হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৯

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৯
রাউফুন

ঘটনাটা পরের দিন ভোর বেলার। মাইজিন নড়েচড়ে উঠে। তার দম বন্ধ লাগে, হাসফাঁস করছে সে। বুকের উপর ভারী কিছু অনুভব হয়। সহাস্যে রেগেমেগে এলোপাতাড়ি উঠে বসে। কোনো কিছু না ভেবে তুলিকাকে নিজের বুকের উপর থেকে ধাম করে ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দেই বিছানা থেকে। আকস্মিক ঘটনা হতবিহ্বল তুলিকা। ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে বিছানা থেকে ফ্লোরে ছিটকে পরে। আক্রোশে ফেটে পরেছে মাইজিন। এই মুহুর্তে তাকে দেখে যে কেউ ভয় পাবে। অত্যন্ত কর্কশ টোনে বলে,

‘তোমার সাহস কি করে হয় আমার কাছে আসার? অসভ্য মেয়ে মানুষ!’
মাইজিন ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। তুলিকার ঘুম ঘুম ভাব উবে গিয়েছে তখনই। মাইজিনের এমন ব্যবহারে যারপরনাই অবাক হয়। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে মেঝেতেই বসে রইলো সে। এ কেমন ব্যবহার মাইজিনের? এমন অদ্ভুত ভাবে রেগেই বা গেলো কেন? সে পরে যাওয়ায় মাজায় ব্যথা পেয়েছে। উঠতে চাইলেও পারলো না। কোনো রকমে খাটের পাশি ধরে উঠার চেষ্টা করতেই মাইজিনের গলা পেলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আরে তুলিকা, ফ্লোরে বসে কি করছো?’
তুলিকার কাছে দুই মিনিটের মধ্যে মাইজিনের এই বদলে যাওয়া টা দেখে অদ্ভুত ঠেকে। কি হলো মাইজিনের?
‘আপনার মনে নেই আমি কিভাবে পরলাম এখানে?’
‘কি মনে থাকবে? দেখি উঠো!’ মাইজিন তুলিকাকে ধরে তুলে খাটে বসালো।
‘ নিশ্চয়ই বা’জে স্বপ্ন দেখছিলে তাই না? খুব বেশি জোরে পরে গেছিলে নাকি? ব্যথা পেয়েছো?’

তুলিকা তখনও মাইজিনের দিকে তাকিয়ে আছে। এখনো তার চোখ মুখে বিস্মিত ভাব বিরাজমান। মাইজিন মুচকি হেসে বললো, ‘কি দেখো? আমার মিসেসের দেখি আমার থেকে চোখ সরছেই না? আদর চাই নাকি? লাগলে বলতে পারো!’
‘আপনি জানেন একটু আগে কি হয়েছে? আপনি আমাকে নিজে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। এবং রেগেমেগে ওয়াশরুমে চলে গেছেন। আর এখন সম্পুর্ন উল্টোটা করছেন। যেনো কিছু হয় ই নি।’ মাইজিন তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে। মাইজিন বেফাঁস হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,

‘বা’জে স্বপ্ন দেখেছো? আমি তোমাকে ধা’ক্কা দেবো? আমি? ভুল করেও তোমাকে আমি আ’ঘা’ত দিতে পারি না এটা জানো তুমি।’
‘হইতো তাই হবে।’ কোনো রকমে মনের ভ্রম ভেবে উড়িয়ে দিলো তুলিকা ব্যাপারটা।
তুলিকা উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়। অজু করে এসে নামাজে বসে৷ মাইজিনও নামাজ পরে নিলো তার সঙ্গে।

মাইজিন আজকে অফিস যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তুলিকা তাকে যেতে দেইনি কোনো ভাবেই। সে পুরো-পুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ভাবেই অফিস করতে পারবে না তার কড়া হুকুম। বউয়ের হুকুম মেনে মুখ গোমরা করে বসে আছে সে। তুলিকার এমন যত্ন, অধিকার বোধ, ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে থাকা বেশ এনজয় করছে। কিন্তু হুট করেই সকালের কথা মনে পরলো তার। সে কি সত্যিই তুলিকাকে ধাক্কা দিয়েছিলো তার বুকের উপর থেকে? না হলে তুলিকা বলবে কেন সে কথা? নাকি বা’জে স্বপ্নই দেখেছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।

