিষ্টির বয়স তুই জানিস?’
‘সে কী জানবো না কেন?’

‘তাহলে কোন সেন্সে তুই ওই বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পরলি? আর তোর মতো বুড়োকে দিয়ে বিয়ে দিবো আমার বোনকে ভাবলি কিভাবে?’
‘হ্যাঁহ ওসব ভেবে কি আর প্রেম হয়? আমি কি করবো যদি আমি একটা বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পরি।’
‘তুই আসলে এখন ইয়েএএ ব্যা’টা!’
‘ধুর! আমি আজকে মিষ্টিকে দেখেছি আমার ঘরে!

স্বপ্ন দৃশ্যে মিষ্টিকে খাটের তলায় ঢুঁকিয়েছিলাম। সেখানে বহুক্ষণ সে থেকেছে। ছবি এঁকেছে। আমার সঙ্গে গল্প করেছে।’
‘শেষ পর্যন্ত খাটের তলায়? আর কোনো জায়গা পাস নি খাটের তলায় ঢুকিয়েছিস। এই তোর আক্কেল? তুই যেমন অদ্ভুত তোর স্বপ্নও অদ্ভুত! খাটে বসাতি।’
‘যাহ এভাবে বলিস না।’ নাফিস আবারও লজ্জা পেলো।
‘ওটা স্বপ্ন নয় ব্যাটা ওটা তোর হ্যালুসিনেশান।’
‘আরে না সত্যিই!’

‘আধুনিক খাটের হাইট সম্বন্ধে তোর কোনও ধারণা আছে? তার তলায় পনেরো-ষোল বছরের বাড়ন্ত একটা মেয়ে ঢুকতেই পারে না। ঢুকলেও সর্বক্ষণ তাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে হবে।’
‘স্বপ্নের মধ্যে সবই হয়।’
মাইজিন হা হা করে হেসে উঠলো। মাটির চায়ের কাপে আর একটা চুমুক দিয়ে বললো, ‘কোনও একটা জায়গায় কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিলন প্রয়োজন। ফাউন্ডেশান ছাড়া বাড়ি দাঁড়ায়?উঁহু শুয়ে পরবে! তেমনি তোর মিষ্টিকে নিয়ে স্বপ্ন টাকে ছাড়তে হবে! তুই তাকে খাটের তলায় ঢুকিয়েছিস এটা মিষ্টি জানলে তোর খবর আছে।’

‘তুই খাটের তলায় ঢোকানো টাকে এত ইমপর্টেন্স দিচ্ছিস কেন?’
‘নিশ্চয় দেবো। এখন তোর প্রতিটি কথা মূল্যবান। তাৎপর্যপূর্ণ। মিষ্টিকে যদি পটাতে না পারিস জীবনে তোর বউ পাওয়া হবে না।’
‘উম হবে না হুহ্! লাইন লেগে আছে আমার পেছনে মেয়ের। জুনিয়র না হলে সিনিয়র, সিনিয়র না হলে বিয়াত্তা আন্টিরা সবাই আছে।’

‘তোর কপালে আন্টিই জুটবে না। এই নারকেল তেল দেওয়া বাদ দে নাইলে মিষ্টি কেন শিমেল ও পাবি না।’
‘তুই আমার জাত শত্রু। না হলে এভাবে বদ দোয়া করতে পারতি না।’ নাফিস উঠে হাঁটা ধরলো।
‘আরে যাচ্ছিস কোথায়?’
‘মিষ্টিকে পটাতে হবে। ‘
‘আবার মা’রা পরিস না দেখিস।’

‘পরলে পরবো তাতে তোর কি? তোর মতো বন্ধু যেনো কোনো মানুষের না হয়। ভু-ত-জ্বীনও তার থেকে বন্ধু হিসেবে ভালো।’
‘পারলে একটা ভু’ত বন্ধু বানিয়ে দেখা।’
‘না বাবা ওসবের কি প্রয়োজন! রাতে যদি ঘা’ড় টাই না থাক তার থেকে তুই ভালো। আয় বন্ধু, আয়। কাছে আয়, গলা ধরে কান্দি!’

‘যাহ ভাগ সা’লা!’
‘মিষ্টিকে পটানোর একটা টিপস দে না ভাই!’
‘জীবনে না। আমার বোনকে বিয়ে দেবো না তোর কাছে সালা।’
‘আরে তুই কেন সালা বলিস? আমি তোকে বলবো এটা।’
‘ম’র’তে না চাইলে এখান থেকে যাহ।’
‘লাগবে না যাহ। মনে রাখিস আজ অবলা বলে আমাকে এভাবে পর করলি তো? দেখিস আমি একদিন ওই বাচ্চা মরিচ কে পটিয়েই ছাড়বো।’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৫

‘তোর শরীরের চামড়াটা তবে পুরু করিস! না হলে হাড্ডি ছাড়া কিছুই খুঁজে পাবি না।’ হাসতে হাসতে বললো মাইজিন।
‘যাহ না। এভাবে ভয় দেখাস কেন? ভয় পাচ্ছি আমি!’
মাইজিন হো হো করে হেসে ফেলে আবারও!

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৭