শাপলা সিদ্দিকা বসে আছে শারমিনের সঙ্গে। তাদের প্রতিটি কার্যক্রম সফল হওয়ার আগেই ফ্লপ হয়ে গেছে।
‘এখন আমাদের করনীয় কি আন্টি? মাইজিন তো বিয়ে করে নিয়েছে এখন কি করবো আমরা?’
‘জানি না। তবে তোর আংকেল দেশে থাকা পর্যন্ত আমাদের চুপ থাকতে হবে। কত নির্যাতন করলাম কিন্তু কোনো ভাবেই সম্পত্তি হাতে এলো না। নিজের বোনের স্বামীর চোখে নিজের বোনকে খারাপ প্রমাণ করে তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাকে ফাসালাম। বোনকে দিনের পর দিন ওষুধ দিয়ে অসুস্থ করে রেখে মে’রে দিলাম। বোনের জায়গা নিলাম কিন্তু কোনো ভাবেই সম্পত্তি হাতে পেলাম না। এই যে এতো এতো সম্পত্তি আমার সব চাই সব।’

‘আহ আন্টি আস্তে কথা বলো। এসব কথা যদি কেউ শুনে ফেলে কি হবে ভেবে দেখেছো? আংকেল বাড়িতে ভুলে যেও না।’
‘আরে ধুর বিশ বছর থেকে ওই লোকের সঙ্গে সংসার করছি। আমি চিনি ওঁকে। এক নম্বরের গর্ধব লোকটা। কিছুই টের পাইনি এতো বছর আর আজকে একদিনেই টের পেয়ে যাবে? আমি যা কিছু বলি তাই বিশ্বাস করে এসেছে এই পর্যন্ত বুঝলি? বড্ড বোকা তোর আংকেল। আমার অভিনয় বুঝতেই পারেনি। তবে তুই চিন্তা করিস না এবার আমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। যা হওয়ার তা তো হবেই। আমার পথের কা’টা এমনিতেই সরে যাবে।’

‘সত্যিই আন্টি ইউ আর আ’ জিনিয়াস৷ যেমন রুপ তেমন গুণ! ওহ হ্যাঁ শয়’তা’নি গুন!’
হো হো করে হেসে উঠলো শারমিন আর শাপলা এক সাথে। পর্দার আড়াল থেকে দুটো পা তম্বন্ধে সরে গেলো। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রুমের ভেতরে প্রবেশ করে।

দুপুরে রান্নায় ব্যস্ত তুলিকা। মাইজিনের শরীরে রক্ত কম। সেজন্য ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী সেসব খাবার খাওয়াতে হবে যেগুলো খেলে শরীর ভালো হবে। কবুতরের মাংস, শিং মাছ, শাক সবজি। কতকগুলো পদ করেই ক্ষান্ত হয় তুলিকা।
মাইজিন তাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে যায় কিন্তু তুলিকার গরম চোখের চাহনীতে চুপসে যায়। হুট করেই মস্তিষ্কে নাড়া দিলো অস্বাভাবিক কিছু। সে ফল কা’টার ছু’ড়ি নিয়ে এগিয়ে যায় রান্না ঘরে৷

‘আচ্ছা যদি আমার হাত কা’টা হয় কত গুলো রক্ত বের হবে? আমি দেখতে চাই!’
কি ভয়ানক সে কথা। তুলিকা ভয়ে শিটিয়ে যায়। মাইজিন নিজের হাতের শিড়া বরাবর ছু’ড়ি ধরে। কেমন অদ্ভুত ভাবে হাসে।
‘ওটা রাখুন মাইজিন। আপনি আমাকে কেন ভয় দেখাচ্ছেন কেন? হাত কে’টে যাবে মাইজিন। প্লিজ রাখুন ছু’ড়িটা!’
মাইজিন হেসে নিজের হাতে ছু’ড়ি বসিয়ে টান দিতে উদ্যত হয় তখনই কলিং বেল বেজে উঠে। সেই সুযোগে মাইজিনের হাত থেকে ছুড়িটা কে’ড়ে নিলো তুলিকা।

‘আমি দেখবো, দেখবো, দেখবো, কত গুলো র’ক্ত হয় দেখবো!’
মাইজিন পাশের রুমে গিয়ে বসে পরলো ধড়াম করে। তুলিকার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পরছে। সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি হয়েছে তার। গলা শুকিয়ে কা’ঠ হয়ে গেছে একেবারে। ঢকঢক করে পানি পান করে সে। এদিকে অনবরত কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে। তুলিকা নিজেকে ধাতস্থ করে দরজা খুলে দিতে যাবে তখনই মাইজিন আসে।

‘আরে তুলিকা কখন থেকে কলিংবেল বাজছে শুনছো না? ঠাই দাঁড়িয়ে আছো। কি যে করো না। ঠিক আছে আমিই খুলে দিচ্ছি!’
মাইজিনের পর পর এরুপ আচরণে খেই হারিয়ে গেছে তার। কতটা ক্যাজুয়ালি কথা বলছে মাইজিন। অথচ একটু আগেই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছিলো। কিছুক্ষন আগের ঘটনা মস্তিষ্কে অন্য কিছুর আভাস দেই তার। নাকি মাইজিন মজা করছিলো তার সঙ্গে? না হলে এরকম কেন করবে? কলিংবেল বাজছে জন্য হইতো সে বিষয়ে কথা বললো না এখন। তুলিকা নিজের ঘার্মাক্ত মুখ মুছে মাইজিনকে বলে,

‘কে এসেছে মাইজিন? দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
‘ভেতরে আসুন!’ বললো মাইজিন।
তুলিকা দরজার কাছে এসে অবাক হয়ে যায় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে।
‘আপনি এখানে?’

‘এতো অবাক হওয়ার কি হয়েছে? আমি কি আমার ছেলেকে দেখতে আসতে পারি না?’
তার কথা শুনে মাইজিন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আড়ালে। তুলিকা অপ্রস্তুত হেসে বললো,
‘না না আংকেল তা কখন বললাম। আপনি আসেন নি তো এর আগে কখনোই। আপনি ভেতরে আসুন না প্লিজ!’
রৌফ সুলতান ভেতরে প্রবেশ করলেন। রুমে ঢুকে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি। রুম গুলো তেমন বড় না। জিনিসপত্রও কম। তবুও রুম গোছানো আর পরিপাটি থাকাই দেখতে ভালো লাগছে। রৌফ সুলতান কাউচে বসলেন। তুলিকা আর মাইজিন নিশ্চুপ। অবাক হয়েছে তারা ভীষণ।

‘আ-আমমম এভাবে তাকিয়ে আছো কেন তোমরা? আমি আসায় কি অসুবিধা হলো তোমাদের?’
‘ছিঃ ছিঃ না আংকেল। আপনি কি নেবেন চা -কফি!’
‘কিছুই জানো না দেখছি মেয়ে। এই দুপুরে কি কেউ চা-কফি খাই?’
তুলিকা বেশ লজ্জা পেলো। মাইজিন তখনও নিশ্চুপ। তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। যতোই অপছন্দ করুক না কেন লোকটাকে সে তো তার বাবা। এভাবে বাসায় এসেছে প্রথম বার তার মুখের উপর কি চটাস চটাস করে কথা বলা যায়। তুলিকা শরবত করতে চলে যায়। মাইজিন আর রৌফ সুলতান মুখোমুখি বসে আছে এই মুহুর্তে। হঠাৎই নিরবতা ভেঙে মাইজিন গলায় স্বর টেনে টেনে বলল, ‘ হঠাৎ কি মনে করে__ আসলেন?’

‘তোমাকে দেখতে এসেছি! এখন তোমার শরীর কেমন?’
এই এটুকু কথায় যেনো এতো দিনের সমস্ত অভিমান গলে জল হয়ে গেলো। মাইজিন অনুভব করলো তার শরীর, গলা কাঁপছে অদ্ভুত ভাবে। মাইজিনের অস্বস্তি কা’টা’তে তুলিকার আগমন হয়। তার হাতে ফলমূল আর শরবতের গ্লাস৷ তুলিকা আসায় বেশ স্বস্তি পেলো মাইজিন। তুলিকা ঠান্ডা শরবত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আংকেল শরবতটা খান!’

‘এই মেয়ে কি আংকেল আংকেল করছো? সহবত জানো না নাকি? সম্পর্কে আমার ছেলের বউ তুমি। সে অনুযায়ী আমি কি তোমার আংকেল হয়? আংকেল আংকেল করছো তখন থেকে!’
‘তাহলে কি বলবো?’ মিন মিন করে বললো তুলিকা।
‘বাবা বলবে। আজ, এখন থেকে।’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৮

তুলিকা আর মাইজিন অবাক সাথে খুশি হয়ে তাকিয়ে থাকে রৌফ সুলতানের দিকে৷ মাইজিন আর রাগ করে থাকতে পারে না। দুজনেই নিরবে অশ্রু ফেলে। এই অশ্রু আনন্দের! এই অশ্রু সুখের! মাইজিন নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে। তার বাবা উপরে উপরে গম্ভীর ঠিকই কিন্তু ভেতর থেকে ততটাই কোমল। ঠিক কত বছর পর এভাবে বাবার বুকে মাথা রেখেছে সে। এরকম সুন্দর দৃশ্য কি সব সময় দেখা যায়? তুলিকা প্রাণ ভরে তাদের বাবা ছেলের মিলন দেখছে। কাঠখোট্টা, রাগী, গম্ভীর মানুষটার চোখেও আজ জল। রৌফ সুলতান চোখ মুছে ছেলেকে আঁকড়ে ধরেন।

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৩০